এবার লেখা পড়তে পারছেন?
লেখাটা পড়তে পারলে অন্য এক ডাইমেনশনে আপনাকে স্বাগতম। এই ডাইমেনশনে এটাই আপনার প্রথম পাঠ। রাজস্থানের কনোই গ্রামের গল্প দিয়ে শুরু করি।
“আপকে ‘রাজ্জো’ মে ... না ‘রাজ্জো’ হবে না ‘রাজ্ইয়্যো’ হবে...আপকে ‘রাজ্ইয়্যো’ মেঁ সন্দেশ পাওয়া যা রহা হ্যাঁয়?” বাহনচালক হনুমন্তকে জিজ্ঞেস করলাম।
“সন্দেশ!? অচ্ছা, আপরোঁ মতলব খবর সা হ্যায়। হাঁ হাঁ জরুর। মাহ্রা কানা রেডিও সা হ্যায়।” হনুমন্ত নিজের ছোট রেডিওটা পিছন দিকে বাড়িয়ে দিল।
বোঝো ঠ্যালা। সন্দেশ চাইলাম, হাতে রেডিওর নিউজ ধরিয়ে দিচ্ছে! “না না। সন্দেশ মতলব ছেনা কা মিঠাই।”
“কাঁয়...কাঁয় বোলো হো সা? মিট্ঠো ছেনা সা বানা হ্যায়! মেহ্ তো ইয়া কদোই কোনো সুনি। মাহ্রো য়াঁহা তো মিট্ঠো সদা ক্ষীর ওরে মাওয়া সে হি বনাওয়া হাঁ সা।”
এ কোথাকার গোমুখ্যু রে! ছানার মিষ্টি শোনে নি! “ধুর বাবা। ক্ষীর তো ক্ষীর, ক্ষীরের আবার মিষ্টি কী? পশ্চিমবঙ্গমে আভি সন্দেশ বন্ধ হ্যায়। প্রফুল্ল বাবুনে সন্দেশ বানানা মানা কর দিয়া। দুধকা আকাল চল রাহা হ্যায় না। সোচা রাজোস্থান মেঁ আগর সন্দেশ মিলতা তো দারুণ হোতা।” নিজের রাজ্যের দুক্কুর কথা জানিয়ে দিলাম।
“বাবুজি, আপরোঁ মাহ্রা রাজস্থাঁড় কা গাঁও দেখান আয়ে হো কে? বঙ্গালী লোগ বিরাজে তো জয়পুর যাওয়ে, উদয়পুর যাওয়ে, জয়সল্মীর যাওয়ে। কনোই গাঁও কোই না যাওয়ে। সুখি বঞ্জার ধরতি, রেত কা টীল্লো ... কনোই গাঁও মেঁ ঔর কুছ না মিলোঁ। আপ কদই যোধপুর পধারো সা।”
আগের কথাবার্তা থেকে মনে পড়ে গেল, টীল্লা হল বালিয়াড়ি। “না না, ঘুরতে নেহি আয়া বাবা। লিখনে আয়া। হাম সিনেমা কে লিয়ে স্টোরি লিখতা হ্যায়।”
প্রযোজক ঘন্শাম্-ই রাজস্থানের প্রান্তিক গ্রামের এই বাড়ির হদিস দেয়। আমি শুধু নিরিবিলি একটা বাড়ির খোঁজ করছিলাম। তাও কলকাতার কাছে। ঘন্শাম্ সব শুনে ওর পৈত্রিক বাড়িটা এক মাসের জন্য বিনা পয়সায় ভাড়া দিয়ে দিল, সঙ্গে ট্রেন ভাড়া, জয়পুর থেকে গাড়ি ভাড়া, আর এই কনোই গ্রামে সব রেশনের ব্যবস্থা। শুধু বলে দিল, “যো ভি লিখ্না উত্তমবাবুকো দিমাগ মেঁ রখকে লিখনা। লেকিন কৃপয়া জতুগৃহ মাফিক কোই বোগাস্ কহানী নেহি। বিলকুল লাল পত্থর মাফিক হিট চাহিয়ে।” বেটা বলে কী! জতুগৃহ বোগাস্?
“অচ্ছা, তো সা ঠায় সিন্মা বনাও হো?” আমি সিনেমা বানাই অনুমান করে নিয়ে হনুমন্তের আর আনন্দ ধরে না। “দেব আনন্দজি কো জানো হে হোগা?”
আরও আনন্দ দেব বলেই দুম্ করে ঢপ মেরে দিলাম, “হাঁ হাঁ দেব আনন্দজিকো জানতা হ্যায়।”
“কে জবরদস্ত সিন্মা বনাওয়া হ্যায় ভেই। গাইড। মা জব ওয়া সিন্মা দেখুঁ হুঁ তো মাহ্রি আঁখা সা পানি আপ হি গিরান লাগা হ্যায় সা।”
“যিস্নে ও সেনিমাকা গল্প লিখা হ্যায়, উসকা ভি আঁখ সে পানি গিরা থা সিনেমা দেখকে। নিজের কাহানীকা সত্যানাস দেখকে ফুট ফুটকে রো পড়ে উয়ো। আপ ‘টারজান অ্যান্ড কিংকং’ দেখা?”
“কুন সি ... ওয়া জিম্মা দারা সিং জি হ্যায়? আপরোঁ ওয়া সিন্মাকি কহানী লিখো হো কে? বড়ি জবরদস্ত কহানী হ্যায় সা।”
“আরে নেহি হনুমন্তজি। হাম কাহাঁ ইতনা অচ্ছা লিখতা হ্যায়। লেকিন ইস বার লিখেগা। রাজস্থানকে উট কো লেকে কহানী লিখেগা ‘উট পটাং অ্যান্ড চিৎ পটাং’।” এ কথাটা বলে গাড়ির পেছনের সীটে নিজেই হেসে গড়িয়ে গেলাম। মনে হলো, দারুণ একটা মজার কথা বলেছি। গাড়ির আয়নায় দেখলাম লোকটা নির্বিকার মুখে রাস্তায় মন দিয়েছে। যাক, কিছুক্ষণ আর বকবক করতে হবে না।
কনোই গ্রামে যখন গাড়ি ঢুকছে, তখন আমি এত জোরে নাক ডাকছি, গাড়ির আর সাইরেন লাগছে না। রাস্তার বাকি সব গাড়ি ভিআইপি গাড়ি ভেবে পথ করে দিচ্ছে। হনুমন্তজির ধাক্কাধুক্কিতে ধড়মড় করে উঠলাম। কোথায় রয়েছি, কী ঘটছে মনে করতে দেরী লাগল। ‘হারানো সুর’-এর উত্তমদার মত। তফাৎ একটাই যে, উত্তমদার স্মৃতিবিভ্রাট ভাঙেন রূপসী রমাদি, আর আমার নাসিকাগর্জন ভাঙেন ডাকাত সর্দারের ন্যায় গুম্ফশ্রী হনুমন্তজি।
“বাবুজি, দেক্খো সা... ইয়ো জো রাস্তো দেখরা হো না, ইয়ো সিদ্ধো অম্বা মা কা ঘরান তক্ জাওয়া হ্যায়। মাঈ ঠাঁরো রাহ দেখ রহিঁ হোগি। রাম রাম সা।”
“সড়ক কিধার ভাই? তাকাই যেদিকে শুধু তো বালি।”
কথাটা বলেই খেয়াল হলো, বালির ওপর দিয়ে পায়ে পায়ে তৈরি হওয়া এক পথ এঁকেবেঁকে চলে গেছে। দূরে একটা একতলা হলদেটে বাড়ি। গিরগিটির মত বালির রঙে মিশে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির গায়ে সাদা রঙের আলপনা না থাকলে ‘কোথায় বাড়ি?’ ‘কোথায় বাড়ি?’ জল্পনাই সার হতো। আমার জব্বর স্যুটকেস টেনে নিয়ে চললাম বালির ওপর দিয়ে। আলপিন থেকে কৌপীন, পাপোশ থেকে বালাপোশ - সমস্ত প্রতিকূলতার সঙ্গে আপোসহীন এই শর্মার ব্যাগে সবই পাওয়া যাবে। এই বাঙালির এক দোষ! বেড়াতে গেলেও সংসারের জাঁতাকল ফেলে আসতে পারেনা। স্যুটকেসে বয়ে বেড়ায়।
