কিচ্ছু মনে পড়ে না ওর। কিচ্ছু না! কেউ যেন ওর স্মৃতির ব্ল্যাকবোর্ড থেকে নিপুণ হাতে ডাস্টার চালিয়ে মুছে ফেলেছে সবকিছু। দলপতি রায়ান এবং অন্যান্য সঙ্গীদের ডাক থেকে জেনেছে যে ওর নাম ঈশিতা। কিন্তু ওর বাবা-মা বা পরিবার পরিজন সম্পর্কে কোনও স্মৃতিই ওর মস্তিষ্কে ধরা পড়ে না। স্মৃতি বলতে শুধু একটা স্বল্প আলোকিত ঘর, কিছু সার্জারি মাস্ক পরা মানুষের মুখ, যাদেরকে আগে কখনও দেখেনি ও।
ঈশিতার বড্ড অসহায় লাগে মাঝেমাঝে। বাকি সঙ্গীদের প্রশ্ন করেও কিছু জানতে পারেনি নিজের অতীত সম্পর্কে। দলপতি রায়ানকে প্রশ্ন করলেই তিনি নানা ছুতোয় এড়িয়ে গেছেন। ওর স্মৃতি শুরুই হচ্ছে এক মাস আগের একটা দিন থেকে। যখন একটা গুহার ভিতর ওর জ্ঞান ফিরে আসে, তখন ওকে ঘিরে শুধুই অপরিচিত মানুষের মুখের ভিড়। আজও নিজের অতীত হাতড়ে ক্লান্ত ঈশিতা মাথা ঠান্ডা করার জন্য তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে আসে। আর একটু এগিয়ে যেতেই দেখতে পায় দৃশ্যটা।
ছেলেটা বিষণ্ণ মনে বসে আছে ডাইভিং বোর্ডের উপর। অন্তত ওর বসার ভঙ্গি তেমনটাই ইঙ্গিত করছে বলে মনে হলো ঈশিতার। বস্তুত এই মাঝরাতে কেউ মনের আনন্দ প্রকাশ করার জন্য ডাইভিং বোর্ডে চড়ে বসতে পারে কি? তাই ছেলেটা যে বিষণ্ণ, সেটা ধরেই নিলো ঈশিতা। চোখের দৃষ্টি সুদূরপরাহত। আসলে এটাও অনুমান মাত্র। কারণ নীচে থেকে ছেলেটার চোখ বা চোখের দৃষ্টি বোঝার কথা নয় ঈশিতার। বিশেষত যখন শুধু ওর মাথার পিছনটাই এখান থেকে দেখা যাচ্ছে। আজ এই মৃত শহরের মাথার উপর গোল চাঁদ উঠেছে। সন্ধ্যের বৃষ্টিতে ধুলো ধোঁয়া অনেকখানি পরিষ্কার, তাই খুব স্পষ্ট দেখাচ্ছে চাঁদটাকে। অন্যদিনের মতো ঘোলাটে ভাব নেই। আর তারা ভরা আকাশের সামিয়ানায় লটকে থাকা চকচকে চাঁদ সহ এই চালচিত্র ছেলেটার গোটা দৃশ্যপথ জুড়ে আছে।
ঈশিতার একটু ভয় ভয় করে। অথচ তীব্র কৌতূহল আছে ছেলেটার বিষয়ে সব কিছু জানবার। এই নিয়ে পরপর তিন রাত ওকে ওইভাবেই বসে থাকতে দেখছে, কৌতূহল হওয়া স্বাভাবিক। প্রথম রাতে ছেলেটাকে দেখে তো চমকে উঠেছিল। এই সময়টা ও ছাড়া অন্য কেউ যে এখানে আসতে পারে, ধারণা ছিল না। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, একা একটা মানুষ এখানে কী করছে? সবাই জানে, এই শহরের সমস্ত জীবকূল নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে! তাহলে?
দ্বিতীয় রাতেও যখন একই ভাবে বসে থাকতে দেখল ছেলেটাকে, তখন থেকেই এই কৌতূহলের উৎপত্তি। হঠাৎ তীক্ষ্ণ কর্কশ স্বরে কোনও রাতচরা পাখি ডেকে উঠল দূরে কোথাও। চিন্তাসূত্র ছিন্ন হলো ঈশিতার। নাহ্, আজ জানতেই হবে ছেলেটা কে, কী তার পরিচয়। কেনই বা রোজ রাতে এসে বসে ওই ডাইভিং বোর্ডটার উপর। ও থাকেই বা কোথায়?
"শুনছেন? আপনাকে বলছি... এই যে...!"
খুব ধীরে ধীরে ঈশিতার দিকে দৃষ্টি ফেরায় ছেলেটা। যদিও দৃষ্টি ফেরানোটা অন্ধকারে বোঝা যায় না ঠিক, আন্দাজ করে নিতে হয়। তারপর প্রায় ফিসফিসে স্বরে পাল্টা প্রশ্ন ভেসে আসে, "আমাকে বলছেন?"
