Advertisment

মনে পড়ে কী পড়ে না ৪: দেশ, বাড়ি

আমাদের সময়ে এম-এ ক্লাশের প্রথম দিন থেকেই কেউ-কেউ মাস্টারমশায়দের সঙ্গে বিশেষ খাতির জমাত। এটাকে নাইনথ পেপার বলা হত।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Debes Ray Memoirs, Mone Pare ki Pare Na

সীমান্তটা তো একটা ক-বছরের ইতিহাস মাত্র, ভূগোলটা কয়েক হাজার বছরের পুরনো। (অলংকরণ- অরিত্র দে)

(ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায় চলছে দেবেশ রায়ের স্মৃতি-সত্তার নানা কথোপকথন। প্রকাশিত হল চতুর্থ ভাগ।)

Advertisment

একবার কী একটা সম্মিলনে আমরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার একটা দল আসানসোল গিয়েছিলাম। হতে পারে—ছাত্র ফেডারেশনের কোনো সম্মিলন। হতে পারে—প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কোনো সন্ধানে। কিছু পুরনো পুথি বা পাথর পাওয়া যেতে পারে, সেগুলোতে কোনো হরফ থাকলে পড়ে দিতে হবে। হরফ না থাকলে পড়তে হবে না। আমরা যারা বাংলা পড়ি তারা কী করে পুরনো বাংলা হরফ চিনব। সেটার কোনো যুক্তি ছিল না। আমাদের সময়ে এম-এ ক্লাশের প্রথম দিন থেকেই কেউ-কেউ মাস্টারমশায়দের সঙ্গে বিশেষ খাতির জমাত। এটাকে নাইনথ পেপার বলা হত। ঘটনা নিছক গুজবই ছিল না। কোনো-কোনো মাস্টার মশায় এ-সব কিছুর ওপরে ছিলেন। আবার কোনো কোনো মাস্টারমশায় শেষ পর্যন্ত নম্বরটা তাঁর হাতে এমন অস্ত্র কোনো সময়ই হাতছাড়া করতেন না।

পড়ুন, মনে পড়ে কি পড়ে না প্রথম ভাগ, পকেটমারের কিসসা

ছাত্র ফেডারেশনের সম্মিলন না প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সাহায্যকারী দল—উপলক্ষের এমন বিস্মরণ কী করে ঘটতে পারে। ছাত্র ফেডারেশনের সম্মিলন হলে তার নেতারা নিজেদের দলবাজির স্বার্থে দীপেনকে, আমাকে বা এমন আরো দু-একজনকে তাদের ফ্যাকশনের বলে দেখাতে চাইতে পারে। আর, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সাহায্যকারী দল হিশেবে লিস্টি তৈরির সময় দীপেন, আমার ও আরো কারো-কারো নাম ঢুকিয়ে দেয়া হতে পারে। আনন্দ বা আনন্দ বাগচীর নামও সেই সুবাদে লিস্টিতে এসে থাকতে পারে। ওর তখন খুব নাম—‘কৃত্তিবাস’-এর প্রথম সম্পাদকদের একজন।

এই সব উদ্‌যোগ আয়োজনের কিছুই আমরা জানতাম না। যারা প্রধান উদ্যোগী তাদের জানতাম না। যারা প্রধান উদ্যোগী তাদের আমাদের বিভাগীয় প্রধান শশিভূষণ দাশগুপ্ত তাঁর নিচু স্বরে বলে দিয়েছিলেন—‘মেয়েদের নিয়ো না, থাকা-খাওয়ার জায়গা ঠিক নেই, ওদের অসুবিধে হবে’।

পড়ুন, মনে পড়ে কি পড়ে না দ্বিতীয় ভাগ বাদল বাউলের একতারা

তা হলে প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ক কাজই হবে। ছাত্র ফেডারেশন হলে আর শশিবাবু আসবেন কী করে?

তখন আমাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে একটু-আধটু মেলামেশা হচ্ছে। পরে তার কিছু কিছু প্রেম হয়ে উঠবে। ও কিছু-কিছু দাম্পত্যও ঘটে যাবে। শশিবাবুর ব্যক্তিত্ত্ব সম্পর্কে কারো কোনো ধারণাই ছিল না। তবে এম-এ ক্লাশে এমন ছাত্রছাত্রী তো থাকতই কেউ-কেউ, যারা বেশ স্বাভাবিক ভাবেই সব কিছু জানে।

তেমনই দু-একজন গিয়ে শশিবাবুকে বলল, ‘স্যার, নমিতাদের বাড়ি আসানসোলেই। ওরা ওখানকারই বাসিন্দে। মেয়েরা ওদের বাড়িতেই থাকতে পারবে—কোনো অসুবিধে হবে না। নমিতা-

নমিতা এগিয়ে এসে শশিবাবুর টেবিলের সামনের একটা চেয়ারের পিঠ ধরে দাঁড়িয়ে ঠোঁট খুলবার আগেই, শশিবাবু চোখ তুলে বললেন, ‘মেয়েদের কাউকে নিতে তো নিষেধ করেছি’।

ব্যাস। কথা শেষ।

পড়ুন, মনে পড়ে কি পড়ে না তৃতীয় ভাগ ঐ দেখা যায় বাড়ি আমার

নমিতাদের বাড়ি সত্যি আসানসোলে কী না, তা আমরা কেউই জানতাম না। আমাদের তেমন কোনো স্বার্থও ছিল না। তবে নামিতা আমাদের দলের সঙ্গেই আসানসোলে ওর বাড়িতে গিয়েছিল। আর, ওর সঙ্গে ওর দুই বন্ধুও গিয়েছিল।