হঠাৎ একটা দমকা কনকনে হাওয়া কানের গোড়ায় এমন কিসি খেল, মনে হল স্যুটকেসি বাঙালি যুগ যুগ জিও। যাই হোক, হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে দরজায় কড়াঘাত করলাম। এক বয়স্কা মহিলা হাতে বাহারি লন্ঠন নিয়ে বেরিয়ে এলেন। কথাবার্তাগুলো বাংলাতেই লিখি। মহিলার চোস্ত মারোয়াড়ী ভাষা মনে করে করে লেখা অসম্ভব। কী লিখতে কী লিখে ফেলব। একবার তামিল এক চিত্রপরিচালককে আমার এক সহকর্মী তাঁর মায়ের মৃত্যুতে ইংরেজিতে এক মর্মস্পর্শী চিঠি পাঠিয়েছিলেন। চিঠির শেষে কাকে না কাকে জিজ্ঞেস করে তামিলে একটা লাইন ঠুকে দিলেন - 'কুলিয়ালারাই এঙ্গাই উল্লাথু!' যার অর্থ ‘টয়লেটটা কোথায়?’।
অশীতিপর অম্বা মাই প্রথম হাসিতেই আমাকে আপন করে নিলেন। ঘরের ভেতর এক খাটিয়ায় আপ্যায়ন করে বসিয়ে চা খাওয়ালেন। সেটা চা না রাবড়ি বোঝা দায়! যাক, সন্দেশ না হোক এরকম রাবড়ি জুটে গেলেও বাঙালির চলবে। অম্বা মাঈ-এর সঙ্গে ঘুরঘুর করছিল ছোট্ট একটি ছেলে। নাম বদ্রী। ক্ষুদে মাথায় মস্ত পাগড়ি। বাড়িতে অতিথির সম্মানে পরেছে। অম্বা মাঈ ঘরের কোণে রাখা কয়েকটা প্যাকেট, কয়েকটা বস্তা, এক ঝুড়ি সবজি দেখিয়ে দিয়ে বললেন, “এক সপ্তাহের খাবারের যোগাড়।”
বাঙালি মাত্রেই খুঁতখুঁতে। “এক সপ্তাহ টিকবে সবজি? খারাপ হয়ে যাবে না?”
“তুমি টিকবে এক সপ্তাহ?”
“আমি তো এক মাসের জন্য এসেছি।”
“দেখা যাক। সব শুনেই এসেছ নিশ্চয়ই।”
“আসার সময় ঘন্শাম্ সব-ই বুঝিয়ে দিয়েছে। একটু অসুবিধে হলেও এক মাস মানিয়ে নিতে পারব। তা কাজের মেয়েটি কখন আসবে?”
“কে? চকোরী? ... ও সকাল সকাল আসবে। চা নাস্তা করে দেবে। দুবেলার খাবার রেঁধে দিয়ে, ঘরদোর পরিষ্কার করে দিয়ে বেলাবেলি চলে যাবে। বিকেলের চা’টা নিজে করে নিতে হবে। আমার এখানে এলে আমিই চা করে দেব এখন। আমার মির্চ পকৌড়া খেলে প্রতিদিন বিকেলে আসতে শুরু করবে।”
“আপনাকে আমার জন্য অতটা পথ হাঁটতে হবে না, আমি বিস্কুট দিয়ে চা খেয়ে নেব।”
“মানে? মির্চ পকৌড়া বানানোর জন্য পথ হাঁটব কেন?”
“সন্দেশ খাওয়া বাঙ্গালী মির্চ পকৌড়া খেয়ে পটল তুললে আপনাকে হাতকড়া পরাবে তো। আসার পথে দেখলাম থানা অনেক দূর। এই বয়েসে হাতকড়া পরিয়ে অতটা পথ আপনাকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাবে! সেটা আমার ধম্মে সইবে না।”
হঠাৎ একটি মেয়ে দুম করে দরজা ঠেলে ঢুকল। ঢুকেই অম্বা মাঈকে জেরা করতে শুরু করল। “বাবুজি এসেছেন? আগের জন তো বলেও এলেন না। সবাই কিন্তু অধৈর্য হয়ে উঠেছে।”
অম্বা মাঈ ইশারা করে আমাকে দেখিয়ে দিল।
মেয়েটি লজ্জায় ঘোমটার খুঁট ঠোঁটে ধরে ভেতরের ঘরে পালাল। যাওয়ার আগে বলে গেল, “আপ মন্নে কদই সেবারও মওকো দেও সা।”
বদ্রী আর চকোরী মিলে জিনিসপত্র তুলে দিল এক উট-টানা গাড়িতে। তারপর আমাকে পেছনে ন্যাজ ঝোলা টিয়ের মত বসিয়ে গাড়ি হাঁকাল। বিকেলের ত্যাড়ছা রোদ্দুর এসে পড়েছে বালিতে। দূরে সূর্যের গোলকটা দিকচক্রবালরেখার ওপারে ডুবব ডুবব করছে। কিছু বালিয়াড়ি, কিছু ফণীমনসার ঝোপ, কিছু ছাগল, অনেক ছাগলনাদা, কিছু গোরুর ঠুংঠাং, বেশ কিছু প্রশ্নচিহ্ন আঁকা নিরীহ চাহনি পেরিয়ে যখন একসঙ্গে অনেকগুলো বাড়িঘর দেখতে পেলাম তখন বুঝলাম অম্বা মাঈ-য়ের বাড়ি গ্রামের কিছুটা বাইরে। আসল গ্রাম শুরু হল এইবার। বা! শুধু শুধুই ভয় পাচ্ছিলাম ধুধু মরুভূমিতে মরতে এলাম বলে!
একটা গাছ ঘিরে প্রবীণদের জটলা চলছে। গাড়িটা অনতিদূরে থামল। চকোরী এগিয়ে গিয়ে কথা বলল তাদের সঙ্গে। সবাই শূন্যে নমস্তে করে ঈশ্বরকে প্রার্থনা জানাল। তারপর সমস্বরে আমাকে দেখে হেঁকে উঠল, “রাম রাম সা!” অতিথির জন্য এত আন্তরিকতা! কিছুদিন আগে এক প্রযোজকের পুত্রসন্তানের বিবাহ ছিল নামী পাঁচতারায়। কিন্তু আমার পোশাক, পায়ে চপ্পল, ইংরেজি ভাষায় অস্বস্তি আর হাতে উপহারের আয়তন দেখে নিরাপত্তা রক্ষী আমায় কিছুতেই ভেতরে ঢুকতে দিল না। এরকম অনেক স্মৃতি গলায় পাক খেয়ে উঠে চোখটা হঠাৎ ভিজিয়ে দিল। আমি কপালে হাত ঠেকিয়ে ওদের উদ্দেশ্যে বললাম, “রাম রাম! সবাই ভালো থাকবেন।”
কিন্তু সুখ ব্যাপারটা চঞ্চলমতি গঙ্গাফড়িঙের মত, আমার কপালে বেশীক্ষণ বসে না। গ্রাম ছাড়িয়ে আবার সুনসান বালুকাভূমে গাড়ির চাকা পড়তেই, বাঙালির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের প্রতি গর্ব আর মনের ভয় দুটোই ফিরে এল। কপালে ধুধুই নাচছে!
