শারদীয়া উপলক্ষ্যে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায় শুরু হয়েছে পুজোর বিশেষ গল্প। আজকের গল্প ‘সেক্টর ফাইভ’ (দ্বিতীয় পর্ব)। লিখেছেন তপশ্রী পাল
এইচ আর ডেস্কের কাছে একবগগা ষাঁড়ের মত দাঁড়িয়ে আছে সাধন হাঁসদা। ও বিদেশ যাবেই বায়না ধরেছে! জাভার একটা প্রোজেক্টে কাজ করে। কাজের দিকে ব্রিলিয়ান্ট! ওকে ছাড়া গ্রুপ ম্যানেজার ভবতোষ বাগচী চোখে অন্ধকার দেখেন! ছেলেটা জয়েন করেছে বছর দেড়েক হয়েছে। প্রোজেক্টের খুব খারাপ অবস্থা তখন। ক্লায়েন্টের রিকোয়ারমেন্ট বদলে গেছে। অথচ ফিক্সড বিড প্রোজেক্টে আর বাজেট নেই। সেই সময় সস্তার ফ্রেশার রিসোর্স হিসাবে জয়েন করে সাধন। এই দেড় বছরে ও প্রায় একার চেষ্টায় কোড চেঞ্জ করে, টেস্টিং করে, ঠান্ডা মাথায় ক্লায়েন্টের সঙ্গে কথা বলে প্রোজেক্টকে দাঁড় করিয়েছে! ক্লায়েন্ট এখন ওকে কোনভাবেই ছাড়তে চায় না, ভবতোষ বাগচীও নয়। এই মূহূর্তে এই প্রোজেক্টের ডেভেলপমেন্ট শেষ। বিদেশ যাওয়ার স্কোপ নেই। ভবতোষ বাগচী জানেন ছেলেটা এক্সেপশনাল! ওকে ধরে রাখতে না পারলে ক্লায়েন্টকেও রাখা মুশকিল। প্রজেক্টের মেনটেন্যান্স বিড করেছে কোম্পানী। অন্তত দশটা ছেলের দু বছরের কাজ! সবই নির্ভর করছে সাধনের ওপরে। ভবতোষ মাত্র দেড় বছর এক্সপেরিয়েন্সের ছেলেকে প্রজেক্ট লিড করে দেবেন, প্রচুর হাইক দেবেন সব কবুল করে রেখেছেন। কিন্তু সাধন ভোলার নয়।
ম্যানেজার এইচ-আর, রমেশ সিনহা জানেন এই মূহূর্তে বিদেশ না পাঠালে ও ছেড়ে দেবে। হাইয়েস্ট রেটিং পাওয়া একটা রিসোর্স ছেড়ে দিলে দায় এইচ আরের ওপরে আসবে। ছেলেটা বড্ড চুপচাপ। ইংরাজীটা দুর্বল। কথা বলতে পারে, তবে পালিশটা নেই। এটাই ওর বিরুদ্ধে একমাত্র পয়েন্ট! ছেলেটার ব্যাকগ্রাউন্ড ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়! দেড় বছরে কোথা থেকে কোথায় পৌঁছেছে ও! মনে পড়ে যায় ওর ইন্টারভিউয়ের কথা। বিভিন্ন কলেজ থেকে ফ্রেশাররা ভীড় করেছিল। কোম্পানী একসঙ্গে প্রায় একশো রিসোর্স নিয়েছিল। রিটন টেস্টে শর্টলিস্ট হয়ে ফাইনাল ইন্টারভিউর জন্য প্রথম যখন সাধন এসে দাড়িয়েছিল সামনে, ওর পরণে একটা প্রায় পিঁজে যাওয়া শার্ট, আর ঢোলা প্যান্ট। আসানসোল ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ থেকে পাশ করা। ওকে নাম জিজ্ঞাসা করেছিলেন রমেশ। উত্তর এসেছিল “সাধন হাঁসদা আজ্ঞা।“ অদ্ভুত বাংলা টান শুনে রমেশ জিজ্ঞাসা করেছিলেন “হোয়ার ইস ইয়োর নেটিভ প্লেস?” “মুর্গাসোল বটেক!” বলেছিল সাধন। দেখে মনে হয়েছিল গ্রাম্য, কিন্তু ওর ব্যাকগ্রাউন্ড শুনে চমকে গেছিলেন রমেশ! জিজ্ঞাসা করেছিলেন “তোমার বাবা মা কী করেন?” “বাপটো লাই। মা মুড়ি ব্যাচে, কেনে!” ওর মা অমানুষিক কষ্ট করে ওর পড়ার খরচ জুগিয়েছিলেন মাধ্যমিক পর্যন্ত! ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ার খরচ দেয় একটি এন-জি-ও। রিসোর্স চেনার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে রমেশের! কেন যেন মনে হয়েছিল সাধনের মধ্যে আগুন আছে! কাজ চালানোর মত ইংরাজী শিখে নিতে হবে এই শর্তে নিয়েছিলেন ওকে।
