নন্দিতা কড়াইতে মাছগুলো ছেড়ে সাধনাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কবে বাড়ি যাবে ঠিক করলে?’
সাধনা তার হাফ লিটারের প্রেশার কুকারটা বেসিনে ধুচ্ছিল। ডাল সেদ্ধ দেবে। বলল, ‘এই সপ্তাহে টিভি শোতে বোধহয় ডাকতে পারে। ফাইনাল কিছু জানায়নি, তাই দু’দিন অপেক্ষা করব। যদি ডাকে, টিভিতে আমাকে দেখাবে। ন্যাশানাল চ্যানেল, কত লোক যে আমার গান শুনবে, তুইও দেখতে পাবি।’
নন্দিতা বলল, ‘তোমার রেডিওর গানগুলো কখন বাজায় তা তো শোনা হয় না। টিভির শোটা কবে দেখাবে আগে থেকে জানিও, দেখব। তবে কোথায় আর দেখব, তোমার টিভিতেই দেখতে হবে।’
‘দাঁড়া, আগে তো ডাকুক।’
নন্দিতার মাছ ভাজা হয়ে গিয়েছে। সে কড়াইয়ের ঢাকনা খুলে তাতে আমের টুকরোগুলো দিচ্ছিল। সাধনা তাই দেখে বলল, ‘কী রান্না করছিস রে? একটা অদ্ভুত গন্ধ বেরোচ্ছে!’
‘মৌরলা মাছের সঙ্গে আম দিয়ে টক রান্না করছি, আর উচ্ছে ভাজা।’
‘তোরা মেদিনীপুরিরা খুব মাছের টক খাস, না রে?’
‘তা তো খাই। তবে শুধু মাছের নয়, সবজিরও টক খাই। যা গরম পড়েছে, এখন টক আর তেতো খেলে গরমটা কম লাগে মনে হয়। এ সময়টায় আমাদের দেশে তো সবাই পান্তাভাত খায় আর দুপুরে টক। তুমিও খাও না? টক খেলে স্কিন ভাল থাকে।’
‘তবে তোর মাছের টক আমাকেও টেস্ট করাস।’ হেসে ওঠে সাধনা। তারপর বলে, ‘তোর আজ অফিস নেই?’
‘না দিদি, ঘরে কিছু কাজ আছে, তাই আজ ছুটি নিয়েছি। তোমার কী সুবিধে বলো তো? রোজ সকালে উঠে অফিস যাওয়া থাকে না। সারাদিন বাড়িতে থাকো। মনের আনন্দে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করো।’
সাধনা যেন কথাটার অন্যদিকে গিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ রে দেখতে ওরকম লাগে। আমার যা ভাগ্য, সে ভাগ্য যেন কারও না হয়। এখন তো মনে হয় পড়াশোনাটা ঠিকঠাক করে করলে তোদের মতো চাকরিবাকরি করতাম। জীবনটা অন্যরকম হত। আর তো তাও হওয়ার নয়।’
সাধনা গান গায়। স্টেজে, রেডিওয়। সেই ছোট থেকেই বড় গায়িকা হওয়ার চেষ্টা করছে সে। সাধনার প্রেশার কুকারের সিটি পড়ছে। সে তার দিকের ওভেনের সুইচ অফ করে দিয়ে বলল, ‘এবার বাড়ি গেলে মামাও আসবে সঙ্গে, আমার বিয়ের কথাবার্তা বলতে।’
‘সত্যি? এ তো ভাল খবর। সোনিয়া আর গোলাপের বিয়েতে তো আর যাওয়া হবে না। তোমার বিয়েতে খুব আনন্দ করব তা হলে।’
এ কথাটাও সরিয়ে রেখে সাধনা বলল, ‘আমার রুমের বেডটা তো ফাঁকাই রয়েছে। এবার ভাবছি মামাকে এখানেই নিয়ে আসব। তোর কোনও আপত্তি নেই তো?’
নন্দিতা আঁতকে ওঠে। মামা এখানে থাকতে আসবে? তারপর খোঁচাটা আনার জন্য সে বলে, ‘বাড়িওলি দিদিকে বলেছ?’
‘বলব। মামা যে ক’দিন থাকবে সে ক’দিনের বেড ভাড়া দিয়ে দেব। তাতে না করবে বলে মনে হয় না।’
নন্দিতার ইচ্ছে ছিল না। দু-একবার দেখা করতে এসে যা খেল দেখিয়ে গিয়েছে! তারপরে লোকটাকে এখানে ঢুকতে দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু বাড়িওলি দিদি যদি রাজি হয়ে যায়! এখন নন্দিতা আর সাধনা এই মেসবাড়িতে থাকে। দোতলা বাড়ির নীচে তিনটে রুম, একটা বাথরুম, রান্নাঘর। এই রান্নাঘরে আগে তারা পাঁচজন ভাগাভাগি করে রান্না করেছে। এখন নন্দিতা আর সাধনা করে। ঘরের সামনে একফালি উঠোন মতো। উঠোনের পাশে একটা গোলাপগাছ, তুলসীগাছ আর সাদা টগরফুলের একটা গাছও আছে। পুব থেকে পশ্চিম দড়ি টাঙানো। এই দড়িতে এখন নন্দিতা আর সাধনা জামাকাপড় মেলে। আগে পল্লবী, সোনিয়া, গোলাপ, সবার কাপড়জামাই ঝুলত।
তিনটে ঘরে তারা পাঁচজন থাকত। উঠোন থেকে ঢুকেই সামনের ঘরে দুটো চৌকি। সেখানে থাকত সোনিয়া আর সাধনা। মাঝখানের টেবিলে সাধনার কেনা ছোট টিভি। ডানহাতে একটা ঘর, তাতেও দুটো বিছানা। একটাতে পল্লবী, একটায় নন্দিতা। রান্নাঘর লাগোয়া একটা ছোট্ট ঘর আছে। গোলাপ একা থাকত সেখানে। একটা ক্যাম্প খাট কোনওমতে যেন গুঁজে দেওয়া হয়েছিল। সে সুটকেসে জামাকাপড় ভরে তার তলায় রাখত। আর বাইরে একটা ব্যাগে রোজকার পরার জামা। গোলাপ নিজেকে সরিয়েই রাখতে চাইত।
নন্দিতা একদিন তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এত ছোট ঘরটা নিলে কেন? থাকতে কষ্ট হয় না তোমার?’
