ছায়াছবির ইতিহাসের দিকে তাকালেই বোঝা যায় নাটক, চিত্রকলা বা সাহিত্যের যে সম্ভ্রমসূচক বনেদিয়ানা আছে তা চলমান চিত্রমালার নেই। সার্কাসের তাঁবুতে তার জন্ম। প্রথম থেকেই সে জনপদবধূ। মূলত নিম্নবর্গীয় শ্রমজীবী সমাজের মুখ চেয়ে সে সমীবদ্ধ সময়ের বিনোদন বিতরণ করে গেছে। বাণিজ্যের পাহারায় ও তাগিদে তার জন্ম। সুতরাং আমরা মেনেও নিয়েছিলাম ধ্রুপদী শিল্পকলার যে অবস্থান সে কিছুতেই পেতে পারে না, অনভিজাতদের জন্য চিহ্নিত এই অপেরা। সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের সবচেয়ে বড় মৃগয়াভূমি হলিউড জীবনকে টেনে নেয় পর্দায়, অপ্সরা ও কিন্নরদল প্রতিস্থাপন করে দর্শনের গভীরতা। সিনেমা হয়ে দাঁড়ায় শ্রুতিদৃশ্য মাধ্যমের নেহাৎ একটি গল্প- আদিমধ্যঅন্তযুক্ত একটি সুবলয়িত নিয়তি।
কিন্তু অপরদিকে চলচ্চিত্রের গণতান্ত্রিক অভিঘাত সুদূর প্রসারিত। ওয়াল্টার বেঞ্জামিন প্রমুখ চিন্তাবিদ অব্যর্থভাবে দেখিয়েছেন চলমান চিত্রমালার মধ্যেই নিহিত আছে আধুনিকতার ইতিবৃত্ত। প্রতিরূপায়ণগতভাবে সিনেমা অন্তর্ঘাতনার একটি মানচিত্র এঁকে দিতে পারে অনায়াসে। ফ্রান্সে পরাবাস্তবাদীরা ও উত্তরবিপ্লব সোভিয়েত রাশিয়ায় বুনএল বা আইজেনস্টাইন প্রমুখ শিল্পীরা মার্কিনি কাহিনি কথনের একটি প্রতি-প্রস্তাব রাখলেন। ফলে ক্রমশ চলচ্চিত্রবিচার বাণিজ্য চিত্র ও শিল্পনিবেদনের মধ্যে বিভাজিত হয়ে গেল। অর্থাৎ ছায়াছবি বলতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে একদিকে রইল আপাতভাবে লঘু চিত্তবিনোদন ও বাণিজ্য সিনেমা। অন্যদিকে শিল্প-সিনেমা - যেমন জঁ রেনোয়া বা ইতালিয় নববাস্তববাদী ছবি। ফরাসী নবতরঙ্গ আন্দোলন এসে অবশ্য এই বিভাজনের ঈষৎ সংস্কার করে। তারা অতর-সিনেমা বা স্রষ্টাদের সিনেমা বনাম প্রচলিত চলচ্চিত্র হিসেবে তর্কটিকে তুলে ধরেন। আমরা পরিচালকদের ভূমিকা নিয়ে নতুন ভাবে অবগত হই। আমাদের দেশেও সত্যজিৎ রায়-ঋত্বিক ঘটকের বিপরীতে জনপ্রিয় সিনেমাকে বিচার করার প্রবণতা রয়ে গেছে। আসলে তর্কটা দুনিয়া জুড়েই একটি বিভাজন শিল্প বনাম বাণিজ্য।
গত শতাব্দীর সত্তর দশক থেকেই এই ঐতিহ্যের সুর পাল্টাতে শুরু করল। আশির দশক থেকেই আমরা বিশেষত দক্ষিণ দুনিয়ার জাতীয় চলচ্চিত্র বা অ-পাশ্চাত্য চলচ্চিত্র বিষয়ক ধারণা পল্লবিত হয়ে উঠল। সেই রকম ভাবনা পরিসর থেকেই জন্ম নিয়েছে মানস ঘোষ লিখিত ছোট কিন্তু চমৎকার তথ্য সমৃদ্ধ এই বইটি- যার বিষয় ইরানের চলচ্চিত্র। বাস্তবিক বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন লিখিত ইমাজিনড কমিউনিটি ধরনের সন্দর্ভই হোক আর ফ্রানজ ফানোঁ প্রণীত দুনিয়ার হতভাগারা জাতীয় উদ্দীপক ইস্তাহারই হোক, অনুন্নত তৃতীয় বিশ্বকে দেখার চোখ যে অন্যরকম হতে পারে সে বিষয়ে ধারণার পরিসর উন্মুক্ত হলে প্রায় আকস্মিকভাবেই আমরা খেয়াল করি রাজনীতি ও জাতিসত্তার একটি ফল্গুধারা সতত সক্রিয় থেকেছে মানস যাকে বলেন চলচ্চিত্রের তৃতীয় দুনিয়া সেইখানে। আফ্রিকা, এশিয়া বা লাতিন আমেরিকার ইতিহাসের নুড়ি-পাথর এত অবিন্যস্ত, আধিপত্যের চোখ রাঙানিতে এত মুখ লুকিয়ে থাকে যে পশ্চিমি অর্থে বিশুদ্ধ শিল্প বা অন্য কোনওরকম কলাকৈবল্যবাদে আস্থা রাখা আর্জেন্টিনা বা সেনেগালের চলচ্চিত্রকারের পক্ষে সম্ভবই নয়। অনেকটা প্রাচীন যুগের বাল্মিকী বা হোমারের মতই তাঁকে একটি সাংকেতিক ইতিহাসগাথা লিখতে হয়। এই জন্যেই তৃতীয় দুনিয়ার চলচ্চিত্রের গহনে রাজনীতির গহন উক্তি সাজানো থাকে সংকেতে, প্রতীকে। ক্যামেরা সেখানে জাতির সঙ্গে স্রষ্টার সংলাপে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নেয়।
মানস ঘোষকে ধন্যবাদ জানাই যে তিনি সূচনা থেকেই পরিহার করেছেন পশ্চিম থেকে পাওয়া 'কর্তার ভূত'-এর বাণী যে একটি ঘন ইসলামি সংস্কৃতির নিষেধাজ্ঞা থেকে জন্ম নিয়েছে ইরানের নতুন চলচ্চিত্র সংস্কৃতি। তাঁর লেখার সূচনাপর্বেই তিনি সফলভাবে পেশ করেছেন কিয়েরোস্তামি-ঘোবাদি কলহের সারাংশ পেশ করে। লেখক দেখিয়েছেন যে আব্বাস কিয়েরোস্তামি বা বেহমান ঘোবাদির তর্ক ইপানের চলচ্চিত্র অনুধাবনের অন্যতম ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে কারণ সেখানে রাজনৈতিক অতিশয়োক্তি বা রাজনৈতিক নির্লিপ্তি প্রতিপাদ্য নয় বরং অন্যদিকে এটা মূলত প্রতি-রূপায়ণের সমস্যা। আপাত ভিন্নমুখ থেকে চিন্তার স্রোতসমূহ শেষ পর্যন্ত একই সাংকেতিক মোহনায় মেলে যেখানে একটি জাতি তার কাব্য ও স্থাপত্যে ঐতিহ্য নিয়ে প্রাণের প্রতিমায় চক্ষুদান করে।
চলমান চিত্রমালায় যখন বিরতিহীন চিত্রের প্রবাহ তখন আমার বিনীত ধারণা আব্বাস কিয়েরোস্তামির দার্শনিকতা ছায়াছবিকে দৃশ্যের অত্যাচার থেকে মুক্তি দিয়েছে। চেরির স্বাদ নামের অবিস্মরণীয় নির্মাণে কী তাৎপর্যময় ভাবে তিনি জীবনের অর্থ ফেরত দেন স্বদেশবাসীকে। আলবিয়ার কামুর সিসিফাসের কিম্বদন্তী পাঠে অভ্যস্ত আমরা জীনব ও মৃত্যুর এমন পুনর্নবীকরণ দেখে স্তম্ভিত হয়ে যাই। জীবন রহস্য যে কী গভীর!
