শারদীয়া উপলক্ষ্যে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায় শুরু হয়েছে পুজোর বিশেষ গল্প। আজকের গল্প ‘সেক্টর ফাইভ’ (শেষ পর্ব)। লিখেছেন তপশ্রী পাল
স্যাপ প্রোজেক্টে প্রায় বছর দেড়েক হয়ে গেল নিবেদিতার। যখন ওর অ্যাডভান্স স্টেজ, ও দুটো মডিউল লিড করছিল। ডাক্তারের অ্যাডভাইসে ছুটিতে চলে যেতে হয়। প্রায় মাস চারেক ছুটির পর জয়েন করেছে। রায়ানকে এখনো ব্রেস্ট ফিড করে নিবেদিতা। খুব কষ্ট হয় ওকে রেখে অফিসে আসতে। যদিও ওরা একটা ফ্ল্যাট বুক করেছে, কিন্তু রায়ান এসে যাওয়ায় শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে এখনো যাওয়া হয়নি।
শাশুড়ির ঘোর আপত্তি সত্তেও অফিস জয়েন করেছে নিবেদিতা, নইলে উইথআউট পে হয়ে যেত। কোনরকমে দিনটা পার করে সাড়ে ছটা বাজলেই দৌড়ে বাড়ি ফেরে। মন পড়ে থাকে কতক্ষণে রায়ানকে দেখবে। লাঞ্চ থেকে ফিরে সবে নিজের কিউবে বসেছিল, ইন্টারকমটা বেজে উঠল। এইচ-আর ডাকছে! বুকটা কেমন ধড়াস করে উঠল। এই মূহূর্তে পুরোনো প্রোজেক্ট চেঞ্জ করার কোন ইচ্ছে নেই। নতুন কাজ বোঝা বা বেশীক্ষণ অফিসে থাকার মত অবস্থায় নেই ও। ধীর পায়ে এইচ-আর রুমে গেল নিবেদিতা।
ওকে দেখেই এইচ-আর এর জুনিয়ার ছেলেটা মিষ্টি হেসে বলল “রমেশ স্যার এর ঘরে চলে যাও”। ভয়ে ভয়ে রমেশের কাঁচের ঘরে ঢোকে নিবেদিতা। ওকে দেখে রমেশ বলে “নিবেদিতা, অ্যাস আই সি, ইউ আর ইন দ্য স্যাপ প্রোজেক্ট ফর ওয়ান অ্যান্ড এ হাফ ইয়ারস নাউ! ইন বিটুইন ইউ ওয়ার ইন ম্যাটারনিটি লিভ অলসো, নাহ?” “ইয়েস স্যার” নিবেদিতা ধরতে পারে না কোনদিকে এগোচ্ছেন রমেশ। “অ্যাস পার দ্য প্রোজেক্ট ম্যানেজার, দিস প্রোজেক্ট হ্যাস স্টেবিলাইজড নাউ অ্যান্ড দে ডু নট নিড সো মেনি রিসোর্সেস। হি উড লাইক টু রিলিজ ইউ!” নিবেদিতা বুঝতে পারছিল গত কয়েকদিন ধরে। জয়েন করার পর তাকে আর নতুন কোন দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। তার মডিউলগুলোও অন্যদের দিয়ে দেওয়া হয়েছে। “স্যার, আই ডু নট ওয়ান্ট টু চেঞ্জ প্রোজেক্ট নাউ! আই নো দিস প্রোজেক্ট ওয়েল! আই ক্যান বি গিভেন এনি মডিউল!” কাতর ভাবে বলে নিবেদিতা। “বাট দে নিড টু রিডিউস কস্ট নাউ! একটা একেবারে নতুন প্রজেক্ট আছে ফ্লোরিডায়, যেখানে তোমার মত এক্সপেরিয়েন্সড রিসোর্স আরজেন্টলি দরকার! তোমাকে অন্তত এক বছরের জন্য যেতে হবে! ভিসার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তুমি এল-ওয়ানে যাবে।“
“কিন্তু স্যার, এখন ইম্পসিবল! আমার বেবির বয়স থ্রি মান্থস! কী করে ওকে ফেলে যাব?”
“দেন টেক হার উইথ ইউ!”
“নট পসিবল স্যার! আমি বেরিয়ে গেলে ওকে দেখবে কে!”
“সি, নিবেদিতা, ইউ ক্যানট ক্লেম স্পেশ্যাল স্ট্যাটাস অ্যাস এ ফিমেল! তুমি আর একটি ছেলে রিসোর্স একই মাইনে পাচ্ছ! তোমাকে প্রোজেক্ট ম্যানেজার র্যাঙ্কে পাঠানো হবে! অনসাইটে তোমার স্যালারি হবে এইট্টি থাউস্যান্ড ডলার পার ইয়ার! যদি না যাও, তোমাকে বেঞ্চে থাকতে হবে! ডিসাইড অ্যান্ড লেট মি নো বাই টুমরো! এটা খুব আরজেন্ট নিড!”
রমেশ যা বলছে তাতে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। শ্বশুরবাড়িতে এ কথা বললে যা রিঅ্যাকশন হবে ভাবা যায় না! ছোট্ট রায়ানের মুখটাও ভেসে ওঠে চোখের সামনে। কিন্তু নিবেদিতা একজন প্রোফেশনাল। যদি হাউসওয়াইফ হয়ে ছেলেই মানুষ করতে হয় তাহলে এতদিনের পড়াশুনা, কাজকর্ম তো বৃথা হয়ে যাবে! নিজের কিউবে ফিরে অনিমেষকে ফোন করে নিবেদিতা। সব শুনে খুব ঠান্ডা গলায় অনিমেষ বলে “ইট’স ইয়োর ডিসিশন নাউ! তোমার কাছে কোনটা প্রায়োরিটি? আশা করি অ্যাবসার্ড কোন ডিসিশন তুমি নেবে না!” “আচ্ছা, তুমি যদি চাকরী ছেড়ে আমার সঙ্গে যাও অনি?” প্রশ্নটা শুনে অনিমেষ সার্কাস্টিকালি বলল “আমি তো নন-আইটি পারসন! তুমি এই মূহূর্তে আমার থেকে অনেক বেশী স্যালারি ড্র করো, তাই তোমার চাকরীই প্রেফারেন্স পাবে! আমার ক্যারিয়ার তো ক্যারিয়ার নয়!” বলে ফোনটা কেটে দিল। রাতে আরো অনেক ঝড় বয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় স্তব্ধ হয়ে বসে রইল নিবেদিতা। ও জানে গেলে আপাতত একাই যেতে হবে। শ্বশুর শাশুড়ি যাই বলুন, একমাত্র নাতিকে অসম্ভব ভালবাসেন। তাই রায়ানকে ওরা প্রাণ দিয়ে দেখবেন। অনিমেষকে কোন জোর করবে না ঠিক করল নিবেদিতা।
পরদিন এইচ-আর কে বলে দেয় নিবেদিতা যে ও যেতে রাজী। সেদিন ক্যান্টিনে কাবেরীর সঙ্গে দেখা হতেই বলে উঠল “নিবেদিতা! দারুণ টাফ ডিসিশন! তিন মাসের বাচ্চা রেখে নাকি অনসাইট যাচ্ছ! তোমার কথা সবাই বলাবলি করছে!” অবাক হয়ে যায় নিবেদিতা! ওর কাছে কী অফার আছে সেটা তো এইচ-আর ছাড়া কারো জানার কথা নয়! তার মানে এইচ-আর এর কেউই এটা লিক করেছে!