মিনিট পনের ‘দোল’-যাত্রার পর বাড়িটা দেখতে পেলাম। রাজস্থানি স্থাপত্যের কালজীর্ণ দোমহলা বাড়ি। ঔপনিবেশিক ঢঙের সঙ্গে জৈন এবং মুসলিম শৈলীর নিরুপম সংমিশ্রণ। বাড়ির গায়ে একটা তিনতলা উঁচু টাওয়ারও রয়েছে। টাওয়ারের মাথায় ঘণ্টা। সাদা রঙের জেল্লা দেখে মনে হল গত তিন-চার বছরের মধ্যে নিশ্চয়ই রং করা হয়েছে। সবুজ রং করা কাঠের জানলাগুলো সব বন্ধ। গ্রামের বাকি বাড়িগুলর সঙ্গে তুলনা করলে এ যেন শুশুনিয়ার পাশে হিমালয়া। ঢকর ঢকর ক্যাঁচ কোঁচ শব্দে এগিয়ে যেতে লাগলাম বাড়িটার দিকে। সাদা মেঘের মহাজগতিক মানচিত্র আঁকা নীল আকাশের বুকে বাড়িটা বড় হতে থাকল।
বাড়ির সামনে অবসরপ্রাপ্ত ভাঙাচোরা লোহার গেট। জং বেশী, লোহা কম। মন খারাপ করে একান্তে দাঁড়িয়ে আছে। গেটের পাশে ইঁটের স্তম্ভে খোদাই করা ১৭৮৬। বয়স আন্দাজে অনেক বেশী বুড়ো। আমাকে দেখলে কলকাতার ডাক্তাররাও এক-ই কথা বলে। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম বাড়িটার বেশ কিছুটা অংশ বালিতে ডুবে গেছে। চকোরী বলল তার ঠাকুমার মেয়েবেলায় বাড়িটা ঘিরে পাঁচিল ছিল। আর পাঁচিলের ভেতর ছিল ফণীমনসার বাগান। এখন সব-ই কালের বালির নিচে। এবার বাড়িটার দিকে তাকিয়ে মনে হল একটা আওয়ার গ্লাসের দিকে তাকিয়ে আছি। সেটাকে উল্টে দিয়ে সময়ের একক হিসেবে ঘণ্টা নয় শতাব্দী মাপা হচ্ছে। বালি ঝরে পড়ছে ওপরের বাল্ব থেকে নীচের বাল্বে।
পিছন ফিরে দেখলাম কনোই গ্রাম দৃষ্টির গোচরে কিন্তু শব্দের আওতার বাইরে। সাদা বাড়ির পটভূমিকায় তখন দিনান্তের আকাশে নানা রঙের মন্তাজ.। উটটা হাঁটু মুড়ে বসে ঘাড়টা নাড়তে লাগল। শব্দ উঠল টিংটিং। দেওয়ালে প্রতিধ্বনি উঠল হিং টিং ছট্।
বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে দরজার লক্ খুলে ভেতরে সব গুছিয়ে রাখার কাজ ওরাই করে দিল। তারপর আমায় ভেতরে ঢুকতে দিল। ঢুকে বেশ বিমর্ষ হলাম! বুঝলাম, বাইরের চুনকামটা মড়ার ঠোঁটে লিপস্টিক্! ভেতরে নোনা ধরা দেওয়াল। রঙের কোনও বালাই নেই। প্রবেশকক্ষে নামমাত্র আসবাব। মেঝের কাছাকাছি দেওয়াল জুড়ে ছোট ছোট গর্ত। সিলিঙের পলস্তরার অবস্থা মেক-আপ ছাড়া নায়ক নায়িকার মত। শুনছি পরের বছর ‘নায়ক’ ছবিতে মাণিকবাবু উত্তমদাকে বিনা মেকআপে নাবিয়ে দেবেন। এরকম ভাবাটা মাণিকবাবুর পক্ষেই সম্ভব!
আমার সঙ্গিহীন হওয়ার কিছু পর আকাশ আলোহীন হল। ঘুট্ঘুটে অন্ধকারে একটি মাত্র মোমের আলোয় ছায়া ছায়া দেওয়াল আর বাড়িটার বিশালত্ব মনের সাহসটাকে আণুবীক্ষণিক করে দিল। তবে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর দুটো জিনিস জেনে ভালো লাগল। রান্নাঘরে দেখলাম ওরা প্রচুর মোমবাতি রেখে গেছে। চারটে ঘরে চারটে বাতি জ্বেলে ধড়ে প্রাণ এলো। আর এটা জেনে আরো ভালো লাগল, বাড়ি যতই বিশাল হোক, আমার গতিবিধি চারটে ঘরের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বাড়ির এই অংশ থেকে অন্য অংশে যাওয়ার একমাত্র দরজা তালা মারা। মনে সাহস ফিরল, সঙ্গে হাত ধরে নিয়ে এল দেহের স্বাভাবিক প্রবৃত্তগুলোকে। এই যা! রাত্তিরে খাব কী? এখন রাঁধতে বসতে হবে নাকি?
ভাবতে ভাবতে রান্নাঘরে ঢুকলাম আবার। ডিম আছে কিনা খুঁজতে গিয়ে দেখলাম, একটা টিফিন কেরিয়ারে করে গুছিয়ে খাবার রাখা। রুটি, তড়কা, আলু ভাজি, সুখি সব্জি। অর্থাৎ কবজি ডুবিয়ে খাওয়ার বন্দোবস্ত। মনে মনে অম্বা মাঈকে আবার প্রণাম জানালাম। বাঃ তাহলে আমার হাতে এখন রাত অবধি অনন্ত সময়। স্যুটকেস খুলে আলমারি গুছিয়ে নিলাম। বাথরুমে একটা মোমবাতি জ্বেলে রেখে এলাম। বাথরুমের পরিধি দেখে মনে হল এখানে মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গলের ম্যাচ হতে পারে। ওফ্! কেন আবার মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল ভাবতে গেলাম? অসীম মৌলিকের লাস্ট মিনিটের গোলটা ... বুকটা ফেটে যাচ্ছে। ওয়াকওভার পেয়েছিলি, বেশ তো না খেলেই চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাচ্ছিলি। কেন ঢং করে রিপ্লে চাইলি? যত মোহনবাগানী সৌজন্য! দিল তো বাঙালগুলো হুল ফুটিয়ে!
শোবার ঘরে ঢুকে দেখলাম পরিপাটি করে মশারি টাঙানো। কই এতক্ষণ রয়েছি, মশা তো একটাও দেখলাম না ... মানে একটা মশাও তো আমায় দেখল না? যাই হোক ভালোই হয়েছে। কে আর বিদেশ বিভুঁইয়ে ম্যালেরিয়া বাঁধাতে চায়?
শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে চতুর্থ ঘরে ঢুকলাম। বইয়ের শেল্ফ্, বিশাল রিডিং টেবিল, ফায়ারপ্লেস ... এটাই নিশ্চয়ই স্টাডি রুম। ঘরের ফার্নিচারে সময়ের ধুলো, কোণে কোণে মাকড়শার জাল, তবু অন্যান্য ঘরগুলোর তুলনায় অনেক বেশী পরিপাটী। ঘন্শাম্বাবু বারবার এটার কথা বলে দিয়েছেন। এত বড় রিডিং টেবিল, সেটা ঘিরে চোর পুলিশ খেলা যায়। ছোটবেলায় এরকম একটা টেবিল পেলে আমি আর মিতিন বোধহয় আনন্দের চোটে পাগল হয়ে যেতাম। আমাদের গোটা ঘরটাই হয়ত এই টেবিলের সাইজের ছিল। তার ভেতর খাট। চেয়ার। কলসি। আলমারি। জানলার ফ্রেমে আটকে থাকা পাশের বাড়ীর দেওয়াল। খাটের এক কোণে বসে বেণী দুলিয়ে মিতিন পড়ছে ‘পাখি সব করে রব’ আর এক কোণে আমি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে নামতা পড়ছি। অঙ্ক আর কবিতা মিলেমিশে মাথার ভেতর জগাখিচুড়ি পাকিয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ টের পেলাম ঘরটা অদ্ভুত রকমের ঠাণ্ডা। একটু ভিজে ভিজে যেন। মরুভূমি এলাকার শুষ্ক আবহাওয়ায় বেশ বেমানান। ফায়ারপ্লেসের ভেতর কাঠের স্তূপ দেখে মনে হল কাজে লাগান যাক। কিন্তু জীবনে কোনোদিন ফায়ারপ্লেস ব্যবহার করিনি। আমার দৌড় কাঠকয়লার উনুন পর্যন্ত। বেশ কিছুটা ধস্তাধস্তির পর আগুন জ্বলল। দেখলাম কাঠের চোঁচে হাত ছড়েছে। বাঁ হাতের মধ্যমায় ছ্যাঁকা খাওয়ার জ্বলুনি। ডান হাতের চেটো কালিঝুলি মাখা। উঠে দাঁড়িয়ে একটা বুকশেল্ফের কাছে গেলাম। কে? আমার পেছনে কে? কাঁচে এটা কার প্রতিবিম্ব? সাঁ করে পিছন ফিরে তাকালাম। না কেউ নেই। আবার তাকালাম কাঁচে। এবার একাই হো হো করে হাসতে শুরু করলাম। রোজ রোজ নিজের মুখে এত কালি দেখা হয়ে ওঠে না তো!
আগুনের কোমল আলোয় ঘরটা তখন মোহিনী হয়ে উঠেছে। চোখে পড়ল দেওয়াল জোড়া ছবিগুলো। শৌখিন কাঠের ফ্রেমে বাঁধান। আগুনের আবছা আভায় ইতিহাসের দলিল ঘাঁটতে লাগলাম। এক ছবিতে এক সাহেব মৃত চিতাবাঘের পিঠে পা রেখে দাঁড়িয়ে। বাহ্ রে লালমুখো বীরপুঙ্গব, হাত থেকে বন্দুক সরিয়ে নিলে দেখব কে কার পিঠে পা রেখে ছবি তোলে! তার পাশের ছবিতে এক-ই সাহেব এক কুলির পিঠে পা রেখে ঘোড়ায় চড়ছেন। বলিপ্রদত্ত কুলির মুখে যন্ত্রণার বলিরেখা। আর এক ছবিতে সাহেবের কোলে ছোট্ট শিশু খিলখিলিয়ে হাসছে। পাশের দেওয়ালের এক ছবিতে সাহেবের সঙ্গে চারজন ব্রিটিশ পুলিস। মাঝখানে কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা এক ফাঁসির আসামি। পাশে ঝুলছে ফাঁসির দড়ি। এ বাড়িটা কার?
খাওয়া দাওয়া সেরে শুয়ে পড়লাম সাড়ে আটটার মধ্যে। ছবিগুলো মাথার মধ্যে ঘুরপাক না খেলে নিঃসন্দেহে বলতে পারতাম এত ভালো রান্না বহুদিন খাইনি। ঘরের মোমবাতি আর নেভালাম না। আয়ু যখন ফুরিয়েই এসেছে, সময়ে নিজেই নিভে যাবে। বিছানায় শুয়ে নিজেকে মনে হল নিঃসঙ্গ রাজকুমার। জীবন এত সুন্দর হতে পারে, একাকীত্বেও এত নিশ্চয়তা থাকতে পারে, কোনোদিন ভাবিনি। একবার মনে হল জানলা খুলে দেখি রাতের মরু-আকাশ। হাজার তারার মখমলি চাদর গায়ে তাকে কেমন লাগে। জানলা খুললে বাঙ্গালী কুল্পি হয়ে যেতে পারে, এই ভেবে ইচ্ছেটাকে পরের দিনের জন্য মুলতুবি করলাম। কলকাতায় খোলা আকাশ আস্তে আস্তে চুরি হয়ে যাচ্ছে। এখান থেকে ফেরার সময় না হয় এক মুঠো আকাশ নিয়ে ফিরব। এরপর ঘটনাটা ঘটে গেল রাত বারোটার কিছু পরে।
মাঝরাতে যখন ঘুম ভাঙল বিছানা ঘিরে প্রচণ্ড শব্দ। খুট্খাট্ খুট্খাট্। কিঁচকিঁচ কিঁচকিঁচ। সারা ঘরময় অদৃশ্য প্রাণের অস্তিত্ব। শব্দগুলো এসে রীতিমত ধাক্কা মারছে শরীরে। ঘুমে এলোমেলো মাথাটায় চেতনা ফিরতেই, টর্চ জ্বাললাম। মশারির গায়ে ঠেকিয়ে দেখতে গেলাম মাটিতে কী? মুহূর্তে শব্দ বন্ধ হল। কিছুই নজরে এলো না। ঘড়িতে দেখলাম বারোটা পনের। ঘুম জিনিসটা যে একটা সময়যান সেটা আবার টের পেলাম। জীবনে তিন ঘণ্টা ফাস্ট ফরওয়ার্ড হয়ে গেছে কয়েক সেকেন্ডে। কিন্তু এত শব্দ করছিল কিসে?
পরদিন সকালে সদর দরজায় প্রচণ্ড ধাক্কায় ঘুম ভাঙল। ওফ্! রাতে শব্দ, ভোরে শব্দ। কলকাতায় কি শব্দ কম পড়িয়াছিল? মরুভূমিতে এসেও শব্দকল্পদ্রুম! গত জন্মে কত যে পাপ করেছি! দেখি চকোরী দরজা খুলে ঢুকছে।
“রাম রাম সা!” যাঃ বাবা! সঙ্গে চাবি ছিল তো এত হাঁক ডাক কেন বাপু?
ঘড়িতে সকাল সাতটা। সাড়ে সাতটার মধ্যে চা আর পুরি-ভাজি রেডি হয়ে গেল।
“চকোরী বেহেন, এ বাড়িতে কে থাকে?”
“কেন? আপনি।”
“না, মানে এমনিতে কে থাকে?”
“অতীত।”
“বাড়িটা কার?”
“অনেক শরিক। কার নাম বলব?”
কখনো দার্শনিক, কখনো ঝাপ্সা উত্তর; কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর বিরক্তি লাগল। বাথরুমে পরিষ্কার হয়ে বেরিয়ে পড়লাম গ্রামের উদ্দেশে।
চায়ের দোকানে ভিড় দেখে বসে পড়লাম। সবার-ই মুখ চলছে। চা, জিলিপি, কচুরি, রুটি, ঘুঘ্নি। কিন্তু নজর সবার আমার দিকে। চা-অলার কাছে এগিয়ে গেলাম। আমার কাছে আমার কলকাতার চা-অলা ভোম্বলদা আর সংবাদপত্র সমার্থক শব্দ।
“বাবু, আপনাকে তো আগে কোনোদিন দেখিনি।”
“হোয়াট আ কোইন্সিডেন্স। আমিও আপনাকে আগে কোনোদিন দেখিনি। আমি ঐ সাহেব কোঠিতে থাকতে এসেছি।”
“জজ্ সাহেবের কোঠি? কিনেছেন?”
“না। আমি এক মাসের মেহমান।”
“আপনি নিশ্চিত?”
কী বোকার মত প্রশ্ন! “আমি সত্যিই মেহমান রে ভাই। পরগাছাও বলতে পারো। আমার এই বাড়ি কেনার ক্ষমতা নেই।”
“জরুর, জরুর।”
“তা বাড়িটার ইতিহাস সম্বন্ধে জানা আছে?”