"হ্যাঁ, আপনাকেই বলছি। আর কাউকে দেখতে পাচ্ছেন কি এখানে, আমাদের দু'জনকে ছাড়া?"
"অ্যাঁ... ইয়ে... ন্ না তো! কে-কেউ তো নেই।"
"বুঝেছেন তাহলে। এবার নেমে আসুন দেখি, কয়েকটা কথা জানার আছে আপনার থেকে।"
"নীচে নামতে ভালো লাগে না। তার চেয়ে আপনি উঠে আসুন না এখানে!"
"বাব্বাঃ, একা একটা অপিরিচিত মেয়েকে ওই শূন্যে উঠতে বলছেন! কেমন মানুষ আপনি?"
"স্-সরি। আ-আমি তেমন কিছু মিন করিনি। ঠিক আছে, আমিই আসছি।"
***
সাল ২০৯৪:
পানীয় জলের গভীর সংকট দেখা দিতে শুরু করে বছর পঞ্চাশেক আগে থেকেই। বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে অসংখ্য মানুষ মারা যেতে থাকে পানীয় জলের অভাবে। প্রত্যেক বছর মৃতের হার বাড়তে থাকে। অর্ধেক আফ্রিকা জনশূন্য হয়ে পড়ে। অবস্থা চরমে পৌঁছলে আফ্রিকার বাকি দেশগুলো এক হয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করে ইউরোপের কিছু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। এইভাবে সূচনা হয় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের। ক্রমে সারা বিশ্বের সমস্ত দেশ জড়িয়ে পড়ে যুদ্ধে।
***
সাল ২০৯৯:
দীর্ঘ পাঁচ বছরের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ফলে গোটা বিশ্ব পরিণত হয় এক বিশাল শ্মশানভূমিতে। রাসায়নিক অস্ত্রের আঘাতে এবং পরমাণু বোমা প্রয়োগের ফলে সারা বিশ্বের সমস্ত বড় শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৯৯ শতাংশ শেষ হয়ে যায় প্রথম দুই বছরেই। ভারত, ইজ়রায়েল ও রাশিয়া মিলিত মিত্রশক্তি হিসেবে এখন সারা বিশ্বের শাসন কর্তা। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বেঁচে যাওয়া মানুষদের অধিকাংশের বাসস্থান এখন 'সেফ জ়োন' নামক কৃত্রিম শহরগুলি। যার চারপাশ ঘিরে পুরু কাচের দেওয়াল। কারণ আবহাওয়ায় এত বিশাল পরিমাণ তেজস্ক্রিয়তা মিশে আছে যে সেখানে মানুষ বসবাস করতে পারে না।
তবে সবাই তত সৌভাগ্যবান নয়। সংখ্যায় অল্প কিছু মানুষ বিভিন্ন দেশেই রয়ে গেছে সেফ জ়োনের বাইরে। আর তেজস্ক্রিয় পরিমন্ডলে থাকতে থাকতে কিছু মানুষ রোজই মারা যাচ্ছে। বাকিরাও মৃত্যুর দিন গুনছে। কারণ খাদ্য ও পানীয়ের অভাব। তবে এদের মধ্যে থেকে কিছু অসম সাহসী মানুষ নির্জন পাহাড় - যেখানে যুদ্ধের আঁচ লাগেনি, সেখানে গুহায় থেকে জমানো 'টিনড ফুড' খেয়ে জীবন নির্বাহ করছে। আর এক দল বেরিয়ে পড়েছে নিকটবর্তী সেফ জ়োনের খোঁজে। ঈশিতা তেমনই একজন। প্রথমদিকে ওদের দলে ছিল পঁচিশ জন। এখন সেই সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে দশে। গত এক মাসে ওরা বিভিন্ন জায়গা ঘুরে সন্ধান চালিয়েছে। কিন্তু সেফ জ়োন থেকে গেছে অধরা।
***
এখন যেখানে ঈশিতারা ক্যাম্প করেছে, এটাই অতীতের তিলোত্তমা মহানগরী কলকাতা। তিনদিন আগে ওদের দলটা এখানে এসে পৌঁছয়। রাসায়নিক অস্ত্রের আক্রমণে জনশূন্য কলকাতা এখন একটি মৃত নগরী। ২০৯৫ সালের শেষ দিকে ইরাকি রাসায়নিক বোমা আছড়ে পড়ে এখানে। আটচল্লিশ ঘণ্টা নরক যন্ত্রণা ভোগ করার পর সমস্ত জীবকূল ধ্বংস হয়ে যায় কলকাতার। এখন গোটা শহর জুড়ে জনশূন্য অট্টালিকার জঙ্গল। ইতিউতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে কঙ্কালের স্তূপ। ঈশিতার দলের দুটো ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়ায় ওরা এখানেই থেকে গেছে কয়েকটা দিন। প্রতি রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর ঈশিতা একা একা তাদের ক্যাম্পের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। আর এই গভীর রাতে টহল দিতে বেরিয়েই ও প্রথম দেখে ছেলেটাকে। এই মুহূর্তে যে এসে দাঁড়িয়েছে ওর হাত তিনেক তফাতে। আর মনের ভিতর হাজার প্রশ্নের ভিড়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা, সেটাই করে বসে ও ছেলেটাকে।
"আপনি থাকেন কোথায়?"