গোলাপ বলেছিল, ‘কী করব বলো? প্রাইভেট স্কুলের চাকরিটা পেয়ে কলকাতায় এসেছিলাম। মুসলিম বলে থাকার জায়গাই তো কেউ দিতে চায় না।’
‘তোমার নাম তো গোলাপ।’
‘ওটা ডাকনাম। আমার নাম আসলে হোসেনারা। এই ঘরটা ছোট বলে কেউ নিতে চায় না বোধহয়, তাই আমি পেয়ে গেছি। মাথা গোঁজার একটা জায়গা তো হয়েছে।’
গোলাপের কথা জেনেও অবশ্য বাকিরা কেউ কিছু বলেনি কোনওদিন। আর এখন তো গোলাপ আর সোনিয়ার বাড়ি থেকে বিয়ে ঠিক করায় তারা চলে গিয়েছে। পল্লবী চাকরিতে বদলি নিয়ে দিল্লি। পার্ক স্ট্রিটে একটা অফিসে কাজ করত সে। দিল্লিতেই তাদের হেড অফিস। পল্লবী সেখানকারই মেয়ে। তার সুবিধেই হয়েছে। সোনিয়ার বাড়িও দিল্লিতেই। সেও চাকরি পেয়ে এখানে এসেছিল। পল্লবীর মজাই হবে। সোনিয়ার বিয়েতে যেতে পারবে। নন্দিতা আর সাধনা কারও বিয়েতেই যেতে পারবে না। সোনিয়ার বাড়ি তো যাওয়া সম্ভব নয়। গোলাপ বর্ধমানের মেয়ে, কিন্তু সে তার বিয়েতে নেমন্তন্ন করেনি। এখন নন্দিতা আর সাধনা দুজনের রুমেই একটা করে বেড ফাঁকা। অন্য কোনও মেয়ে দেখতে আসেনি। সাধনা এই সুযোগটাই নিতে চাইছে।
দু’দিন অপেক্ষা করার পরও টিভি থেকে ডাক এল না সাধনার। শিলিগুড়ি চলে গেল সে। কয়েকটা দিন থেকে ফিরবে। মেসে এখন নন্দিতা একা। সে একদিন শর্মিষ্ঠাদিকে ফোন করেছিল। তিনিই তাদের বাড়িওয়ালি। এ বাড়ির দোতলায় তার বাবা আর দাদা-বউদি থাকেন। মা মারা গিয়েছেন অনেকদিন। বিয়ের পর শর্মিষ্ঠাদি বাবার কাছ থেকে একতলাটা পেয়েছিলেন। দাদা-বউদি যদিও দিতে চায়নি। তাদের সঙ্গে লড়ে গেছেন তিনি। কী করে ঝগড়া বাঁধিয়ে নিজের প্রাপ্য অধিকার বুঝে নিয়েছেন সেই কথাই প্রত্যেক মাসের দু’তারিখে একবার করে বলে ভাড়া নিয়ে চলে যান। নিজে থাকেন কিছু দূরে একটা ফ্ল্যাটে, আর এখানকার রুমগুলো ভাড়া দিয়েছেন।
নন্দিতা জানতে চেয়েছিল, ‘দিদি, সাধনাদির মামা কি আসছেন?’
শমিষ্ঠা বললেন, ‘হ্যাঁ, ‘অনেকদিন বেডগুলো ফাঁকা পড়ে রয়েছে। কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছি কিন্তু কেউ যোগাযোগ করেনি। আর কিছুদিন দেখব, না হলে তোমাদের ভাড়া বাড়াতে হবে। ওর মামা এসে দিন কয়েক থেকে যাক, তারপর ভাবব।’
এই জায়গাটা গীতাঞ্জলি মেট্রো স্টেশন থেকে অনেকটা ভেতরে। যেতে-আসতে অটো ভাড়া গুনতে হয়। হেঁটে এলে পায়ে ব্যথা ধরে যায়। তাছাড়া এই দেড় বছরে নন্দিতা দেখে নিয়েছে, বর্ষায় জল জমে এখানে। ভাড়া নিতে কেন আসবে কোনও মেয়ে? তাও পেয়িং গেস্ট সিস্টেমও নয়।
নন্দিতা বলল, ‘মেয়েদের থাকার জায়গায় আপনি একজন পুরুষমানুষকে থাকার পারমিশন দিয়ে দিলেন!’
