(১)
দরজার আওয়াজে বিছানায় শুয়েই চোখ খুলল মেখলা। মরচে রঙের পর্দা ভেদ করে সকালের নরম রোদ এসে সাদা ধবধবে বিছানায় হলদেটে ছাপ ফেলেছে। আজকাল অসহ্য লাগে এই দিনের আলো। শিখাকে বহুবার বলার পরেও সকালে এসে এই জানলা খুলে দেওয়াটা দিনদিন ওর রাগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। গরম কফির গন্ধটা নাকে আসতেই স্নায়ু একটু শান্ত হয়। পাশের টেবিলে ধোঁয়া ওঠা কফির কাপটা রেখে শিখা ঘর থেকে বেরোতে উদ্যত হতেই মেখলা বলে ওঠে, "কতদিন ধরে আমার কথা অগ্রাহ্য করে চলেছিস সেটা মাথায় আছে? কতবার বলেছি দিনের আলো আমার সহ্য হয় না! এটা আটকানোর জন্য কাচের জানলার সাথে কাঠের জানলা লাগিয়েছি সেটাও তোর কাছে অজানা নয়। তাও শুনবি না কথা।"
"দিদি, আজকের দিনটা অন্যদিনের থেকে একটু আলাদা, বিশেষ দিন, তাই…"
"বাবা চলে যাবার পর থেকে আমার জীবনে বিশেষ দিন বলে কিছু নেই।"
"রাজ আঙ্কেল তোমার মোবাইল বন্ধ দেখে বাড়ির ল্যান্ড ফোনে ফোন করেছিলেন। তুমি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। সকাল দশটা নাগাদ আসবেন বলেছেন উনি।"
"আঙ্কেল কলকাতায় এসেছেন! আমাকে তো জানান নি!"
"তুমি রাগ করবে বলে বলিনি দিদি। কাকু চলে যাবার পর থেকে তোমার যা অবস্থা হয়েছে সেটা চোখে দেখা যায়না। দিনের পর দিন অফিস যাচ্ছ না, ঠিকমত খাচ্ছ না, পারলে সারাদিন ঘর অন্ধকার করে বিছানায় শুয়ে আছ। আমি আর থাকতে না পেরে রাজ আঙ্কেলকে ফোন করে সব বলেছিলাম।"
"বাহ্! তোর কথায় রাজ আঙ্কেল সেই কানাডা থেকে চলে এলেন?"
শিখা উত্তর না দিয়ে কাঠের পুতুলের মত একপাশে দাঁড়িয়ে রইল। মুখে যাই বলুক, রাজ আঙ্কেল আসছেন শুনে ওকে ইশারায় ঘরের বাইরে যেতে নির্দেশ করে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতেই পোশাকটা বদলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে একতলায় নেমে সোফায় বসে মোবাইল ঘাঁটতে শুরু করল। আবার কিছুক্ষণ পরেই মোবাইলটা একপাশে ছুড়ে ফেলে সেন্টার টেবিল থেকে খবরের কাগজটা টেনে নিয়ে শেয়ার মার্কেটের পাতায় মনোনিবেশ করল।
(২)
মেখলা রায়, অল্প বয়সেই বিদেশী ব্যাঙ্কের কলকাতা শাখায় উচ্চপদে আসীন। খুব ছোটবেলায় মাতৃহীন হলেও বিত্তশালী পিতার কড়া অনুশাসনে ছোট থেকে সব পরীক্ষায় প্রথমদিকে থাকার ফলে ম্যানেজমেন্ট পাশ করে এই চাকরিটা জোগাড় করতে কোনও অসুবিধাই হয়নি।
বাবার আদরের দুলালী মেখলার ছোটবেলা থেকেই বন্ধুবান্ধব কম, নিজের মনে থাকতেই ভালোবাসে। বাবা আর মেয়ের ছোট সংসার কিছু কাজের লোকজন নিয়ে বেশ ভালোভাবেই চলছিল। দুজনেই ব্যস্ত থাকত নিজেদের কাজ নিয়ে। সমস্যাটা শুরু হলো সেদিন থেকে, যেদিন হঠাৎ বুকে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে অনিমেষ রায় আর বাড়ি ফিরলেন না। অভিজাত পাড়ার ডুপ্লেক্স বাংলো আর বহু কোম্পানির শেয়ারের একমাত্র মালকিন হয়েও মেখলা বাবার অভাবে নিঃস্ব হয়ে গেল। বছর দশেক ধরে ওদের বাড়িতে দেখাশোনার কাজ করতে এসে আত্মার বন্ধনে জড়িয়ে পড়া শিখা হয়ে দাঁড়াল মেখলার একমাত্র সঙ্গী।