পাশ থেকে একজন সাবধান করল চা-অলাকে, “মেহমানকে বেশী ভয় দেখিও না! উনি চলে গেলে যে অকল্যাণ হবে, তার দায় তুমি নেবে?” এদের কাছে অতিথি নারায়ণ, কলকাতায় বিরক্তির কারণ।
কোনও কোনও বাড়িতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির আবহ বাড়ির মালিক সম্বন্ধে অনেক কথা বলে দেয়। আমি অনুভব করে দেখেছি মালিকের মৃত্যুর পরও এটা হয়। জীবতাবস্থায় তার মানসিকতা, তার আচার-আচরণ বাড়ির পরিবেশে এমন এক ছাপ রেখে যায়, মৃত্যুর বহুদিন পরও সেই বাড়িতে গেলে বাড়ির মালিকের আবদ্ধ আবেগ টের পাওয়া যায়। ঘন্শাম্ বাবুর বাড়িতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশটা খুব ভারি মনে হয়েছিল। কেমন একটা দমবন্ধ করা ভাব। তখন ভেবেছিলাম জানলা বন্ধ থাকার কারণ অক্সিজেনের অভাব। কিন্তু চা-অলার গল্প শুনে বুঝলাম, না! কারণটা হাওয়ার অভাব নয়, কারণটা বাড়ির মালিকের ফেলে যাওয়া নিঃশ্বাস।
চায়ের দোকান থেকে বাড়ি ফিরে দেখলাম তখনো চকোরী রান্নাঘরে রয়েছে। জোর কদমে রান্না চলছে। আমি আর একবার চা চেয়ে স্টাডিরুমে গিয়ে বসলাম খাতা পেন নিয়ে। পাশে শরদিন্দু বাবুর ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’। আগের দিন লক্ষ্য করিনি, আজ দেখলাম টেবিল ঘিরে চেয়ারগুলোর মধ্যে একটা চেয়ার অনেকটা সিংহাসনের মত। সেটা ফায়ারপ্লেসের পাশে রাখা। চকোরী দু’কাপ চা দিয়ে গেল।
“বাকি ঘরের জানলা খুলে গেল। এ ঘরেরটা খুলতে গিয়ে দেখি পেরেক মেরে বন্ধ করা। দিনের বেলাও মোম জ্বালিয়ে বসে আছি। কালকে কাউকে পাঠিয়ে জানলার পেরেকগুলো তুলে দিও।”
“এ ঘরে বই আছে। জানলা বন্ধ রাখা নিয়ম।”
“হক্ কথা। আচ্ছা আর একটা কথা বলতো। কাল রাতে শোয়ার ঘরে খুব শব্দ শুরু হল। সে বিকট সমবেত শব্দ। কান মাথা ভোঁ ভোঁ করছিল। কিসের শব্দ?”
“দিনে এত বার চা খেলে, পেট গরম হয়ে নিজের পেটেই ওরকম শব্দ হয়। বাবুজি, চা খাওয়া কমিয়ে দিন।”
“যাঃ শালা। চায়ের দোষ হয়ে গেল?” চা, চামচা আর চাচা আপন প্রাণ বাঁচা - টিমটিম করে এই তিনটেই তো বাঙালির নিজস্বতা রয়ে গেছে। চা গেলে বাঁচব কি নিয়ে?
দুপুরে গট্টে কি সবজি, ডাল, আলু ভাজি দিয়ে ঘন্শাম্ বাবুর অন্ন ধ্বংস করে ঘুম লাগালাম। ঘুম থেকে উঠে দেখলাম বিকেলের ঝিম ধরেছে। জানলা দিয়ে হুহু করে ঠাণ্ডা হাওয়া ঢুকছে। জানলা দরজা বন্ধ করে মোমের আলো জ্বালিয়ে বসলাম। স্টাডি রুমের নিশ্ছিদ্র নিবিড়তার আলিঙ্গনে বসে চিত্রনাট্য এগিয়ে চলল গড়গড় করে। বাইরে একটা জানলা খোলা রেখেছিলাম আকাশ দেখব বলে। একটা সময় সেই জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, সন্ধে নেমেছে। খাতা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙলাম। আবার ঘরের মধ্যে সেই অদ্ভুত ভিজে ভিজে ঠাণ্ডা ভাবটা। ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বালাতেই দেওয়ালের ছবিগুলো গল্প বলে উঠল।
চা-অলার গল্প মিলে গেল ছবিগুলোর সঙ্গে। এলাহাবাদ হাই কোর্টের সামনে দাঁড়িয়ে জজ্ সাহেব স্যার জন ক্লার্ক। সঙ্গে হাইকোর্টের উকিলবাবুরা। ১৮৯৪। রজত জয়ন্তী উৎসব পালন হচ্ছে। একটিও নেটিভ মুখ নেই ছবিতে। একের পর এক অপরাধীকে ফাঁসি কাঠে ঝোলানোর ধর্ষকামী আনন্দটা ফুটে উঠেছে তিনটে ছবিতে। আসামির মুখে কালো কাপড়, ওঁর হাতে শ্যাম্পেন, ঠোঁটে সিগার। এর পাশাপাশি কনোই গ্রামে ছুটি কাটাতে আসার ছবিগুলো ব্যতিক্রমী এবং উজ্জ্বল। পোর্টিকো জুড়ে খ্রিস্টমাস ট্রি। পাশে ভিক্টোরিয়ান পোশাকে স্ত্রী ইলিয়ানা। সরু-হাতা উঁচু-কলার বডিস্, লম্বা স্কার্ট, মাথার ওপর উঁচু করে বাঁধা চুল, পরচুল হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। দোলনা ঘোড়ায় মেয়ে জেনিফার। সোনালী চুল, গোড়ালি অবধি সাদা ফ্রক। এক মুখ হাসিতে দুটো দাঁতের দুষ্টুমি। একটা ছবিতে মায়ের কোলে গাল ফুলিয়ে। ছবি তোলার জন্য ঘোড়ার পিঠ থেকে মায়ের কোলে যাত্রাটা পছন্দ হয় নি। আর একটা ছবিতে নিষ্পাপ মুখটা জানলা দিয়ে চেয়ে আছে দূরে কোথাও, হয়ত বালুকাসমুদ্রে মরু জাহাজ দেখছে, কিম্বা দেখছে ভোরের আকাশে শেষ চাঁদ।
হঠাৎ চাওলার গল্পের লেন্সটা মনে লাগাতেই, চোখের সামনে ভেসে উঠল মেয়েটির ছিন্নভিন্ন দেহ। এই ঘরেই কোথাও পড়েছিল রক্তস্নাত নিষ্পাপ দেহটা ... বাবার পাপের শাস্তি হিসেবে। এই টেবিলের ওপর হতে পারে, ফায়ারপ্লেসের সামনে হতে পারে, দরজার কাছে হতে পারে। আজ দুদিন হল আমি সেই জায়গা মাড়িয়ে মাড়িয়ে হেঁটে যাচ্ছি। এই শিশুকে ছুরির ডগায় ফালাফালা করতে কোন্ মানুষের হাত কাঁপে না? সেই রকম মানুষকে দেখতে কী রকম হয়? তাদের ছোটবেলা কী রকম কেটেছে?
মেয়ে জেনিফারের চেয়ে ইলিয়ানার মৃত্যুটা অনেক শান্তির। এক বুলেটে তাঁর দেহ নিথর হয়ে যায়। আততায়ীকে যখন গ্রামের লোক ধরে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে সে তখন উন্মাদের মত চীৎকার করছে, “মাহ্রা ছোরা না ঠারো কে বিগারো থো সা? কে বিগারো থো সা? ঠায় মাহ্রা ছোরা না কাঁয় সুলি পা চঢ়াও সা, সাহিব?” “আমার ছেলে তোমার কী ক্ষতি করেছিল? কেন তাকে ফাঁসি চড়ালে, সাহেব?” গ্রামের লোক নৈতিক উভয়সঙ্কটে ভাসতে ভাসতে চলেছে - এই উন্মাদ প্রতিশোধকামী তাদের ত্রাণকর্তা না খলনায়ক?