সেই ছেলে কত পালটে গেছে! আজ তারই সামনে দাঁড়িয়ে আছে ঘাড় শক্ত করে। রমেশ বললেন “সাধন, ইউ ওয়ান্ট টু গো অ্যাব্রড, বাট অ্যাট দিস মোমেন্ট দেয়ার ইস নো অপরচুনিটি। প্রোজেক্টে কাজ করো। আশা করছি মাস ছয়েকের মধ্যে কিছু হয়ে যাবে। এ বছরের এইচ ওয়ান ভিসার কোটাও প্রায় ভরে গেছে।“
“আমার মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়েছে বটে! নিড লট মানি! পঠায়ে দ্যান”
এতক্ষণে ওর এত জেদের কারণ বোঝেন রমেশ! এ ছেলেকে আটকানোর সাধ্য তার নেই। একটা এইচ ওয়ান ভিসার ফর্ম ওর হাতে ধরিয়ে দেন। বলেন “এটা ভরো তারপর দেখছি!” রমেশ জানেন আর দু বছর পরে ও আরো অনেক বদলে যাবে। হারিয়ে যাবে মুড়িওয়ালীর ছেলে সাধন। কিছুতেই আর দেশে ফিরিয়ে আনা যাবে না ওকে। এমন অনেক বদল রোজ দেখছেন রমেশ এইচ-আরের চেয়ারে বসে।
সেক্রেটারী রাকেশকে কনফারেন্স রুম রেডি করতে বললেন মিস্টার দুরাইস্বামী, ডি-এম-এসের সিইও।
ঘড়িতে সকাল এগারোটা। হন্তদন্ত হয়ে ল্যাপটপ নিয়ে কনফারেন্স রুমের দিকে ছুটছে রাকেশ।
প্রোজেক্টর সেটআপ করে পনেরো মিনিটে প্রেসেন্টেশন দেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে! ওনার পনেরো মিনিট মানে
পনেরো মিনিট।
সাপোর্ট ডিপার্টমেন্টের হেড, হরিৎ ছুটে এসেছে। শেষ সময় কিছু না কিছু প্রবলেম হয় এই সব বড় মিটিং এর আগে, জানে হরিৎ। তখন সব গালাগালি এসে পড়ে সাপোর্ট ডিপার্টমেন্টের ঘাড়ে! রাকেশ এক কোণে হোয়াইটবোর্ড, মার্কার সব রেডি আছে কিনা দ্রুত চেক করছে! সাপোর্ট স্টাফেরা ল্যাপটপ প্রোজেকটরে কানেক্ট করে দেখে ফোকাস ঠিক হচ্ছে না কিছুতেই! প্রোজেকটর উঁচু করতে হবে! হাতে আর মাত্র তিন মিনিট! রাকেশ হরিৎকে বলে “তাড়াতাড়ি কিছু একটা ভাবো! আমি ততক্ষণ দেখি আবার গুগল মিটিংটাতে সবাইকে ইনক্লুড করা হয়েছে কি না!”
হরিৎ একজনকে লাইব্রেরীতে কটা মোটা জার্নাল আনার জন্য পাঠিয়ে বলল “আজ কিসের মিটিং?” “খুব হাই প্রোফাইল মিটিং! আমার কিছু বলা বারণ!” “তুমি না বললেও বাইরে জোর খবর আছে!” “কী খবর পেলে? এ সব টপ ম্যানেজমেন্ট ছাড়া কেউ জানে না!” “আমাদের কাছে সব খবর এসে যায়! বুড়ো কোম্পানী কিনছে!” চমকে ওঠে রাকেশ। হরিৎ জানে মানে গোটা ব্রাঞ্চেই রাষ্ট্র হয়েছে! ওরা যা সিক্রেট রাখতে চায় সেটাই কী করে সবার আগে বেরিয়ে যায়? দুরাইস্বামী জানলে রাকেশের চাকরী যাবে!
