“স্মরণ হইল, আজ ১৮৯৯ খৃষ্টাব্দ, ৩১শে ডিসেম্বরের রাত্রি। আমার শৈশবের শতাব্দীটি কালের অতল রসাতলে এখনি নিমগ্ন হইবে। ... আমাদের নিকটে যাহা অনন্তবৎ - সেই তারকারাজি নভস্তলে ফুটিয়া উঠিয়াছে। গুরুভার অনন্তের ভাব আসিয়া, আমার ন্যায় ক্ষণজীবি প্রাণীর চিত্তকে বিদলিত করিল। ...সকল পদার্থই শীঘ্র চলিয়া যাইতেছে- মরিয়া যাইতেছে- এইরূপ একটা ভাব আসিয়া মনোমধ্যে উৎকট যন্ত্রণা উপস্থিত হইল। বৃহৎ বন ও বৃহৎ মন্দিরসমূহে আমি পরিবেষ্টিত- সংকীর্ণ ব্রাহ্মণ-ভারতের মধ্যে- ছায়ান্ধকারের মধ্যে আমি আবদ্ধ- এই কথা মনে হওয়ায়, মনোমধ্যে একপ্রকার অভূতপূর্ব্ব ও সুমধুর উদ্বেগ উপস্থিত হইল।...”
আজ থেকে একশ সতেরো বছর আগের এক রাতে, দক্ষিণ ভারতে ত্রিবাংকুরের একটা ঘরে বসে এই কথাগুলো লিখছেন একজন ফরাসি নৌ-সেনানায়ক। একান্ত গূঢ় এক আত্মানুসন্ধানের পাথেয় হিসেবে তিনি আঁকড়ে ধরতে চেয়েছেন ভারতকে। তাঁর ভারতকে- যে ভারত সত্যিই কোথাও আছে কিনা তা নিয়ে সবচেয়ে বেশী সংশয় এবং দ্বিধাদীর্ণ হয়েছেন তিনিই সবচেয়ে বেশী।
নৌসেনার পেশায় ব্যাতিক্রমী, এই আশ্চর্য মানুষটার আসল নাম লুই মেরি- জুলিয়েন ভয়্যাদ (১৮৫০-১৯২৩) হলেও ফরাসি ভ্রামণিক এবং সাহিত্যিক পিয়ের লোতি হিসেবেই এনাকে আমরা চিনি আরও ঘনিষ্ঠ ভাবে। পেশা সূত্রে পৃথিবীর নানা জায়গায় গিয়েছেন তিনি। গিয়েছেন ভারত ছাড়াও চিন, জাপান, ইজিপ্ট, টার্কি এবং তাহিতি দ্বীপপুঞ্জ। তাহিতির এক লালরঙের ফুল- রোটির নামেই স্থানীয় মানুষ আদর করে জুলিয়েনকে- লোতি বলে ডাকতে শুরু করেন। এই ফুলের নাম উনি সঠিক ভাবে উচ্চারণ করতে পারতেন না যে। পেশা ছাপিয়েও এই প্রতিটা ভ্রমণ পিয়েরের নিজস্ব এক যাত্রাও। গভীর হতাশা, উদ্বেগ এবং যুগপৎ ভাবে এক সান্ত্বনাদায়ক অজ্ঞেয়চেতনার খোঁজ এবং অসংখ্য প্রশ্ন নিয়ে লোতি ছুটে গিয়েছেন অসংখ্য জায়গায়। এই নিদারুণ সংশয় আর এক অজানা শান্তির অপরিমেয় বিশালতার খোঁজ ওই যুগের পশ্চিম ইউরোপের এক বিশেষ লক্ষণও বটে। পাঠকের নিশ্চয়ই রোমা রলার জাঁ ক্রিস্তফের কথা মনে পড়ছে।