ঘটনার পরবর্তী সময়ের আর কোনও ছবি নেই দেওয়ালে। শোনা যায় জজ্ সাহেব আর একবার এসেছিলেন। আগের চেয়েও তিনি তখন দোর্দণ্ডপ্রতাপ। আগে যতবারই এসেছেন, এসেই টাওয়ারের ঘণ্টা বাজিয়ে গ্রামের লোক জড়ো করেছেন। দেদার অর্থের বিনিময়ে তাদের ক্রীতদাসের পরিমাণে পরিশ্রম করিয়েছেন। শেষবার যখন এলেন তখন বেতন নয়, শুধুই বেত। এক হাতে বোতল, অন্য হাতে চাবুক। সেইবার এক রাতে তিনি নিজেই নিজেকে ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত করেন। জজ্ সাহেবের শেষ বছরটা বোধহয় মৃত্যুর চেয়েও করুণ। সেটাই কি ওঁর যথার্থ প্রাপ্য নয়? আমি জানি না। আমি বিচারক নই। আমি সিনেমার অন্ধকার ঘরে স্বপ্ন বেচি। আসল সিনেমার ডিরেক্টর তো ঐ উপরওয়ালা – চিত্রনাট্য তাঁর, নির্দেশনা তাঁর, ক্যামেরা তাঁর, স্ল্যাপস্টিক তাঁর।
বিছানায় শরীরটা এলিয়েও গল্প পিছু ছাড়ল না। মাথার তলায় হাত দিয়ে শুয়ে অন্ধকার ছাদের দিকে তাকিয়ে মনে হল আমাদের মতো না-পাওয়া মানুষগুলো বড্ড সুখি। আগের দুটো বই দর্শক বোঝেনি, তৃতীয়টা ফ্লপ হলে টালিগঞ্জ আমাকে বুঝে নেবে। তবু আমি ভালো আছি। আকাশ কুসুম ভাবতে ভাবতে হঠাৎ স্বপ্ন, বাস্তব, ঘুম সব কিছু মিশিয়ে চেতনার এক পাঁচমেশালি চানাচুর স্তরে চলে গেলুম। তুঙ্গভদ্রার তীরে জালার মত পেট বার করে ঘন্শাম্ বাবু জগিং করছেন। অম্বা মাঈ কোত্থেকে একটা জং ধরা তরোয়াল তুলে এনে ওঁকে তাড়া করতে শুরু করলেন। ঘন্শাম্বাবু চীৎকার করছেন, “খাবো না খাবো না! লঙ্কা পকৌড়া খাব না। আমার ছেলে আপনার কী ক্ষতি করেছে?” হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে বদ্রী ঘুরে তাকাল। সারা মুখে রক্ত। দরদর করে ঘামতে ঘামতে ঘুম থেকে উঠে শুনলাম আবার সেই কানে তালা ধরানো শব্দ।
আজ আরো ভয়ঙ্কর, আরো তীব্র। জানলাগুলোও আজ খট্খট্ করে কাঁপছে। রান্নাঘরে বাসন পড়ছে। খাটের পায়ায় শব্দগুলো আছড়ে পড়ছে। খাট কেঁপে উঠছে। ঘরের দরজায় ধাক্কা লাগছে, দরজা নড়ে উঠছে। বালিশের তলায় হাত রাখলাম টর্চের খোঁজে। শূন্যে ধাক্কা খেল হাতটা। পাগলের মত গোটা খাট খুঁজলাম টর্চের জন্য। কোথাও নেই। শব্দটা আটকানোর জন্য কানে বালিশ চেপে ধরে রইলাম কিছুক্ষণ। এভাবে কতক্ষণ শোওয়া যায়? আগের রাতে ভয় হয় নি। আজ ভয় হলো। শব্দ, অন্ধকার আর বালিশের ভ্যাপসা গন্ধে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার অল্প আগে চীৎকার জুড়লাম। এক চীৎকারে শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। অন্ধকারের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে বসে রইলাম। সেটা জানলার দিক, না দরজার দিক, কিচ্ছু মাথায় এল না।
এরপর ঘুম এল ভোরের দিকে। সকালে আবার চকোরীর দরজা ধাক্কায় ঘুম ভাঙল। চকোরীর হাতে অনবদ্য পুরি সব্জি দিয়ে প্রাতরাশ হল। আজ আর কোনও প্রশ্ন করে ওকে বিব্রত করলাম না। সকালে লেখা এগোল অনেকটাই। দুপুরে লাঞ্চ করে পাড়া ঘুরতে বেরলাম। গ্রামের পূর্ব দিক করে ছোট একটু সবুজ জমি। হলুদের মাঝে খাপছাড়া ভাবে কিছু ঘাসের উপস্থিতি। একটি ছেলে দেখলাম ছাগল চরতে দিয়ে রাবনহট্টা বাজাচ্ছে। আস্তে করে পিছনে গিয়ে বসলাম, যাতে বাজনা না থামায়। বুকে মোচড় তোলা সুরটা ছড়িয়ে পড়ছে বালির এক টিলা থেকে আর এক টিলায়। কলকাতার অনেক বিকেল, মিতিন আর আমার ঝগড়ায় মায়ের মধ্যস্থতা, বাবার ফেলে যাওয়া খড়ম, বাক্সবন্দী মায়ের ছবিটা ভিড় করে আসতে লাগল। এবার একটা চেনা সুর বেজে উঠল - ‘কেন জানিনা যে, বেণু বাজে মনমাঝে’। উত্তমদার ‘রাজকন্যা’। এ কী করে সম্ভব! এই প্রত্যন্ত রাজস্থানি গ্রামে বাংলা সিনেমার গান! কিছুক্ষণ পর মনে হলো, ছেলেটির সুর পাল্টায়নি। ওর সুরের সঙ্গে আমার ‘দুঃশালা! খুব হয়েছে, এবার কলকাতা পালাব’ ভাবটা মিশে গিয়ে শ্রবণযন্ত্রকে ধোঁকা দিয়েছে।
ছেলেটি বাজনা থামিয়ে ছাগল জড়ো করতে লাগল। কয়েক মিনিট পর আমার পাশ দিয়ে চলে গেল ওরা। নিঃসঙ্গ বসে রইলাম অনন্তকাল ধরে। আকাশ লালচে হলে বালিতে ভর দিয়ে উঠতে গেলাম। একটা কাগজে হাত ঠেকল। চার ভাঁজ করা কাগজটা পড়ে ছিল আমার ঠিক পেছনে। ভাঁজ খুলে চোখ বোলাতে দেখলাম উলটো ধরেছি। সোজা ধরে দেখলাম হিন্দি হরফে রাজস্থানি কথা লেখা, “দড়ি তোমায় খুঁজছে। পালাও।” কিম্বা “তুমি দড়ি খুঁজছ? দৌড়ও।” আজও জানি না, কাগজটা আমার পেছনে কে ফেলে গেছিল।
বিকেল থেকে শুধু বায়ু সেবন করেই আছি। রাতে লেখার পাট চুকিয়ে তাড়াতাড়ি উদরের সেবা সেরে নিলাম। এবার অপেক্ষা করতে লাগলাম শব্দের। হয় এই বাড়িতে শব্দের রহস্য থাকবে, নয় আমি। কিন্তু আজ আর কোনও শব্দ নেই। একটা সময় চোখ জুড়ে ঘুম এল। ঘুমের বয়স বাড়ার আগেই শব্দ উঠল। আবার সেই মাটি কাঁপান শব্দ। দিন দিন যেন শব্দের তীব্রতা বাড়ছে। দরজা জানলা সব কাঁপতে লাগল। কিন্তু আজ রাতটা অন্য। কোথাও পড়েছিলাম, সাহসের থেকে কৌতূহলে ভয় বেশী কাবু হয়। তাই আজ মশারির ভেতরে আমি ছিলাম না। শোওয়ার ঘরেও না। আমি ওত পেতে ছিলাম প্রবেশকক্ষে, শোওয়ার ঘরের দরজার অল্প কাছে এক চেয়ারে। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। এরপর আর কোনোদিন অবশ্য কোনও ভুল করিনি।
