রবীন্দ্রনাথ আমাদের আত্মার আত্মীয় কেন? কারণ, দুঃখের সময় রবীন্দ্রগানই আমাদের সান্ত্বনা, পীড়িতের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন জগতের হৃদয়।
কবিগুরু এইরকম সময়েই লিখেছিলেন, ক্ষুদ্র দুঃখ সবে ভুলে যদি তাকাও, দেখবে আনন্দধারা বহিছে ভুবনে। এইরকম সময়ের জন্যই লিখেছিলেন নির্ঘাত, যখন পৃথিবী জুড়ে সার্কাস চলছে। একদিকে করোনা ভাইরাসের উপদ্রব নিয়ে বিজ্ঞানীরা নাজেহাল। লোকে অথৈ জলে। টপাটপ মানুষ মরছে ইতালিতে, আমেরিকায়। পাবলিকের শব্দভাণ্ডারে নতুন শব্দ ঢুকে গেল, কোয়ারান্টাইন।
“দাদুর প্রতি আমার অসীম প্রেম আছে”: রোদ্দূর রায়ের একান্ত সাক্ষাৎকার
বিদেশ থেকে ফিরে এসে জনৈক অক্সফোর্ডের ছাত্র কোয়ারান্টাইনে যাননি বলে, যা জনরোষ দেখা যাচ্ছে, এবার 'করোনায় আক্রান্তকে গণপিটুনি' জাতীয় হেডলাইন দেখা গেলে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। অথচ কী হলে কোয়ারান্টাইন, কে করবে পরীক্ষা, কখন করবে পরীক্ষা, কখন অজ্ঞাতবাসে যেতে হবে, কখনই বা হাসপাতালে, কে করবে সেসব ব্যবস্থা, এসব কিছুই স্পষ্ট করে জানা নেই। সম্পূর্ণ ক্যাওস একেই বলে।
এর মধ্যে আনন্দটা কোথায়? রাষ্ট্রনায়কদের কাজকর্মে। পৃথিবী রসাতলে যাক, তাঁরা নিজেদের খেলা দেখিয়ে যাচ্ছেন। সবার মাথায় পৃথিবীর সম্রাট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি আজ নিজেকে ১০০য় ১০০ দিচ্ছেন, কালই বলছেন অবস্থা সংকটজনক। একদিন বললেন ইউরোপ এবং আমেরিকার যাতায়াত তো বন্ধ করে দিলামই, সঙ্গে ফাউ, ব্যবসাবাণিজ্যই বন্ধ করে দেওয়া হল। পরে জানা গেল ব্যাপারটা ঠিক তা নয়, কিন্তু ততক্ষণে ধাঁইধপাধপ শেয়ার বাজার পড়ে গেছে।
আরেকদিন বললেন ক্লোরোকুইনই হল মহামারীর অব্যর্থ ওষুধ। শুনে সমবেত বিজ্ঞানীদের মুখ চাওয়াচাওয়ি। তাঁরা আমতা আমতা করে বললেন, এরকম একটা কথা শোনা যাচ্ছে বটে, কিন্তু নিশ্চিত হবার আগে ক্লিনিকাল ট্রায়াল দিতে হবে। ভারতবর্ষে অবশ্য আরও এককাঠি বাড়া। এখনও করোনা মহামারী হিসেবে ছেয়ে ফেলেনি, কিন্তু শোনা যাচ্ছে, গোমূত্র খেয়ে তজ্জনিত অসুস্থতায়ই হাসপাতালের যাবতীয় বিছানা তার আগে ভর্তি হয়ে যাবে।
এই বিশুদ্ধ ভারতীয় পদ্ধতিতে চিকিৎসার মাথায় অবশ্যই আছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি তবু স্রেফ আবোলতাবোল বকেই ক্ষান্ত দিচ্ছেন, বাকি কাজটা বিজ্ঞানীদের করতে দিচ্ছেন, ভারতে ওসবের বালাই নেই। দেশের মাথাই সবকিছু জানেন। তিনিই বিজ্ঞান, তিনিই ইতিহাস। তিনিই সাক্ষাৎ মহাদেব আর তাঁর দলবলই হল নয়া নন্দী ভৃঙ্গী। তারা হোয়াটস্যাপে যা বলবে তাই মানতে হবে, নইলে ত্রিশূলের খোঁচা।
শোনা যাচ্ছে করোনা তাড়ানোর অব্যর্থ উপায় হল দুপুর রোদে ছাদে গিয়ে দাঁড়ানো। সূর্যের আলোয় ভাইরাস টপাটপ মরে যায়। সারা ভারতবর্ষ যদি একযোগে দুপুর বেলা ছাদে গিয়ে সূর্যপ্রণাম করে, তবে সব ভাইরাস খতম। সারা পৃথিবীর তাবৎ বিজ্ঞানীরা এই সহজ ব্যাপারটা কেন এতদিনেও বুঝতে পারেননি, সেটা ভেবে শিহরিত হতে হয়। তাতেও যদি এক আধটা বেঁচে যায় তাদের জন্য থালা-কাঁসর বাজানোর মহৌষধ তো আছেই। সেটার রহস্যটা অবশ্য এখনও ক্লাসিফায়েড।
এইসব কাণ্ড দেখলে এই দুঃখের মধ্যেও হাসতে ইচ্ছে করে। আর ইচ্ছে করে গলা ছেড়ে গালাগাল পাড়ার। হাসার ব্যাপারটা বোধগম্য, রবিবাবুই বলে দিয়ে গেছেন। কিন্তু গাল কেন? ট্রাম্প এবং মোদীর কাণ্ডডকারখানা দেখে রাষ্ট্রপ্রধানদের কথায় সারগর্ভ কিছু খোঁজার আশা কি ইতিমধ্যেই আমরা ছেড়ে দিইনি? অবশ্যই দিয়েছিলাম।
কিন্তু এই সংকটকালে সেকথা ভুলে আবার তাঁদেরই গাল পাড়ার ইচ্ছে হচ্ছে, তার কারণ একটাই। সেটাও রবিবাবু বহুবছর আগে এক কথায় লিখে গিয়েছিলেন -- বৃথা আশা মরিতে মরিতেও মরেনা। এর উপর আর কথা হয়না।
করোনা আবার প্রমাণ করল, রবীন্দ্রনাথ একজন জিনিয়াস। আমরা করোনায় মরি বা বাঁচি কবিগুরু বাঁচবেনই। ট্রাম্প এবং মোদীর রাজত্বে আমরা মরিয়া প্রমাণ করিব কবিগুরু মরেন নাই।
(সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় গুরুচন্ডালি ওয়েবজিনের সম্পাদক)
এই কলামের সব লেখা পড়ুন এই লিংকে