‘আরে, উনি তো সাধনার মামা হন। ওর রুমে থাকবেন, তুমি তোমার রুমে থেকো। ভয় পেও না, কোনও অসুবিধে হবে বলে মনে হয় না। বয়স্ক মানুষ।’
এই কথা শোনার পর নন্দিতা আর কিছু বলেনি। ফোন ছেড়ে দিয়েছিল। চাইলে একটা কথা বলতে পারত সে - মামা তো নিজের নয়। গানের গুরুজি।
অফিস ছুটির পর নন্দিতা আর শান্তনু কিছুক্ষণ গল্প করে যে যার বাড়ি ফেরে। দুজনে একই অফিসে চাকরি করে। একটা প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে। শান্তনু কলকাতারই ছেলে। এই অফিসে ঢুকেই তার সঙ্গে আলাপ। নন্দিতা বলল, ‘জানো, সাধনাদির মামা আসছেন। আমাদের মেসেই থাকবেন।’
‘তোমাদের বাড়িওলি অ্যালাও করলেন!’
‘টাকার জন্য মানুষ সব পারে।’
‘আসছেন কেন উনি?’
‘সাধনাদির বিয়ের কথা বলতে।’
‘এত বয়স হয়ে গেছে, আর বিয়ে হবে ওর?’
‘জানি না, তবে আমারও ওর দশাই হবে বলে মনে হচ্ছে। প্রেম করার বেলায় আছ আর বাড়িতে জানাতে পারছ না!’
‘তুমিও তো বাড়িতে জানাওনি।’
‘তোমার বাড়িতে জানাও, আমিও মা-বাবাকে জানিয়ে দেব। দিদির বিয়ে হয়ে গেছে, এবার আমার পালা। বাড়িতে দাদা-বউদি আছে বলে এতদিন চাকরি করছি। এবার তারাও ছেলে দেখছে। কতদিন আর চাকরি করতে দেবে? ছেলে দেখলে আমি বিয়ে করে নেব। তুমি তখনও বাড়িতে না জানিয়ে চুপ করে থেকো।’
শান্তনু তার দিকে মুখ ফিরিয়ে হেসে বলল, ‘বিয়ে করতে গিয়ে দেখো না, তুলে নিয়ে এসে বিয়ে করব।’
‘যত কথা মুখে, কাজে তো কিছুই করতে পার না। এই তো বুড়োটা এসে থাকবে। আটকাতে পারবে তুমি?’
এবার শান্তনু কিছুটা চিন্তা মুখে নিয়ে বলল, ‘লোকটার থেকে সাবধানে থেকো। উনি কি আদৌ বিয়ে দিতে চান তোমার সাধনাদির?’
মামা আসেন নি তা তো নয়। আগেও কয়েকবার এসেছেন। সাধনার কাছ থেকেই জেনেছিল নন্দিতা। সাধনা মেসে আসার পর তার সঙ্গে দেখা করতে বীরেশ্বর রায় যখনই শিলিগুড়ি থেকে কলকাতায় আসতেন, একটা আশ্রমে উঠতেন। তখন মেস থেকে সাধনাও চলে যেত সেখানে। আশ্রমের কিছু নিয়ম আছে। থাকতে গেলে প্রত্যেককেই মানতে হয়। মামা সেই নিয়ম ভেঙেছিলেন। সাধনাকে নিয়ে থাকা, ঘুরতে বেরিয়ে রাত করে ফেরা। আশ্রম থেকেই সকলের খাওয়ার ব্যবস্থা করে। কিন্তু মামা সাধনার সব বাসনপত্র নিয়ে গিয়ে একটা স্টোভ কিনে ঘরের মধ্যেই রান্না শুরু করেছিলেন। তখন আশ্রম থেকে চলে যেতে বলেছিল। ওখান থেকেই দু-একবার মামা এসেছিলেন মেসে। প্রথম দিন সাধনা পরিচয় করিয়েছিল নন্দিতার সঙ্গে।
সেদিন তখনও মেসের বাকি মেয়েদের কেউ ফেরেনি। সাধনা গিয়েছিল রান্নাঘরে, চা করতে। নন্দিতা দাঁড়িয়ে। বীরেশ্বর বলেছিলেন, ‘বাঃ, তোমায় দেখতে তো সাধনার চেয়ে সুন্দর, বয়সও কচি। প্রেম করো নিশ্চয়ই?’