পিতৃতন্ত্র ও যৌনতা: প্রাচীন বাংলা কাব্য থেকে উনিশ শতকের পরম্পরা
বৌদ্ধিক চেতনার জিজ্ঞাসা ও শ্রমমুখর বাস্তবের মধ্যস্থতা ও সংলাপ সম্পন্ন হয় ক্লোজ-আপ-এর মত চলচ্চিত্রে। সেখানে আন্তোনিওনির মেধাবী-শূন্যতার বিকল্প প্রস্তাব হয় ঐহিক জিজ্ঞাসা। দেখা যায় গূঢ়তম অর্থে শিল্পী বলেই কিয়ারোস্তামি ফাঁকি দিতে পারেন প্রতিষ্ঠানের অনুশাসন- তা রাষ্ট্র বা ধর্ম যেই জারি করে থাকুক। সিনেমার আপাতত অন্তিম আশীর্বাদ এই আব্বাস কিয়োরোস্তামি যাঁর কাব্য ও দার্শনিকতা যুগপৎ ভৌগোলিক ও সাময়িক ঘটনাবলীকে নশ্বরতার বাঁধনমুক্ত করে পৌঁছে যায় অনন্ত নক্ষত্রের দেশে।
আধুনিক চলচ্চিত্রনির্মাতাদের শিক্ষণীয় হতে পারে ইরানের চলচ্চিত্রকার যেভাবে শিশুকে খুঁজে পান দৈনন্দিনতার প্রেক্ষিতে। এই দৃষ্টি আপাত নিষ্পাপ, সংলগ্ন নয়। কিন্তু তা বয়স্কের পরিসীমার বাইরে বলেই আমাদের ডাক দিয়ে যেতে পারে এমন আকুল স্বরে- বাহির হয়ে এসো তুমি যে আছো, অন্তরে। এক্ষেত্রেও দেখা যায়, সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী বা ভিত্তোরিও ডি সিকার বাইসাইকেল থিভস-এর কথা মনে রেখেও ইরান যে শিশুটিকে জগৎপারাবারের তীরে খেলা করতে দেখে সে অনেক গহন দৃষ্টির। আপাতভাবে রোজনামচার অতিরিক্ত বলেই শৈশব যে ইরানিয় সিনেমার সত্যভাষণের দায়িত্ব পায় তা মানস বেশ গুছিয়ে বলেছেন।
এই বই যতটা কিয়েরোস্তামি ও জাফর পানাহিকে নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে ততটা মহসিন মখবলবাফ বিষয়ে নজর দিতে পারেনি। আধুনিক ইরানের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটটিও সমান আলো পায়নি রচনাটিতে। তবু ইরানিয় চলচ্চিত্র বিষয়ে আমাদের মাতৃভাষায় এত সুলিখিত গ্রন্থ আর কই! এই রচনা সেই পাঠকের জন্য ইমেজকে পাঠ্য ভাবেন। যদি মানস কবিতাগুলির বাংলা অনুবাদ করে দিতেন পাঠক হিসেবে আমার যে কত ভাল লাগত! এ কবিতা যদি ইংরেজরা অনুবাদ করতে পারে তাহলে আমরা পারব না কেন! আর যেসব জায়গা অনূদিত হয়েছে, সেই সব অনুবাদকের নাম থাকলে ভাল হত। যদি লেখক নিজেও করে থাকেন, তবে তা স্পষ্টভাবে জানা যায় না। হয়ত তরুণ লেখক বলেই তিনি যখন ব্রুগেল বা দ্যলুজ প্রমুখ পশ্চিমি অনুষঙ্গ আনেন তা মূল বয়ানের সঙ্গে মিশে যায় না বরং কিছুটা আরোপিত মনে হয়। আসলে চলচ্চিত্রবিদ্যা ক্রমশই আমাদের সারস্বতচর্চায় কেন্দ্রীয় গুরুত্বের হয়ে উঠছে বলেই আমাদের প্রত্যাশার মাত্রাও বেশি। মানস ঘোষ অ-পশ্চিমি চলচ্চিত্র বিষয়ে আমাদের আগ্রহ অনেকটাই উসকে দিলেন।
চলচ্চিত্রে তৃতীয় দুনিয়া- ইরান
মানস ঘোষ
বৈ-চিত্র প্রকাশন, ৩০০ টাকা