শ্বশুর শাশুড়িকে অনিমেষই বুঝিয়েছে গতকাল, অনসাইটে গেলে ও কত পাবে! ওনাদের চোখ কপালে উঠে গেছে! তবু শাশুড়ি বলেছিলেন “বেশি লোভ ভাল নয় বাপু! নিজের ছেলে সবার আগে! অনি কি তোমাকে খাওয়াতো না?” অনিমেষ খালি বলেছিল “মা! তোমাদের যুগ আর নেই!” রায়ানকে বুকে জড়িয়ে নিতে নিতে নিবেদিতার সেদিন হঠাত মনে হয়েছিল শাশুড়ি বোধহয় ঠিক কথাই বলছেন! রায়ানের এই শিশুবেলা তো আর ফিরে আসবে না!
দিন দুয়েক পরে অনিমেষ ওকে জানিয়েছিল যে ও চাকরীতে রিজাইন করেছে। ও নিবেদিতার সঙ্গেই ডিপেন্ডেন্ট হিসাবে যাবে। ওখানে গিয়ে নিশ্চই কিছু জুটে যাবে। তখন আবার আলাদা ভিসা করে নিলেই হবে। এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে এক নতুন আশার আলোয় মনটা ভরে উঠল নিবেদিতার!
আটলান্টা পৌঁছে অথৈ সাগরে পড়েছিল নাতাশা! তখন ওর আই-টি তে মোটে দুবছর হয়েছে। ও সাধারণ বি-এসসি। পার্ক সার্কাসে বাবার মুদীর দোকান ছিল। ডি-এম-এস সফটওয়ারের মত বিশাল কোম্পানীতে কোনদিনই ঢুকতে পারত না যদি ইন্টারভিউ প্যানেলে পুণীতদা না থাকত। পুণীতদা তখন অফশোরে কী একটা প্রোজেক্ট ম্যানেজ করত। সেই প্রোজেক্টের জন্যই জাভা রিসোর্স খুঁজছিল ওরা। অন্তত শ’খানেক ছেলেমেয়ে এসেছিল পরীক্ষা দিতে। রিটেন টেস্ট খুব একটা ভাল হয়নি, তাই ইন্টারভিউতে ওর ডাক পড়ায় ও বেশ অবাক হয়েছিল। ইন্টারভিউ রুমেই প্রথম পুণীতদার সঙ্গে দেখা।
ওর টানটান লম্বা চেহারা, পুরু দুই ঠোঁটের মধ্যে মুক্তোর মত দাঁতের সারি, ঈষৎ খয়েরী টানা টানা দুটি চোখ, কাঁধ পর্যন্ত ছাঁটা ঘন সোজা সিল্কের মত চুল, সুগৌল বক্ষ, সরু কোমর, ঈষৎ ভারী নিতম্ব সব মিলিয়ে আয়নার সামনে নিজেকে দেখতে ওর ভালই লাগত। খুড়তুতো দিদি বলেছিল “তুই ভীষণ সেক্সি!”
পুণীতদার চোখে সেদিন এক অদ্ভুত মুগ্ধতা দেখেছিল নাতাশা! চাকরীটা হয়ে গিয়েছিল। এর কিছুদিনের মধ্যেই নাতাশার বাবা মারা যান! মুদী দোকানটা চালাবার কেউ ছিল না। মাকে নিয়ে নাতাশা যখন হাবুডুবু খাচ্ছে, এক দুপুরে ওদের বাড়িতে দেখা করতে এসেছিল পুণীতদা। বলেছিল “জয়েন করো তাড়াতাড়ি। আমি দেখব যাতে আমার প্রোজেক্টে তোমার অ্যালোকেশন হয়। এর পরেই ঐ প্রোজেক্টে কাজ শুরু করে নাতাশা। এর মাস ছয়েক পর, পুণীতদা লং টার্মে বিদেশ চলে গেল। টেকনিকালি খুব ভাল না হয়েও প্রোজেক্টে মানিয়ে নিয়েছিল নাতাশা। ওর গুণ হল ও ঠিক ধরতে পারে কী করলে ওর দাম বাড়বে। যখন ওদের ক্লায়েন্ট এসেছিল, তাকে নিয়ে কলকাতা দেখিয়ে মার্কেটিং করিয়ে আনল ও! সে তো নাতাশা বলতে অজ্ঞান! প্রজেক্টের যখন দরকার ও রাত জেগে টেস্টিং করে দেয়। যে কাজগুলো কেউ করতে চায় না, সেই একঘেয়ে কারেকশনগুলো করে বসে বসে। এগুলো করতে করতে সিস্টেমটা বেশ ভাল জেনে গেল ও। ক্লায়েন্ট কলে খুব সহজেই রিকোয়ারমেন্ট বুঝে সবাইকে বুঝিয়ে দিত।
গত সপ্তাহে যখন প্রি-সেলস গ্রুপের প্রদ্যুম্নদা হঠাত ডেকে পাঠাল ও বেশ অবাক হয়েছিল। ওকে প্রদ্যুম্নদা চিনল কী করে? অনেকক্ষণ ধরে বোঝাল প্রদ্যুম্নদা। একটা নতুন প্রজেক্ট নাকি ওর ওপরেই নির্ভর করছে! ক্লায়েন্টের কাছে গিয়ে কাজ বুঝতে হবে, তারপর সবাইকে অফশোরে বুঝিয়ে দিতে হবে! ক্লায়েন্ট খুশি হলে পুরো কাজটাই কোম্পানী পাবে। অনেক টাকার প্রজেক্ট! কোম্পানীর সিনিয়ার ম্যানেজমেন্ট নাকি ওর ওপর নির্ভর করে আছে! পুরো ব্যাপারটা শুনে ও বলল “আমি কি পারব?” “নিশ্চই পারবে! পুণীত হ্যাস এ লট অফ বিলিফ ইন ইউ!” এতক্ষণে বুঝেছিল নাতাশা! এর মধ্যে পুণীতদা আছে! নইলে এতবড় কাজ ওর কাছে আসে কী করে? কমিউনিকেশন ডোমেনের ও কিছুই জানে না! তবে কোন কিছু থেকে হেরে ফিরে আসবে না ও। বিদেশ আসার আগে মা খুব কেঁদেছিল! বলেছিল “আর কি তোর সঙ্গে দেখা হবে? কত দূরে চলে যাচ্ছিস!” বাবার দোকানটা মা-ই এখন চালায়। ও ঠিক করেছিল বিদেশে এসে ভাল পয়সা হলে মাকে নিয়ে আসবে।