লোহিত সাগর পেরিয়ে আঠারোশো নিরানব্বইয়ের শেষ প্রান্তে লোতির জাহাজ হপ্তাখানেক আগেই তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে সিংহল দ্বীপে। অনুরাধাপুরের প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দিরের ধংসাস্তুপ দেখে তিনি আপাতত এসেছেন ত্রিবাংকুরে, অধুনা যা ত্রিবান্দাম শহর। স্থানীয় রাজার জন্যে তিনি এনেছেন ফরাসি সরকারের এক মানপত্র। রাজাও তাঁকে প্রচুর সম্মান জানিয়েছেন। আদর আতিথেয়তার বিপুল আতিশয্যের মাঝে অবশ্য লোতির মন খারাপ। তাঁকে ইউরোপীয় ঢঙে সাজানো অতিথিনিবাসে থাকতে দেওয়া হয়েছে যে। তিনি তো চেয়েছিলেন স্থানীয় রসে ডুবতে।
এর মাঝে তাঁর অসম্ভব তীক্ষ্ণ চোখ শুষে নিচ্ছে পথের যাবৎ অভিজ্ঞতা। শকটের চালক ও বলীবর্দের রূপ, ভ্রাম্যমাণ নারী-পুরুষ, বিয়ের শোভাযাত্রার সাজ, গয়না, ভাব, নৃত্যরীতির ভারতীয় লাস্যরূপ, হিন্দু মন্দিরের গঠনশৈলী, গ্রহণক্ষমতা এবং রীতিরেওয়াজের রহস্যময়তা কিছুই এড়িয়ে যাচ্ছে না তাঁর কাছে। পথেপ্রান্তরে, মন্দির-গীর্জা-মক্তবে ঢেউয়ের পর ঢেউয়ের মতন প্রশ্নের তরঙ্গ উঠছে তাঁর মনে আর প্রাণপণে তিনি খুঁজে চলেছেন উত্তর; নিজেকেও। অপ্রতিরোধ্য অনুভব , পরিব্যাপ্ত এবং নিখুঁত নজর আর প্রখর অনুসন্ধিৎসা নিয়ে লোতির এই ভারত সফর শুরু।
১৮৯৯-১৯০০ সালের এই সব অভিজ্ঞতা যা লোতি লিপিবদ্ধ করেন ১৯০৩ সালে L’Inde sans les Anglais নামে, তা মূল ফরাসি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। ইংরাজ বর্জ্জিত ভারত- বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের এক অক্ষয় কীর্তি।
মুজতবা আলীর ভাষায় – “ভারতবর্ষ সম্বন্ধে লোতি যে বইখানা লিখেছেন তার নাম ল্যাদ, সাজাংলো’। অর্থাৎ ‘ভারতবর্ষ, কিন্তু ইংরেজকে বাদ দিয়ে’। অর্থাৎ তিনি ভারতবর্ষের ছবি আঁকতে বসেছেন। কিন্তু মনস্থির করে ফেলেছেন যে, এ-দেশের ইংরেজদের সম্বন্ধে তিনি কিছু বলবেন না।
স্বীকার করি, ইংরেজ-বর্জ্জিত-ভারত’ ‘ল্যাদ, সঁজাংলে’র ঠিক অনুবাদ নয়, কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্রনাথের অনুবাদশশাঙ্কে ঐ একটি মাত্র কলঙ্ক। বাদবাকি পুস্তকখানা অনুবাদ-সাহিত্যে যে কি আশ্চর্য কুতুব-মিনার, তার বর্ণনা দিতে হলে লোতির কলমের প্রয়োজন।”
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেও ছিলেন এক আশ্চর্য গতিময় মানুষ। মূল নামের অনুবাদে “বর্জ্জিত” শব্দে বহুলাংশে তাঁরই জীবন দর্শন বহন করছে। আলী সাহেব ‘লোতি’ বানান বললেও যেহেতু জ্যোতি ঠাকুর নিজের অনুবাদে লোটি বলেছেন , এর পর থেকে আমরা লোটি বানানটাই ব্যবহার করে চলব। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুবাদ ২২, কর্ণওয়ালিস স্ট্রিট থেকে, প্রথম প্রকাশিত করেন ইন্ডিয়া পাবলিশিং হাউসের শ্রীচারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯২৮ সালে। অসামান্য শব্দচয়নে, ভাবঝংকারে, মনোমোহন ব্যাঞ্জনায় আর শিল্পিত অনিবার্যতায় এই অনুবাদ সত্যিই লোটির সঙ্গে আর এক অন্বেষকেরও সহযাত্রা বিশেষ।
লোটির ভ্রমণ ১৮৯৯ সালে সিংহল থেকে শুরু হয় আর ত্রিবঙ্কুর হয়ে এগিয়ে চলে ১৯০০ সালের কোচিন, মাদুরাই, তাঞ্জোর, শ্রীরঙ্গম, পুদুচেরী, হায়দ্রাবাদ, গোলকোন্ডা, উদয়পুর, জয়পুর, মাদ্রাজ, পুরী, আগ্রা, দিল্লি এবং অবশেষে বারাণসী অব্দি।
গভীর চেতনার গোপন অন্তঃস্থল থেকে এক করুণ স্রোত লোটির চেতনা গ্রাস করতে উদ্যত হয় আর প্রতিবারে তিনি নিজেকেই যেন কালিভরা কলমের মতন ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বাস্তবের নিদারুণ কাগজে এঁকে চলেন এক পরিপূর্ণ আলেখ্য। জন্ম থেকে মৃত্যু অব্দি যাতে কিছু বাদ পড়েনা। তাঁর ভারত একান্তই তাঁরই মনোলোকের নির্মাণ এবং তিনি খুব তাড়াতাড়িই সেটা বুঝেও ফেলেন। এ ভারতে ইংরেজের বা ইউরোপের চিহ্ন নেই। তিনি খুঁজে ফিরছেন এক কল্পিত প্রাচীন প্রাচ্যকে। নগরে, পথে, মন্দিরে, মহল্লায় খুঁজে ফিরছেন রহস্যময় জ্ঞানের ধারক ব্রাহ্মণদের। তাঁর তৃষ্ণার্ত, কাতর অন্তরকে যারা দিতে পারবেন অলীক ক্ষমতাশীল সান্ত্বনার পানপাত্র। ভুলিয়ে দিতে পারবে সমস্ত জাগতিক বেদনা, আততি, জিজ্ঞাসা ও সংশয়। কুয়াশা মুছে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর ফুটে উঠবে মধ্যাহ্ন সূর্যের দীপ্তি নিয়ে।
তাঁর দ্যাখা হচ্ছে সিরিয় খৃষ্টানদের সাথে। তাঁর নজর এড়াচ্ছে না বিদেশী খৃষ্টানদের সাথে এদেশীয় খৃষ্টানদের সামাজিক সম্মানের তারতম্য। তাঁর দ্যাখা হচ্ছে ভারতীয় মুসলমানদের সাথেও। কিন্তু তাতে তাঁর তৃপ্তি আসছে না। তিনি হন্যে হয়ে ছুটছেন হিন্দুদের গোপন গহন গর্ভগৃহ সম্বলিত, বিশাল তোরণদ্বার বিশিষ্ট, অতিকায় পৌরাণিক চরিত্রদের মূর্তি দিয়ে ঘেরা মন্দিরে মন্দিরে। তাঞ্জোর, মাদুরাই, জয়পুর, উদয়পুর, পুরী এবং বারাণসী ছেনে ফেলছে তাঁর অনুসন্ধান। তাঁর আকুতি বহুবার ব্রাহ্মণ্য অনুশাসনের নিগড়ে ঠোক্কর খেয়ে ছিটকে পড়ছে। বহু জাতিগত ব্রাহ্মণের সাথে তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ আলাপ পরিচয় হয়ে উঠলেও