মোটা বইয়ের ওপর রেখে প্রোজেকটরের ফোকাস ঠিক হতে না হতে মিস্টার দুরাইস্বামী ঢুকলেন। হরিৎ এবং তার টিম বিদায় নিয়েছে। মিস্টার দুরাইস্বামী বেশি লোক পছন্দ করেন না। তাঁর সঙ্গে ভিপি-ডেলিভারী, ভিপি-ফিন্যান্স, আরো দুজন গ্রুপ ম্যানেজার আর এক ভদ্রলোককে রাকেশ চিনতে পারল না। মনে হয় বাইরের কেউ! রিসেপশনে অপেক্ষা করছিল, মিস্টার দুরাইস্বামী ডেকে নিয়েছেন! সবাই বসে যাওয়ার পর দুরাইস্বামী বললেন “ইউ নিড নট বি দেয়ার রাকেশ। উই উইল ম্যানেজ। মিস্টার মুখার্জী উইল প্রেসেন্ট। হি হ্যাস অল নেসেসারি প্রেসেন্টেশন্স।” ঐ অচেনা লোকটি মিস্টার মুখার্জী। ফর্সা শার্প চেহারা। বয়স খুব বেশি হলে পঁয়ত্রিশের বেশি হবে না। ব্লু ব্লেজার আর লাইট ক্রিম ট্রাউসার পরণে। মনে হয় “ডাটা ডোমেনের” কোন বিগ শট হবেন। এই কোম্পানীটাই কেনার প্ল্যান চলছে। কাগজপত্র সব তো রাকেশের হাত দিয়েই আসে যায়। দুরাইস্বামীর চিঠিপত্রও রাকেশই সব রেডি করে। তার জানা আছে গত তিন চার মাস ধরে এই প্রোসেস চলেছে। আজকেই হয়ত একটা ফাইনাল ডিসিশন হবে! মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন আর কৌতুহল চেপে হল থেকে বেরিয়ে এল রাকেশ।
প্রেসেন্টেশন শুরু করলেন মিস্টার মুখার্জী। বিদেশ থেকে ফিরে স্টার্ট-আপ হিসাবে তিলতিল করে “ডাটা ডোমেন” গড়ে তুলেছেন। কোম্পানীর একটি নিজস্ব ডাটা অ্যানালিসিস প্রোডাক্ট আছে “নিশডাটা” বলে। এটি নির্ভুল ভাবে নানা প্রেডিকশন দেয়। নিশডাটার কল্যাণেই মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে ডাটা ডোমেন আজ একশো কোটি টাকার কোম্পানী! রাইভ্যাল কোন প্রোডাক্টই নিশডাটাকে টক্কর দিতে পারেনি। সেই লোভেই মিস্টার দুরাইস্বামীর নজর পড়েছে ডাটা ডোমেনের দিকে। ইন ফ্যাক্ট আরো কটি বড় কোম্পানীর নজর আছে। তারা কেউ এগোবে না এই মূহূর্তে, যতক্ষণ না মিস্টার দুরাইস্বামী এই ডিল ছেড়ে দেন। ঘরে যারা রয়েছেন, তাঁরা ছাড়াও অন কল আছেন আমেরিকা থেকে হেড অফ বিসনেস রুডি এবং ক্লায়েন্ট এনগেজমেন্ট ম্যানেজার পুনীত। ডাটা ডোমেনের প্রধাণ ক্লায়েন্টের লিস্ট, গত তিন বছরের ফাইন্যানশিয়াল ডাটা, ভবিষ্যত প্ল্যান, নতুন প্রোডাক্ট, ম্যানপাওয়ার ও স্কিল ডিটেল, নিশডাটার আরকিটেকচার, হার্ডওয়ার এবং সার্ভার কেমন দরকার, সব কিছু প্রেসেন্ট করার পর মিস্টার দুরাইস্বামীর মুখে হাসি