কাজপাগল মেখলা দিনের পর দিন অফিস কামাই করতে শুরু করল, সাথে নিজের প্রতি চরম উদাসীন হয়ে গেল। ঠিকমত খায় না, স্নান করে না, একই জামা দিনের পর দিন পরে থাকে, আর দিনের আলো যেন মেখলার চোখে অসহ্য লাগে। দিন পনেরোর মধ্যেই তাকে দেখে গুরুতর অসুস্থ মনে হতে লাগল।
অনেক ছোটবেলা এবাড়িতে কাজ করতে এসে ভালোবাসার মানে নতুন করে জেনেছে শিখা। তাই অন্য কাজের লোকজনের মত আড়ালে আলোচনা না করে সোজা রাজ আঙ্কেলকে ফোন করল। উনি অনিমেষ বাবুর ছোটবেলার বন্ধু, এবাড়ির তিনটে বাড়ি পরেই ওঁর বাংলো। সপরিবারে রাজ আঙ্কেল বহুবছর হল কানাডা নিবাসী। মাঝেসাঝে অনিমেষ-মেখলাকে নিয়ে কানাডায় ঘুরতে যেতেন, নিজেও মাঝেমধ্যে কলকাতায় আসতেন। ওঁকে ছাড়া এদের কোন কাছের আত্মীয়স্বজনকে শিখা বহুবছর দেখেনি। নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত অনিমেষ রায় কারোর সাথে খারাপ ব্যবহার না করলেও দিনের পর দিন যোগাযোগ না করার ফলে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। শুধুমাত্র রাজ আঙ্কেলই ছিলেন ওঁর আত্মজন।
কানাডায় নিজের রেস্তোরাঁর কাজের ব্যস্ততার জন্য অনিমেষবাবুর মৃত্যুতে না আসতে পারলেও কন্যাসম মেখলার এই অবস্থা শুনেই তিনদিনের মধ্যে কলকাতায় চলে এসেছেন রাজ।
(৩)
এখন মেখলার জাগতিক কোন বিষয়ে বিশেষ আগ্রহ নেই, তাই বাবার রেখে যাওয়া শেয়ারগুলোর প্রতিও ঠিকমত নজর দিতে পারছে না। আজ কাগজে শেয়ারের খবর দেখে মনে হচ্ছে বেশ কিছু শেয়ার অবিলম্বে বিক্রি করে দেওয়া দরকার, কিন্তু কোনও কাজ করার সেই জোরটাই যে পাচ্ছে না।
রাজ আঙ্কেলের স্নেহমিশ্রিত স্বরে, "সোনামা, এ কী চেহারা করেছ?" শুনে সম্বিত ফিরল মেখলার। বিশাল চেহারার রাজ আঙ্কেল পুরো দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছেন দেখে ছোট শিশুর মত ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল সে। পরক্ষণেই পেছনে একজন সুন্দর চেহারার যুবককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লজ্জা পেয়ে নিজেকে সামলে নিল।
আঙ্কেল সোফায় বসেই গমগমে স্বরে মেখলাকে বললেন ড্রাইভারকে খবর দিতে, ওকে নিয়ে নাকি কোথায় যাবেন। ওর এখন বাইরে বেরোতে একদম ভালো লাগে না, তবুও আঙ্কেলের কথায় বাধ্য মেয়ের মতো শিখাকে ডেকে ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলল।
