আমি শান্তিনিকেতন দেখি প্রথম, সম্ভবত ১৯৬০-এ। আমি একা কলকাতা থেকে ট্রেনে চড়ে বোলপুরে নেমেছিলাম। কেন তা আর কিছুতেই আজ মনে পড়ে না। নিশ্চয়ই চাকরিগত কোনো ব্যাপার নয়। আমি তো তখন জলপাইগুড়ি আমার নিজের বাড়িতে থেকে সেখানে আমারই কলেজে পড়াই। শান্তিনিকেতন বা কলকাতায় চাকরি খোঁজার কোনো কারণই ছিল না আমার। তবু, হয়তো বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে পড়াবার গোপন বাসনায় দু-একবার কোনো প্রিয়জনকে চিঠি লিখেছি। অনেক পরে। ১৯৬০-এ নিশ্চয়ই নয়।
আর শান্তিনিকেতনে আমার এমন কোনো সাহিত্য সংযোগ ছিল না, যার কাছে আমি যেতে চাই। আমি কোনও কাজেই গিয়েছিলাম, গেস্ট হাউসে এক রাত্রি থেকে পরের দিনই আনরিজার্ভড কামরায় জলপাইগুড়ি রওনা দি। এই একরাত্রি একদিন আমি একটা রিকসা নিয়ে শান্তিনিকেতন ভ্রমণ সেরেছিলাম। রিক্সাওয়ালাই বলে দিচ্ছিল—‘মোহরদির বাড়ি’, ‘মাস্টারমশায়ের বাড়ি’, ‘ক্ষিতিমোহন সেনের বাড়ি’, রিক্সাওয়ালা কোনো পদবী বলেন নি, কিন্তু ‘শাস্ত্রী মশায়ের বাড়ি’ বলে বিধুশেখর শাস্ত্রীর বাড়ি দেখিয়েছিলেন, ‘সংগীত ভবন’, ‘কাল বাড়ি’, ‘শান্তিদেব ঘোষের বাড়ি’।
দেবেশ রায়ের কলাম ‘নিরাজনীতি’: সব পর্ব পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে
আমি এক মফস্বল কলেজের ছাত্র, তার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের। আমাদের উত্তরবঙ্গেও রংপুর কলেজ, কোচবিহার কলেজ ও পাবনার এডোয়ার্ড কলেজের ক্যাম্পাসের নাম ছিল। আমি দেখি নি। আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ বিল্ডিং, দ্বারভাঙা বিল্ডিং বা রাজাবাজার সায়েন্স কলেজকে কোনওক্রমেই ক্যাম্পাস বলা যায় না।
শান্তিনিকেতনই আমার প্রথম ক্যাম্পাস-দর্শন। কোনো বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ও তখন পর্যন্ত আমার দেখা নেই। আজ বোধহয় বলা চলে—শান্তিনিকেতনই আমাকে প্রথম এমন একটা সাজানো-গোছানো অথচ সাধারণ, অতি-সাধারণ, জায়গা দেখায়, যা, এক-একজন ব্যাক্তির কীর্তিতে সৌধ হয়ে উঠেছে, তার কেন্দ্রে ‘উত্তরায়ণ’ গৃহমণ্ডলী—যা শান্তিনিকেতন নামক স্থানটির কেন্দ্র। রবীন্দ্রনাথের পল্লিগঠন বা পল্লিবিন্যাস পরিকল্পনা বা ‘শান্তিনিকেতন’-এর গঠন পরিকল্পনা নিয়ে কি বিশদ কোনও গবেষণা হয়েছে?
এই একদিন-একরাত্রির প্রথম সাক্ষাতে আমার সবচেয়ে বেশি চোখে পড়েছিল দুটি বিষয়। শান্তিনিকেতিনের মেয়েরা পায়ে চটি পরেন না।
আরও পড়ুন, ধুলামাটির বাউল: সন্মাত্রানন্দের জীবনপথ
রিক্সাওয়ালার নিপুণ বিবরণ তো শান্তিনিকেতন সম্পর্কে আমার যা-জানা, তাকেই সত্য করে তুলছিল এমন একটা বালকশোভন বিষয়ে যে শান্তিনিকেতনটা তা হলে সত্য।
কিন্তু সেই সত্যকে রূপ দিয়েছিল—রাস্তার মোরামের রং আর মেয়েদের খালি পা। মনে হচ্ছিল—ঐ রঙের পথ থেকে মেয়েরা যেন তরু বা গাছ বা বৃক্ষ হয়ে উঠছে ও সেই তরু বা গাছ বা বৃক্ষ চলমান। তাদের সেই খালি পায়ের চলনে শান্তিনিকেতন-নামের সেই গ্রামটি অহরহ, অহরহ, অহরহ বদলে-বদলে বদলে-বদলে চলেছে। সেই প্রথম দর্শনেই আমার ভিতর এই মায়া খেলেছিল যে শান্তিনিকেতনের নিসর্গ এক নিয়ত পরিবর্তমান নিসর্গ, যার শিকড় গাড়া আছে আশ্রম-বাসিনীদের খালি পায়ে।
পরে, যখন শান্তিনিকেতন প্রায় আমার ঘরবাড়ি হয়ে উঠেছিল তখনো মেয়েরা নানা রঙা বেনারসী বা আরো উজ্জ্বল শাড়িতে নিজেদের মুড়ে এক-একটা ঝোপ বা ঝাড়ের মত কোনো বিয়েবাড়িতে যেত বা কোনো অনুষ্ঠানে। সেই চলমান নটমান বল্লরীগুলির ছন্নছাড়া অথচ ভিতরের ছন্দে ছন্দিত নানা পদক্ষেপ, যা মাটির ভিতর থেকে উদ্গত হয়ে তাদের সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ত।
শান্তিনিকেতনের মেয়েরা এখনও খালি পায়েই হাঁটে তো!
এই সিরিজের সবকটি লেখা একত্রে পাওয়া যাবে এই লিংকে