ফুটল। ভিপি-ফিন্যান্সের কপালে তখনও ভাঁজ! তিনি হঠাত বলে উঠলেন “কিন্তু গত ছ মাসে সেল তো প্রায় স্ট্যাগন্যান্ট!” একটু অস্বস্তির সঙ্গে মিস্টার মুখার্জী বললেন “হ্যাঁ, একটা ক্রিটিক্যাল বাগ ধরা পড়েছিল প্রোডাক্টে, ডাটা সিকিউরিটি ব্রিচ করে দেখিয়েছে এক এথিক্যাল হ্যাকার! সবচেয়ে মুশকিল, মিডিয়ায় সামহাউ খবরটা চলে গেছিল। আমরা ইমারজেন্সি বেসিসে কাজ করেছি! তবে এটা ধরা পড়াতে প্রোডাক্টটা আরো ভাল হবে। এই মাসেই নতুন ভারশন রিলিজ হচ্ছে।“
মিস্টার দুরাইস্বামী ভিপি ফিন্যান্সের দিকে চোখাচোখি করে বললেন “কিন্তু তাহলে তো আমরা অত হাই বাইং প্রাইস দিতে পারছি না। উইথ এ বাগি প্রোডাক্ট – “ ক্ষণেক চুপ করে থেকে মিস্টার মুখার্জী বললেন “আই হ্যাভ অলরেডি টোল্ড দ্যাট দ্য নিউ ভার্শন উইল রিলিজ দিস মান্থ! ইফ ইউ ডু নট এগ্রি আই হ্যাভ আদার পার্টিস ওয়েটিং!” বলে সব গুছিয়ে ওঠার উদ্যোগ করলেন। ভিপি-ফিন্যান্স জানেন ডাটা ডোমেনকে ছাড়ার প্রশ্ন নেই। অতএব আরো পনেরো মিনিটে ডিল ফাইন্যাল করে রুম ছাড়লেন মিস্টার মুখার্জী।
এবার ডি-এম-এসের নিজের প্রেসেন্টেশন। আফটার মার্জার, কোম্পানীর ওপর কী ইম্প্যাক্ট পড়বে, টাকার সোর্স, কস্ট কমানো, হ্যান্ডওভার টেকওভার টিম এবং প্রোসেস, অডিট এই সব নানা প্রেসেন্টেশনের পর এইচ-আর হেডের ডাক পড়ল। মিস্টার দুরাইস্বামী রমেশকে বললেন “উই হ্যাভ ফাইনালাইজড এ ডিল উইথ ডাটা ডোমেন টুডে! দিস ইস ভেরি কনফিডেনশিয়াল! শুড নট বি আউট টু এনিওয়ান! ডাটা ডোমেন থেকে টেকনিক্যাল ম্যানপাওয়ার সবাইকে নিয়ে নেওয়া হবে, শুধু ওদের সিনিয়ার ম্যানেজমেন্ট আর ম্যানেজিং ডিরেকটর মিস্টার মুখার্জী ছাড়া!” দুরাইস্বামীর কথা শুনে চমকে গেল রমেশ, শুধু বলতে পারল “ও আচ্ছা!” ভাবল কী নিষ্ঠুর ওপরতলার মানুষগুলো! একটা কোম্পানীকে যারা দাঁড় করালো, তাদেরই দরকার ফুরোল! নীরবে বেরিয়ে গেল রমেশ।
মিটিং শেষ হতে যাবে, তখনই এক নতুন চমক অপেক্ষা করছিল! রুডি কলে বলে উঠলেন “আই থিঙ্ক পুনীত হ্যাস সামথিং ফর ইউ অল! পুনীত বলল “প্রদ্যুম্ন অ্যান্ড টিম হ্যাভ অলমোস্ট ব্যাগড এ বিগ প্রোজেক্ট! হি উড ব্রিফ ইউ অল!” মিস্টার দুরাইস্বামী লাফিয়ে উঠলেন “ওহ! আই নিউ! প্রদ্যুম্ন ইস ব্রিলিয়ান্ট! দিস উইল বি আওয়ার ফোরে ইন্টু এ নিউ ডোমেন! আই অ্যাম ভেরি মাচ এক্সাইটেড! প্লিস কল প্রদ্যুম্ন!”