মামা সম্পর্কে সাধনার কাছে অনেক কথা শুনেছিল নন্দিতা। কত কিছু জানেন, সাধনার জন্য কত কিছু করেছেন। সে ভাবছিল, এত গুণী মানুষ, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করবে। কিন্তু কথা শুনে মনে হল লোকটা কোনও মাংসের দোকানে ঢুকেছে। কোনটা কচি আর কোনটা বুড়ো বেছে নিতে। প্রণাম না করে, কথা না বলে মুখে হালকা হাসি দেখিয়ে নিজের রুমে চলে গিয়েছিল নন্দিতা।
সাধনার অনেক বয়স হয়ে গেছে। চল্লিশের কাছাকাছি। সে নিজেও বুঝে গিয়েছে, গানের পিছনে লেগে থেকে কিছু হবে না।
ছোটবেলা থেকে পড়াশোনার চেয়ে গানের দিকে ঝোঁক বেশি ছিল সাধনার। শিলিগুড়িতে নাম আছে বীরেশ্বর রায়ের। সেখানকার রেডিও স্টেশনে কী একটা উঁচু পোস্টে ছিলেন। গানও শেখান। সাধনার বাবা-মা তার কাছেই ভর্তি করেছিলেন। সাধনা বড়, তার নীচে আরও এক ভাই আর বোন আছে। পড়াশোনার পাশাপাশি গান শিখত সে। তবে মাধ্যমিকে ফেল করায় আর পড়েনি। গান নিয়েই ছিল। যদিও ভাইবোনের পড়ার খরচ, সাধনার গান - বাড়ি থেকে পেরে উঠছিল না। চালিয়ে যাচ্ছিল কোনওমতে।
বেশ কয়েক বছর গান শেখার পর শিলিগুড়ি রেডিওয় গান গাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন মামা। সাধনা নন্দিতাকে বলেছিল, ‘জানিস, বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না আমি রেডিওয় গান গাইব। আমি সাধনা বিশ্বাস, হাজার হাজার লোক আমার গান শুনবে। ভেবে কী ভয়ই না পেয়েছিলাম প্রথমে। কিন্তু যখন গান রেকর্ড করে বেরিয়েছিলাম, অনেকেই প্রশংসা করেছিল। তারপর গান শুনে কয়েকজন ফোনও করেছিল। ভরসা পেয়েছিলাম। তখন ভেবেছিলাম আমার গানের অ্যালবাম বেরোবে, রেডিও আর টিভিতে আরও গাইব। কত মানুষ আমার গান শুনবে, নাম জানবে। গানই হবে আমার পরিচয়। সেসব তো কিছুই হল না।’
কথাটা বলে চুপ করে গিয়েছিল সাধনা। নন্দিতা জানতে চেয়েছিল, ‘প্রথম কী গান গেয়েছিলে?’
শুনেই সাধনা যেন চঞ্চল হয়ে উঠল। ‘শুনবি? দাঁড়া, শোনাই তোকে।’ বলে হারমোনিয়াম কোলের কাছে টেনে নিল।
‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান... তার বদলে...’
শেষ হওয়ার পর নন্দিতা বলল, ‘তুমি রবীন্দ্রসংগীত গাও না কেন?’
হারমোনিয়াম ঠেলে সরিয়ে সাধনা বলেছিল, ‘ও গান আমার গলায় আর আসে না রে।’
এখানে সাধনা নিজে কয়েকজন ছাত্রী জোগাড় করে বাড়ি বাড়ি গান শেখাতে যায়। তাদের মধ্যে কয়েকজন অবাঙালি মহিলা আছেন। শখে গান শেখেন। আর একটা অর্কেস্ট্রা গ্রুপে জয়েন করেছে সে। তারা মাঝে মাঝে শোয়ে ডাকে। কোনও পাড়ার পুজো, নানারকমের ফাংশন, বিয়ে কিংবা বউভাতের রিসেপশন, ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি, বাচ্চার জন্মদিন। অর্কেস্ট্রা গ্রুপের ডাক পড়লে সাধনাও যায়। তখন রাত করে মেসে ফেরে। চাবি খুলে ঢোকে। কয়েকবার কলকাতার বাইরে গিয়েও গান গেয়ে এসেছে।
নন্দিতা বলল, ‘এখানে তো হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাও, বাইরে গেলে কী কর?’
সাধনা বলল, ‘অর্কেস্ট্রায় তো মিউজিক হ্যান্ডের সঙ্গে গাই। হিন্দি গান। রিহার্সাল দিতে হয়। শোয়ের সময় ভুল-টুল হলেও ওরাই সব চাপা দিয়ে দেয়। হারমোনিয়াম ওখানে চলে না। নিয়ে বসলে লোকে হাসবে।’
ক্লাস সেভেন থেকে সাধনা মামার কাছে গান শিখছে। যখন তার বয়স সাতাশ-আঠাশ, তখন বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য চাপ দেওয়া শুরু করে। বাড়ির বড় মেয়ে। দু-একবার রেডিওয় গান গাওয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি। তার বিয়েটা হয়ে গেলে ছোট মেয়েকেও দিতে পারবে। বাবা একটা কারখানায় কাজ করতেন। এখন যদিও সে কারখানা বন্ধ। ছেলে গ্র্যাজুয়েশন করে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে ঢুকে গেছে। তার ওপরেই সংসার। সময় থাকতে মেয়েদের বিয়ে না দিলে ছেলেই বা বিয়ে করবে কী করে।
সাধনা তখন কারও কথা কানে তোলেনি। সব ফেলে মুম্বই পাড়ি দিয়েছিল। সেখানে এক বছর এ স্টুডিয়ো ও স্টুডিয়ো ঘুরে একটা সিনেমায় গান গাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু সেই সিনেমা রিলিজ করেনি। আর কোথাও সুযোগ করতে পারেনি সে। ওই এক বছর তার সব খরচ মামাই চালিয়েছিলেন। তারপর সাধনা চলে আসে কলকাতায়। মুম্বইয়ে সে লেডিস হস্টেলে থাকায় মামা গিয়ে থাকতে পারেননি। কলকাতায় এসে সাধনা একটা ঘর ভাড়া নিয়েছিল।
বাড়ি থেকে সাধনার বাবা-মা তখনও যোগাযোগ করেছিলেন। ‘গানের লাইনে কিছু করতে পারবি না, ফিরে আয়।’
ফিরতে চেয়েছিল সাধনা। তখন বোধহয় বুঝতে পেরেছিল, সে কিছুই করতে পারছে না। কিন্তু মামা ফিরতে দেননি। বলেছিলেন, ‘আমার এত বছরের পরিশ্রম, সব চেষ্টা ফেলে তুমি ফিরে যাবে! কত টাকা খরচ হয়েছে বলো তো আমার এতদিনে? এত অল্পে হার মানলে চলে না। জীবনে কিছু করতে গেলে লেগে থাকতে হয়। কত সম্পর্ক আসবে-যাবে। নিজের পায়ে দাঁড়াও। ফেলে আসা সম্পর্ক আপনি ফিরে আসবে।’
বাড়ি যাওয়ার কথা ভুলে সাধনা আবারও গানে মন দিয়েছিল। তার বাড়ির লোকজন প্রথম দিকে বীরেশ্বর রায়কে পছন্দ করলেও পরে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। রেডিয়োয় কয়েকবার গান গাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া ছাড়া আর করেছে কী লোকটা!