আগের প্রজেক্টে, ক্লায়েন্টের সঙ্গে কথা বলে, আমেরিকান অ্যাক্সেন্টে ইংরাজীটা ধাতস্থ হয়ে গিয়েছিল। এমনকি নিজেও খানিকটা ঐ আক্সেন্টে কথা বলা রপ্ত করে ফেলেছিল নাতাশা। ছ’ফুটের মিস্টার জেমস হেন্ডারসন যখন ঈষৎ হলুদ দাঁত বার করে হাত বাড়িয়ে বললেন “ওয়েলকাম!” তখন সহজেই “হাই” বেরিয়ে গেল মুখ থেকে। নাতাশাকে আপাদমস্তক দেখে চোখ চকচক করে উঠেছিল মিস্টার হেন্ডারসনের। বলেছিলেন “ন্যাটাশা! নাইস নেম! নট লাইক আদার কমপ্লিকেটেড ইন্ডিয়ান নেমস!” প্রথম দিনই ওকে কফি খেতে নিয়ে গেছিলেন মিস্টার হেন্ডারসন এবং বলেছিলেন “প্লিস কল মি জেমস!” সেই থেকে জেমসই ডাকত ও। ওঁর সিটের কাছাকাছিই বসার ব্যবস্থা হয়েছিল নাতাশার। জেমস যখন তখন একটু বসে গল্প করে যেতেন। নাতাশাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখেই যেন ওর সুখ। একসঙ্গে বাইরে লাঞ্চ খেতে নিয়ে যেতেন। বেসবল ম্যাচ আর কনসার্ট দেখতেও নিয়ে গেছিলেন। ওঁর বিশাল টিমের আর সবার থেকে নাতাশার খাতির ছিল বেশী।
এদিকে প্রজেক্ট তো নামাতে হবে। বিশাল পরিমাণ টেকনিকাল ডকুমেন্ট চলে এসেছিল নাতাশার কাছে। নাতাশা জানে এ প্রজেক্ট বোঝা ওর সাধ্যের বাইরে। ও সফটকপি গুলো একটু রাত্রের দিকে আপলোড করে দিত অফিসের সার্ভারে। অফশোরে বিশাল অ্যালোকেটেড হয়েছিল এই প্রজেক্টে। সব ও দেখে নিত। ক্লায়েন্টের টেকনিকাল টিমের সঙ্গে কথাবার্তা ও সামলে নিত। নাতাশার কাজ ছিল শুধু মিষ্টি হেসে জেমসকে খুশী রাখা! সে কাজটা নাতাশা ভালই করছিল।
সন্ধ্যার দিকে পুণীতদা প্রায়ই ওকে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে যেত। পুণীতদা একা থাকে। প্রথমদিন গিয়ে অবাক লেগেছিল নাতাশার! কী অগোছালো চারিদিক! যেখানে সেখানে জামাকাপড় ঝুলছে! নোংরা থালাবাসন পড়ে আছে! টেবলে মদের বোতল আর গ্লাস! সন্ধ্যাবেলা ভাল হুইস্কি না হলে পুণীতদার চলে না। নাতাশা জিজ্ঞাসা করেছিল “তুমি ফ্যামিলি নিয়ে আসো না কেন পুণীতদা? এ ভাবে একা কি চলে?” বেশ ক’পাত্তর হয়ে যাওয়ার পর একদিন সরাসরি নাতাশাকে বলেছিল পুণীত “আমার কেউ নেই নাতাশা! আই অ্যাম সো অ্যালোন!” নাতাশা জেনেছিল পুণীতের বৌ ওকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করেছে। দুটো বাচ্চা মেয়ে আছে। তাদের নিজের বাবা মার কাছে রেখে এসেছে। একদিন সরাসরি নাতাশাকে বলেছিল “প্রথমদিন থেকে তোমাকে আমার ভাল লাগে! তাই তো তোমাকে অনসাইটে নিয়ে এলাম! জানতাম জেমসকে তুমি ম্যানেজ করে নেবে! শালা বুড়ো ভাম! মেয়ে দেখতে ভালবাসে, আর কিছু চায় না। তোমাকে আমি আরো ভাল প্রজেক্টে নিয়ে যাব এরপর, দেখো! তোমার বছর বছর প্রমোশন হবে! তোমার মাকে নিয়ে আসতে পারবে এখানে! আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই নাতাশা!” বলে ওকে জড়িয়ে ধরেছিল পুণীত! সেদিন সন্ধ্যায় ওর খপ্পর থেকে ছাড়া পাওয়া খুব মুশকিল ছিল! ক্রমেই ওর জোর বাড়ছিল। সোফায় নাতাশাকে বসিয়ে আদরে ভরে দিচ্ছিল! ওর মুখের মদের দুর্গন্ধ সহ্য হচ্ছিল না নাতাশার! ও বুঝতে পারছিল এই অতিরিক্তি মদ্যাসক্তির জন্যই হয়তো ওকে ছেড়ে গেছে ওর বৌ! কিন্তু কীভাবে ঠেকিয়ে রাখবে পুণীতের এই প্রেম? এই সময় অন্য কয়েকটি অনসাইটের ছেলে এসে গিয়েছিল পুণীতের অ্যাপার্টমেন্টে। সেদিন আসলে ছিল পুণীতের জন্মদিন! সারপ্রাইস পার্টি দিয়েছিল ছেলেরা। কেক কাটিং-এর পর ওদের সঙ্গেই কোনক্রমে চলে গিয়েছিল নাতাশা। কোন কারণেই আর পুণীতের অ্যাপার্টমেন্টে যায়নি। পুণীত সরি বলেছিল, কিন্তু সেখানে যাওয়া সেফ মনে হয়নি নাতাশার। পুণীতের ভালবাসা পুরোই এক তরফা। নাতাশা ওকে দাদার মত দেখে! ওর সঙ্গে প্রেম বা বিয়ে অসম্ভব! অনসাইটে বেশ মন বসে গেছিল! ফিরে যাওয়ার কোন ইচ্ছে ছিল না। অনেক উঁচুতে ওঠার পথ স্পষ্ট তখন সামনে। কিন্তু কী করে বাঁচবে পুণীতের খপ্পর থেকে?
