Advertisment

বাদল বাউলের একতারা

আমাদের জ্ঞান সত্ত্বেও আমরা ভুলে যাই যে ভূমিকম্প ঘটে যে প্রাকৃতিক নিয়মে, তার সঙ্গে বাড়ির উচ্চতা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতির কোনো দূরতম কার্যকারণ সম্পর্ক নেই।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Debes Ray Memoirs, Mone Pare ki Pare Na

সীমান্তটা তো একটা ক-বছরের ইতিহাস মাত্র, ভূগোলটা কয়েক হাজার বছরের পুরনো। (অলংকরণ- অরিত্র দে)

(৮৩ বছরের এক জীবনে কত কী-ই তো থাকে! সে জীবন যদি হয় রাজনীতিক-সাহিত্যিক-সমাজবিজ্ঞানীর, তাহলে তেমন জীবন থেকে বিচ্ছুরিত হতে থাকে বর্ণমালা। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায় দেবেশ রায়ের কলাম, মনে পড়ে কী পড়ে না- দ্বিতীয় ভাগ)

Advertisment

আমাদের প্রস্তত, নিশ্চিত, গোছানো, বিজ্ঞানসমর্থ, ভবিষ্যৎ-জানা, আশ্বস্ত দৈনন্দিন জীবনে যখন বা যদি আকস্মিক, অপ্রস্তুত, প্রাকৃতিক, নিয়ন্ত্রণ-অতীত, অজানিত একটা ঘটনা ঘটে তখন বিমূঢ় হয়ে চকিতে আমরা অসহায় হয়ে পড়ি, কারণ, আমরা তো অভ্যস্তই এই অতটা অজ্ঞান জীবনযাপনে।

টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনে-বিজ্ঞাপনে আমাদের তো নিশ্চিত থাকা অভ্যেস হয়ে গেছে যে আমরা বিশ বা চল্লিশ তলা উঁচু বাড়িতে থাকলেও আমাদের সেই উচ্চতা কখনো টলবে না, প্রবলতম ভূমিকম্পেও না; কারণ মাটির তলায় এমন ধরনের বিশেষ টিউব ব্যবহার করা হয়েছে ও ঐ বিম বা চল্লিশ তলা উচ্চতাতেও এমন ‘বিশেষ’ রিম ব্যবহার করা হয়েছে যা ভূমিকম্প-রোধক।

যেন, তা সম্ভব?

আমরা এত সরল যে বিশ্বাস করি: সম্ভব। আমাদের জ্ঞান সত্ত্বেও আমরা ভুলে যাই যে ভূমিকম্প ঘটে যে প্রাকৃতিক নিয়মে, তার সঙ্গে বাড়ির উচ্চতা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতির কোনো দূরতম কার্যকারণ সম্পর্ক নেই। আমরা ভুলে যাই—ভূমিকম্প-নিরোধক টিউব ও রিম—বিজ্ঞানের আবিষ্কার নয়। যদি হত, তা হলে ছোট-বড় সব স্টিল কোম্পানিই সেটা তাদের বিজ্ঞাপনে সেটা বলত।

পড়ুন, মনে পড়ে কি পড়ে না প্রথম ভাগ, পকেটমারের কিসসা

ওটা অ্যাড-এজেন্সির বানানো শ্লোগান। ওটার কপিরাইট আছে। আর-কোনো কোম্পানি বিজ্ঞাপনে ঐ কথাগুলি ব্যবহার করতে পারবেন না।

আর, এটাও আইনে আছে যে বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত কথাগুলির সত্য হওয়ার কোনো দায় নেই, প্রতিশ্রুতিও নয়।

তাই ভূমিকম্পরোধক চল্লিশ তলা বাড়ির লিফটে এমন সাবধানতা সর্বত্র লেখা থাকে কেন, ‘আগুন লাগলে সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করুন’। কোনো-কোনো তেমন উঁচু বাড়িতে তো ‘ফায়ার একজিট’ বলে আলাদা খাড়া সিঁড়িই থাকে।

কিন্তু এই ভুলে-থাকাটুকুই, আমাদের জীবনের ভিৎ। আগুন-লাগা ঠেকাতে পারে না, তারা ভূমিকম্প ঠেকাবে?

এই ভুলে-থাকাটুকু দিয়েই তো আমরা রোহিঙ্গা বাঙালিদের বাঙালি বলে স্বীকারই করি না—যদিও সেখানকার রাজসভায় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে উল্লিখিত কত বই লেখা হয়েছে। এই ভুলে-থাকাটুকু নিয়েই তো আমরা ভুলে থাকি বাংলার উপকূল আর ওড়িশার উপকূলের মধ্যে প্রাকৃতিক কোনো বিভাজনই নেই। একটাই সমুদ্র উপকূল। কাঁথিতে খাল আছে আকস্মিক ও অনিশ্চিত যে সমুদ্র-উচ্ছ্বাসের জলকে স্থলভাগের ভিতরে বইয়ে দিতে, প্লাবন ঠেকাতে, সে-সমুদ্র উচ্ছ্বসিত হয়েছে বালাসোরে ওড়িশায়। সেই একই সমুদ্রের আকস্মিক ও অনিশ্চিত উচ্ছ্বাস বালাসোরের দিকে না এসে হাওয়ার সঙ্গে চলে যায় বাংলাদেশের চট্টগ্রামের দিকে।