সাধনা একা হয়ে পড়ছিল। ভাড়াবাড়িতে থাকতে তার ভাল লাগছিল না। মামা বছরে দু-তিনবার এসে দশ-পনেরো দিন করে থেকে যান। তাছাড়া সারাবছর তার ঘরে সে একা। তাই সাধনা মেসে উঠে এসেছিল, অনেকের সঙ্গে থাকবে বলে। তবে এখানকার অন্য মেয়েদের থেকে সে অনেকটাই বড়। বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করে তেমন কিছু হয়নি। সবাই চাকরি করে। পল্লবীর প্রেমিক দিল্লি থেকে ফোন করত। নাগাড়ে কথা বলে যেত। বাকি সময় হোয়াট্সঅ্যাপ, ফেসবুক। যে যার মতো সময় কাটায়। সাধনা কারও কাছে মন খুলে কথা বলতে পারত না। সোনিয়া আর পল্লবী হিন্দিতে কথা বলত, আর গোলাপের সঙ্গে তেমন কথা বলা যেত না। নন্দিতার কাছেই মনের কথা বলত সে। এতদিনে নন্দিতা তাই তার অনেক কথাই জেনে গিয়েছে।
মামা মাঝখানে আরও একবার এসেছিলেন এই মেসে। সেদিন সাধনা তার সঙ্গে বেরিয়ে গিয়েছিল। ফিরল হাতে কয়েকটা প্যাকেট নিয়ে। অনেক কিছু নাকি কিনেছে। পল্লবী, সোনিয়া, গোলাপ সবাই ছিল তখন। তবু তার মধ্যেই লোকটার ছোঁকছোঁকানি বুঝতে অসুবিধে হয়নি নন্দিতার। ওরা খানিকটা কথা বলে চলে যাওয়ার পর সাধনা নন্দিতাকে বলল, ‘তুই একটু গল্প কর, আমি চা করে নিয়ে আসি।’
নন্দিতা সঙ্গে সঙ্গে বলেছিল, ‘আমি চা বানাচ্ছি। তোমরা বাইরে থেকে এলে, বোসো।’
‘করবি? আমি তা হলে বরং গা-টা ধুয়ে আসি।’
চা করতে গিয়েও মামাকে পিছুছাড়া করতে পারেনি নন্দিতা। রান্নাঘরে হাজির হয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি গান শিখবে? কিছু দিতে হবে না, এমনি শিখিয়ে দেব। এখানে এলে আলাদা দেখা করে শেখাব। সাধনাকে কিছু বলতে হবে না।’
নন্দিতা কঠিন হয়ে বলেছিল, ‘না।’
‘কেন?’
‘শিখতে চাই না বলে।’
‘তোমার গলা তো সুরেলা, বেশ মিষ্টি। সেই যে আগে এসেছিলাম, সেই থেকে আমার কানে বসে গেছে একেবারে।’
‘ওটা আপনার মনের ভুল। সাধনাদির গলা অনেক ভাল। ওকে তো শিখিয়েছেন।’
পিচ করে মুখে আওয়াজ করলেন বীরেশ্বর। ‘শিখিয়েছি, কিন্তু ওর কোনও কোয়ালিটি নেই। সেই জন্যই কোথাও কিছু করতে পারেনি। ওরকম কত ঘুরে বেড়াচ্ছে।’
চায়ের জল ফুটছে। নন্দিতা সেখানে থেকে চোখ সরিয়ে ঘুরে তাকিয়েছিল। লোকটা কী! পাশেই বাথরুমে রয়েছে সাধনাদি। যদি শুনতে পায়! গোলাপও শুনতে পেতে পারে। সেও তো কাছেই। বলল, ‘আপনি ঘরে যান।’
মামা নড়লেন না। ‘আমার কথাটা ভেবে দেখো। এখন আমি রিটায়ার করেছি। তবু কানেকশন তো আছেই। কত মেয়েকে কত চান্স করে দিয়ে তরিয়ে দিলাম। ফেঁসে গেলাম শুধু এর কাছেই। তোমার ফোন নম্বরটা দিও তো।’
‘আমি সবাইকে নম্বর দিই না।’
‘আরে দিও। ভয় কীসের? ফোনে তো শুধু কথাই বলা যায়, আর তো কিছু করা যায় না। আমি কথাই বলব। সত্যি বলছি, তোমায় আমি ভুলতে পারছি না। তোমায় আবার দেখব বলেই তো এখানে এলাম।’
বাথরুমের দরজায় খট করে আওয়াজ হতেই নন্দিতাকে আর কিছু বলতে হল না। সাধনা বেরিয়ে মামাকে দেখে বলল, ‘তুমি আবার এখানে কী করছ? চলো, ঘরে চলো। ওকে কাজ করতে দাও।’
নন্দিতা বুঝতে পারেনি সাধনাদি সেদিন মামার কথাগুলো শুনতে পেয়েছিল কিনা। বাড়ির সঙ্গে সাধনার যোগাযোগ এখন কমে এসেছে। ছোট বোনের বিয়ে হয়েছে, ভাইও বিয়ে করে নিয়েছে। মাঝে মাঝে তারা ফোন করে সাধনার খোঁজখবর নেয়। সে কখনওসখনও গিয়ে সবার সঙ্গে দেখা করে আসে। নিজের বাড়িতেই ঘুরে আসার মতো।
বীরেশ্বর রায়ের বয়স হয়ে গিয়েছে। বাড়িতে বউ একা। তাকে সময় দিতে হয়। এক মেয়ে, তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ছেলে বিদেশে চাকরি করে। বিয়ের পর বউ নিয়ে গিয়েছে সঙ্গে।
মেসে থাকতে থাকতে সাধনা নিজেই নিজের বিয়ের চেষ্টা করছিল। খবরের কাগজে পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন থেকে ফোন নম্বর নিয়ে কখনও পাত্রীর দিদি সেজে, কখনও পাত্রীর মা সেজে ফোন করত। একবার নন্দিতা শুনতে পেয়ে বলে ফেলেছিল, ‘কার বিয়ের কথা বলছ দিদি?’