ঠিক এই সময় সাধনের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল নাতাশার। তখন ডি-এম-এস সফটওয়ারকে প্রজেক্ট দিয়ে দিয়েছে জেমস। এর কৃতিত্ব দাবী করছে পুণীত এবং রুডিও। মডিউল বাই মডিউল কাজ চলে যাচ্ছিল অফশোর টিমের কাছে। অফশোরে রিকোয়ারমেন্ট বুঝে প্রডাক্ট কাস্টমাইজেশন শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু অফশোরের কাছে তো নিজেদের কোন প্রডাক্ট নেই! অন্য কোম্পানী থেকে চুরি করা প্রোডাক্ট দেখিয়ে প্রজেক্ট জোগাড় করেছিল প্রদ্যুম্ন আর পুণীত! সুতরাং ইমারজেন্সি বেসিসে অফশোরে রাত জেগে কাজ শুরু হয়েছিল। দু তিনমাসের মধ্যে একটা কিছু কোনক্রমে দাঁড় করিয়ে পাঠাতে হবে। এই অবস্থায় অনসাইটে খুব ভাল টেকনিকাল কাউকে দরকার, যে ব্যাপারটা সামলাতে পারবে! অন্য একটা প্রজেক্ট থেকে তুলে সাধন হাঁসদা বলে একটি ছেলেকে দেওয়া হল এই প্রজেক্টে! সাধন নাকি অসম্ভব ভাল টেকি! তবু নাতাশার বেশ টেনশন হচ্ছিল! মিষ্টি হাসিতে আর কতকাল ভুলবে জেমসকে ভগবান জানে!
প্রথম যেদিন সাধনকে দেখে নাতাশা, খুবই আনস্মার্ট, গেঁয়ো লেগেছিল। কথা খুব কম বলত। বাংলায় একটা অদ্ভুত টান আর ইংরাজী তো ভুলভাল যা পারে বলত! নাতাশার হতাশ লেগেছিল! তারপর জানল, ছেলেটা নাকি এখানে আসার আগে ক্যালিফোর্নিয়ায় কোম্পানীর একটা পুরোনো প্রজেক্টের সাপোর্টে ছিল। সেখানে সফটওয়ারে প্রচুর প্রবলেম ছিল! সাধন নাকি একার চেষ্টায় প্রবলেম সল্ভ করে। ক্লায়েন্ট এত খুশী যে আরো দু বছরের মেনটেন্যান্স দিয়ে দিয়েছে! অথচ সাধন নাকি রিলিজ না পেয়েই এইচ-আরের সঙ্গে প্রচুর ঝামেলা করে জোর করে অনসাইটে এসেছিল! তাই পানিশমেন্ট হিসেবে ওকে ঐ প্রজেক্টে দেওয়া হয়েছিল। এ সব কথা পুণীতই বলে নাতাশাকে।
প্রথম দিকে নাতাশা সাধনের সঙ্গে বিশেষ কথাবার্তাই বলত না। তারপর যেদিন অফশোর থেকে প্রথম মডিউলের ডেলিভারী হল সেদিন নাতাশা দেখেছিল সাধন কত অমানুষিক খাটতে পারে! সারা রাত অফিসে ছিল সপ্তাহখানেক। অফশোরের সঙ্গে সারা রাত কলে আর সকাল হলে সারাদিন এক মূহূর্ত উঠত না নিজের ল্যাপটপ ছেড়ে। প্রতিটা কোড খুলে কাজ করত, প্রতিটা ফাংশন টেস্ট করত, ক্লায়েন্টের সার্ভারে ফেলে ডাটা দিয়ে চেক করত। যেখানে দরকার পরিবর্তন করত। ওর একাগ্রতা, খাটার ক্ষমতা, টেকনিকাল জ্ঞান মুগ্ধ করেছিল নাতাশাকে! এক সপ্তাহ ছিল ইন্টিগ্রেশনের সময়। তারপর যেদিন প্রথম ডেমো হবে সেদিন পুণীতের সঙ্গে রুডিও এসেছিল, অফশোর থেকে পুরো প্রজেক্ট টিম, প্রদ্যুম্ন সবাই ছিল! জেমসের টিমও ছিল ক্লায়েন্টের হয়ে। ডেমো শেষে দু চারটে পরিবর্তন ছাড়া আর কোন কিছু বলতে পারেনি ক্লায়েন্ট। ওদের দেখে মনে হয়েছিল ওরা বেশ খুশি! নাতাশার মনে হয়েছিল সাধন অতিমানব! সাত দিন এক ফোঁটা না ঘুমিয়ে বাঁচে কী করে! ডেমো হয়ে যাওয়ার পর সাধনকে খাওয়াতে নিয়ে গেল পুণীত। জেমসও ছিল। সেদিনই জেমস জিজ্ঞাসা করায় সাধন বলেছিল ওর বাড়ির কথা। ওর মা ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করছেন। এক সময় সামান্য মুড়ি বিক্রি করে সংসার চালাতেন! যত দেখেছে সাধনকে তত অবাক হয়েছে নাতাশা! খুব খাঁটি মনে হয়েছিল সাধনকে।
পাশাপাশি কাজ করতে করতে কাছাকাছি এসে গেছিল ক্রমে দুজনে। তবে সেটা যথাসাধ্য অন্যদের চোখের বাইরে। অফিসে ওরা কাজ ছাড়া বিশেষ কথাবার্তা বলত না। কথা হত রাত জেগে, ফোনে। সব সময়েই ভয় ছিল পুণীত বা জেমসকে।
সত্যিই একদিন পুণীত এসে হাজির হয়েছিল ওর রুমে। নাতাশার সঙ্গে আরো দুজন মেয়ে থাকত, যারা উইকএন্ডে বাড়ি চলে যেত। সেটা হিসাব করেই এসেছিল পুণীত। বলেছিল “তুমি কি আমাকে অ্যাভয়েড করছ নাতাশা? জানো না, আমি তোমাকে কতটা ভালবাসি? সবাইকে সরিয়ে আমি তোমার মত জুনিয়ার রিসোর্সকে এরকম ক্রিটিকাল প্রজেক্টে নিয়ে এসেছি! তোমার প্রোমোশনের ব্যবস্থা করেছি! তোমার সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের রাস্তা খুলে দিয়েছি যা তোমাদের পরিবার কোনদিন ভাবতেও পারত না! আর তার বদলে শুধু পেতে চেয়েছি তোমাকে! কিন্তু তুমি আমাকে বারে বারে দূরে সরিয়ে দিয়েছ! কেন? বল! আমি কোনদিক থেকে তোমার যোগ্য নই?” বলতে বলতে নাতাশাকে আশ্লেষে জড়িয়ে ধরেছিল পুণীত! তারপর কোন বাধা না মেনে ধীরে ধীরে খুলে নিয়েছিল ওর হাউস কোট! ওর মোমের মত শরীরের সর্বত্র আদর করেছিল! নাতাশা জানত বাধা দিলে কোন লাভ নেই! চীৎকার করলেও কেউ শুনবে না! যতক্ষণ সম্ভব সহ্য করেছিল! তারপর চরম মূহূর্তের আগে যা থাকে কপালে ভেবে প্রাণপণ চেষ্টায় পাশে পড়ে থাকা মোবাইলের হট নম্বরে আঙ্গুল লাগিয়ে রিং করেছিল পুণীতের ফোনে। বেজে উঠেছিল ওর মোবাইল! কে ফোন করল দেখার জন্য, কয়েক সেকেন্ডের জন্য মোবাইল বার করার দিকে নজর দিয়েছিল পুণীত আর সেই সময় ওকে জোরে সরিয়ে এক ছুটে রেস্টরুমে ঢুকে দরজা প্রাণপণে আটকিয়ে দিয়ে ইমারজেন্সি নম্বর ডায়াল করেছিল নাতাশা! পুণীত সমানে দরজায় ধাক্কা মেরে ক্লান্ত হয়ে চলে গেছিল কিছুক্ষণ পর! ঠিক তারপরেই পুলিশ এসেছিল ওর ফ্ল্যাটে! ও বলেছিল যে কেউ ওর দরজায় বেল দিয়েছিল। ও ভুল করে দরজা খোলায় এক অপরিচিত লোক ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়েছিল! তাই ও ভয়ে ফোন করেছিল! পুলিশ আর বেশি কিছু না বলে ফিরে গিয়েছিল!