প্রদ্যুম্ন ঘরে ঢুকে দ্রুত বুঝে নিতে চাইল পরিস্থিতি। কেন ডাকা হয়েছে সে জানে না। হঠাত ভিডিও কলে রুডির গলা “হাই প্রদ্যুম্ন! ইউ হ্যাভ ডান ওয়ান্ডার, ম্যান!” যাক, তাহলে ভাল খবরই হবে! রুডি বলল “ক্লায়েন্ট হ্যাস কমিউনিকেটেড টু পুনীত দ্যাট দে হ্যাভ শর্টলিস্টেড টু কোম্পানীস ফর দেয়ার প্রোজেক্ট অ্যান্ড ইন অল প্রোবাবিলিটি উই আর গোইং টু গেট ইট, অ্যাজ আওয়ার কস্ট ইস লোয়ার!” জানা গেল ক্লায়েন্ট চায় অনসাইটে একজন ভাল টেকনিকাল রিসোর্স যে তাদের কনফিডেন্স দেবে যে রিকোয়ারমেন্ট পরিষ্কার বোঝা গেছে। এই রিসোর্স প্রজেক্টের পুরো সময় অনসাইটে থেকে অফশোরের সঙ্গে যাবতীয় কোঅরডিনেশন করবে যাতে ক্লায়েন্টকে কষ্ট করে সে সব করতে না হয়!
ভিপি-ডেলিভারি প্রণব রয় বললেন “আমরা আমাদের বেস্ট রিসোর্স দেব। প্লিস লিভ ইট টু মি!” তিনি প্রায় গোটা মিটিং ঝিমিয়েছেন। চাকরীর আর বছর তিনেক বাকী! বসে বসে মোটা মাইনে পাচ্ছেন, কিন্তু কোন আউটপুট নেই, তাঁর সম্বন্ধে এমনই ধারণা দুরাইস্বামীর। অথচ গ্রুপ ম্যানেজাররা সবাই এই মানুষটিকে নিয়ে খুশি! তাঁর টেকনিক্যাল নলেজ, স্থির বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা, ঠান্ডা মেজাজ ও ভাল ব্যবহার ডেলিভারি টিমকে অনেক পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে সাহায্য করে। তাই মিস্টার দুরাইস্বামী তাকে ঘাঁটান না। এক কোণে ফেলে রেখেছেন। গত দু বছরে তাঁর কোন স্যালারি বৃদ্ধি হয়নি। তাকে সম্পূর্ণ ইগনোর করে বলে উঠলেন “প্রদ্যুম্ন! আই লিভ ইট কমপ্লিটলি অন ইউ টু সিলেক্ট দ্য কী-রিসোর্স!” প্রদ্যুম্ন স্মার্ট হেসে বলল “সিয়োর!”
ভিপি-ডেলিভারীর মুখ শুকিয়ে গেছে। এই কোম্পানীতে তাঁর বছর বারো হয়ে গেল! রোজই ভাবেন ছেড়ে দেবেন, কিন্তু ছেলের আই-আই-এমের খরচ, মেয়ের বিয়ে, বাড়ির ই-এম-আই ভেবে আর এগোতে পারেন না। আজ আবার মনে হল এ মাসটাই শেষ! তিনি রিজাইন করবেনই! এ অপমান সহ্য হয় না!
