Advertisment

ঐ দেখা যায় বাড়ি আমার

কোনো দিন না-শোনা গান কোনো বেসুরো কালাও যদি নিজের মত করে শুনে ফেলে নিজেরই ভিতর থেকে, সে আর বদলানো যায় না, যায় না।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Debes Ray Memoirs, Mone Pare ki Pare Na

সীমান্তটা তো একটা ক-বছরের ইতিহাস মাত্র, ভূগোলটা কয়েক হাজার বছরের পুরনো। (অলংকরণ- অরিত্র দে)

(ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায় শুরু হয়েছে দেবেশ রায়ের স্মৃতি-সত্তার নানা কথোপকথন। প্রকাশিত হল তৃতীয় ভাগ।)

Advertisment

কেন জানি না, কখন জানি না, এই গানটি আমার কেমন করে যেন নিজের গান হয়ে গেছে। নিজের গান কাকে বলে? নিজে খেয়াল না করে যে সুর গুনগুন করি। আমার পক্ষে গুনগুননো সম্ভব নয়, আমি এতই বেসুরো। গানটা কোনো এক ভাবে কানে আসতে থাকে। প্রায় আমার অজান্তেই।

পড়ুন, মনে পড়ে কি পড়ে না প্রথম ভাগ, পকেটমারের কিসসা

কিন্তু এই গানটা নিয়ে বিস্ময় এই জায়গায় যে এই গানটি আমি কখনো শুনিই নি, পুরোটা তো নয়ই, আরম্ভটুকুও নয়। তেমন গান তার শ্রোতার কাছে ঠিক পৌঁছে যায়—এটা আমার পক্ষে এতবার পরীক্ষিত যে আমাকে একটু একা-একা ভাবতেও হয়েছে গানের এই নিজস্ব গতিপথ। আমার গলার সুরহীনতা এতই নিশ্চিত ও বহু পরীক্ষিত যে শোনা-গানের স্মৃতি থাকাও সম্ভব নয়। শ্রুতি ও স্মৃতির সংযোগের পথটা খুব সহজ-সরল। আমার ছোটোভাইয়েরই তেমন ছিল, একবার শুনলে সে কোনো সুর ভুলত না। তার সহোদর হয়েও অনেক ধরনের গান আযৌবন শুনে এলেও আমার কোনো সুরস্মৃতি নেই। আথচ এমনও তো কতবার পরীক্ষিত হয়েছে ব্লু-জ্যাজের একটা, একটাই, নির্দিষ্ট চলন আমার নির্ভুল মনে পড়ে গেছে। দেবব্রত বিশ্বাস একদিন আমাকে বকার সুরেই বলেছিলেন, ‘আপনি মাথা দিয়ে গান শোনেন’, আবার, একই সঙ্গে প্রায় এক নিঃশ্বাসে আমার স্ত্রী কাকলিকেও বকার সুরেই বললেন, ‘ডোন্ট সিঙ্গ উইথ ইয়োর ভয়েস, সিঙ্গ উইথ ইয়োর হেড’!

আমার চোখ যাঁর তত্ত্বাবধানে, অর্ণব বিশ্বাস, তিনি একদিকে অত্যন্ত আধুনিক এক ফটোগ্রাফার ও চোখের এফ-আর-সি-এস, সারা পৃথিবীতে ওঁর খ্যাতি। উনি আমার চোখের সমস্যা ব্যাখ্যা করলেন, ‘আপনার মাথা থেকে চোখে জল আসে। চোখের জল মাথায় যাচ্ছে না’।

পড়ুন, মনে পড়ে কি পড়ে না দ্বিতীয় ভাগ বাদল বাউলের একতারা

দেবব্রত বিশ্বাস বা অর্ণবের মত কথা শুনতে আমার একটু বেশি ভাল লাগে। কথাগুলোর মধ্যে একটা ধাঁধা থাকে, যে-ধাঁধাটা বহু বহু বহু বছর ধরে ভাঙতে হয়। মানেটা ওঁদের জিগেশ করলেই তো জানা যেত। কিন্তু ওঁরা কথাটা বলেন, এমন গভীর জ্ঞান থেকে, যে-জ্ঞানটাকে ব্যাখ্যা করতে বললে, ওঁদের মাহাত্ম্য খর্ব করা হয়। ওঁরা অনুভব থেকে জ্ঞানে পৌঁছেছেন। এমন করে কথা বলার মানুষজন আছে বলে ও তাদের সঙ্গে আচমকা দুর্বোধ্যতায় দেখা হয়ে যায় বলেই, বাঁচা এখনো বাঁচা থাকে।

যেমন, যে-গান সত্যি-সত্যি কখনো শুনিনি, সেই গানটাই আমার আপন গান হয়ে ওঠে। এমন দুর্বোধ্যতা ছাড়া বাঁচাটা তো বাঁচা থাকে না।