নাতাশা বেশ ভালই বুঝতে পেরেছিল এই কোম্পানী এবং এই প্রজেক্টে কাজ করা সম্ভব নয় বেশীদিন! পুণীত যে কোন সময় আসতে পারে। আজকাল কাউকে দরজা খোলে না নাতাশা! ওর সঙ্গের দুজন মেয়ে চলে গিয়েছে। ঐ রুমে আপাততঃ ও একা। কেন যেন মনে হয়েছিল সাধনকে ও বিশ্বাস করতে পারে। সব কথা শোনার পর সাধনের মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল রাগে! ও বলেছিল দেশ গ্রাম হলে ও দেখে নিত পুণীতকে।
সাধন ইতিমধ্যেই ক্যালিফোর্নিয়ায় যে ক্লায়েন্টের কাছে কাজ করত তার কাছ থেকে ডাইরেক্ট অফার পেয়েছিল। সাধন বলেছিল ও ডি-এম-এস ছেড়ে ঐ বিদেশী কোম্পানীতে জয়েন করবে আর যাওয়ার সময় নাতাশাকেও সঙ্গে নিয়ে যাবে। শুনে বেশ অবাক লেগেছিল নাতাশার! কই ও তো কখনো সাধনকে বলেনি যে ও ওর সঙ্গে যাবে! কী করে এত জোর প্রকাশ করল সাধন! প্রজেক্টের আর দুটো মডিউল দাঁড় করিয়ে মাস দুয়েক পরে লুকিয়ে বিয়ে করে নাতাশাকে নিয়ে লস অ্যাঞ্জেলিস চলে গেল সাধন, নতুন চাকরী নিয়ে। ডি-এম-এস ভাবতে পারেনি, এমন দুজন রিসোর্স ছেড়ে যাবে! সাধনকে বিয়ে করে খুব খুশী নাতাশা! সাধনের মধ্যে কোন দেখানো ব্যাপার নেই, কিন্তু গভীর ভালবাসা আছে। নাতাশাও একটা নতুন চাকরী জুটিয়ে নেবে আর তারপর সাধনের সঙ্গে জমিয়ে সংসার করবে! আসবে ওদের সন্তান! দুজনেই মাকে নিয়ে আসবে। খুব সাধারণ ঘর থেকে উঠে আসা দুটি ছেলেমেয়ে দেশ থেকে বহু মাইল দূরে নতুন করে স্বপ্ন দেখে!
রায়ানকে ডে-কেয়ারে ছেড়ে দিয়ে ক্যাব নিয়ে অফিসের দিকে দৌড়োয় নিবেদিতা। সকালে মিটিং রয়েছে একটা। অনিমেষ চাকরীর জন্য নিয়মিত দৌড়োদৌড়ি করছে। কখনো আশ্বাস পায় যে অন্ততঃ মার্কেটিং-এ কিছু একটা জুটে যাবে। দু বার প্লেন খরচা করে নিউজার্সি গেছে ইন্টারভিউতে। কিন্তু এখনো কোন অফার হাতে আসেনি।
বাড়িতে রান্নাবান্না করার অভ্যাস কোনদিনই নেই অনিমেষের। মায়ের হাতে বাড়া ভাত খেয়ে অফিসে গেছে চিরদিন। কিন্তু নিবেদিতা ছেলে সামলাবে, না অফিস সামলাবে? তাই চক্ষু লজ্জায় ব্রেকফাস্টটা করতেই হয়। দুপুরে ফ্রিজে রাখা বার্গারের টুকরো কামড়ে দিন পার করে অনিমেষ। রাতের রান্না নিবেদিতাই করে। সারাদিন টিভিতে আবহাওয়ার খবর শুনে আর আমেরিকান অখাদ্য রিয়েলিটি শো আর মারামারির সিরিয়ালগুলো দেখে দেখে ক্লান্তি লাগে অনিমেষের। দেশের কোন খবর এরা দেখায় না। বইপত্র পড়ার নেশা তেমন নেই। নিউজপেপারটায় চোখ বোলায়। ছোট দু ঘরের অ্যাপার্টমেন্টটা পুরোনো ফারনিচারে সাজানোই ছিল। নতুন কিছু এখনো কেনেনি ওরা। কতদিন থাকবে তারই ঠিক নেই। একটা খাট ছিল, সেটাতে নিবেদিতা আর রায়ান শোয়। অনিমেষের স্থান হয়েছে মেঝেতে একটা ম্যাট্রেসে। বিকেলে গাড়িটা নিয়ে একমাত্র কাজ রায়ানকে ডে-কেয়ার থেকে তুলে আনা। সারাদিন ডে-কেয়ারে থেকে ও কেমন যেন ঘ্যানঘ্যানে হয়ে যায়। বাড়িতে এনে ওকে চেঞ্জ করে বিকেলে দুধ খাওয়ানোও অনিমেষের আর এক কাজ। এখানে এসে বাচ্চার ন্যাপি চেঞ্জ করতে শিখেছে অনিমেষ। বাড়িতে মা দেখলে চোখ কপালে তুলত! এভাবে যত দিন যাবে, টেকনিকাল কাজের সঙ্গে, বিজনেসের সঙ্গে সংযোগ কমে যাবে! ভাবলেই ভয় হয় অনিমেষের। আর কতদিন নিবেদিতার হাত ধরা হয়ে থাকবে? প্রায় মাস ছয়েক হতে চলল ওরা এসেছে। নিবেদিতার কাজ শেষ হওয়ার কোন লক্ষণ নেই, বরং ক্রমেই কাজের চাপ বাড়ছে! নিবেদিতা এখন একটা টিমকে লিড করছে। ওর অনেক দায়িত্ব। মাঝে মাঝেই ক্লায়েন্টের অন্য অফিসে যেতে হয় ডেনভারে। তখন অনিমেষ আর রায়ান একা! কী ভাবে যে কাটে দিনগুলো অনিমেষই জানে। এখানে ভাল লাগে না ওর। প্রতি মূহূর্তে দেশে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। সবাই বলে এটা সব পেয়েছির দেশ! কাজের অভাব নেই। কিন্তু অনিমেষ সিভিল ইঞ্জিনীয়ার! সেই কাজের স্কিল প্রচুর আছে। দেশে স্কিল থাকতে বাইরের লোক ওরা নেবে কেন? কাল রাতে একজন কনসালট্যান্ট ফোন করেছিল। নেভাডার দিকে কিছু নতুন কনস্ট্রাকশন হচ্ছে। সেখানে টেম্পোরারি লোক লাগবে। অনিমেষ হ্যাঁ করে দিয়েছে। এখন ওয়ার্ক-ভিসা হলে হয়!