সবাই ধীরে ধীরে কনফারেন্স রুম থেকে বেরিয়ে এল। সবার পিছনে ভিপি-ডেলিভারি প্রণব রয়ের লম্বা ছায়া পড়েছে! এক কাপ চায়ে গলা ভেজাতে ক্যান্টিনের দিকে চলেছেন এক সময়ের আই-আই-টিয়ান প্রণব! বিদেশের বড় চাকরী ছেড়ে দেশে ফিরবেন বলে এই কোম্পানীতে জয়েন করেছিলেন।
প্রদ্যুম্ন বেশ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ঠিকমত রিসোর্স বাছতে না পারলে প্রোজেক্ট তো হাতছাড়া হবেই, দুরাইস্বামীর বিষনজরে পড়তে হবে! ডেলিভারীর প্রণব রয় কোন সাহায্যই করবেন না এটা সে বেশ ভালই বুঝেছে।
সেদিন লাঞ্চ টাইমে প্রদ্যুম্ন রাগিনীকে বলল “রাগিনী তুমি তো অডিট গ্রুপের হয়ে সব প্রোজেক্টেই ঘুরতে। আমরা যে প্রোজেক্টটা বিড করেছিলাম, সেটা হাতে এসে যাবে যদি অনসাইটে আমরা একজন ভাল টেকনিকাল রিসোর্স দিতে পারি যার কমিউনিকেশন ডোমেনে ভাল ফান্ডা আছে।“
রাগিনী মুচকি হেসে বলল “আমরা তো ফ্রড করে প্রোজেক্টটা বিড করেছি প্রদ্যুম্ন! বললাম আমাদের ভাল কমিউনিকেশন প্রোডাক্ট আছে, ডোমেন নলেজ আছে! এদিকে টেকনিক্যাল টিম অন্য কোম্পানী থেকে ঝাড়া একটা প্রডাক্ট খাড়া করে প্রেসেন্ট করল! আসলে, আমাদের কোম্পানী ওয়ান অফ দ্য বিগেস্ট হলেও, এই ফিল্ডে আগে কাজ করেনি। অনেক স্পেশ্যালাইজড কোম্পানী আছে যারা কমিউনিকেশনেই কাজ করে। প্রোডাক্ট, স্কিল, ডোমেন নলেজ কিছুই নেই তাও আমাদের প্রেসেন্টেশনে ভুলে ক্লায়েন্ট টোপ গিলেছে। এবার টেকনিকাল টিমকেই জিজ্ঞাসা কর তারা কাকে দিতে পারে!“
প্রদ্যুম্ন ভাবতে পারেনি রাগিনী এক কথায় তাকে নাকচ করে দেবে! আপাতত টেকনিকাল টিমের সঙ্গেই কথা বলতে হবে। এই প্রোজেক্টের জন্য টেকনিকাল প্রোপোসাল বানিয়ে দিয়েছে একটা জাভা প্রোজেক্ট টিম! সেই প্রজেক্টের ম্যানেজার বিশাল বাত্রা পাঞ্জাবে একটি মোবাইল সার্ভিস সফটওয়ার কোম্পানীতে কাজ করত। ও ঐ প্রোডাক্ট প্রেসেন্টেশনটা আগের কোম্পানী থেকে ঝেড়ে এনেছিল! প্রদ্যুম্ন সেদিন বিশালের সঙ্গে কফি খেতে গেল। এখন বেশী পাঁচ কান করা যাবে না প্রোজেক্ট আসার কথাটা। না আঁচালে বিশ্বাস নেই! প্রদ্যুম্ন বলল “বিশাল তোমার টোটাল এক্সপেরিয়েন্স কতদিন হল?” “তা বছর সাতেক তো হল!” “বাইরে গেছ কখনো?” “নাঃ, দিল্লীতে থাকতে পাপার ডেথ হয়ে গেল। মা কে একা রেখে যেতে পারিনি। যেতে তো খুব চাই!“ বিষণ্ণ মুখে বলল বিশাল। তার মানে বিশালের বাইরে যাওয়ার ইচ্ছে আছে! ওকেই সাজেস্ট করে দিতে হবে। খুশী হয়ে প্রদ্যুম্ন বলল “একটা ভাল অপরচুনিটি আছে। এইচ-আর বলছিল একটা নতুন প্রোজেক্টে লোক চাইছে আটলান্টায়! তোমার নাম বলে দিই?” বিশাল জিজ্ঞাসা করে “শর্ট টার্ম ইয়া লং?” “লং
