Advertisment

কলকাতায় ‘ধূমকেতু’ আবির্ভাবের শতবর্ষ, কেমন ছিল সে ইতিহাস?

কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাংবাদিকতা জীবনের এক অন্যতম পর্যায় ছিল ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা।

author-image
suman Pal
New Update
Centenary year of Kazi Nazrul Islam's Dhumketu Magazine

পত্রিকার পথচলা শুরু করার ইতিহাস নাকি আরও আকর্ষণীয়।

কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাংবাদিকতা জীবনের এক অন্যতম পর্যায় ছিল ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা। যা প্রকাশ পেয়েছিল একশো বছর আগে ১৯২২ সালের অগস্ট মাসে। পত্রিকার পাশাপাশি পত্রিকার এই নামের পিছনেও আছে ইতিহাস। এই শব্দটাকে নিয়ে লিখে ফেলেন একটা আস্ত কবিতা। যেখানে তিনি নিজেকে ব্যক্ত করেছেন “ আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুন মহাবিপ্লব হেতু/ এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!” - এমনভাবেই। একশো বছর পর আসুন একবার স্মরণ করে নেওয়া যাক ‘ধূমকেতু’ পত্রিকাকে।

Advertisment

লেখক/অধ্যাপক প্রীতিকুমার মিত্র তাঁর “The Dissent of Nazrul Islam: Poetry and History” (২০০৭) গ্রন্থে লিখেছেন “In Dhumketu Nazrul set out to propagate, illustrate and elucidate the rebellion that he had pronounced in ‘Bidrohi”। এর বাংলা করলে দাঁড়ায় এমন, যে ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় নজরুল তাঁর যে বিদ্রোহের ঘোষণা করেছিলেন, ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় তাকেই প্রচার, ব্যাখ্যা এবং স্পষ্টভাবে পরিচালন করতে শুরু করলেন। অতএব, এটা আন্দাজ করাই যায় যে ‘ধূমকেতু’ শব্দটা নিয়ে তিনি প্রচণ্ড ভাবিত ছিলেন। এবং যখন সুযোগ পান তখন এই শব্দের একটা উৎকৃষ্ট প্রয়োগ করেন পত্রিকার নামকরণের মাধ্যমে।

কেমন ছিল ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার আবির্ভাবের ইতিহাস। তা জানতে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা কথা বলেছিল ইন্সটিটিউট অফ ল্যাঙ্গুয়েজ স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চের বর্তমান ডিরেক্টর ড. স্বাতী গুহর সঙ্গে। প্রথমে তিনি বলেন কেমন ছিল একশো বছর আগে এই পত্রিকা প্রকাশের সলতে পাকানোর পর্ব। তিনি বলেন, “ধূমকেতু বেরোচ্ছে ১১ অগস্ট ১৯২২। এসময়ে কবির জীবনে একটা অস্থির পর্যায় চলছিল। ’ব্যাথার দান’ বলে একটা গল্পের সংকলন বেরিয়েছে সেটাও তেমন একটা বিক্রি হচ্ছে না। প্রকাশকের কাছে তিনি চিঠি লিখছেন যে কুড়ি টাকা পাঠালে ভালো হয়। একটা সুযোগ আসে ‘সেবক’ পত্রিকা থেকে, মাসে একশো টাকা মাইনেতে সাংবাদিক হিসাবে কাজ করার ইত্যাদি। আবার ইতিমধ্যে তিনি মুজাফফর আহমেদের সঙ্গেও থাকছিলেন। এমন সময়ে তাঁরা একজন লোকের খবর পেলেন ওরা, তাঁর নাম হচ্ছে হাফিজ মাসুদ। হাফিজের ইচ্ছা ছিল তিনি একটা সংবাদপত্রের তথা একটা পত্রিকার মালিক হবেন। কিন্তু তাঁর কাছে ছিল মাত্র ২৫০ টাকা। মুজাফফর আহমেদ বুঝে যায় যে এটা একটা সাংঘাতিক অন্ধকার পরিকল্পনা। আড়াইশো টাকা যেখানে সম্পদ সেখানে কটাই বা সংখ্যা বেরোবে? কী করবে?”