সন্ধ্যায় নিবেদিতা ফিরতে অনিমেষ বলল “তোমাকে রোজই জিজ্ঞাসা করব ভাবি – তুমি টায়ার্ড থাকো তাই বলা হয় না – তোমার এই প্রজেক্ট কতদিন চলবে?” “তুমি তো জানোই অন্তত এক বছর বলেই পাঠিয়েছে আমাকে!” আশ্চর্য হয়ে বলে নিবেদিতা। “কিন্তু তুমি তো আগে কাজ শেষ হয়ে গেলে ফিরেও যেতে পারো! তাই না?” অধৈর্য হয়ে টেবলে থাপ্পড় মেরে বলে অনিমেষ। ওর এই চেহারা চেনা নেই নিবেদিতার! “কিন্তু আমার তো খুব ভাল লাগছে এখানে! কাজের পরিবেশ খুব ভাল। আমার ক্লায়েন্ট ম্যানেজারও খুব ভাল! আমার আন্ডারে অন্তত গোটা দশেক রিসোর্স কাজ করছে! প্রজেক্ট খুব ভাল চলছে। এমন চললে আমার প্রমোশন কে ঠেকায়? এখানকার সুযোগের সঙ্গে দেশের তুলনা চলে না! পকেটে কত আসছে হিসেব আছে অনি? দেশে এর দশভাগের একভাগও আসত না! এখানকার রোজগারে একটা ভাল গাড়ি, দেশে একটা বড় ফ্ল্যাট কিনে রাখা কোন ব্যাপারই না! রায়ান কত ভাল স্কুলে পড়বে বল তো! আমার এখন এখান থেকে নড়ার কোন ইচ্ছে নেই।“ বেশ জোরের সঙ্গে বলে নিবেদিতা। অনিমেষ বিয়ের পর থেকে নিবেদিতাকে কখনো জোর করেনি। সবসময় ওর সঙ্গে কোঅপারেট করেছে। বাবা মাকে বুঝিয়েছে! আর আজ নিবেদিতা ওর অবস্থাটা বুঝতেই পারছে না! ও যদি স্যাক্রিফাইস করে না আসত, ঐটুকু বাচ্চাকে ফেলে রেখে আসতে হত নিবেদিতাকে! মুখে বলে “বেশ, তাহলে আমি নেভাডা চলে যাব! শেষ চেষ্টা করে দেখি!” চুপ করে রায়ানকে নিয়ে খেলে নিবেদিতা। সারাদিন কাজের পর ঝগড়া করার আর এনার্জি নেই।
নেভাডার দিকে অনেকেই যেতে চায় না। অনিমেষ জানে ওখানে হয়তো কাজটা হয়ে যাবে। আর ছ মাস দেখবে ও তারপর দেশে ফিরে যাবে। নিবেদিতাকে এক বছর সময় দেবে অনিমেষ। আর দেওয়া সম্ভব নয়। ওর নিজেরও ক্যারিয়ার বলে একটা জিনিস আছে। নিবেদিতাকে বেছে নিতে হবে ক্যারিয়ার ওর প্রায়রিটি, না পরিবার। ক্রমশঃ কেন যেন মনে হচ্ছে নিবেদিতা এখানকার চাকচিক্যের নেশায় পড়ে এখানেই থেকে যেতে চায়! ওর উচ্চাশা খুব বেশী। আগে এটা বোঝেনি অনিমেষ। ধীরে ধীরে রায়ানকেও ওর মতোই গড়ে তুলবে নিবেদিতা! কেন যেন অনিমেষের মনে হয়, ও আর নাগাল পাবে না নিবেদিতার! আজকাল ওর সঙ্গে শরীরী সম্পর্কও প্রায় নেই। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ম্যাট্রেসে দেহ ছড়িয়ে দেয় অনিমেষ।
প্রদ্যুম্নর একান্ত অনুরোধে গোয়া গেছিল প্রদ্যুম্ন আর রাগিনী দিন তিনেকের জন্য। বাড়িতে বলেছিল অফিসের কাজে মুম্বই যাচ্ছে। রাজীব বলেছিল “রাগিনী তুমি কিন্তু আগে কোনদিনই অফিসের কাজকে ফ্যামিলির চেয়ে বেশী প্রায়োরিটি দাওনি। আর এখন দুটো ফুলের মত বাচ্চাকে ছেড়ে কিসের নেশায় দিনরাত অফিসে কাটাও? তোমার ফোনে প্রায়ই প্রচুর মেসেজ আসতে দেখি। ডিসেন্সি আমাকে আটকায় সেগুলো খুলে দেখতে! কিন্তু ডোন্ট টেক দিস অ্যাস মাই উইকনেস! আর ইউ ইন রিলেশন উইথ সামওয়ান?” রাগিনী বলেছিল “রাজীব! ইট’স অল ওয়ার্ক! প্রি-সেলস গ্রুপে এখন আমি সিনিয়ার পোজিশনে আছি! কোম্পানী নতুন প্রজেক্ট আনার ব্যাপারে আমার ওপর নির্ভর করে! ভাল কাজ করলে আমি অনেক ওপরে উঠব! তুমি চাও না সেটা? প্রদ্যুম্ন ইজ মাই গুড ফ্রেন্ড অ্যান্ড গাইড! ও-ই মেসেজ করে মাঝে মাঝে! ইউ শুড নট বি জেলাস!”