শিখা এসে আঙ্কেলকে, সঙ্গের ছেলেটাকে আর মেখলাকে জলখাবার দিয়ে গেল। খেতে খেতেই রাজ আঙ্কেল ছেলেটাকে নিজের ভাগ্নে বলে পরিচয় দিলেন। মেখলার মনে পড়ল, খুব ছোটবেলায় একে দেখেছে দু-একবার। কানাডায় আঙ্কেলের ভারতীয় রেস্তোরাঁর খুব নামডাক হয়ে গেছে, তাই এখন আর এদেশে বিশেষ আসা হয় না। অনিমেষবাবুই বছর দুয়েক আগে শেষবারের মত মেয়েকে নিয়ে বন্ধুর সাথে দেখা করতে কানাডায় গেছিলেন। তাই এই ভাগ্নেকে বহুবছর না দেখে মেখলা ভুলে গেছিল, আঙ্কেলের কথায় মনে পড়ল এর নাম অর্জুন।
অর্জুনের চেহারার মধ্যে একটা আকর্ষণীয় ব্যাপার আছে, টানটান নির্মেদ চেহারা, তার সঙ্গে উজ্জ্বল দুটো সপ্রতিভ চোখ। আঙ্কেলের সাথে কথা বলতে বলতেই মেখলা অনুভব করল, দুটো চোখ ওকে আড়চোখে দেখছে। নিজের পরনের কোঁচকানো সুতির ট্রাউজার আর রংজ্বলা কালো রঙের টি-শার্টের জন্য এবার মেখলার একটু লজ্জাই লাগছিল। ও আগে কখনোই এমন পোশাক পরত না, আজকাল সত্যিই যেন কেমন একটা হয়ে যাচ্ছে।
রাজ আঙ্কেল আর অর্জুনের খাওয়া হয়ে যেতেই আঙ্কেল মেখলাকে খাবার শেষ করার জন্য তাড়া দিতে শুরু করলেন। ও ফেলে ছড়িয়ে খেয়ে আঙ্কেলের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল।
(৪)
শহরের নামকরা হাসপাতালে পৌঁছে মেখলা জানতে পারল, ওকে আঙ্কেল মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে এসেছেন। সেই শুনে ও গাড়ি থেকে নামতেই চাইছিল না। আঙ্কেল অনেক করে বুঝিয়ে ওকে চিকিৎসকের চেম্বারে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার বটব্যালকে দেখে মেখলার মনের সব ভয় দূর হয়ে গেল। দেখেই মনে হচ্ছে, এঁকে ভরসা করা যায়। ডাক্তারবাবু ওর অনেক কথা শুনলেন। মেখলারও বাবা চলে যাবার পর থেকে মনের সব জমা কথা এঁকে বলে বেশ হালকা লাগছিল।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আঙ্কেল ওদের দুজনকে একটা নামকরা বাঙালি রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ করিয়ে, ডাক্তারের দেওয়া সব ওষুধ কিনে মেখলাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেলেন। সেইদিন থেকে শিখা বেশ মনোযোগ সহকারে ওষুধগুলো মেখলাকে সময়মতো খাওয়াতে লাগল। তাছাড়া, রাজ আঙ্কেলও দিনের মধ্যে একবার অন্ততঃ এসে ওকে দেখে যেতে লাগলেন।
মাঝেমধ্যে অর্জুনও আঙ্কেলের সাথে আসত মেখলাকে সঙ্গ দিতে। অর্জুনের চোখের দৃষ্টিতে একটা আলাদা টান খুঁজে পেত মেখলা। শুধুমাত্র ওর চোখে সুন্দর থাকার জন্য আবার স্বাভাবিক সাজগোজ শুরু করে দিল। যখনই বাবার জন্য মন খারাপ হতো, আঙ্কেলের বাড়িতে গিয়ে গল্প করে আসত। মাঝেমধ্যে তিনজনে মিলে রেস্তোরাঁয় খেতে বা সিনেমা দেখতে যেত। এইভাবে চলতে চলতে কয়েকদিনের মধ্যেই কাজপাগল মেখলা আবার নিয়মিত অফিসে যেতে লাগল। কাজের জগতে ফিরে এসে নতুন উদ্যমও ফিরে পেল।
