Advertisment

যোগবিয়োগের প্রভাত চৌধুরী

কবিতারাজ্যে প্রভাত চৌধুরীর জন্ম পোস্টমর্ডান বা উত্তর আধুনিক কবি হিসেবে মোটেই হয়নি।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

কবি প্রভাত চৌধুরী প্রয়াত


নীলার্ণব চক্রবর্তী: 'রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, তার পর আমি।' যিনি বললেন, তাঁর নাম প্রভাত চৌধুরী। পটলডাঙা স্ট্রিটের ছাদের ঘরে কবিতাপাক্ষিকের অফিসে বসে আছি তখন, সবে ২০০০ সাল পড়েছে। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কেউ কি নিজের সম্পর্কে এমন বিস্ফোরক বলতে পারেন! শুধু তাই নয়, প্রভাত চৌধুরী বললেন, ওই যে দেখছ পেপারওয়েট, ওইটি শতদল ঘোষ (নাম নিয়েছিলেন এক প্রসিদ্ধ কবির, শিষ্টতার খাতিরে তা বলা যাবে না)। এমন আরও কয়েকটি বস্তু দেখিয়ে আরও কয়েক জন হেভিওয়েট কবি-লেখক, যাঁরা হাতে মাথা কাটেন তখন, তাঁদের নাম বলে গেলেন, পান খেতে খেতে। হাঁ আমার ধীরে ধীরে বড় হচ্ছিল শুনতে শুনতে। এ সব কী বলছে-রে বাবা এই লোকটা! চেতনা আমার চলকে পড়ে যাচ্ছিল মেঝেতে, খাচ্ছিল নুটোপুটি। হাঁ-য়ের ভিতরে একটি মাছি ঢুকে যেতে জ্ঞান ফিরল শেষ পর্যন্ত। ছাদের ঘরে ওই সাক্ষাৎ, প্রভাত চৌধুরীর সঙ্গে প্রাথমিক আলাপপর্বে হয়েছিল। তাই হাহাকারের মতো ওই অবাক-পানা হাঁ-টা ছিল। কিছু দিনে বুঝে গেলাম, এমনই ইনি বলে থাকেন। এটা ওঁর ব্যক্তিত্বের প্রকাশ। ম্যানারিজমও বলা যায়। গিমিক বুনে বুনে যা তৈরি করা। তাঁর গুরু, বাংলার এক দুরন্ত লেখক, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। প্রভাত চৌধুরীর ওই গিমিকাল ডেলিভারির মধ্যে শ্যামলগন্ধ মিশে থাকত, অন্তত ভরি'খানেক ।

Advertisment

আরও কিছু দিনেই তৎসহ বুঝতে পেরেছিলাম প্রাতিষ্ঠানিক অসম্মান তাঁর আনখশিরে আগুন ধরিয়ে রেখেছে, অবহেলা তাঁর কপাল ফুঁড়ে মস্তিষ্কে গোলযোগ করছে। তাই তাঁর ব্রেন এই ভাবে প্রতিষ্ঠানিক নামী কবিদের নস্যাৎ করে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধ ঘোষণা করে যাচ্ছে। পাল্টাও আসছে, লাগাতার। তিনি যদিও বিদ্রোহী রণক্লান্ত হওয়ার পাত্র নন, শান্ত হবারও নন, বুঝতে পারছিলাম। তাই বিরাট বড় সব পত্রিকার সমকক্ষ-স্বীকৃতি নিজেই দিয়ে দিয়েছিলেন নিজের পত্রিকা কবিতাপাক্ষিক-কে। গ্রাম-গঞ্জ-মফসসলের গাদা গাদা কচি-কাঁচা-তরুণকে দিয়ে সেখানে লেখাচ্ছিলেন। লেখার মান অনেক সময়ে বিতিকিচ্ছিরি, কিন্তু তাতে প্রভাত চৌধুরীর কিছু যায়-আসত না। তিনি বলে যাচ্ছিলেন, এক শতাব্দীতে অগুনতি লোক কবিতা লিখে থাকে ভাই, হাতে গোনা দু'-তিন জন মহাকালে বেঁচে থাকে, তাই কত জন লিখছে সেটা মোটেই বড় কথা নয়। তা ছাড়া আজ যে খারাপ লিখছে, কাল সে যে ভাল লিখবে না, তা কে বলতে পারে গো! জল কোথা থেকে কোথায় গড়ায় কেউ তা জানে না। ফলে সংখ্যা যত বেশি তত ভাল কবি তৈরির সম্ভাবনা থাকছে, থাকছে কি না! এবং কবিতাপাক্ষিক গুচ্ছ গুচ্ছ কবির জন্ম দিতে থাকল ক্রমে, কবি তৈরির কারখানা একটা।