ইয়ার – যিতনা দের চাহে রহো উধার!” বলে প্রদ্যুম্ন। প্রায় লাফিয়ে উঠল বিশাল “নহি ইয়ার! আভি মত বোল! ম্যায় যা নহি পাউঙ্গা!” “কিঁউ?“ “ওয়াইফ আভি এক্সপেক্টিং হ্যায়! তিন মাহিনা! ইসকে পহলে দো মিসক্যারেজ হো চুকা হ্যায়! ইস বার মুঝে উসকে পাস রহনা হ্যায়!” সিরিয়াস মুখ করে বলে বিশাল। প্রদ্যুম্নর ভুরু কুঁচকে যায় বিরক্তিতে! একমাত্র আই-টিতেই রিসোর্সদের এত বায়নাক্কা শোনা হয়! “ওকে ইয়ার, দেখতা হুঁ” বলে তেতো মুখে উঠে যায় প্রদ্যুম্ন।
সন্ধে সাতটা। ব্যাগ গুছিয়ে তাড়াহুড়ো করে বেরোতে যাচ্ছিল রাগিনী। অফিস বাসটা বেরিয়ে গেছে। ট্যাক্সি পাওয়া মুশকিল! রাজীব ট্যুরে, আসতে পারবে না। প্রদ্যুম্ন এসে দাঁড়াল “এত তাড়া কিসের ডার্লিং? আমি তোমাকে ছেড়ে দিয়ে যাব!” “না, প্রদ্যুম্ন, বাচ্চাগুলো খুব মিস করে! রাজীবও কলকাতায় নেই।“
“অত সহজে বেরিয়ে ট্যাক্সি পাবে নাকি অফিস টাইমে? দাঁড়াও, আমি আধ ঘন্টার মধ্যেই বেরবো! লক্ষ্মী মেয়ের মত কিউবে গিয়ে বস!” অমোঘ আদেশের সুরে বলল প্রদ্যুম্ন! কেন যে ওর কথা শোনে, রাগিনী নিজেই বোঝে না। প্রমোশন আর হাইকের লোভে ওকে চটাতে সাহসও পায় না। প্রদ্যুম্নর মোবাইলটা বেজে ওঠে। পুনীত! “হ্যাভ ইউ সিলেক্টেড দ্য রিসোর্স ফর দ্যাট অনসাইট পোজিশন?” “আই অ্যাম অ্যাকটিভলি লুকিং। বিশাল কুড বি এ গুড চয়েস, বাট হিস ওয়াইফ ইস এক্সপেকটিং অ্যান্ড হি ডাসন্ট ওয়ান্ট টু গো!” “নো পয়েন্ট ইন সিলেক্টিং সামওয়ান উইথ এ বার্ডেন!” গম্ভীর স্বরে বলে পুণীত। “ডু ইউ হ্যাভ এনিওয়ান ইন মাইন্ড?” প্রদ্যুম্নর কথার উত্তরে হেসে ওঠে পুণীত! অবাক হয় প্রদ্যুম্ন! পুণীত বলে “শালা ক্লায়েন্ট কো ফেয়ার সেক্সকে উপর বহোত বায়াস হ্যায়! উসকে পাস এক অচ্ছি চিজ ভেজা যায়ে তো হামারা কাম আসান হো যায়েগা!” “ইস স্কিল কা কোঈ রিসোর্স হি নহী হ্যায় ইঁহা! তো ফেয়ার সেক্স! উয়ো ভি অনসাইট জানে লায়েক?” অবাক হয়ে বলে প্রদ্যুম্ন। “নাতাশা কো ভেজ দো!” গলা খাঁকড়িয়ে বলে পুণীত। “কৌন নাতাশা?” প্রদ্যুম্ন বুঝতে পারে না। “আরে, উয়ো বিশাল কে প্রোজেক্ট মে হি হ্যায়, জুনিয়ার রিসোর্স! বহোত অচ্ছি চিজ হ্যায়!” কেন পুণীত এনগেজমেন্ট ম্যানেজার হিসাবে এত প্রিয় দুরাইস্বামীর, বুঝতে পারে প্রদ্যুম্ন। প্রোজেক্ট আনার জন্য সব কিছু করতে পারে ও। “বাট উসকো ডোমেন, রিকোয়ারমেন্ট, টেকনিকাল কুছ পতা নেহি হোগা! অনসাইট জাকে পুরা প্রোজেক্ট ক্যায়সে কোঅরিডিনেট করেগী!” “কুছ নহী হোগা ইয়ার! ম্যায় সামহাল লুঙ্গা! তু ভেজ দে বস!” ফোন রেখে দেয় পুণীত! মনে মনে প্রদ্যুম্ন বলে “কুত্তা কাঁহিকা”