মাসখানেক পরে রাজ আঙ্কেলের কানাডায় ফেরার সময় হয়ে এল। যতই ছেলেরা ব্যবসা সামলে নিক, নিজের পরিবার, ব্যবসা ছেড়ে আর কতদিন থাকতে পারেন! মেখলার মনটা আবার বিষন্ন হয়ে গেল। পিতৃস্থানীয় আঙ্কেলের সাহচর্যে ওর অবসাদ অনেকটা কেটে গেছিল। আঙ্কেল মেখলাকে অনেকবার ওঁর সাথে কানাডায় নিয়ে যেতে চাইলেও ও রাজি হলো না। অফিসের কাজে অনেক ফাঁকি পড়েছে, এখন আর ওর পক্ষে ছুটি নেওয়া সম্ভব নয়। যাবার সময় আঙ্কেল বলে গেলেন, কোনও দরকার পড়লে যেন অর্জুনকে ফোন করে ডেকে নেয়।
(৫)
আঙ্কেল চলে যাবার পর প্রায় প্রতিদিনই নিজে থেকে সন্ধ্যেবেলা অর্জুন মেখলার খবর নিতে আসতে শুরু করল। অফিস থেকে ফিরে এই সময়টার জন্য মেখলা অপেক্ষা করে থাকত। অর্জুনের মধ্যে যে কোনও পরিস্থিতিকে হাসি-ঠাট্টার মাধ্যমে হালকা করে দেওয়ার ক্ষমতার জন্য নৈকট্য বাড়তে সময় লাগল না। দিনে দিনে দুজনে মনের দিক থেকে অনেক কাছাকাছি চলে এল। অর্জুন ওকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাওয়া থেকে ওষুধ কিনে আনা, সব মন দিয়ে করতে লাগল। দুজনে মিলে অনেক রাত পর্যন্ত হুইস্কির গ্লাস নিয়ে আড্ডা দেওয়াটা অত্যন্ত স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়াল।
মুখে কিছু না বললেও হাবেভাবে মেখলার মনে হতো, শিখা অর্জুনকে ঠিক সহ্য করতে পারছে না। একদিন রাজ আঙ্কেলের ফোনে মেখলা বুঝতে পারল যে, শিখা আঙ্কেলকে ওর সাথে অর্জুনের মেলামেশার কথা জানিয়েছে। আঙ্কেল ওকে বললেন, অর্জুনরা বন্ডেল রোডের কাছে নিম্নবিত্ত এলাকায় থাকে, ও বাড়িতেই ছোটখাটো ডিটিপির কাজ করে। মেখলার সাথে বিত্তের প্রভূত তফাৎ, তাই যেন বুঝেশুনে মেশে। আঙ্কেলের কথার কোন প্রতিবাদ না করলেও সেদিনই অর্জুনকে বিয়ের প্রস্তাব দিল মেখলা। অর্জুন যেন ওর প্রস্তাবের জন্যই অপেক্ষা করছিল। পরের দিন দুজনে মিলে ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিসে গিয়ে নোটিশ দিয়ে এল।
সেদিন অনেক রাতে রাজ আঙ্কেল উত্তেজিত হয়ে ফোন করে বিয়ে না করতে বললেন। ওঁর বক্তব্য ছিল, অর্জুনকে উনি অনেক টাকা দিয়েছিলেন ব্যবসা করতে, যা ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে ফূর্তি করে উড়িয়ে দিয়েছে। মেখলার উচিৎ নিজের সমমর্যাদার একজন ছেলেকে বিয়ে করা। মেখলা অনেক কষ্টে ভদ্রভাবে ফোনটা রেখে দিল, অবশ্য ওর সিদ্ধান্ত যে বদলাবে না, সেটাও জানিয়ে দিল। মনে মনে বেশ বুঝতে পারল, শিখাই আঙ্কেলকে ওদের ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিসে যাওয়ার কথা জানিয়েছে।
(৬)
পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই শিখাকে ডেকে এক মাসের বেতন অগ্রিম দিয়ে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিল মেখলা। শিখার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, ও যেন নিজের চোখ-কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ও নিজেকে এই পরিবারের একটা অংশ বলেই মনে করত। মেখলারও মনটা একটু খারাপ লাগছিল, তবুও মুখে কোনও ভাবান্তর আসতে দিল না। শিখা অবিশ্বাস-ভরা চোখে ওকে দেখতে দেখতে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল।
শিখা ছাড়া অন্যান্য কাজের লোকজন কেউ রাতে থাকে না বলে অর্জুন মেখলার একাকীত্ব দূর করতে রাতেও থেকে যেতে শুরু করে দিল। জীবনের অন্য একটা মানে খুঁজে পেল মেখলা। একমাস পরে সাদামাটা ভাবে দু'পক্ষের কয়েকজন বন্ধুর উপস্থিতিতে মেখলা আর অর্জুনের বিয়ে হয়ে গেল। শুরু হল নবদম্পতির সাংসারিক জীবন। অর্জুনকে মেখলা দু-একবার ওর বাড়িতে নিয়ে যেতে বললেও অর্জুন এড়িয়ে যেতে লাগল। ওর বাড়িঘরের দৈন্যদশা কল্পনা করে মেখলাও আর জোর করল না।
(৭)
ছোটবেলা থেকেই বিছানা ছাড়ার আগে হাতে ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ নিয়ে শিখা চলে আসত। ওর অনুপস্থিতিতে মেখলাকে নিজেই সকালে উঠে অফিস যাওয়ার আগে নিজের কফি, অর্জুনের জন্য চা, ব্রেকফাস্ট সব বানাতে হয়। রান্নার মাসি একটু বেলায় আসে রান্না করতে। প্রথম প্রথম খুব একটা অসুবিধা না হলেও বেশ কিছুদিন চলার পর এটা একটা বোঝা বলে মনে হতে শুরু করল মেখলার।
মেখলা অফিস যাওয়ার আগে অর্জুন ঘুম থেকেও ওঠে না, যেন সব মেখলার একার দায়িত্ব। থাকতে না পেরে একদিন মেখলা অনুরোধের সুরে বলল, "সকালে শুয়ে না থেকে আমায় একটু হাতেহাতে সাহায্য তো করতে পারো।" এই সামান্য কথায় অর্জুন ভয়ানক রেগে গিয়ে বলল, "এত অসুবিধা যখন, শিখাকে ছাড়ালে কেন? নতুন একটা কাজের লোক রাখ। আমি কি তোমার কাজের লোক?"
মেখলার মাথাও গরম হয়ে গেল। না খেয়েই অফিসে চলে গেল। সেই দিনের পর থেকে অর্জুনের হাবভাবে কিছু পরিবর্তন দেখা দিতে শুরু করল। ভালো করে কথা বলে না, মাঝেমাঝেই রাতে বাড়ি ফেরে না। নিজের বাড়িতে নিজেই উপেক্ষিত হতে হতে একদিন মেখলা অর্জুনকে ডেকে জানিয়ে দেয়, বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে সে। অর্জুন যেন বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। কথাগুলো বলার পর সে রাতেই মেখলা নিজের শোবার ঘর আলাদা করে নেয়।
অর্জুনের হাবভাবে কোনও পরিবর্তন দেখতে পায় না মেখলা। উপরন্তু তার পর থেকে ওকে না বলেই টাকা সরাতে শুরু করে। একদিন তো ওদের ড্রয়িং রুমে রাখা একজন বিখ্যাত শিল্পীর আঁকা বহু মূল্যবান একটা ছবি সরিয়ে ফেলে বেচে দেয়! সেদিন মেখলা অফিস থেকে ফিরে আর নিজেকে সামলাতে না পেরে আজন্ম লালিত শিক্ষা রুচি ভুলে অর্জুনের গালে সপাটে চড় কষিয়ে দেয়।