প্রভাত চৌধুরী তো রবীন্দ্রপূজারী, তায় রবীন্দ্রনাথের অনুসারীও, ফলে তাঁর ভক্তকুলের প্রয়োজনও ছিল। গুচ্ছগুচ্ছ লেখা ছাপিয়ে সেই ভক্তদল তিনি পেয়ে গেলেন। পাতাল চিরে উঠলেন সদলবলে।

গত সহস্রাব্দ শেষের লপ্তে পোস্টমর্ডান আন্দোলনের ছোট হলেও পায়াভারি ঢেউ উঠেছিল বাংলায়। মলয় রায়চৌধুরী-সমীর রায়চৌধুরীরা হাংরি আন্দোলনের ওভারকোট তখন খুলে রেখে, পোস্টমর্ডান চক্করখোপ জামা গায়ে দিয়েছেন। এমন আরও বেশ কয়েক জনের নাম করা যেতে পারে, যাঁরা পোস্টমর্ডান লেখক হিসেবে নিজেদের চিহ্নিত করে হাততালি কুড়োচ্ছেন। প্রভাত চৌধুরী ও তাঁর পত্রিকা সেই পোস্টে নিজেদের তরণীটি বাঁধে দিল তখন। ওই যে গুচ্ছ গুচ্ছ প্রান্তিকের কবি কবিতাপাক্ষিকে নিজেদের প্রকাশ করে চলেছেন, তাতে ওই পোস্টমর্ডান তত্ত্বও এঁটে গেল। প্রভাত চৌধুরী তাঁর নানা গদ্যে সেই সব নানা কবির লেখা বিচার করে পোস্টমর্ডান নানা গুণ টেনেটুনে বার করলেন। নিজের লেখা থেকেও ভূরি ভূরি তেমন চিহ্ন আবিস্কার করলেন। এক দিকে তিনি রবীন্দ্রনাথের যোগ্য উত্তরসূরি, এবং সেই যোগ্যতা বলে পোস্টমর্ডান কবিতা লিখছেন। তাঁর বিচারে তিনি সেই সব লেখাই লিখে চলেছেন, যা রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে লিখতেন।

তা ছাড়া প্রান্তজনের সখা তো তিনিই হবেন, কারণ প্রতিষ্ঠান তাঁকে অস্বীকার করেছে। তাঁর চেহারাটি সেই মতো, খাপে খাপ এক্কেবারে। কোনও ব্রাহ্মণ্যগন্ধ নেই-- কৃষ্ণবর্ণ, মাঝারি উচ্চতা এবং শীর্ণকায়। তাতে দাড়ি রেখে, ওই রবীন্দ্র-যোগ। বহু কবি যাঁরা প্রতিষ্ঠানে একেবারেই কলকে পাচ্ছিলেন না, মূলত তাঁরা নিজেদের উজাড় করে দিলেন কবিতাপাক্ষিকে। প্রান্তিককে টেনে হিঁচড়ে মূলস্রোতে এনে ফেললেন চৌধুরীর মশায়। উত্তর আধুনিক চিন্তাধারার মহাজন জাক দেরিদা তখন মুখে মুখে ফিরছে। দেরিদা ফরাসি, আলজেরিয়ার ইহুদি, ভেদাভেদে দেরিদাও কেঁদেছেন, তা আমাদের অবহেলার স্বীকার দাদা-রা বেশ দেরিদা আলোয় মানিয়ে গেলেন। মন্দ হল না কিন্তু ব্যাপারটা।

