Advertisment

মনে পড়ে কী পড়ে না ৫: প্রতিষ্ঠান ইন্দিরা

দর্শন শাস্ত্রের এক অত্যন্ত ভাল ছাত্রীকে আমি কিছুতেই ‘ফ্যালাসি’ বোঝাতে পারি নি। সে কিছুতেই যুক্তির ফাঁকটা ধরতে পারত না।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Debes Ray, Nostalgia

অলংকরণ- অরিত্র দে

আমাদের রোজকার জীবনে এমন ঘটনা কি হামেশা ঘটে যে আমাদের ধ্যানধারণার জগতে বড় রকমের ধাক্কা লাগে! এমনই ধাক্কা, যে আগে যেমন ভাবতাম, তেমন করে আর ভাবতেই পারছি না!

Advertisment

‘ইন্দিরা’ তো আমাদের শহরের রবীন্দ্র সংগীতের পুরনো প্রতিষ্ঠান। তাঁদের চাইতেও পুরনো রবীন্দ্র সংগীত প্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু ‘ইন্দিরা’ শুধুই রবীন্দ্র সংগীত শেখার স্কুল নয়। প্রতিষ্ঠার (১৯৬৬) পর থেকেই ‘ইন্দিরা’ রবীন্দ্র সংগীতের অনুষ্ঠানের প্রচলিত ধরণ থেকে সরে আসে। কবি ও রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞতম শঙ্খ ঘোষ তাঁদের অনুষ্ঠানগুলোর পরিকল্পনা করে দিতেন প্রায় প্রতি বছর। ফলে ‘ইন্দিরা’র বার্ষিক অনুষ্ঠানগুলি হয়ে উঠত রবীন্দ্র অধ্যয়ন। সেই অনুষ্ঠানগুলির নির্বাচিত অংশ পরে লং প্লেয়িং রেকর্ড হিশেবে বেরত। কিছু-কিছু।

‘ইন্দিরা’ রবীন্দ্র সংগীত বিপণন-শ্রবণ ব্যবস্থাতেও এমন একটা গভীর বদল ঘটালেন যা বাংলার গ্রাম-গঞ্জেও ছড়িয়ে পড়ল।

কলকাতা খুব সংগঠিত শহর। কলকাতায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কাজকর্ম, খেলাধুলো সহ, সুসংগঠিত ও বিভিন্ন স্তরে বাঁধা। অনেক সময় হয়তো আমরা এই সাংগঠনিকতাতে আড়ষ্ট বোধ করি, বিরক্তও হই। কিন্তু একটু বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যায়—এই সাংগঠনিকতা অচলায়তন নয়, পাড়ার ক্লাব থেকে সংগীতচর্চার প্রতিষ্ঠানের একটা যোগ্য জায়গা  জুটে যায়—এই প্রবল বেগে বাড়তে থাকা মহানগরটিতে। সেখানে চকিত বিস্মিত হয়ে উঠতে হয় সুখচর-পঞ্চম, বা কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্রের কোনো নাট্যানুষ্ঠানে বা দক্ষিণ গড়িয়া থেকে দেবব্রত চট্টোপাধ্যায়ের একক চেষ্টায়, সম্পদনায় ও পরিকল্পনায় প্রকাশিত ‘পরিকথা’-র মত অনিয়মিত সাময়িকপত্র দেখে। কলকাতা সত্যিই বিস্ময়কর—কলকাতা বলতে যে ক্রম বৃহত্তরতা তৈরি হয়ে চলেছে তার সাংস্কৃতিক ব্রতীদের কল্পনায় অশেষ মৌলিকতায় ও সেই মৌলিকতাকে সবল বাস্তব করে তোলার কঠিন পারদর্শিতায়। এমন সব উদ্যোগ হয়তো আমাদের সব সময় চোখে পড়ে না, কিন্তু চোখের বাইরের বাস্তব, বাস্তবের চাইতে কঠিন বাস্তব।

১৯৬৬-তে শান্তিনিকেতনের কয়েকজন প্রাক্তনী ‘ইন্দিরা’ প্রতিষ্ঠা করে যে এই মহত্তর নগরে রবীন্দ্রচর্চার নতুন পরিবেশ সৃষ্টি করলেন তার কোনো সমর্থক বা গ্রহীতাই জুটত না যদি তাঁদের পরিকল্পনা ও রূপায়ণে আবিষ্কার ও অভিনবত্ব না থাকত। ‘জ্যোতিরিন্দ্রনাথের গান’, ‘ঠাকুরবাড়ির গান’, ‘উপাসনার গান’, ‘নবজীবনের গান’।

এ-ছাড়া ‘ইন্দিরা’ প্রকাশ করে চলেছে, রবীন্দ্র সংগীত নিয়ে নানা লেখকের চিন্তা-, অনুভব ও ভাবনা-গ্রন্থ।

এ-সবই সম্ভব হত ‘ইন্দিরা’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সুভাষ চৌধুরী-র প্রায়-অমানুষিক কর্মক্ষমতায়। রবীন্দ্র সংগীতের ওপর তাঁর তথ্যসংগ্রহের অধিকারের প্রমাণ তাঁর মহাগ্রন্থ ‘গীতাবিতানের জগৎ’। সুভাষ বাবুর মৃত্যুর পর প্রধানত শ্রীনন্দা মুখোপাধ্যায়ের যোগ্য নেতৃত্বে, সুপূর্ণা চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে ‘ইন্দিরা’ তার বিশিষ্ট কর্মসূচি পালন করে চলেছে। এটা সম্ভব হয়েছে, সুভাষ চৌধুরী-র আদর্শ ও শ্রম তাঁরা এখনো মেনে চলেছেন বলে। এ শহরে ‘ইন্দিরা’ সত্যি এক একক অধিষ্ঠান।