"এই তো, এখানেই।"
"কিন্তু এই শহরের সমস্ত প্রাণীই তো মারা গেছে রাসায়নিক বোমা হামলায়! তাহলে...?"
"জানি না, মনে পড়ে না।"
এবার খানিকটা দ্রব হয় ঈশিতার মন। নিজের পরিস্থিতির সঙ্গে বিলক্ষণ মেলাতে পারে ছেলেটাকে। ও নিশ্চয়ই ঈশিতার মতোই আরেক হতভাগ্য, যার স্মৃতি লোপ পেয়েছে। তাই নরম সুরে আবার প্রশ্ন করে, "আপনি ওই ডাইভিং বোর্ডের উপর বসে থাকেন কেন?"
"আকাশ দেখি," মৃদু স্বরে কেটে কেটে বলে ছেলেটা।
"রোজ?"
"আর তো কিছু করার নেই এখন। তাই আকাশ দেখি। জানেন, আগে এই জায়গাটার নাম ছিল কলেজ স্কোয়ার। পোশাকি নাম বিদ্যাসাগর উদ্যান। কত ছেলেমেয়ে রোজ এখানে সাঁতার শিখতে আসত। ওয়াটার পোলো খেলত। আমি দূর থেকে ওদের দেখতাম। জলকে খুব ভয় পেতাম তো! খুব ইচ্ছে হতো ওই উপরের ডাইভিং বোর্ডটায় উঠে বসি। তখন সম্ভব হয়নি, এখন তাই সুযোগ পেলেই চলে আসি এখানে। আর উঠে বসি ওই ডাইভিং বোর্ডটায়।"
"কিন্তু আপনি এসব জানলেন কী করে? আপনার যে তাই কিছু মনে নেই!"
এবার একটা বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে ছেলেটার ঠোঁটে। একটু একটু করে এগিয়ে আসতে থাকে সে ঈশিতার দিকে। চাপা হিসহিসে স্বরে ছেলেটা বলে, "আমরা অমর। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের ভিড়ে মিশে তাদেরই রক্তে জীবন ধারণ করেছি আমরা। তিনদিন আগে ক্যাম্প পড়ছে দেখে তখন থেকেই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। বহুদিন পর আজ তৃষ্ণা মিটবে আমার।"
ছেলেটার কথাগুলো যেন কানে শিসে ঢেলে দেয় ঈশিতার। অস্বাভাবিক ভাবে জ্বলে ওঠা চোখ আর দুই কষ থেকে বেরিয়ে আসা ক্রমবর্ধমান শ্বদন্ত দুটো দেখে ফিসফিসে স্বরে ঈশিতা উচ্চারণ করে, "ভ্যাম্পায়ার...!"
চোখের পলক ফেলার আগেই ছেলেটা যেন শূন্যে ভেসে এসে কামড় বসায় ওর গ্রীবায়। আর সঙ্গে সঙ্গে অঘটন। হিউম্যানয়েড ঈশিতার সিন্থেটিক লেদার স্কিনের নীচে থাকা শক্ত স্টেইনলেস স্টিলের কাঠামোতে কামড় তো বসেই না, উপরন্তু বাঁদিকের শ্বদন্তটা টুক করে খসে পড়ে ভ্যাম্পায়ারের। এবার হাসার পালা ঈশিতার। হি হি করে হেসে উঠে শ্লেষ মিশ্রিত স্বরে বলে, "কী, ভ্যাম্পায়ার মশাই! রক্ত তৃষ্ণা মিটল আপনার?"
বেকুবের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে রক্তচোষা। চরম অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ঈশিতাকে দেখতে থাকে। তারপর অব্যক্ত একটা হুঙ্কার ছেড়ে দ্রুত কেটে পড়ে। আর ঈশিতা প্রাণ খুলে হাসতে থাকে, হাসতেই থাকে। হঠাৎ করেই যেন অনেক কিছু বুঝতে পারে ও।
আসলে ওই স্বল্প আলোকিত ঘরে অস্ত্রোপচার করে ওকে মানুষ থেকে অর্ধেক যন্ত্রে পরিণত করা হয়েছে। তাই ওর ব্রেনের সার্কিটে পুরোনো স্মৃতিরা ধরা দেয় না! উপলব্ধি করে, অন্যরা অসুস্থ হয়ে মারা গেলেও ওর কোনও ক্ষতি হবে না। কারণ ও আর মানুষ নেই। দৃঢ়সংকল্প হিউম্যানয়েড ঈশিতা এগিয়ে যায় তাঁবুর দিকে। কাল থেকে নতুন উদ্যমে শুরু করতে হবে সেফ জ়োনের খোঁজ। যে ভাবেই হোক বাঁচাতে হবে ওর অবশিষ্ট মানুষ সঙ্গীদের। কারণ ও-ই যে তাদের আশা ভরসা।
(শেষের শুরু)