গোয়াতে দুজনে শরীরী খেলায় মেতে উঠেছিল! প্রদ্যুম্নর খোলা শরীর যে কোন মেয়েকে পাগল করে দিতে পারে! মোটাসোটা রাজীব কোনদিনই আনন্দ দিতে পারেনি রাগিনীকে। প্রদ্যুম্নর সাহচর্যে যেন নতুন যৌবন ফিরে পেয়েছে রাগিনী!
ফেরার পর, ডিপার্টমেন্টে কিছু ফিসফাস কানে এসেছিল। কিন্তু দুজনেই সিনিয়ার। কেউই ওদের কিছু বলতে সাহস পায়নি।
সেদিন ছেলের স্কুলের মিটিং সেরে একটু বেলা করেই অফিসে ঢুকেছিল রাগিনী। ঢুকেই দেখে বিভিন্ন কিউবে ফিসফাস চলেছে। প্রদ্যুম্ন তখনো আসেনি। রাগিনী জিজ্ঞাসা করেছিল “হোয়াট ইস দ্য ম্যাটার গাইস? হোয়াট আর ইউ ডিসকাসিং?” যা শুনেছিল তাতে কেঁপে উঠেছিল! প্রদ্যুম্নর ওয়াইফ সুইসাইড করেছে!
আগেই আন্দাজ করেছিল রাগিনী! ওর ওয়াইফের কিছু মেন্টাল প্রবলেম ছিল সম্ভবতঃ। প্রচন্ড সন্দেহ করত প্রদ্যুম্নকে। প্রবল ডমিনেট করত। প্রদ্যুম্নর ফ্যামিলি লাইফ বলে কিছু ছিল না। তাও বুকটা কেমন ধড়াস করে উঠল রাগিনীর। এ মাসে ও পিরিয়ড মিস করছে! এমনিতেই একটা অস্বস্তি ওকে ঘিরে আছে! ও তো ওষুধ খায় নিয়মিত! কিছু হওয়ার কথা না! তবু একবার টেস্ট করিয়ে নিতে হবে!
ঘটনার পর প্রায় মাসখানেক কেটে গেছিল। কাজে কিছুতেই মন বসাতে পারছিল না রাগিনী! হোমটেস্ট বলছে ও প্রেগন্যান্ট! নিজেরই অবিশ্বাস্য লেগেছিল! বউয়ের মৃত্যুর পর থেকেই প্রদ্যুম্ন আর ওকে পাত্তা দিচ্ছে না। ও দুঃখপ্রকাশ করায়, কেমন বাঁকা হেসে বলেছিল “আমি পুলিশের জেরায় পড়েছি! সব সেটল না হওয়া অবধি আমাদের না মেলামেশাই ভাল!” তবে কি রাগিনীর সঙ্গে মেলামেশার জন্যই ওর বউয়ের আত্মহত্যা বলে ইঙ্গিত করছে প্রদ্যুম্ন?
প্রি-সেলসে প্রিয়ংকা বলে একটি বাচ্চা মেয়ে জয়েন করেছে। প্রদ্যুম্ন এখন সেই সুন্দরী, স্মার্ট মেয়েটিকে গ্রুম করতে ব্যস্ত! ও অন্য ব্রাঞ্চে বদলী নেবে কোন নতুন পোজিশনে এমনও শুনছিল রাগিনী! কিন্তু রাগিনীকে তো অ্যাবর্ট করতেই হবে! রাজীবকেই বা কী বলবে! মাথায় একগাদা চিন্তা নিয়ে প্রদ্যুম্নকে ছুটির পর রাগিনী বলেছিল ওকে ড্রপ করে দিতে। নেহাত অনিচ্ছায় রাজী হয়েছিল প্রদ্যুম্ন! গাড়িতে উঠে সব খুলে বলেছিল রাগিনী! প্রদ্যুম্ন ঝেড়ে ফেলে বলেছিল “গো অ্যান্ড অ্যাবর্ট! ইট’স ইয়োর বেবি!” আশ্চর্য হয়ে গেছিল রাগিনী, বলেছিল “তোমার কোন দায়িত্ব নেই! কে আমাকে গোয়া নিয়ে গিয়েছিল?” “ইউ আর নট এ চাইল্ড! আমি তোমার অনিচ্ছায় কিছুই করিনি!” মুখের ওপর বলেছিল প্রদ্যুম্ন! অপমানে কান লাল হয়ে গিয়েছিল রাগিনীর! ও গাড়ি থেকে মাঝরাস্তায় নেমে ট্যাক্সি নিয়ে ফিরেছিল।
সেদিন রাতটা রাগিনীর জন্য অভিশপ্ত রাত ছিল! রাতে খাওয়ার পর রাজীব ওকে বলেছিল “রাগিনী, আমার মনে হয় তুমি সিরিয়াসলি কারো সঙ্গে এনগেজড! আমার থেকে বহু দূরে সরে গেছ তুমি! ছেলেমেয়েরাও তোমার কেউ নয় এখন! জানি না কোন নেশার পিছনে ছুটছ! বাট ইট’স ইয়োর পারসোনাল লাইফ! আমাকে ছেড়ে দাও তুমি! আমি ডিভোর্স ফাইল করতে চাই!” বেশ খানিকক্ষণ গুম হয়ে থেকে হাউ হাউ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল রাগিনী! ক্ষমা চেয়েছিল রাজীবের কাছে। খুলে বলেছিল প্রদ্যুম্নর সব কথা। “স্কাউন্ড্রেল!” বলে রাজীব সব ভুলে ওর মাথাটা টেনে নিয়েছিল বুকে!
“ডাটা ডোমেন” কয়েক কোটি টাকায় কিনে নিয়েছে ডি-এম-এস সফটওয়ার। নিজের চেম্বারে কেমন একটা শূণ্য চোখে চেয়ে বসেছিলেন প্রীতম মুখার্জী। ডাটা ডোমেনকে জিরো থেকে স্টার্ট-আপ হিসাবে আজকের জায়গায় নিয়ে এসেছেন। ডাটা ডোমেনের মার্কেট দর এত বলেই তো ডি-এম-এস রাজী হয়েছে এই কোম্পানী কিনতে!