ঐ দেখা যায় বাড়ি আমার

চৌদিকে মালঞ্চ ঘেরা

দুর্বোধ্যতাটা ঐ খানেই। বানানের সমতাসাধন যেন আমাদের একটা প্রধান কর্তব্য হয়ে ওঠে—কখনো।

এমন কর্তব্যবোধের মধ্যে গোপন থাকে একটা হীনমন্যতা, যেন আমরা জন্মাবার আগে, এমন কি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ও তৈরি হওয়ার আগে হাজার খানেক বছর ধরে যে বাংলা লিপিতে বাংলা ভাষা ভুষো কালিতে ও নানা ধরনের খাগের কলমে তালপাতায় লেখা হয়ে আসছিল—সেটা কোনো একটা অনিশ্চিত নীতি অনুযায়ী ঠিকঠিক বাংলা হরফ ছিল না। বুঝতে অসুবিধে হয় না যে সেই অনিশ্চিত নীতিটা ইংরেজি আদর্শ অনুযায়ী একই ধাঁচের ছিল না। আমি এখন গান থেকে বানান তত্ত্বে ঢুকছি না। গানেই থাকছি। কী কারণে জানি না—বানান সংস্কারের আছিলায় আমাদের কয়েকটি বর্ণ তুলে দেয়া হল। বিদ্যাসাগর মশায় তাঁর বর্ণমালায় দীর্ঘ ঋ-ও দীর্ঘ ৯ তুলে দিয়েছিলেন এই যুক্তিতে যে ঐ দুটি বর্ণ বাংলায় ব্যবহারে লাগে না।

কিন্তু ‘ঐ’ ‘ঔ’ বর্ণ বা কারচিহ্ন কী দোষ করল? ওগুলো নাকী যুক্তস্বর। ওই, ওউ, এমন যুক্তস্বর। যুক্তস্বর বাংলায় নিষিদ্ধ না কী

এই যে-গানটি নিয়ে কথা তুলেছি তার ‘ঐ’ টি কি যুক্ততায় ব্যবহৃত, নাকি দূরত্ব-সূচকতায়?

যিনি গাইছেন তিনি কি কাউকে দেখিয়ে দিচ্ছেন—‘ওই’ টি আমার বাড়ি?

‘ঐ’ যদি ‘ওই’ হয়ে যায় তবে গানটি তো শুরুতেই মাঠে মারা গেল। ‘দেখা যায়’—এই বিশেষ্য-ক্রিয়ার ব্যবহারে ‘ঐ’ বর্ণটি তো দূরত্বকে বিশিষ্ট করল—সবে দেখা যাচ্ছে, বাড়িটা চিনতে পারা যাচ্ছে, কিন্তু এখনো দূরেই আছে, ‘ঐ’-এর দূরত্বে দেখা যায় মাত্র। ‘ওই’ বললে সেই দূরত্বটা ঘুচে যায় না? আমি যে বাড়ির কাছাকাছি যাচ্ছি—তেমন পথ-চলাটা ছোট হয়ে যায় না? বাড়ির সঙ্গে ভালবাসাবাসি একটু কমে যায় না?

পারের চরণটা যা আমি আমার ভিতর থেকে শুনতে পাই, সেটা, ‘চৌদিকে মালঞ্চ ঘেরা’।

আরও পড়ুন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায় প্রকাশিত দেবেশ রায়ের কলাম নিরাজনীতি

কেন যে এই চরণটাই শুনি, জানিনা। আমি তো গানটা শুনিই নি কখনো। কিন্তু লেখার আগে যাচাইয়ের অভ্যেসে—‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি’ প্রকাশিত ‘বাঙালির গান’- দুর্গাদাস লাহিড়ি সংকলিত ও সম্পাদিত—তাতে দেখছি ‘চারিদিকে মালঞ্চ বেড়া’, গোপাল উড়ে-র রচনা। যে-কারণেই হোক, এমন একটি কখনো না-শোনা গানের যে-চরণ আমার ভিতর থেকে আমি শুনি—আমি তো সেটাই শুনি, আমার কী সাধ্য আছে চরণটা আমি বদলাই—‘ঐ দেখা যায় বাড়ি আমার/চৌদিকে মালঞ্চ ঘেরা’। বাড়িটা বড় কাছে এসে গেছে—ভ্রমরের গুন গুন শোনা যাচ্ছে, তারও পরে, ‘কোকিলেতে দিচ্ছে সাড়া’। আমি কোকিলের সাড়া যে নিজের ভিতর থেকে উঠে আসা আগেই শুনে ফেলি। শুনে ফেললে একবার, কোকিলের ডাক সে কি আর পেছুনো যায়?

যায় না। যায় না। কোনো দিন না-শোনা গান কোনো বেসুরো কালাও যদি নিজের মত করে শুনে ফেলে নিজেরই ভিতর থেকে, সে আর বদলানো যায় না, যায় না।

ঐ দেখা যায় বাড়ি আমার

চৌদিকে মালঞ্চ ঘেরা।

Debes Ray Mone Pore ki Pore Na
Advertisment