(৮)
সেই রাতে কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না মেখলার। আশেপাশে কেউ নেই যাকে এই সমস্যার কথা বলতে পারে। এই অর্জুনের জন্য শিখা আর রাজ আঙ্কেলকেও পর করে দিয়ে বড় ভুল করেছে। এখন অনুতাপ ছাড়া উপায় নেই।
চিন্তাভাবনার মাঝেই কখন ঘুমে চোখ জুড়িয়ে এসেছে, খেয়াল নেই। হঠাৎ ওর ঘরের দরজার পাশেই কারোর পা ঘষটে ঘষটে চলার আওয়াজে ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসল। নাইট ল্যাম্পটা হাত বাড়িয়ে জ্বালাতে গিয়ে বুঝল লোডশেডিং হয়ে গেছে, এতক্ষণে খেয়াল হলো, এয়ার কন্ডিশনারটাও কখন যেন বন্ধ হয়ে গেছে, বুঝতেই পারেনি। বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা তুলে নিয়ে আলো জ্বালিয়ে দরজা খুলে প্যাসেজে কাউকেই দেখতে পেলনা, অর্জুনের ঘরের দরজাও বন্ধ আছে।
সবে দরজা বন্ধ করতে যাবে, এমন সময়ে একটা ভয়ঙ্কর জোরে থালা বাসন পড়ার আওয়াজ শুনে ভয়ের চোটে তাড়াহুড়ো করে দরজা বন্ধ করে ঘরে ঢুকে বিছানায় বসে রইল। বেশ কিছুক্ষণ পরে এয়ার কন্ডিশনার নিজে থেকে চালু হতে বুঝল যে কারেন্ট এসে গেছে। এয়ার কন্ডিশনারের সবুজ আলোর ডট দুটোকে ওর কোন হিংস্র শ্বাপদের ভয়াবহ জ্বলন্ত চোখ বলে মনে হচ্ছিল। সারারাত আর দু'চোখের পাতা এক করতে না পেরে আলো জ্বালিয়ে বসে রইল।
রাতে না ঘুমিয়ে পরের দিন অফিসে কাজ করতে বেশ বেগ পেতে হলো। সেদিন অফিস থেকে ফিরে কোনোরকমে খেয়েই শুয়ে পড়ল মেখলা, একটা শান্তির ঘুম বড়ই প্রয়োজন। সারাদিনের ক্লান্তিতে বিছানায় শুতেই ঘুম এসে গেল। গভীর ঘুমের মধ্যে খালি মনে হতে লাগল, কেউ যেন ওর ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ওর নাম ধরে ডাকছে, গলাটা কোনও মহিলার। ওদের বাড়িতে তো শুধুমাত্র ওরা দুজন থাকে, তবে কে ওর নাম ধরে ডাকছে? ভয়ের চোটে গলা শুকিয়ে গেল মেখলার। এসব কী শুরু হলো ও বুঝতেই পারছে না। সেদিন রাতটা ভয়ে ভয়ে কেটে গেল।
পরের দিন দু'রাত জাগার ক্লান্তির ফলে আর অফিসেই যেতে পারল না। সকালে হঠাৎ নিজে থেকেই অর্জুন কফি নিয়ে দরজায় ধাক্কা দিল। মেখলার নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। এত ভালো মানুষ হয়ে গেল অর্জুন? অর্জুন ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, "দুদিন ধরে তোমায় ভীত সন্ত্রস্ত লাগছে, কী হয়েছে তোমার?" মেখলাও আদরে গলে গিয়ে সব খুলে বলল। অর্জুনকে একটু চিন্তিত দেখাল যেন। ও মেখলাকে একবার ডাক্তার বটব্যালের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলল। মেখলাও ওর কথায় যুক্তি খুঁজে পেয়ে রাজি হয়ে গেল। ওর মনে হল, ভালোবাসা এখনও মরে যায়নি। আবার নতুন করে শুরু করাই যায়। তাছাড়া, মাস দুয়েক হল ওর অবসাদের ওষুধ খাওয়াও বন্ধ আছে।