মিস্টার মুখার্জী কোম্পানী বিক্রি করেছেন নিজের প্ল্যান অনুযায়ী! তিনি এবং তাঁর সব রিসোর্স ডি-এম-এসের মত কোম্পানীতে কাজও করবে, মুনাফা লাভও হল! তাও সকাল থেকে মনটা খুব ভারাক্রান্ত হয়ে আছে। মেয়ের বিয়ে দিলে বাবার মন বোধহয় এমনই খারাপ হয়! সেক্টর ফাইভের এই এক ফ্লোরের অফিস তাঁর দিনরাতের আশ্রয় ছিল গত পাঁচটা বছর! বিদেশ থেকে এসে এখানেই ডাটা ডোমেন সেটআপ করেছিলেন।
ঘরে এসে বসলেন ডেলিভারি হেড মিস্টার দুবে। ব্রিলিয়ান্ট ম্যানেজার আর তেমনই টেকনিক্যাল জ্ঞান। প্রীতম মুখার্জী খুব ভরসা করেন আই-আই-টির বন্ধু মিস্টার দুবেকে। মুম্বইয়ের একটা বড় কোম্পানী ছেড়ে মিস্টার মুখার্জীর কথায় ডাটা ডোমেন জয়েন করেছিলেন। মিস্টার দুবের মুখ কেমন ফ্যাকাশে। বলে উঠলেন “প্রীতম, দে হ্যাভ ব্রিচড আওয়ার ট্রাস্ট!” চমকে উঠলেন মিস্টার মুখার্জী “হাউ?” “দে হ্যাভ অফারড অনলি দ্য টেকনিক্যাল রিসোর্সেস কিপিং ইউ, মি অ্যান্ড অল সিনিয়ার পিপল আউট!” নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেন না প্রীতম মুখার্জী “হোয়াট! হাউ ডু ইউ নো?” “আই হ্যাভ সিন সাম অফ দ্য অফার লেটারস দ্যাট ডি-এম-এস গেভ আওয়ার পিপল। দে হ্যাভ অফার্ড অল রিসোর্সেস স্টার্টিং ফ্রম প্রজেক্ট ম্যানেজার লেভেল, বাট নো বডি সিনিয়ার দ্যান দ্যাট! সো আওয়ার এইচ-আর, অ্যাডমিন, সিনিয়ার ম্যানেজমেন্ট অল আর লেফট আউট!”
উত্তেজনায় মুখ থেকে বাংলা বেরিয়ে এল মিস্টার মুখার্জীর “কিন্তু কেন! আমাদের লাস্ট যে মিটিং হয়েছিল তাতে দুরাইস্বামীর সঙ্গে স্পষ্ট কথা হয়েছিল সবাইকে অফার করা হবে! এমনও তো হতে পারে বাকীদের এরপর অফার করবে!” “ফরগেট দ্যাট! দে হ্যাভ বিন টোল্ড টু জয়েন ফ্রম টুমরো ইটসেলফ! সো আই থিঙ্ক ইট’স ফুল অ্যান্ড ফাইনাল। অনলি ফর ইউ, আই লেফট মাই ক্যারিয়ার ইন মুম্বই অ্যান্ড জয়েনড হিয়ার! নাউ হোয়ার উইল আই গো? মাই সন ইস স্টাডিইং হিয়ার অ্যান্ড মাই ওয়াইফ হ্যাস টেকন এ ট্রান্সফার! দেয়ার ইস নো গুড জব ইন দিস রটেন কলকাতা, হুইচ উইল অফার মি দিস প্যাকেজ!“
“আই শুড নট হ্যাভ সাইনড দ্য ডিল বিফোর দে অফারড অল রিসোর্সেস! আই উইল টক টু দুরাইস্বামী রাইট নাউ!” উত্তেজিত ভাবে বেরিয়ে গেলেন মিস্টার মুখার্জী।
প্রায় আধ ঘন্টা পর নিজের চেম্বারে এসে ধপ করে বসে পড়লেন মিস্টার মুখার্জী। বহু চেষ্টাতেও দুরাইস্বামীকে কানেক্ট করতে পারেননি। ওনার সেক্রেটারী রাকেশ সমানে বলে গেল যে উনি হাই লেভেল মিটিং-এ আছেন। শেষে ডেসপারেট হয়ে ওনার পারসোনাল মোবাইলে ফোন করেছিলেন মিস্টার মুখার্জী। দুরাইস্বামী ধরেওছিলেন। কিন্তু যেই মিস্টার মুখার্জী বললেন যে তিনি ডাটা ডোমেন থেকে বলছেন, সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা এনগেজড হয়ে গেল এবং তারপর থেকে অফ! রাকেশ জানালো দুরাইস্বামী মিটিং সেরে এয়ারপোর্টে বেরিয়ে গেছিলেন। রাতে ওনার আমেরিকার ফ্লাইট। এয়ারপোর্টে থাকার জন্যই নাকি ওনার ফোন সুইচড অফ ছিল!
মিস্টার মুখার্জী জানেন তিনি যে পরিমাণ অর্থ পেয়েছেন তাতে তিনি হয়তো ডাটা ডোমেনের মত আর একটা স্টার্ট আপ খুলে আবার প্রথম থেকে শুরু করতে পারেন! সিনিয়ার ম্যানেজমেন্টে যাঁদের কোম্পানীর শেয়ার আছে, তাঁরা হয়তো পথে বসবে না, কিন্তু তিনি তো এতগুলো লোকের কাছে দায়বদ্ধ! কোম্পানী কিনে প্রচুর মুনাফা করবে ডি-এম-এস! মাঝখান থেকে কস্টও কমিয়ে নিল অনেকগুণ! একেই বলে টপ লেভেলের নোংরা পলিটিকস! দুবেকে দেখানোর মত মুখ নেই মিস্টার মুখার্জীর! চোরের মত চেম্বার থেকে বেরিয়ে লিফটে উঠে নীচে নামলেন, হয়তো শেষবারের মত! গাড়িটা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে দেখলেন বিকেলের নরম আলো এসে পড়েছে নলবনের বিশাল ঝিলে! মাছরাঙ্গাগুলো উড়ে বেড়াচ্ছে! ডানদিকের বিশাল উঁচু বাড়িগুলোয় একে একে ফ্লোরে ফ্লোরে আলো জ্বলে উঠেছে! ঐ খুপরীতে খুপরীতে কতজনের জীবন গড়ে উঠছে অথবা ভেঙ্গে যাচ্ছে কে জানে! রাস্তায় ফিরতি গাড়ির সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে! মিস্টার মুখার্জীর মনে পড়ল আজকে থেকে দশ বছর আগে প্রথম যখন এখানে এসেছিলেন কেমন ধূ ধূ করত রাস্তাঘাট সন্ধ্যা হলে! ঝিঁঝিঁর ডাক শোনা যেত! কয়েকটি অফিস আর কয়েকটি ঝুপড়ি ছাড়া কিছু ছিল না এই দিকে! আনমনে গাড়ি রাস্তার ধারে রেখে নলবনের ঝিলের ধারে এসে দাঁড়ালেন মিস্টার মুখার্জী! কখন যেন সেক্টর ফাইভ তাঁর জীবনের অঙ্গ হয়ে গেছে! আবার হয়ত বাইরে চলে যেতে পারেন, কিন্তু কী এক অমোঘ টানে সকাল হলেই এখানে আসার জন্য মন আনচান করে! তাঁর মত আরো অনেকের এমন আবেগই ক্রমে মহীরুহ করে তুলেছে সেকটর ফাইভকে!
(শেষ)