দুম্ করে টর্চ জ্বেলে ফোকাস করলাম শোওয়ার ঘরের মেঝেতে। শয়ে শয়ে মিশকালো ইঁদুর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল আলোর দিকে, আমার দিকে। চোখগুলো জ্বলজ্বল করে উঠল। ঘরের জানলা বেয়ে উঠছে, দরজা বেয়ে উঠছে, আলমারি বেয়ে উঠছে। কাতারে কাতারে। এবার আমার দিকে ধাওয়া করল। আমি পড়িমরি করে ছুট লাগালাম স্টাডির দিকে। ঢুকেই পেছনে দরজা বন্ধ করে দিলাম। দুতিনটে ঢুকে পড়েছে ততক্ষণে। তারা দেখলাম হারিয়ে গেল একটা বইয়ের তাকের পেছনে।
ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বালিয়ে নিলাম। সঙ্গে দুতিনটে মোমবাতি। যাক্! রহস্যের সমাধান হল শেষ পর্যন্ত। নিজের বুদ্ধি নিয়ে গর্ববোধ না করে পারলাম না। জব্বর ফাঁদ পেতেছিলাম, কি বলেন! আর এ বাড়িতে নয়। হয় শালারা আমাকে চিবিয়ে খেয়ে নেবে, নয় আমি প্লেগ হয়ে মরব। খুব বেঁচেছি। কিছুক্ষণ আপন মনে হেসে নিলাম। ভূত টুত কত কি না ভাবছিলাম! সেটা মনে পড়ে লজ্জাও পেলাম ভীষণ। আজ রাতটা এই রিডিং রুমের টেবিলটাকে বিছানা বানিয়ে কেটে যাবে। কাল চকোরীর হাতে প্রাতরাশ করে আই উড রাশ্ আউট।
টেবিলে উঠে শুতে যাব, দেখলাম দুটো বই পড়ে রয়েছে কোণে। একটি তো ইয়োরস্ ট্রুলির বই - তুঙ্গভদ্রার তীরে। আর একটি বই কোত্থেকে এল ভগবানই জানেন। বইটা খুলে দেখলাম, প্রথম পাতার শিরোনাম ছাড়া কোনও পাতায় কিচ্ছু লেখা নেই। হলদেটে হয়ে যাওয়া পাতার পর পাতা। ছোপ রয়েছে, ছাপা নেই। সরিয়ে রেখে দিয়ে সেজ হয়ে ওঠা মেজে শুয়ে পড়লাম।
দেওয়ালের ছবিগুলোর দিকে চোখ যেতে একটু অস্বস্তি হল। ভূতের মতো আমার দিকে চেয়ে আছে যেন। ভূত কিরকম করে চেয়ে থাকে সেটা বিশেষ জানিনা যদিও। কিন্তু মনে হল কুতকুতে চোখে ভূত চেয়ে থাকলে এরকম চাহনিই হত। ছবিগুলো দেওয়ালের দিকে মুখ করে ঘুরিয়ে রাখতে রাখতে একটা নতুন ছবিতে দৃষ্টি আটকে গেল। মধ্যমণি হয়ে দাঁড়িয়ে ক্লার্ক সাহেব। হাতে ধরা একটা ফাঁসির দড়ি। পাশে, পেছনে, সামনে কয়েদীর পোশাক পরে বহু লোক। খুব সম্ভবত বেশ ক’বছর ধরে সাহেবের সব শিকারের ছবি একসঙ্গে। সুপার ইম্পোজিশন করে তৈরি করা হয়েছে। শুধু একটা লোকের মুখ সাদা করে দেওয়া, হয়তো জল ঘষে ঘষে। নির্ঘাত সেই লোকটা যার ভাই এসে পুরো পরিবারটা তছনছ করে দেয়।
একটা বালিশ দরকার। এখন বালিশ কোথায় পাই? প্রথমে হাতটা মাথার নিচে রেখে শুতে চেষ্টা করলাম। মনে ধরল না। এবার সেই সিংহাসনের মত চেয়ারটার কথা মনে পড়ল। সেটার সীটটা বোধহয় খুলে নেওয়া যায়। লে ব্যাটা, রাজা তো হতে পারলি না। এবার যেখানে রাজার পাছা বিরাজ করত, সেটা মাথায় দিয়ে শো। সিংহাসনের কাছে পৌঁছে চমকে গেলাম।
চেয়ারের ওপর বসে রয়েছে ধেড়ে একটা ইঁদুর। এত বড় ইঁদুর আমি কোনোদিন দেখিনি। শরীরটা প্রায় কুড়ি ইঞ্চি লম্বা। মুখটা ভোঁতা। আমার দিকে তাকিয়ে। গা ঘিনঘিন করে এল। ফাঁকা পাতার বইটা নিয়ে ছুঁড়ে মারলাম। অত্যন্ত দ্রুত গতিতে পালাল ইঁদুরটা। সেই বইয়ের তাকের আড়ালে যার পেছনে বাকি তিনটে গিয়ে লুকিয়েছিল। শোয়া মাথায় উঠল। আমি তাক থেকে কয়েকটা ইংরেজি বই নামিয়ে রাখলাম টেবিলে... অস্ত্র হিসেবে। জেগে থেকে বরঞ্চ লেখাটা আরও এগিয়ে নিয়ে যাই। শরদিন্দুবাবুর বইয়ের ত্রিশ পাতাটা খুলে তাতে মন দিলাম। বইয়ের পাতায় চোখ রেখে সিংহাসনে শরীরটা এলিয়ে দিতে যাব, ইঁদুরটাকে ছুঁয়ে ফেললাম।
কখন ব্যাটা ফিরে এসে আবার বসে পড়েছিল চেয়ারটায়। টের-ই পাইনি। আমি প্রায় ওর ওপর বসে পড়ছিলাম। ছোঁয়া লাগতেই তীব্র চীৎকার করে পালাল ইঁদুরটা। তীক্ষ্ণ ডাকটা কানের মধ্যে রয়ে গেল। আমি অন্য একটা চেয়ার টেনে এনে সিংহাসনের উল্টো দিকে বসলাম। ফায়ারপ্লেসের উষ্ণতায় চোখ বুজে এল কিছু পরে। হাত থেকে বই খসে পড়ার শব্দে ঘুম ভাঙল। বইটা হাতে তুলে নিতেই চোখ গেল উল্টোদিকের সিংহাসনে। আবার ইঁদুরটা এসে বসে রয়েছে সেখানে। এবার একটা শেক্সপীয়র তুলে ছুঁড়ে মারলাম। মোক্ষম টিপ। আবার তীক্ষ্ণ শব্দ করে পালাল শুয়োরের বাচ্চার সাইজের ইঁদুরটা।
এবার ভেতরে একটা অদম্য ইচ্ছে হল ওটাকে মেরে ফেলার। দাঁতে দাঁত চেপে এগিয়ে গেলাম সেই বইয়ের তাকটার দিকে। শরীরে কেমন যেন অসুরের বল এসে গেছে। ঠেলে সরাতে লাগলাম তাকটা। পেছন থেকে ইঁদুরটাকে বের করে এনে পিটিয়ে মেরে ফেলব। তাকটা সরতেই হাঁ হয়ে গেলাম। পেছনে একটা পাল্লাহীন আর্চ শেপের দরজা, ফুট ছয়েক লম্বা। ফায়ারপ্লেসের আবছা আলোয় মনে হলো, দরজার ওপাশে একটা ফুট তিনেক ব্যাসার্ধের গোলাকার ঘর। বাইরে থেকে ঘরের ছাত দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু ছাত থেকে একটা মোটা সাদা দড়ি ঝুলছে, সেটা স্পষ্ট দেখতে পেলাম। দড়িতে ঝুলছে আমার শিকার। আর একটা গাব্দা সাইজের বই ছুঁড়ে মারলাম। দড়ি দুলে উঠল। ইঁদুর পালাল আরো ওপরের দিকে। আমার চোখের আড়ালে। বেপরোয়া ভাবে, হাতে মোমবাতি নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়লাম। নাকে দুম করে একটা কটু গন্ধ লাগল। সাধারণত গলা পচা কুকুরের দেহ ঘিরে এই গন্ধটা পেয়েছি।