বিদেশী হওয়ার দরুণ তাঁর জন্যে বন্ধ থাকছে মন্দিরের দরজা। এই দ্বিচারণ তাঁকে ক্ষুণ্ণ করছে। ক্রুদ্ধ হতে হতেও তিনি এক অদ্ভুত আশাবাদ নিয়ে যুঝে যাচ্ছেন এই অপমানদের। নিবিড় ভাবে তাঁর নিজের একান্ত এই যাত্রার সাথে সাথে তিনি দেখছেন বিগ্রহের অলঙ্কার এবং তৈজস, প্রতীক এবং ভক্তদের, বাইরের ঠাটবাট এবং অন্তরের অভাবকেও। লিখে রাখছেন নিখুঁত বর্ণনাময় ছবির মতন।
মাদুরাইতে মীনাক্ষী মন্দিরে এসে লোটির ভাগ্যে বিগ্রহ দর্শন হয়। নিদারুণ বিস্ময়ে এবং আতঙ্কে কেঁপে ওঠেন তিনি– “জমকাল গদীর উপর উপবিষ্ট এই বিগ্রহগুলিকে, যখন কতকগুলি নগ্নকায় বৃদ্ধ স্বীয় বলিরেখাঙ্কিত বাহুর উপর বসাইয়া লইয়া গেল, তখন আমার যেকি বিস্ময়- এমন কি, আতঙ্ক উপস্থিত হইয়াছিল- তাহা আর কি বলিব! কতকগুলি বিকটাকার পুত্তলিকা; - দেখিতে নরম- তলতলে; গ্রীবাদেশ কাঁধের মধ্যে যেন ঢুকিয়া গিয়াছে; গোলাপী রঙ্গের ছোট ছোট মূর্ত্তি– কমলানেবুর মতন ট্যাবাটোবা। (কি জন্যে গোলাপী রঙ্গ?– ভারতবাসীর রঙ্গ তাম্রাভ বলিয়াই কি?) ওষ্টাধর পাতলা; চক্ষু নিমীলিত ও পক্ষ্মশূণ্য;- দেখিলে মনে হয় মনুষ্যের ভ্রুণ,- মৃতশিশু; এই চিরনিদ্রার অবস্থাতেও মুখের ভাব ভীষণ; কিন্তু এই ভীষণতার সঙ্গে একপ্রকার ভোগতৃপ্ত হৃষ্টপুষ্ট ভাব, প্রমত্ততার ভাবও প্রকটিত রহিয়াছে।”
তাঞ্জোর এবং পন্ডিচেরীতে লোটির সুযোগ হয় ভারতনাট্যম দ্যাখার। এই বর্ণনায় অনুবাদক প্রায় অসম্ভবকে ছুঁয়েছেন। ছায়াচিত্রের মতন নিখুঁত সে বর্ণনা। নর্তকীর লাস্য, উল্লাস, ব্যঙ্গ, ভান এবং গতির প্রত্যক্ষতা লেখার পাতা ছাপিয়ে পাঠকের চোখের সামনে ফুটিয়ে তুলেছেন লোটি। নর্তকীদের একজনের বর্ণনা পড়লে অক্ষরের ফোকর দিয়ে গলে গিয়ে পাঠক উপস্থিত হয়ে পড়বেন নাট্যসভায় – স্বয়ং। -
“ যেন একপ্রকার বিষাক্ত সুন্দর ফুল, পাতলা ও লম্বা; মুখটা সরু; একেই ত বড় বড় টানা চোখ, তাতে আবার সুর্মা দেওয়ায় আরও বেপরিমাণ দীর্ঘ হইয়াছে; ... অলঙ্কারের মধ্যে শুধু মাণিকের অলঙ্কার; হাতে মাণিক, বাহুতে মাণিক; এবং একগুচ্ছ মাণিক নাসিকা হইতে লম্বিত হইয়া ওষ্ঠের উপর ঝুলিয়া পড়িয়াছে, মনে হইতেছে যেন রক্তপায়ী রাক্ষসীর মুখে এখনও রক্তের দাগ লাগিয়া রহিয়াছে।”