সেদিনই সন্ধ্যেবেলা ডাক্তারবাবুর কাছে গেল। উনি সব শুনে বললেন যে, আজকের যুগে ভূতের আবির্ভাব অস্বাভাবিক ব্যাপার। ওঁর মনে হচ্ছে এ এক ধরনের ফোবিয়া। আবার অবসাদের ওষুধ আর ঘুমের ওষুধ দিলেন। সাথে বারেবারে রাতে একা শুতে নিষেধ করে দিলেন। সেই রাতে আবার আগের মত যত্ন করে অর্জুন ওষুধপত্র খাইয়ে কাছে টেনে নিল মেখলাকে। দুজনের বিছানা আবার এক হলো। ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোল মেখলা, পরের দিন অফিসেও গেল।
আবার ওদের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে গেল। অর্জুন নিজে থেকেই সকালের কফি আর ব্রেকফাস্ট বানিয়ে মেখলাকে দিতে শুরু করল। দু'তিনদিন পর থেকে মেখলাও সব কিছুতে হাত লাগাল। একটা প্রকৃত সুখের সংসারের সব লক্ষণ দেখা যেতে লাগল। মেখলা বিবাহ বিচ্ছেদের কথাও মাসখানেকের মধ্যে ভুলে গেল। সবকিছুই…ডাক্তার, ওষুধ, অফিস, ভালোভাবে চলতে লাগল।
এরমধ্যে একদিন ডাক্তারবাবুর কাছে যেতেই উনি ওষুধ কমিয়ে দিলেন। মেখলাকে বললেন ও সুস্থ হয়ে উঠছে দেখে উনি খুশি হয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা, অর্জুন না বলে টাকাপয়সা সরানো একদম বন্ধ করে দিল।। এইভাবেই একটু একটু করে দুজনের দাম্পত্য জীবন ফের স্বাভাবিক হয়ে যেতে শুরু করল।
(৯)
ওদের বিয়ের বয়স প্রায় একবছর হতে যাবে, এমন সময় একদিন মেখলা রাতে ঘুমের মধ্যে বেশ কয়েকজন মানুষের ফিসফিসিয়ে কথা বলার আওয়াজ পেয়ে ভয়ের চোটে উঠে বসল। পাশেই অর্জুন ঘুমোচ্ছে দেখে ওকে ডেকে তুলল। অর্জুন ঘুম ভেঙে উঠতে উঠতেই সেই আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল, মেখলাও আর সেই স্বর শুনতে পেল না। অর্জুন ওকে বোঝাল, ভয়টা মেখলার মনে আবার ফিরে এসেছে। মেখলা আবার চেষ্টা করতে লাগল ভয় কাটিয়ে ওঠার।
পরের রাতে কিছুই হলো না। দ্বিতীয় রাতে ঘুমের মধ্যে মেখলার মনে হলো, কেউ যেন ওর মুখে বালিশ চাপা দিয়েছে। ধড়মড় করে উঠে ভয়ে চিৎকার করে উঠল সে। অর্জুন কাঁচা ঘুম ভেঙে উঠে খুব বিরক্ত হলো। কিন্তু মেখলার মুখের ওপর সত্যিই একটা বালিশ চাপা দেওয়া ছিল, যেটা ও ঘুম ভেঙে সরিয়েছে। অর্জুন মোটেও ওর কথা বিশ্বাস করতে চাইল না, ওর একটাই কথা, "তোমার আবার সমস্যা হচ্ছে।"
পরের দিন ফের ডাক্তারের কাছে গেল ওরা। উনিও মেখলাকে অনেক বোঝালেন। আবার ওষুধ আর কাউন্সেলিং শুরু হলো। অর্জুনও মোবাইলে ফোবিয়া নিয়ে প্রতিদিন প্রচুর পড়াশোনা করছে দেখে মেখলা মনে মনে খুব খুশি হলো। ছেলেটা ওকে মন থেকেই সুস্থ দেখতে চায়, নাহলে সারাদিন এটা নিয়ে এত ভাবতও না, আর ওকে এভাবে সাহায্যও করত না। ভুল বুঝে যে ওকে সত্যিই ডিভোর্স দিয়ে ফেলেনি এটাই বড় ব্যাপার। ডাক্তার বটব্যাল, এমনকি অফিসের সহকর্মীদের কাছেও মেখলা বারেবারে অর্জুনের প্রশংসা করল।