ছাতের দিকে তাকাতে দেখলাম, কোথায় ছাত, কোথায় কী? এটা কোনও ঘরও নয়। আমি বেল-টাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে আছি। মাথার অনেক উঁচুতে ঘণ্টা ঝুলছে। যে ঘণ্টা বাজিয়ে ক্লার্ক সাহেব ক্রীতদাস জড়ো করতেন। মোমবাতিটা একটু উঁচু করে ধরতে চোখে পড়লে ইঁদুরটা অনেক উঁচুতে উঠে গেছে। শাসনের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে। এবার আমার পিছন দিক থেকে একটা শব্দ উঠল। সেই শব্দ। দরজা কাঁপানো, জানলা কাঁপানো। তাকিয়ে দেখলাম, স্টাডি ঘরের মেঝে, টেবিল, বুকশেল্ফ, মেঝের ধারে ধারে গর্ত, সব কালো কালো ইঁদুরে ভর্তি। আমার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে। কে কার ফাঁদে পা দিয়েছে এবার টের পেলাম! ওপর দিকে আর একবার তাকাতেই ঝাঁপ দিল বড় ইঁদুরটা। নড়াচড়ার সময় পেলাম না। ইঁদুরটার ভার না নিতে পেরে আমার মাথাটা গিয়ে ধাক্কা খেল ঘণ্টা-মিনারের কালো দেওয়ালে। তারপর কী ঘটল আমার আর কিছু মনে পড়ে না।
ঘুম ভাঙল চকোরীর দরজা ধাক্কায় আর প্রচণ্ড ঘণ্টার আওয়াজে। লাইব্রেরির টেবিলে শুয়ে আছি আমি। শুধু চকোরী নয়। দেখলাম বহু গ্রামবাসী ঢুকে পড়ল ঘরে। প্রথমে রান্নাঘরে গেল। তারপর শোবার ঘরে। তারপর ছিটকে বেরিয়ে এসে সকলে ঢুকল স্টাডিতে। আমার দিকে বিস্ময় নজরে একবার তাকিয়ে সবাই ছুটল মিনারের তলার অন্ধকারে। বেরিয়ে এসে সেকি উল্লাস। কেউ ঈশ্বরকে ডাকছে। কেউ ঘন্শাম্ বাবুর নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে। একজন আমার নামেও পেন্নাম সেরে নিল। একজন গিয়ে ক্লার্ক সাহেবের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমাদের নিবেদন গ্রহণ করুন। ঘন্শাম্ বাবু আবার পাঠাবেন। হয়ত সময় লাগবে। কিন্তু পাঠাবেন নিশ্চিত।”
পাশ থেকে একজন কাঁধে হাত রেখে বলে উঠল, “প্রণাম করে লাভ নেই। তিন মাস অন্তর নৈবেদ্য না পাঠালে রেয়াত মিলবে না। এবার দেরী হওয়ায় লাখানকে হারিয়েছি। পরেরবার হয়ত তুমি, কিম্বা আমি।”
আমি সবাইকে অনুরোধ করতে লাগলাম বেরিয়ে যাওয়ার জন্য। এক কথাতেই কাজ হল। লোকজন দ্রুত ঘর ছেড়ে পালাল। বাইরে থেকে লক্ বন্ধ করার শব্দ হতে আবার বাড়িটা নিশ্চুপ হয়ে গেল। ঘণ্টা বন্ধ হয়ে গেছে, লোকজনের সোরগোল নেই, ইঁদুরের দাপাদাপি নেই। ওফ্, যা একখানা রাত গেল! কপালে এখনো বেশ ব্যথা। তা অত জোরে দেওয়ালে গুঁতো খেলে এতটাই লাগার কথা।
ইচ্ছে হলো, দিনের বেলা একবার ঘণ্টাটা নিচ থেকে দেখা যাক। ইঁদুর বেটা কোথায় গা ঢাকা দিয়ে থাকে আমিও দেখব। অন্ধকার ঘরটায় পা রেখে ওপরে তাকালাম। সারা শরীর ভয়ে শিউরে উঠল। ঘণ্টার দড়িতে একজন মানুষের রক্তাক্ত দেহ ঝুলছে। সারা শরীরের মাংস খুবলে খুবলে খাওয়া। পা’টা তো প্রায় পুরোটাই খাওয়া হয়ে গেছে। প্রচণ্ড জোর বমি পেয়ে গেল। ছিটকে বেরিয়ে চলে এলাম। মাথা ঘুরতে লাগল। টলতে টলতে দেওয়ালের ছবিগুলোর দিকে এগিয়ে গেলাম। আচমকা চোখ পড়ল ক্লার্ক সাহেবের সেই ছবিতে। দেওয়াল থেকে খুলে নিলাম হাতে। মধ্যমণি হয়ে দাঁড়িয়ে ক্লার্ক সাহেব। হাতে ধরা একটা ফাঁসির দড়ি। পাশে, পেছনে, সামনে কয়েদীর পোশাক পরে বহু লোক। খুব সম্ভবত বেশ ক’বছর ধরে সাহেবের সব শিকারের ছবি একসঙ্গে। সুপার ইম্পোজিশন করে তৈরি করা হয়েছে। শুধু একটা লোকের মুখ... না! সাদা নয়... খুব চেনা। প্রতিদিন মুখটা আয়নায় দেখতে পাই।
হাতটা কেঁপে গিয়ে ছবি পড়ল মাটিতে। ফাঁকা ঘরে কাচ ভাঙার ঝন্ঝন্ শব্দ উঠল। দেওয়ালে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ঘুরতে লাগল শব্দটা। চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম, যত্রতত্র বই পড়ে রয়েছে। টলতে টলতে চেয়ারের উদ্দেশে পা বাড়াতেই একটা বই পায়ে লাগল। সেটা কপালে ছোঁয়ালাম অভ্যাসবশত। সেই বইটা, যার পাতা ভরা শুধুই শূন্যতা। আর একবার খুললাম বইটা। সে কী!
বইয়ের পাতায় পাতায় লেখা। অসম্ভব! আগের রাতেই দেখেছি একটি পাতাতেও কালির আঁচড় নেই। প্রথম পাতায় চোখ রাখতেই মনে হল পায়ের তলা থেকে কেউ যেন মাটি সরিয়ে নিয়েছে। যা দেখলাম, সেটা বিশ্বাস হলো না। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আবার বইটা চোখের সামনে মেলে ধরলাম। প্রথম পাতায় লেখা -
এবার লেখা পড়তে পারছেন?
লেখাটা পড়তে পারলে অন্য এক ডাইমেনশনে আপনাকে স্বাগতম। এই ডাইমেনশনে এটাই আপনার প্রথম পাঠ। রাজস্থানের কনোই গ্রামের গল্প দিয়ে শুরু করি।
“আপকে ‘রাজ্জো’ মে ... না ‘রাজ্জো’ হবে না ‘রাজ্ইয়্যো’ হবে ... আপকে ‘রাজ্ইয়্যো’ মেঁ সন্দেশ পাওয়া যা রহা হ্যাঁয়?” বাহনচালক হনুমন্তকে জিজ্ঞেস করলাম।