সাধনা সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল চেপে ধরে ঠোঁটে আঙুল রেখেছিল। পরে বলেছিল, ‘কী করব বল, আমার হয়ে কে আর চেষ্টা করবে!’
ফোনে কথা বলে সাধনা কয়েকজনের সঙ্গে দেখাও করতে গেছে কয়েকবার। নন্দন, ময়দান কী কোনও রেস্তোরাঁয়। একবার তো ছেলের মা-বাবা মেসেই মেয়ে দেখতে চলে এসেছিলেন। কিন্তু কেউ পছন্দ করেনি। একে তো বয়েস হয়ে গেছে, তার ওপর খাটো আর মোটা। ভুঁড়িটাও বোঝা যায়। রং শ্যামলা, মাথার চুল পাতলা বলে কাঁধের কাছ থেকে কেটে রাখে। মুখে মেকাপ করে করে স্কিনও নষ্ট করে ফেলেছে।
তবুও একজন সাধনাকে পছন্দ করল। বয়স সাতচল্লিশ-আটচল্লিশ হবে। ছোট একটা অ্যাড এজেন্সিতে বিজ্ঞাপনের ডিজাইন করে। দশ-বারো হাজার টাকা মাইনে। বাবার রেখে যাওয়া একটা এক কামরার ফ্ল্যাটে মাকে নিয়ে থাকে। ভাই-বোন কেউ নেই। মা অসুস্থ। মাকে রেখে সে অফিস করতে পারে না ঠিকমতো।
সাধনাই বলেছিল, ‘ওদের বাড়িতে একজন লোক চাই যে মায়ের দেখাশোনা করবে, বুঝলি। যার কাছে মাকে রাখা যাবে। দেখি, যদি এটা হয়ে যায়।’
দেবাশিস সাহা সাধনাকে পছন্দ করেছে। সে সাধনাকে নিয়ে গিয়েছিল তার ফ্ল্যাটে। মায়ের সঙ্গে দেখা করাতে। মায়ের চিন্তার শেষ নেই। ছেলের বয়স হয়ে গেছে, বিয়ে হল না এতদিনেও। মহিলা শান্তিতে শ্বাস ফেলতে পারছিলেন না। গাইয়ে মেয়ে, ছেলেও তার অবসর সময়ে ড্রাম বাজায়, দুজনে মিলবে ভাল। নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন তিনি।
একদিন সন্ধেবেলা অফিস থেকে ফিরে রাস্তা থেকেই নন্দিতা শুনতে পাচ্ছিল সাধনাদির গলা। হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইছে - ‘তুম আ গয়ে হো, নুর আ গয়া হ্যায়...।’
ঘরে ঢুকেই নন্দিতা সাধনাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কী দিদি, আজ এত খুশি কেন?’