না, কবিতারাজ্যে প্রভাত চৌধুরীর জন্ম পোস্টমর্ডান বা উত্তর আধুনিক কবি হিসেবে মোটেই হয়নি। অনেক আগে থেকে কবিতা লিখছিলেন, ধ্বংসকালীন আন্দোলন বলে একটি ক্ষীণতনু ধারাতেও ছিলেন, এবং সেই থেকেই তাচ্ছিল্যের ওম নিচ্ছিলেন, তাঁর লেখা চেনা ছন্দ-- অক্ষরবৃত্ত-ঘেঁষা, কিন্তু একেবারেই চেনা-রকমের নয় সে লেখা। ফলে বড় পত্রিকা কেনই বা ছাপবে। সাক্ষাৎকার, আবার সাক্ষাৎকার, নোটবই-এর মতো কবিতার বই তিনি সহস্রাব্দের শেষ বেলায় লিখে নিজের আলাদা-টা চিনিয়ে ছিলেন, এবং এই সব লেখার সময়ে পোস্টমর্ডান বাবু ও বোদ্ধারা তাঁর কবিতায় সেই গুণটি দেখতে পেলেন, এবং প্রভাত চৌধুরীও তা জানতে পেরে যেন পুনর্জীবিত হলেন-- জয় মা বলে তরিটি ভাসলেন। প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তাঁরা তড়িদ্বেগে এগোতে থাকলেও, এই নয় যে, কবিতাপাক্ষিকের লেখকরা বড় প্রতিষ্ঠানে লেখেননি, লিখেছেন অনেকেই।

প্রভাত চৌধুরী কবির সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশক, তার পর তাত্ত্বিক। নানা বড় বড় পরিকল্পনা দেখা গেল বেরচ্ছে তাঁর আস্তিন থেকে। কবিতাপাক্ষিকে তিনিই শেষ কথা, বিরোধিতাকে আমল দেওয়ার প্রবণতা তাঁর কম, তাই কবিতার দুই লাইনের মাঝখানের ফাঁকে অসন্তোষও দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু প্রভাত চৌধুরী গায়ে সেই সব কোনও আঁচ লাগায়নি। 'একটা গাছে যদি ৫টি পাখি এসে বসে, তা থেকে যদি/ ২টি উড়ে যায়, তা হলে গাছটিতে যে ৩টি পাখি/ বসে থাকবেই, এটা ঠিক নয়। এমনও হতে পারে,/ যে ২টি পাখি উড়ে গেল, তাদের দু'-একটি নরম পালক/ লেগে থাকবে ডালে, আর তাদের ছায়া!/ তাদের ছায়া তো উড়ে যেতে পারে না গাছ থেকে,/ গাছের ডাল থেকে।/ তা হলে দেখা যাচ্ছে বিয়োগ চিহ্নের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে/ পাখির কথা, পাখিদের হ্রদের কথাও…' -- এই হল টিপিকাল প্রভাত চৌধুরীর কবিতা, এবং এই-মতো যে সব পাখি তাঁর গাছ থেকে উড়ে গিয়েছিল, যে শোক প্রভাত চৌধুরীরের মনে বোঁও বোঁও ঘুরত, সেই চলে যাওয়া পাখিদের পালক তো ছিলই লেগে কবিতাপাক্ষিকে, সেইটা কি তাঁকে সান্ত্বনা দেয়নি এতটুকুও? যেমন প্রভাত চৌধুরী আর নেই, কিন্তু বিয়োগের মধ্যে যোগ হয়ে তো থাকছেন। থাকছেন বলেই না লিখছি! আমি দেখেছি, অনেক বিদ্রুপ-হাসি হয়েছে তাঁর চক্রের ঠিক অদূরে। সেই হাসি, মশকরার শব্দগুলি ভেসে এসেওছে তাঁর কানে, স্বাভাবিক ভাবেই। কিন্তু মৃত্যু তো কান-মুখ দুটোই কেড়ে নেয়, শুধু নানা রঙের কালি পড়ে থাকে হরফে হরফে।

Prabhat Chowdhury
Advertisment