(১০)
একদিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরে অনেকবার বেল বাজিয়ে সাড়া না পেয়ে মেখলার মনে হলো অর্জুন হয়ত কোথাও বেরিয়েছে, তাই চাবি দিয়ে দরজা খুলে বাড়িতে ঢুকল। ঢুকেই কেমন একটা অস্বস্তি শুরু হলো। মনে হচ্ছে যেন বাড়িতে অন্য কেউ আছে। একতলার সব ঘরে আলো জ্বালিয়েও কাউকেই দেখতে পেল না।
দোতলায় নিজেদের শোয়ার ঘরে কাচের শার্সি গলে আসা হালকা আলোয় ভেতরে ঢুকে আলো জ্বালানোর জন্য আন্দাজে ডানদিকের স্যুইচ বোর্ডের দিকে হাত বাড়াতেই একজন মানুষের শরীরে হাত লাগছে বলে মনে হলো। ভয়ের চোটে সেদিকে তাকিয়ে সেই স্বল্প আলোয় যা দেখল, তাতে ওর সারা শরীরে শীতল স্রোত বয়ে গেল। আপাদমস্তক কালো পোশাকে ঢাকা একটা অবয়ব, মুখটা ভয়াবহ।
সাহায্যের আশায় রাস্তা থেকে লোক ডাকার জন্য ছুটে গিয়ে বারান্দার দরজা খুলে বারান্দায় যেতেই পেছন থেকে একটা ধাক্কা খেয়ে সোজা নিচু রেলিং টপকে মাথা নিচের দিকে করে রাস্তায় পড়ে গেল মেখলা। সঙ্গে সঙ্গেই সব শেষ।
(১১)
পুলিশের কাছে কান্নাভেজা গলায় অর্জুন জানাল, ও সন্ধ্যেবেলা একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল, তাই কখন মেখলা বাড়ি ফিরেছে জানতেও পারে নি। পাড়ার লোকজনের দরজায় ধাক্কার আওয়াজ শুনে দরজা খুলে দেখে এই অবস্থা। কার্যত বস্তি থেকে তুলে এনে মেখলা ওকে বিয়ে করে সম্মান দেওয়ার জন্য ও মৃতা স্ত্রীর প্রতি চিরকৃতজ্ঞ। পুলিশকে মেখলার আত্মহত্যার কারণ না বলতে পারলেও ডাক্তারের দেওয়া সব প্রেসক্রিপশন খুলে দেখাল। মেখলার অফিসের সহকর্মীদের বা ডাক্তার বটব্যালের সঙ্গে কথা বলে পুলিশ মেখলা এবং অর্জুনের ভালোবাসার কথা আর অর্জুনের স্নেহময় চরিত্রের কথাই জানতে পারল। আর জানতে পারল মেখলার জীবনে বারবার অবসাদ বা ফোবিয়া ফিরে আসার কথা।
পরের দিন খবরের কাগজের ভেতরের পাতায় ছোট করে মানসিক অবসাদগ্রস্ত অভিজাত মহিলার আত্মহত্যার খবর বেরোল।
(১২)
পারলৌকিক কাজকর্ম সব মিটে যাওয়ার পর একদিন ভোরবেলায় উদীয়মান সূর্যের দিকে তাকিয়ে বসে অর্জুন নিজের মনে বলে উঠল, "বোকা মেয়েটা যদি ঝামেলা না করে সবকিছু মেনে নিত তবে আর এভাবে মরতে হতো না।"
কয়েকদিন শোকগ্রস্ত অবস্থায় কাটানোর পরে অর্জুনের মধ্যে এখন নতুন উদ্যমের সঞ্চার হয়েছে। মৃতা স্ত্রী আর শ্বশুরমশায়ের সম্পত্তির সব মালিকানা বুঝে নেওয়া সহজ কথা নয়। কতদিন ধরে পরিকল্পনা করে, ফোবিয়া নিয়ে পড়াশোনা করে, মোবাইলে ইন্টারনেট ঘেঁটে বিভিন্ন রকমের শব্দ ডাউনলোড করে বানানো বহুদিনের নাটক যখন সাফল্য পায়, তখন তো সুখের সময়ই বটে।