সাধনা গান বন্ধ করে রান্নাঘরে চলে গেল। তারপর একটা প্লেটে পরোটা আর চানার তরকারি এনে নন্দিতার হাতে ধরিয়ে দিল। তার আনন্দের কারণ জানাচ্ছিল। অনেক কথা একসঙ্গে। দেবাশিসের বাড়িতে গিয়েছিল। তার মাকে মা বলে ডেকে এসেছে। তারপরেও কয়েকবার সাধনা দেখা করেছে দেবাশিসের সঙ্গে। তার অফিস ছুটির পর দুজনে ময়দান, ভিক্টোরিয়ায় ঘুরেছে। সাধনা কয়েকবার রান্নাও করে নিয়ে গিয়েছিল দেবাশিসের বাড়ি। তার হাতের রান্না পছন্দ হয়েছে ওদের। এখন মামা এসে দেবাশিসকে পছন্দ করলেই বিয়ে। দিন কয়েক পর মামাকে নিয়ে শিলিগুড়ি থেকে ফিরে এল সাধনা। নন্দিতা একটু আড়ালে বলল, ‘মামাকে গোলাপের রুমে থাকতে দাও দিদি। সামনের ঘর দিয়ে ঢোকা-বেরোনো করতে হয়। উনি এই রুমে না থেকে পাশের রুমে থাকুন।’
সাধনা মাথা নেড়ে বলল, ‘না রে, বয়স্ক মানুষ। রাতে যদি জল-টল কিছু হাতের কাছে লাগে। আসার সময় মামি বারবার করে বলে দিয়েছে - খাওয়া, ঘুম কোনও কিছুরই যেন অনিয়ম না হয়। আমার ভরসায় ছেড়েছে।’
মামা আসার পর সাধনার জীবনই যেন বদলে গেল। খাওয়াদাওয়া, ঘোরা, সাজগোজ - সবেরই বদল ঘটেছে। নন্দিতাকে একদিন পাঁঠার মাংসের ঝোলভাতও খাইয়ে দিল। নন্দিতার ভাল লাগছিল না, তবু সাধনার খারাপ লাগবে ভেবে ওদের সঙ্গে বসেই খেতে হল। মামা নানারকম ঠাট্টা করার চেষ্টায় ছিলেন। নন্দিতা হুঁ হাঁ করে খেয়ে উঠে গেল।
তবে তার পরের রবিবার যা হলো, সেটা আর ঠাট্টা হিসেবে নিতে পারল না নন্দিতা। রবিবার শান্তনু দেখা করতে পারে না। মেসেই থাকতে হয় নন্দিতাকে। সাধনা গান শেখানোর টিউশনে যাওয়ার আগে তাকে বলল, ‘তুই যখন চা খাবি, মামাকেও এক কাপ করে দিস।’
বিকেলের দিকে বাড়িতে ফোন করেছিল নন্দিতা। কথা শেষ হওয়ার পর চা করে মামাকে দিতে গেল। খাটে রেখেই চলে আসছিল। ফাঁকা ঘর। মামা বললেন, ‘চলে যাচ্ছ কেন? আমায় কি একেবারেই পছন্দ নয়? এসো না, দুজনে বল ড্যান্স করি।’
নন্দিতা ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, ‘আপনি কি নাচতেও পারেন না কি?’
লোকটার মাথার সামনের দিকে গোটাটাই টাক। পিছন দিকের চুল টেনে এনে পেতে রাখা। কলপ করা সেই চুলে হাত বুলিয়ে বীরেশ্বর বললেন, ‘আমায় বুড়ো মনে কোরো না। ভেবো না কিছু পারি না। ইয়ংদের থেকে ভাল পারি। সব করতে পারি। দেখবে ট্রাই করে?’
নন্দিতার মনে হল তার রক্তের স্রোত উলটো দিকে বইতে শুরু করেছে। কী ভাবে নিজেকে এই লোকটা? মেয়ে দেখলেই লাল পড়ে! গা পাকিয়ে উঠেছিল তার। সোজা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। খুলেছিল একেবারে সাধনা ফেরার পর। একবার ভেবেছিল বলে দেবে। বললেও কি বিশ্বাস করবে সাধনাদি? না কি সে জানে? তাড়াতাড়ি বিয়েটা হয়ে গেলে বেঁচে যাবে বোধহয়।
দেবাশিসের মায়ের সঙ্গে কথা বলতে গেলেন বীরেশ্বর রায়। সাধনাও যেতে চেয়েছিল কিন্তু মামা তাকে ঘরে রেখে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে গম্ভীর মুখ করে বললেন, ‘এখানে তোমার বিয়ে হবে না। ছেলেটি ভাল নয়।’
সাধনা ভেঙে পড়ল। মামা হ্যাঁ করলেই বিয়েটা হয়ে যায়। সে এতবার দেবাশিসের সঙ্গে দেখা করেছে, বাড়িতেও গেছে। তার মা এবং তাকে তো খারাপ বলে মনে হয়নি।
নন্দিতার কাছে এসে সাধনা বলল, ‘তুই একবার মামাকে বুঝিয়ে বল, দেবাশিস কিসে খারাপ?’ সাধনার চোখে জল। দেখে অসহায় লাগছিল নন্দিতার। চাইলে নিজেই তো বিয়ে করে নিতে পারে। মামার কথা শুনছেই বা কেন? কথাটা বলে ফেলতেই সাধনা বলল, ‘না রে, মামা না চাইলে হবে না।’
লোকটার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে ছিল না। তবু নন্দিতা গিয়ে বলল, ‘সাধনাদি নিজে মুখে আপনাকে বলতে পারছে না। ও দেবাশিসকেই বিয়ে করতে চায়। আপনি ওর বিয়ে ওখানেই দিয়ে দিন।’
সাধনা পাশের ঘরে। বীরেশ্বর খাট থেকে নেমে এসে নন্দিতার দুটো হাত চেপে ধরে ফিসফিস করে বললেন, ‘ওর বিয়ে দিয়ে দেব। তুমি আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে বলো! ওর সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে তোমার সঙ্গে কেন দেখা হল না!’
এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চলে এল নন্দিতা।
মামা কেন বিয়ে ভেঙে দেওয়ার কথা বলেছেন, সেই কারণটা সে বুঝতে পেরেছিল রাতে। বাথরুমে যাবে বলে উঠেছিল। আলো না জ্বালিয়েই এসে দাঁড়িয়েছিল ঘরের বাইরে। পাশেই সাধনার ঘরের দরজা। ভেতর থেকে বন্ধ। কীরকম আওয়াজ ভেসে আসছে সেখান থেকে। তারপর চাপা গলার কথাও এল কানে। প্রথমে সাধনাদি, তারপর মামা।
‘ও ঘরে নন্দিতা আছে কিন্তু, আস্তে।’
‘আরে কিছু হবে না। ও ঘুমিয়ে পড়েছে।’
বাথরুমে না গিয়ে ঘরের দরজার পাল্লা কোনওমতে জুড়ে দিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়েছিল নন্দিতা। তার সন্দেহটাই তাহলে ঠিক!
কয়েকদিন পর মামা বাড়ি চলে গেলেন। তারপর তাকে না জানিয়ে খবরের কাগজে ‘পাত্র চাই’ বিজ্ঞাপন দিয়ে দিল সাধনা। মেসে যতক্ষণ থাকে, নন্দিতা শুনতে পায় যখন তখন তার ফোন বেজে উঠছে। সে কখনও পাত্রীর মা, কখনও দিদি অথবা পিসি সেজে কথা বলছে। নন্দিতাকেও শিখিয়ে পড়িয়ে দু-একবার ফোনে কথা বলিয়ে নিল। বলল নন্দিতা। যদি কোথাও লেগে যায়।
মাঝে একদিন বাড়িওয়ালি এসেছিলেন। কোনও মেয়ে পাননি। বলে গিয়েছেন, ‘হয় তোমাদের ভাড়া বাড়াতে হবে, নয় তো আমি বেশি টাকায় কোনও ফ্যামিলিকে ভাড়া দেব।’ নন্দিতা এখানে আর থাকতে চায় না। সে জানিয়ে দিল অন্য জায়গায় ভাড়া দেখে ছেড়ে দেবে। কাছেই এক দোকানি বাড়ির দালালিও করে। তাকে খোঁজ করতে বলল। সাধনাকেও বলে দিল, ‘দিদি, আমি ভাড়া বাড়াতে পারব না। মেস ছেড়ে দিচ্ছি। এর চেয়ে সিঙ্গল রুমে থাকা ভাল।’
সাধনা বলল, ‘আবার কেন ঘর খুঁজছিস? শান্তনুকে বল না এবার বিয়েটা করে নিতে। তোর তো পঁচিশ-ছাবিবশ হয়ে গেল। বিয়ে করবি না? গেলে নিজের ঘরে যা।’
‘নিজের ঘর তো আমার দেশের বাড়ি।’
‘শ্বশুরবাড়ি নিজের ঘর হতে পারে না? এখানে পড়ে থাকিস না। নয়তো আমার দশা হবে।’
নন্দিতা কিছু বলতে পারছিল না। সান্ত্বনার কথা বলার কোনও মানে হয় না। তখন সাধনা আবার বলল, ‘তুই ছেড়ে চলে গেলে আমি একদম একা হয়ে যাব রে। কী করব আমি! আমায় তো রাখবে না। রুম ছেড়ে দিতে হবে। কোথায় যাব?’
দালাল ঘরের খবর এনে দিল তিনদিনের মধ্যে। এখান থেকে বেশি দূরে নয়। একটা ঘর, রান্নাঘর আর বাথরুম ভেতরেই। ভাড়াও কম। শান্তনু বলল, ‘চিন্তা কোরো না। কিছুদিন থাকো। বাড়িতে তো বলেছি তোমার কথা। এবার চলো একদিন। বাবা বলেছে, তোমার বাবা-দাদার সঙ্গে কথা বলবে তারপর।’
জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য শান্তনু আসতে চেয়েছিল। নন্দিতা না করেছে। সে নিজেই পারবে। এমন কিছু তো নেই। দালাল এক চেনা ভ্যানওলা ঠিক করে দিয়েছে। একবারেই উঠে যাবে সব। নন্দিতাও পিছনে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাবে। যতক্ষণ মালপত্র ভ্যানে উঠছিল, সাধনা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে। একটাও কথা বলেনি। ভ্যানওলা দড়ি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাঁধছিল। নন্দিতা কাছে গিয়ে সাধনাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘চলি দিদি।’ সাধনা বাইরের ছোট লোহার গেটের আংটা ফেলে দিতেই টুং করে শব্দ হল। সে শুধু বলল, ‘আয়।’ তারপর চুপ করে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিল।
ভ্যানওলা গাড়ি টানতেই কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছিল বইয়ের বাক্সটা। এখানে থাকতে থাকতে কিছু বই কেনা হয়ে গেছে নন্দিতার। পড়তে ভাল লাগে তার। সে তাড়াতাড়ি গিয়ে চেপে ধরল। ‘কী করছেন কী? ঠিক করে বাঁধেননি? পড়ে গেলে নষ্ট হয়ে যাবে তো।’
দড়ি ঘুরিয়ে আবার গিঁট দিতে গিয়ে সময় লাগল। তারপর সব দেখে নিয়ে নন্দিতা বলল, ‘হয়েছে, চলুন এবার।’
আস্তে আস্তে গড়াতে শুরু করল ভ্যানরিকশাটা। নন্দিতাও হাঁটতে শুরু করেছে। তখনই সে শুনতে পেল, ছেড়ে আসা বাড়িটার ভেতরের ঘরে সাধনা হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান ধরেছে। 'এই কথাটি মনে রেখো… তোমাদের এই হাসিখেলায়… আমি যে গান গেয়েছিলেম… জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়…'
নন্দিতার কানে আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে আসছিল সেই গান।