আরও পড়ুন বেঙ্গল থিয়েটার ও বাংলার সাধারণ রঙ্গালয়ে প্রথম অভিনেত্রী নিয়োগের সার্ধশতবর্ষ

এমন সময়ে নজরুল কিন্তু হাল ছাড়েননি। ড. গুহ বলেন, “কিন্তু নজরুলের ওই যে ভাবাবেগ বেশি। তিনি বললেন না, তিনি পত্রিকা করবেন। কীভাবে করবেন? ওই ৩২ নং কলেজ স্কোয়ারে মেটকাফ প্রেস থেকে ছাপিয়ে। ঠিক করা হল, পত্রিকাটা অর্ধ সাপ্তাহিক কিস্তিতে বেরবে। এইভাবে ২৬ শ্রাবণ ১৩২৯, ১১ অগস্ট ১৯২২ শুক্রবার, মানে এখনকার ফ্রাইডে রিলিজের ঢঙে তিনি প্রকাশ করলেন ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা।”

পত্রিকার পথচলা শুরু করার ইতিহাস নাকি আরও আকর্ষণীয়। ড. গুহ বলেন, “এই পত্রিকার সম্পাদককে ‘সারথি’ বলা হবে। এবং ‘সারথি’ হবেন নজরুল। ম্যানেজার হচ্ছে শান্তিপদ সিংহ। আর প্রতি সংখ্যার দাম হবে এক আনা। আর বার্ষিক গ্রাহক চাঁদা পাঁচ টাকা। এই কাজে নজরুল মুজাফফর আহমেদকে সেভাবে তাঁর পাশে পান নি। কিন্তু তাতেও তিনি দমে না গিয়ে চলে গেলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে। বললেন আশীর্বাণী চাই। রবীন্দ্রনাথ আশীর্বাণী লিখে পাঠালেন তাঁর নিজের হস্তাক্ষরে। কবিগুরু, কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু দিয়ে শুরু করে লিখলেন – “আয় চলে আয় রে ধূমকেতু/ আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু।” রবীন্দ্রনাথকে এইভাবে সঙ্গে পাওয়াটা নজরুলের ইচ্ছে আর আগ্রহকে আরও অনেকটা বাড়িয়ে দিল। শুধু রবীন্দ্রনাথ নয় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উপদেশ পাঠালেন, তারপরে কালিদাস রায় লিখলেন কবিতা, শরৎচন্দ্র পণ্ডিত ওরফে দাদাঠাকুর পত্রিকার হয়ে কলম ধরলেন, বিপ্লবী উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখলেন “কাজী ভায়া, রুদ্ররূপে ধূমকেতুতে চড়ে তুমি দেখা দিয়েছো, ভালোই হয়েছে, আমি প্রাণভরে বলছি স্বাগত!”।

আবির্ভাব হল ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার। এখানে প্রকাশিত হত কবিতা, প্রবন্ধ, বিভিন্ন খবর। এবং এই পত্রিকায় নজরুল নাকি বিশেষভাবে স্থান দিয়েছিলেন মহিলাদের। পত্রিকায় লেখালেখির বিষয়ে ড. গুহ বলেন “ক্ষুদিরাম যখন মারা যাচ্ছেন তখন কবি/সম্পাদক ক্ষুদিরামের মাকে স্মরণ করে লেখা লিখছেন। আইরিশ বিদ্রোহী রবার্ট এমিটের জীবনী প্রকাশ হচ্ছিল। লিখছিলেন কলহন মিশ্র। এছাড়া ওনার ‘যুগবাণী’, ওনার আগের লেখা কিছু প্রবন্ধ, অগ্নিবীণার দ্বিতীয় খণ্ড, বেশ কিছু বিজ্ঞাপন ইত্যাদিও প্রকাশ হচ্ছিল। এই পত্রিকায় তিনি মহিলাদের একটা বিশেষ স্থান দিয়েছিলেন। সম্পর্কে প্রমিলার জেঠিমা হওয়া সত্ত্বেও বীরজাসুন্দরী দেবীকে তো উনি মা ডাকতেন, তো এই বীরজাসুন্দরী দেবী ‘মায়ের আশিস’ নামে একটা লেখা দিয়েছিলেন। যে লেখাটা তিনি প্রথম সংখ্যায় এবং পরে ১৯২৩ সালের ২৭ জানুয়ারির সংখ্যায় পুনর্মুদ্রণ করেছিলেন। বীরজাসুন্দরী দেবী লিখেছিলেন, “গগনে ধূমকেতুর উদয় হলে জগতের অমঙ্গল হয়। ঝড়-ঝঞ্ঝা, উল্কাপাত, ভুমিকম্প, দুর্ভিক্ষ, মহামারি অনিবার্য হয়ে ওঠে। এটা জ্যোতিষশাস্ত্রের জ্ঞান হয়েছে অবধি শুনে আসছি। আমরা বাঙালি, আমরা বড় শান্তিপ্রিয় গোবেচারী জাতি। তাই আমাদের ধূমকেতু নামটা শুনলেই প্রাণটা কেঁপে ওঠে।” তারপরে উনি বলছেন “কিন্তু মা বিদ্রোহী দুরন্ত ছেলেকে শান্ত করবার শক্তি রাখে। অতএব ভয় নেই। তাই বলে অহংকার কোরো না। কর্ম করে যাও। তোমার যাত্রা শুরু হোক, বলো মাভৈঃ।”