এই ভুলে থাকাটুকু নিয়েই তো আমরা ভুলে থাকি—শেয়ালদা থেকে নদীয়া-সীমান্ত কয়লা-চালানো ইঞ্জিনেও লোক্যাল ট্রেনের দূরত্ব মাত্র—সকালে গিয়ে সন্ধের মুখেই ফিরে আসা যেত। এখন নদীয়ার পর যশোর তো বিদেশ। এই ভুলে-থাকাটুকু নিয়েই তো আমরা ভুলে ছিলাম—‘ফণী’ ঘূর্ণিঝড়ের মুখে কত গতিপথ খোলা ছিল।

আবহাওয়া-বিদদের কোনো ভুল হয় নি।

তাঁরা সবচেয়ে জনবহুল এলাকার ভিতর দিয়ে ফণীর যে সম্ভাব্য গতি তার ওপরই জোর দিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায় প্রকাশিত দেবেশ রায়ের কলাম নিরাজনীতি

২ মে বৃহস্পতিবার বিকেল থেকেই কলকাতা ফণীর জন্য তৈরি হচ্ছিল। খুব একটা আতঙ্ক ছড়ায় নি কারণ প্রশাসনের সতর্কতা ও পরের দিন ৩-তারিখে শুক্রবারে পুরীর খবরটা পুরোপুরি পৌঁছয় নি। পুরীতে ফণী সকাল ৮টা নাগাদ প্রথম ধাক্কা দেয়। আসলে, সেটা প্রথম ধাক্কা ছিল না—পুরীতে পৌঁছবার আগে গোপালপুরেই প্রথম মাটি পেয়েছে ফণী। গোপালপুরে তো কোনো সৈকতই নেই—সমুদ্রের মুখোমুখি কিছু বসত। যে- বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় (২ মে) কলকাতা চলমান ছিল সেই বৃহস্পতিবারই, সন্ধ্যার আগে থেকেই, পুরীতে সমস্ত বিদ্যুৎ-সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। অন্ধকার পুরীর ওপর ফণী সম্ভবত ঘন্টায় ২০০ কিলোমিটার বেগেই আছড়ে পড়েছিল। সেই গতিবেগের হিশেব কষেই আবহাওয়াবিদ্‌রা জানিয়েছিলেন—পরের দিন শুক্রবার রাত বা ভোরে ফণী কলকাতায় পৌঁছুবে প্রায় ১০০ কিমি বেগে।

আমি বৃহস্পতিবার, ২ মে, একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। পরের দিনও একটা অনুষ্ঠান ছিল, সেখানে আমাকে যেতেই হবে। ফেরার সময় ড্রাইভারকে জিগগেশ করলাম। ওঁর সাহস আছে। উদ্যোক্তারা জানালেন অনুষ্ঠান হবে। আমি ঝড় একটু চিনি। চলতি গাড়ি ঝড়জলে আটকায় না। কিন্তু এক সময় আমি তো একটা ভাঙা ফিয়াট গাড়ি নিয়ে ও স্কুটার নিয়ে কলকাতা দাপাতাম। সেই অভিজ্ঞতায় জানি, এত বেশি ফ্লাইওভার আর দু-পাশে ফাঁকা উঁচু রাস্তা হয়েছে আর সেই সব রাস্তায় আকাশ সমান ক্রেন খাড়া আছে যে—সেই ফাঁকগুলো দিয়ে আমার শস্তা গাড়িকে উড়িয়ে ফেলে দিতে পরে।

একটু বেশি রাতে উদ্যোক্তারা জানালেন—অনুষ্ঠান স্থগিত রাখা হয়েছে। ভালই করেছেন। বাচ্চাদের নিয়ে অনুষ্ঠান—কোত্থেকে কী ঘটত।

কিন্তু সারা রাত ঘুমুতে পারলাম না। বাড়ির ভিতরে সম্পূর্ণ আত্মরক্ষার মধ্যে নিরাপত্তায় ‘ফণী’র আগমন দেখব না? মাঝে-মাঝেই দরজা খুলে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াচ্ছিলাম। শুক্লপক্ষ ছিল। রবীন্দ্রনাথের গান প্রায় সত্য হয়ে উঠছিল—‘সকাল বেলা চেয়ে দেখি, দাঁড়িয়ে আছ তুমি এ কি, ঘর-ভরা মোর শূন্যতারই বুকের পরে....’।

শরতের সকালের মত সকালে ঘুম ভাঙল।

লেখাটি যে-কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম সেই কথাতে ফিরে আসি।

‘ফণী’র পথ তো ম্যাপে আঁকা হয়ে গিয়েছিল। পুরী থেকে বালাসোর-এর বাঁ দিক দিয়ে খড়গপুর-আরামবাগ হয়ে বর্ধমান-নদীয়ার মাঝপথ দিয়ে, মুর্শিদাবাদকে বাঁয়ে রেখে পদ্মা পেরবে ও বাংলাদেশে ঢুকবে।

এই পথে ফণীর মুখে পড়বে—দুই মেদিনীপুর, ঝড়গ্রাম, পুরুলিয়া, বীরভূম, বাঁকুড়া ও দুই চব্বিশ পরগনা।

ফণী ও-পথই মাড়ায় নি।

কোথাও যেন হঠাৎ ডাইনে বেঁকে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবাংলাটার সীমান্ত মুছে দিয়ে দুই দেশকে এক করে দিয়ে জানিয়ে গেল: সীমান্তটা তো একটা ক-বছরের ইতিহাস মাত্র, ভূগোলটা কয়েক হাজার বছরের পুরনো। ফণী যেন গান গেয়ে গেল—‘বাদল বাউল বাজায় বাজায় রে একতারা’।

ইতিহাস তো অ্যাড-এজেন্সির শ্লোগান।

মাঝে-মাঝেই ভূগোল যদি ইতিহাসকে ফণীর মত ভুলিয়ে দিত!

Debes Ray Mone Pore ki Pore Na
Advertisment