রাগিনী আজ একদম চুপচাপ। প্রদ্যুম্নদের কথোপকথন কিছু শুনেছে বোধহয়। মেয়েরা এ সব ব্যাপারে খুব সেনসিটিভ হয়। সেকটর ফাইভ থেকে বেরিয়ে বাইপাসে পড়তেই জোর বৃষ্টি এসে গেল। রাস্তার দুদিক ফাঁকা! তুমুল বৃষ্টিতে গাড়ির ওয়াইপার কাজ করছে না। সামনেটা ঝাপসা। এর মধ্যে গাড়ি চালানো খুব রিস্কি! অনেক গাড়িই রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে গেছে বৃষ্টি থামার অপেক্ষায়! গাড়িটা সাইডে পার্ক করে প্রদ্যুম্ন! রাস্তার আলো-আঁধারিতে রাগিনীর মুখের শুধু একটা দিক দেখা যাচ্ছে। কানে ঝোলা একটা পাথরের টাব পড়েছে রাগিনী। ওর পরণে নীল সিল্কের শাড়ি আর মেরুণ ব্লাউজ। হাতে একটা সুন্দর কঙ্গন! স্থান কাল ভুলে প্রদ্যুম্ন হঠাত ঝুঁকে পড়ে প্রবল ভাবে চুমু খেল রাগিনীকে! “হোয়াট আর ইউ ডুইং! শুড আই গেট ডাউন!” দু চোখে আগুন ঝরিয়ে বলল রাগিনী “তোমার বিরুদ্ধে এমপ্লয়ী হ্যারাসমেন্টের চার্জ আনলে কিন্তু তোমার চাকরীটা যাবে প্রদ্যুম্ন! ফ্লার্টিং এর একটা সীমা আছে! আই অ্যাম ম্যারেড অ্যান্ড মাদার অফ টু!” হা হা করে হেসে উঠল প্রদ্যুম্ন “ইউ আর মাই ডারলিং! ইউ য়োন্ট ডু দ্যাট আই নো!” বলে আবার চুমু খেল ওকে। রেগে গাড়ি থেকে নেমে যাবে ভেবেও কেমন যেন দুর্বল হয়ে পড়ল রাগিনী! কতদিন রাজীব এমন জোরালো চুমু খায়নি ওকে! ইন ফ্যাক্ট সেকেন্ড বেবি হওয়ার পর থেকে ওদের শারীরিক সম্পর্ক তলানিতে এসে ঠেকেছে! রাজীব কেন যেন ভীষণ স্টেল হয়ে গেছে ইদানিং! রাগিনী জানে এই চাকরীটা আর প্রমোশনটা এখন খুব দরকার ওদের দুই ছেলেমেয়েকে মানুষ করতে। চাকরী ছেড়ে দিলে কলকাতাতে বড় আর একটা কোম্পানীতে চাকরী পাওয়া সহজ হবে না। চুপ করে বসে একমনে ভেবে চলেছে রাগিনী। এমন সময় প্রদ্যুম্নর ফোনটা বেজে উঠল! উঁচু স্বরে ওদিক থেকে কোন মহিলা কথা বলছেন, বোধহয় প্রদ্যুম্নর ওয়াইফ! কথার তোড়ে একটাও উত্তর দিয়ে উঠতে পারছে না প্রদ্যুম্ন! এখনো কেন বাড়ি ফেরেনি সেই নিয়ে চার্জ করছেন! প্রায় মিনিট দশেক ঝড় বয়ে গেল যেন। ফোন রেখে দিয়ে প্রদ্যুম্ন শুধু বলল “হেল!! ইউ নো শি ইস মেন্টাল! শি হ্যাস ফিক্সড এ ডিটেকটিভ ফার্ম টু স্পাই অন মি! আই অ্যাম জাস্ট ডাইং রাগিণী!” বলে রাগিণীর কাঁধে মাথা রাখে প্রদ্যুম্ন। রাগিনীর ফোন বেজে ওঠে। রাজীব! “হোয়ার আর ইউ! মুন্নি কলড মি! ইউ আর স্টিল নট ব্যাক?” “আই অ্যাম স্টাক ইন রেইন!” “চিলড্রেন নিড ইউ রাগিনী!” বলে ফোনটা রেখে দেয় রাজীব। হঠাত বাচ্চাগুলোর জন্য মন কেমন করে ওঠে। বৃষ্টি থেমে গেছে। দ্রুত এগোয় প্রদ্যুম্নর গাড়ি। দুজনেই কেমন নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকে নিজের নিজের বৃত্তে।
(চলবে)