এই পত্রিকা নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিভিন্ন মত দেখা গিয়েছিল। ড. গুহ বলেন, “মুজাফফর আহমেদ দ্বৈপায়ন ছদ্মনামে একটা চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘ভাই সারথি, তোমার ধূমকেতু আমি রীতিমতো পড়ছি। কিন্তু সত্য কথা বলতে কী, সমস্ত প্রাণ-মন দিয়ে যে জিনিসটি চাইছি সেইটি ওতে আমি পরিস্ফুটরূপে পাচ্ছি নে। আমাদের দেশের নির্যাতিত জনমণ্ডলীর প্রতি তোমার সহানুভূতি আছে, তোমার লেখাতেও তার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু বড় দুঃখ তুমি তাদের বিষয়ে পরিস্কার করে আজও কিছু বলোনি।’ কল্লোলগোষ্ঠীর লেখক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত এক জায়গায় লিখেছিলেন ‘সপ্তাহান্তে বিকেলবেলায় অধীর আগ্রহের সঙ্গে জগুবাবুর বাজারের মোড়ে দাড়িয়ে থাকি হকার কতক্ষণে ধূমকেতুর বাণ্ডিল নিয়ে আসে। হুড়োহুড়ি কাড়াকাড়ি পড়ে যায় কাগজের জন্য। কালির বদলে রক্তে ডুবিয়ে লেখা এইসব সম্পাদকীয় প্রবন্ধ।”

আরও পড়ুন ঐতিহ্যবাহী মুর্শিদাবাদ জেলা: বাঙালির ইতিহাসের ধারক

সবশেষে, এই পত্রিকার শেষ সংখ্যা প্রকাশ হয়েছিল ১৩২৯ এর মাঘ মাসে অর্থাৎ ২৭ জানুয়ারি ১৯২৩ সালে। একশো বছর পরে সম্পাদকের প্রথম সম্পাদকীয় প্রবন্ধের কয়েকটা লাইন উদ্ধৃতি করে ড.গুহ বলেন, “প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে নজরুল লিখেছিলেন - ‘মাভৈঃ বাণীর ভরসা নিয়ে, জয় প্রলয়ঙ্কর বলে ধূমকেতুকে রথ করে আমার আজ নতুন পথে যাত্রা শুরু হল।’ তিনি সেখানে আরও লিখেছিলেন ‘আমার কর্ণধার আমিই।’ তারপরেই একজায়গায় স্পষ্টভাষায় তিনি লিখছেন ‘ধূমকেতু কোনো সম্প্রদায়ের কাগজ নয়। মানুষ ধর্মই সবচেয়ে বড় ধর্ম। হিন্দু মুসলমানের মিলনের অন্তরায় বা ফাঁকি কোনখানে তা দেখিয়ে দিয়ে এর গলদ দূর করা এর অন্যতম উদ্দেশ্য।’ আজও একশো বছর পরে এসে এই কথাগুলো কত কন্টেম্পোরারি লাগে না? এত বছর পরে এসে আজও মনে হচ্ছে যেন এই কথাগুলোই আমাদের বলবার কথা, এই কথাগুলোই আমাদের ভাববার কথা। এসময়ে এসে দাঁড়িয়ে আমাদের এখন মনে হয় না যে আমাদের একটা ধূমকেতুর খুব প্রয়োজন? শুধু ভারতবর্ষের নয় সারা পৃথিবীতে যেভাবে মানুষ মানুষের বিরুদ্ধে লড়ছে তাতে খুবই মনে হয় যে একটা ‘ধূমকেতু’ খুব জরুরি ছিল।”

Kazi Nazrul Islam
Advertisment