তারা তো আর পুরনো বাংলা হরফ পড়তে যাচ্ছে না। তারা যাচ্ছে নমিতাদের বাড়ি—সেখানে শশিবাবুর নিষেধ তো কার্যকর নয়।

গল্পটা বা ঘটনাটার বিষয় বাংলা পুরনো হরফও নয়, নমিতাদের বাড়িও নয়। ঘটনাটা দেশবাড়ির কথা নিয়ে। অ্য়াকাডেমিক কাউন্সিলের কোনো মেম্বারের মনে হয়েছে, বাংলা ও ওড়িয়ার ছাত্রছাত্রীদের পুরনো হরফ চেনা দরকার। উঠল বাই তো কটক যাই। তাই আমরা আসানসোলে ও সেখানে থেকে বর্ধমানের একটা ভগবানেরও ভুলে-যাওয়া গ্রামে। ভগবান ভুলে না থাকলে বাংলা পুরনো হরফ আর কোথায় যাবে—এই গ্রাম ছাড়া।

আমরা একটা ভাঙাচোরা চালার বাঁশের বেঞ্চিতে বসে ছিলাম—তারা আমাদের দুপুরের ভাত দেবে। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে নাকি এমন কষ্ট করেই কাজ করতে হয়। হোক। আমাদের তো আর করতে হয় না। এ-সব প্রান্তরে অনেক গ্রামে থাকে। সেই গ্রামের মানুষজন বাইরের মানুষ এলে মাইল-মাইল হেঁটে মানুষ দেখতে আসে। এখানেও আসছিল। যে-ঘটনাটা বলতে চাই সেটাতে এতক্ষণে পৌঁছুলাম। কথায় পৌঁছনো খুব কঠিন। পথে হারিয়ে যায় কত কথা।

যাঁরা আমাদের ঘেরা ভিড়টা বাড়াচ্ছিলেন, তাঁদেরই মধ্যে বুড়ো-মতন দু-চারজন জানতে চাইছিলেন, আমরা কোত্থেকে এসেছি, কেন এসেছি, কদিন থাকব, কোথায় থাকব—এমন সব প্রশ্ন।

একজন বুড়ো মানুষ জিগগেস করছিলেন, ‘আমাদের বাড়ি বা দেশ কোথায়’।

প্রথমে যাকে জিগগেস করলেন, অংশু, সে উত্তর দিল ঠিকঠাক, ‘নদীয়া বর্ডারের কাছে হাঁসখালি আমাদের দেশ। পড়াশুনো করেছি কৃষ্ণনগর কলেজে। এখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম-এ পড়ছি’।

অংশুর উত্তর দেয়ার রকমে উনি খুশি হলেন। সেটা বোঝা গেল ওঁর জবাবে, ‘বাঃ, বাঃ, কী সুন্দর বললেন, আমাদের দেশ। এম-এ পরীক্ষায় পাশ করে কি আবার দেশে ফিরে যাবেন?’

অংশু একটু লম্বা ছিল, কাঁধটাও চওড়া। ওর হাসিটা খুব আন্তরিক ছিল, ‘দেশে ফেরার জন্য তো আর এম-এ পড়ছি না। আমাদের দেশে এম-এ পাশের চাকরি পাব কোথায়?’

‘দেশে খেতজমি নেই? বাড়ির? খেতজমিতে তো বাড়ির সবাইকেই কাজ করতে হয়’।

‘গ্রামে তো একটু-আধটু জমি সবারই থাকে। সেই জমি দেখাশোনার মানুষজনও তো আছে। জমি তো বাড়ে না। এক-জমি আর কত জন মানুষকে খাওয়াবে? আপনাদের দেশগাঁয়ের ছেলেরা পড়তে বাইরে যায় না? পড়াশুনো শেষ করে তারা কি দেশগ্রামে ফিরে আসে?’

বুড়ো-মানুষটি একটু চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, ‘কেউ-কেউ দেশগ্রামের বাইরে যায় না, কেউ-কেউ গিয়ে আবার ফিরে আসেও তো। দেশগ্রাম থেকে সবাই যদি চলেই যায় আর ফিরে না আসে, তা হলে দেশগাঁ বলে তো কিছু আর থাকবেই না। নিজের দেশগাঁ না-থাকলে মানুষের চলবে কী করে?’

অংশু খুব নরম গলায় বলল, ‘কাজ না থাকলে দেশগাঁয়ে এসে মানুষ করবেটা কী? মানুষ তো নিজের কাজ চায়, আয় চায়, সংসার চায়’।

‘দেশ-গাঁয়ে সে-সব তৈরি করা যায় না?’

‘হয়তো যায়। আমার তো সে ক্ষমতা নেই’।

অংশুর পাশে ছিল অমিতাভ। ওরা জোব চার্নকের আমলের কলকাতার ঘটি। বৌবাজারে নিজেদের পুরুষানু-ক্রমিক বিশাল বাড়ি। বুড়ো মানুষটি তাকে জিগগেস করলেন, ‘আপনার দেশ কোথায়?’

অমিতাভ বলল, ‘কলকাতা’।

বুড়ো মানুষটি একেবারে হাততালির আওয়াজে হেসে উঠলেন, ‘কী যে বলেন, তার মানে আপনার কোনো দেশগাঁ নেই। কলকাতা কারো দেশ হয়? যেখানে গেলে কারো আর ফেরার দেশ থাকে না’।

Debes Ray Mone Pore ki Pore Na
Advertisment