পন্ডিচেরীতে একটুকরো স্বদেশকে পেয়ে লোটির খুব ভালো লাগলেও তিনি হতাশ হয়ে পড়তে থাকেন। অবশেষে নিজামের রাজ্য ঘুরে ইলোরার মন্দিরে গিয়ে পৌঁছোন এক মেষপালকের সহায়তা নিয়ে। তখন রাত্রি নেমে এসেছে। আবিষ্ট হয়ে লোটি আঁধারমগ্ন মন্দির ও গুহায় ঘুরতে থাকেন। খুঁজতে থাকেন মনে জমে থাকা প্রশ্নদের উত্তর। অচিরেই হতাশ হয়ে পড়েন অযুত নিযুত বিগ্রহ,দালান,প্রকোষ্ঠ আর কুলুঙ্গি দেখতে দেখতে। লোটির সৎ পর্যবেক্ষণে ধরা দ্যায় কালি ধোঁয়া পড়া শৈব চিহ্নরা, দীর্ঘডিম্বাকৃতি এক কালো নুড়ি। হতাশায় তাঁর কলম বলে ওঠে- “এখানকার সমস্তই দীন-হীন-মলিন; - সমস্তই সেই ভীষণ ধর্ম্মানুষ্ঠানের নিদর্শন”। আবার ধ্বংসের দেবতার প্রতীকের ভাব সমীক্ষণ করে একই জায়গায় লোটি অধীর আনন্দে বলে ওঠেন- শিবলিঙ্গ অতীব অপূর্ব্ব। অদ্ভুত এই দ্বন্দ্ব! হয়তো এই দোলাচল অনিবার্যও।
রাজপুতানায় লোটি যখন আসেন রাজার বিশেষ অভ্যর্থনায়, তখন রাজ্যজুড়ে চলছে নিদারুণ দুর্ভিক্ষ। মরা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ট্রেনে করে আসবার সময়েই লোটি দেখতে পান দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের ঢল। এক টুকরো খাদ্যাংশের জন্যে অপেক্ষায়। ছুঁড়ে দিলে সবার শক্তিও নেই কেড়ে খাওয়ার। রাজার বিপুল বিলাস এবং বৈভবের পাশেই লোটির কলমে ধরা পড়ে যায়– “ কিন্তু প্রাকারাবলীর পাদদেশে ছেঁড়া ন্যাকড়ার বস্তার মত ও সব কি দেখা যায়? – উহার মধ্যে কতকগুলো মনুষ্যের আকার প্রচ্ছন্ন রহিয়াছে। জমির উপর ঐ লোকগুলো কে? উহারা কি মাতাল?উহারা কি রুগ্ণ? আহ! কতকগুলো শীর্ণকায় জীব, কতকগুলো অস্থিপঞ্জর, কতকগুলো “মমি” শব! কিন্তু না এখনো যে নড়িতেছে: চোখের পাতা পড়িতেছে, চোখ মেলিয়া চাহিতেছে! শুধু তাহা নহে খাড়া হইয়া উঠিয়াছে।” এই নিদারুণ দ্বন্দ্ব লোটির পার্শ্বচর থাকে প্রায় গোটা ভারত।
রাজপুতানা ও গোয়ালিয়র হয়ে লোটি যখন মাদ্রাজ আসেন তখন সেখানে তাঁর আলাপ হয় থিয়োসফিস্টদের সাথে। তিনি যে সিদ্ধদের খুঁজে তাঁদের কাছ থেকে শান্তি ও সান্ত্বনা লাভ করবেন বলে ভাবতেন তাঁদের কাছে বৌদ্ধ এবং অদ্বৈত জ্ঞানবাদের ধাঁচে পরামর্শ শুনে দুঃখে ভেঙে পড়েন তিনি। নিজেকে বিলীন করে যে অমরত্ব তাতে তাঁর সন্তুষ্টি নেই। লোটির কথায়- “ আমি চাই আমার আমিত্ব, আমার নিজত্ব, আমার বিশেষত্বটুকু বরাবর থাকিয়া যাইবে;”। এবং এইখানেই লোটি খুঁজে পেতে শুরু করেন তাঁর প্রশ্নদের উত্তরকে। নিজেরই ভেতর থেকে। বারাণসী যাওয়ার পরামর্শ পেয়ে তিনি দুরুদুরু বুক নিয়ে মেতে ওঠেন খুশীতে। বলে ওঠেন- “হয় – চিরকালের মত ব্যর্থ মনোরথ হইব; নয়- অন্বেষণ করিয়া কিছু পাইব;”।
