Advertisment

দেবেশ রায়, আনিসুজ্জামান... একে একে নিভিছে দেউটি

মর্মান্তিক সমাপতন। একই দিনে প্রয়াত দুই বাংলার দুই কিংবদন্তী, দেবেশ রায় এবং আনিসুজ্জামান। তবে দুই বাংলা বলা যায় কি? বার্লিন থেকে লিখলেন নির্বাসিত কবি দাউদ হায়দার

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
bengali writer debesh roy

একই দিনে বঙ্গ সংস্কৃতির দুই মহীরুহের পতন। দেবেশ, রায়, আনিসুজ্জামান

অভাবনীয়। মেধা ও বোধের জগত শূন্য হচ্ছে, দুই বাংলায়। প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ক্রমশ বিলীন। আগামী প্রজন্ম খুঁটি হিসেবে ধরতে চান যাঁদের, আশ্রয় পেতে চান যাঁদের কাছে - পথের শেষ কোথায় জেনেও পথহীনতায় দিশেহারা হবেন, সন্দেহ নেই। কেউ যখন আস্থা হারায়, একাকীত্বের নির্মম প্রহারে নিজস্বতায় চিড় ধরে। বুদ্ধিজীবীহীন দেশ গভীর ক্ষতে এতিম। সুস্থ সংস্কৃতি, মুক্ত চিন্তা, মানবিকতা, বাকস্বাধীনতা, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, যখন উধাও হয়ে যায়, দেশও নড়বড়ে, ভিত্তির শিকড়ও ঘুনধরা।

Advertisment

রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ যে রেনেসাঁর বীজ বুনেছিলেন, বাংলার সমাজ, রাষ্ট্র, শিল্পসাহিত্য, সংস্কৃতি, এমনকী আন্দোলন, প্রতিবাদ, আমাদের মনমানসে নানাভাবে সঞ্চারিত। এই সঞ্চার আনিসুজ্জামান, দেবেশ রায়ের রক্তমজ্জায় ছিল সচল। দুজনেই অধ্যাপক, দুজনেই লেখক, দুজনেই বুদ্ধিজীবী, দুজনেই প্রতিবাদী। দুজনেই সমাজবাদ তথা সাম্যবাদে উদ্দীপ্ত। সোচ্চার ছিলেন ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে। দুজনেই সংগ্রামী, দুজনেই উন্নতশির। দুজনেই মানুষের সহমর্মী, মানুষের সহকর্মী, সুখদুঃখে সঙ্গী। দুজনেই ভয়ডরহীন। এবং দুজনেই গদ্য লেখক।

আনিসুজ্জামান কবিতা লিখেছেন যৌবনের শুরুতে, যেমন স্কুল-কলেজের বয়সে লেখেন অধিকাংশ বাঙালি। কবিতা ছেড়ে পরে গল্প। খুব বেশি নয়, দুই-তিনটি। গল্প লেখা থেকেই গদ্যের হাত তৈরি। ধারণা করি, তাঁর সমসাময়িক গল্পকারদের গল্পের চেয়ে জোরালো নয়, জনপ্রিয় নয়, অনেকটাই দুর্বল, বেছে নেন গবেষণা, যা বাংলার সম্পদ। গবেষণাই ছিল তাঁর মূল পাণ্ডিত্য। বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি ধনী।

আরও পড়ুন: দেবেশ রায়কে ধরা যায় না

দেবেশ রায়ও গবেষক। তাঁর গবেষণায় মার্কসীয় ধ্যানধারণা। মার্কসীয় চিন্তাচেতনা বোধে উদ্দীপ্ত, ছিলেন একদা কৃষক-শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত।

আনিসুজ্জামান চিন্তক, সমাজকর্মী, বুদ্ধিজীবী, গবেষক হিসেবেই বহুখ্যাত, উপন্যাস লেখেন নি। লিখেছেন আত্মজীবনীও। তাঁর 'বিপুলা পৃথিবী' আত্মজীবনী, পরে আরও বিস্তারিত, বড় আকারে গ্রন্থ, নামকরণ 'কাল নিরবধি'।

দেবেশ রায় গবেষক হিসেবে সাধারণ পাঠককুলে অপরিচিত, গাল্পিক-ঔপন্যাসিক এবং রাজনৈতিক প্রবন্ধের জন্য বহুমান্য। আমজনতার লেখক নন, জনপ্রিয়ও নন বাজারি লেখকদের মধ্যে। দেবেশের লেখা পড়তে হয় বোধবুদ্ধি-মাথা সজাগ রেখে। চটজলদি পাঠ্য নয় বলে বুদ্ধিজীবীর কদরে শ্রদ্ধেয়। বহুমানিত।

দেবেশের মতো আনিসুজ্জামান প্রত্যক্ষ রাজনীতিক নন, কোনও রাজনৈতিক সংগঠন, দলে একীভূত হন নি। কিন্তু সব প্রগতিশীল আন্দোলনে, সব অসামাজিকতার বিরুদ্ধে কঠোর, অগ্রগণ্য, সংগ্রামী, সোচ্চার। বিপদ জেনেও উচ্চকণ্ঠী। মিছিলে পয়লা, পদাতিক। দেবেশও। দুজনেই সমাজ-রাষ্ট্র-মানুষের কল্যাণে অগ্রপথিক।

দেবেশের উপন্যাস, তাও আবার উত্তরবঙ্গের পটভূমি, মানুষ সমাজের প্রাধান্য সেখানে। উদ্বাস্তু মানবতার দলিল। লিখেছেন বরিশালের যোগেন মণ্ডলকে নিয়ে রাজনৈতিক উপন্যাস। তিস্তাপারের বৃত্তান্ত নিয়ে দুইবার, উপন্যাস। দেশভাগের রাজনীতি, স্মৃতি নিয়ে আনিসুজ্জামান, দেবেশ রায়ের লেখায় যে ছবি, যাতনা, বঙ্গীয় সমাজের ইতিবৃত্ত, হালের লেখকের লেখায় পাওয়া যাবে না।

দুজনের আরও মিল। আনিসুজ্জামানের জন্ম তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার বসিরহাটে (বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগণায়)। দেবেশ রায়ের জন্ম বাংলাদেশের পাবনায়। দেশভাগে দুজনেই দুই দেশে, উদ্বাস্তু, মাতৃভূমিহীন, মূল শিকড়, ভিটেমাটি-ছাড়া। দুজনেই আঁকড়ে ধরেছিলেন বাংলার সমাজ, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি। দূরে যান নি। দুজনেরই একাত্মতা বাংলাদেশ। দুজনেরই মাটিমানুষ বাংলার। দুজনেরই একই দিনে, ঘণ্টা কয়েকের ব্যবধানে প্রস্থান। এই প্রস্থানে, সর্বার্থেই, একে একে নিভিছে দেউটি, দীপ জ্বালানোর থাকছেন না কেউ।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Advertisment