আমি ‘ইন্দিরা’র কথা বলার জন্য এই লেখাটি শুরুই করি নি। আমার একটা সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা জানানোর জন্য ‘ইন্দিরা’র কথাটা না তুলে পারা গেল না।

এবার কবিপক্ষে ‘ইন্দিরা’ আমন্ত্রণ জানিয়েছিল—‘অন্বেষা’ কে। ‘অন্বেষা’ বেহালার একটি প্রতিষ্ঠান। তাঁরা এক বিশেষ ধরনের শারীরিক পশ্চাৎপদ শিশুদের স্বাভাবিকতা প্রমাণের অভিযানে কাজ করে চলেছেন। এমন প্রতিবন্ধকতার বিশেষজ্ঞ নাম—ডাউন সিনড্রোম। ‘অন্বেষা’ রবীন্দ্র সংগীতকে অবলম্বন করে এই শিশু-কিশোর দের উপ্ত ছন্দজ্ঞান ও ছন্দরূপায়নকে সক্রিয় করে তুলতে অনুশীলনের প্রতিষ্ঠান।

এখানে, একটু ব্যক্তিগত কথা বলে রাখি, নইলে বোঝানো যাবে না—‘অন্বেষা’র এই অনুষ্ঠানটি আমার ব্যক্তিগত ধারণার জগতে কী বদল ঘটিয়েছে।

ব্যাহত শিশু বলতে আমি নিজের মত করে বুঝে নিতাম: সেই ব্যক্তিশিশুটি কোনো শারীরিক কারণে সামাজিক ছন্দের সঙ্গে, সামাজিক দৈহিক ও মানসিক ছন্দের সঙ্গে, নিজেদের ব্যক্তিগত ছন্দকে মেলাতে পারছে না। অনেক দিন তো  মাস্টারি করেছি। ছন্দ-অলঙ্কার পড়াতে গিয়ে দেখছি—কোনো কোনো ছাত্র ছাত্রী কিছুতেই ছন্দের পর্বটা ধরতে পারেন না। কিন্তু তাকে যদি পুরো কবিতাটি পড়তে বলা হয়, সে নির্ভুল ছন্দে পড়ে যায়।

দর্শন শাস্ত্রের এক অত্যন্ত ভাল ছাত্রীকে আমি কিছুতেই ‘ফ্যালাসি’ বোঝাতে পারি নি। সে কিছুতেই যুক্তির ফাঁকটা ধরতে পারত না।

দেবেশ রায়ের কলাম 'নিরাজনীতি': সব পর্ব পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে

এরা কোনো কারণেই ব্যাহতিবুদ্ধি বা ব্যাহত-বিকাশ নয়। এদের বোধের ছন্দ অন্যদের সঙ্গে মেলে না এই টুকুই যা তফাৎ।

কলকাতার বেহালার ‘অন্বেষা, দ্য কোয়েস্ট‘ (Anwesa, the quest) রবীন্দ্র সংগীত ও নৃত্যচর্চাকে এই ডাউন সিন্ড্রোম লক্ষণাক্রান্ত শিশু-কিশোরদের ব্যবহারিক স্বাভাবিকতার জগতে ফিরিয়ে আনছেন।

শ্রী অনুপ মতিলাল অত্যন্ত তথ্যনিষ্ঠ অথচ বিশেষজ্ঞতা ভারাক্রান্ত নয়, এমন একটি ভাষণে সংগীত ছন্দ, ‘অন্বেষা’- সংগঠনের লক্ষ সম্পর্কে বলায় আমাদের পক্ষে পরবর্তী গান ও নাচের অনুষ্ঠানটির বৈশিষ্ট্য বোঝা সহজ ও সম্ভব হয়েছিল। আর কী আশ্চর্য, ‘অন্বেষা দি কোয়েস্ট’ এর ছেলেমেয়েদের গান ও নাচকে কোনো ভাবেই কলকাতার কোনো বিখ্যাত মঞ্চের কোনো অনুষ্ঠানের চাইতে একটুও আলাদা মনে হল না। এমন কি আমাদের সমস্ত অঙ্গের মধ্যে সবচেয়ে বাঙমুখর যে-দৃষ্টি, সেই দৃষ্টিতেও কোনো ব্যাতিক্রম চোখে পড়ল না, মঞ্চ থেকে হাত কয়েক দূরের প্রথম সারির মাঝখানে বসেও।

আমার কাছে ‘অন্বেষা’র একটা অনুষ্ঠান সূচি ছিল। এই লেখাটির সময় সেটি আর হাতের কাছে পাচ্ছি না। পেলেই-বা কী এমন হত। তাতে গান ও নাচের তালিকা ছিল। দেখতে-দেখতে শুনতে-শুনতে দু-একজন শিল্পী বিশিষ্ট হয়ে উঠছিলেন। তাঁদের কয়েকজনের নাম যদি এখানে ছাপতে পারতাম—তাতে তাঁদের কিছু আসত-যেত না আর এই স্বর্গীয় ঘটনাটিও চাক্ষুষ করা যেত না যে সেই সোনার চাঁদ হীরের টুকরোরা কী দৈব পরাক্রমে রবীন্দ্রনাথকে অবলম্বন করে তাদের অন্তরের ছন্দকে বিশ্ব ছন্দের সঙ্গে মিলিয়ে দিচ্ছেন—কোথাও কোনো ব্যাহতি নেই, কোথাও কোন ব্যাধি নেই।

এই সিরিজের সবকটি লেখা একত্রে পাওয়া যাবে এই লিংকে

Debes Ray Mone Pore ki Pore Na
Advertisment