কিন্তু লোটি কী পাবেন, কী পাওয়ার আশা তিনি করছেন সেইটা তিনি নিজেও বোধকরি বুঝতে পারেননি। শুধু কী পেলে মন ভরবে না, ভরছে না সেই প্রত্যয় সম্বল করেই পুরী আর আগ্রার সৌধদের দেখে লোটি পৌঁছোন তাঁর স্বপ্নের পুণ্যধাম– বারাণসী।
যোগী-ভোগী-নর্তক-বাদক-তত্ত্বপিয়াসী এবং তত্ত্বজ্ঞদের উজিয়ে বারাণসী লোটিকে শেখায় যে এখানে সত্যিই বিচিত্র বহুবর্ণ মায়াময় সুন্দরের ঠিক পাশেই চলে দেহাতীত পরমের যুগপৎ খোঁজ। তাই ঘাটে লাগা শ্মশানের চিতা, জলসমাধিতে নিমগ্ন সাধু এবং বারাণসীর নিকটে তথাগতের প্রথম প্রচার ক্ষেত্রের সঙ্গে তিনি লক্ষ করে চলেন দেহোপজীবি এবং বারাঙ্গনাকে, বৈরাগ্য ভুলে ফেলে মৃত আত্মীয়ার শব দেখে বৃদ্ধের চোখের কোটর থেকে গড়িয়ে পড়া চোখের জলকে। মৃত্যুতে হারিয়ে যাওয়া কোনো কিছুই কি পৃথিবীর কোনো মতের চর্চাই ফিরিয়ে আনতে পারবে এ নিয়ে লোটির মনের গভীরে হয়ে চলা উথালপাথাল- উত্তর খুঁজে পায়না।
বারাণসীতে অ্যানি বেসান্তের সঙ্গে দেখা হলে লোটি তাঁর কাছে শান্তি খুঁজতে চান ‘ভারতীয়’ রীতি মেনে। অ্যানির দেখিয়ে দেওয়া পথ ধরে পরমে নিমগ্ন হতে চেয়েও লোটি দ্বন্দ্বমুক্ত হতে পারেন না। লক্ষ্য ছাপিয়েও এই দ্বন্দ্বমুখর পথটাই ধীরে ধীরে তাঁর উপজীব্য হয়ে ওঠে। গভীর এক বেদনা ও যন্ত্রণাদীর্ণ কাতরতার মুখোমুখি দাঁড়ানো লোটি খুঁজে চলেন তাঁর আপন ভারতের কাছে প্রশ্নের সারি নিয়ে নতজানু হয়ে। নিজেরই অন্তঃস্থল থেকে আঁধার রাতের তারাদের মতন ফুটে উঠতে থাকে উত্তরগুলো। লোটির বয়ানে আর জ্যোতিরিন্দ্রের অনুবাদে এই অবিশ্বাস্য এবং অসামান্য ভ্রমণকথা তপতপে এক জীবন প্রবাহে আলোকিত হয়ে ওঠে। আজকের পাঠকও এই আলোর সন্ধান পাবেন।
পিয়ের লোটির এই ভ্রমণকাহিনী সটীক ও সভাষ্য পুনর্মুদ্রণ করেছেন সুচেতনা প্রকাশনা। সুচেতনা সংস্করণের সম্পাদনা করেছেন ফাল্গুনি ঘোষ। তাঁর ভূমিকা অংশের আলোচনায় আমার সায় আছে। এই পাঠ প্রতিক্রিয়া সুচেতনার সংস্করণ পড়েই লেখা।
ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ
পিয়ের লোটি
ফরাসী হইতে শ্রীজ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক ভাষান্তরিত
সম্পাদনা- ফাল্গুনি ঘোষ
প্রকাশক- সুচেতনা
মুদ্রিত মূল্য- ৩০০/-