ফিচার: চার্জার

বয়সের দিক থেকে প্রবীণ না হলেও বেশ কিছুদিন ধরেই বাংলা ভাষায় গল্প ও গদ্য লিখে আসছেন বিনোদ ঘোষাল। ব্যক্তিগত মুন্সিয়ানার সুবাদেই তাঁর লেখা, তা সে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হোক বা না হোক, নজর কেড়েছে পাঠকমহলের।

বয়সের দিক থেকে প্রবীণ না হলেও বেশ কিছুদিন ধরেই বাংলা ভাষায় গল্প ও গদ্য লিখে আসছেন বিনোদ ঘোষাল। ব্যক্তিগত মুন্সিয়ানার সুবাদেই তাঁর লেখা, তা সে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হোক বা না হোক, নজর কেড়েছে পাঠকমহলের।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

বিনোদ ঘোষাল

লেখাটি লিখতে বসেই কিছুদিন আগে দেখা একটা শর্টফিল্মের কথা মনে পড়ে গেল। মিনিট ছয়েকের থ্রিডি অ্যানিমেটেড সেই ছবির নাম ছিল 'চার্জিং ব্যাটারিজ'। ছবির গল্পটা এইরকম, এক বৃদ্ধা গ্রামের বাড়িতে একা থাকেন। একদিন তাঁর কাছে একটি পার্সেল এল। সঙ্গে ছোট একটি চিঠি। পাঠিয়েছে তাঁর প্রবাসী ছেলে। এই বছর সে কাজের কারণে বাড়িতে ফিরতে পারবে না। তাই মায়ের দেখাশোনার জন্য সে ওই পার্সেলে পাঠিয়েছে দারুণ একটি জিনিস, মা পার্সেল খুলে দেখলেন ছেলে পাঠিয়েছে ছোট্ট একটি রোবট। তো সেই রোবট বৃদ্ধার সঙ্গে থাকে, ঘরের বাগানের যাবতীয় কাজ করে, তারপর সন্ধেবেলা ঘরের বারান্দায় বসে সূর্যাস্ত দেখে। দুজনের মধ্যে ভারি সুন্দর একটি সম্পর্ক তৈরি হয়। দুজন দুজনের বন্ধু হয়ে ওঠে।

Advertisment

একদিন খাবার টেবিলে দুজন গল্প করতে করতে বৃদ্ধা দেখেন রোবটটি নেতিয়ে পড়ছে। তিনি বুঝতে পারেন তার চার্জ শেষ হয়ে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে রোবটের বুকের মাঝখানে রাখা ধাতব পকেটটি খুলে পুরনো ব্যাটারি রিপ্লেস করে দেন, রোবট আবার নতুন  উদ্যমে বেঁচে ওঠে। এভাবেই চলতে থাকে জীবন।

একদিন বৃদ্ধার ডাকবাক্সে দুটো সার্কাসের টিকিট আসে। বৃদ্ধা সেই রোবটকে নিয়ে সার্কাসে যাবেন ভাবেন এবং সার্কাস জিনিসটি কী, তা ওই ছোট্ট রোবটকে বুঝিয়ে দেন। বালক রোবটটি শুনে ভারি উচ্ছসিত। কিন্তু তার পরদিন থেকেই বৃদ্ধা অসুস্থ হয়ে পড়েন, বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা বাড়তে বাড়তে একদিন বিকেলের দিকে চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে নেতিয়ে পড়েন। রোবটটি ভাবে তার মতো বৃদ্ধারও বুঝি চার্জ শেষ হয়ে এসেছে। সে তখনই ঘরে গিয়ে তার জন্য রাখা ব্যাটারি নিয়ে এসে বৃদ্ধার ফতুয়ার পকেটে সেই ব্যাটারি ভরে দেয়। কিন্তু সে তো আর জানে না, মানুষের চার্জার রোবটের মতো রিপ্লেস করা যায় না। একবারের জন্যই চার্জ নিয়ে তাঁর এই পৃথিবীতে আসা। চার্জ শেষ তো গল্প শেষ। রিচার্জ করার কোনও সুযোগ নেই। তো বৃদ্ধা প্রাণত্যাগ করেছে সেটা ওই রোবট বুঝতে পারে না। সে ঘরে যত ব্যাটারি ছিল সব এনে বৃদ্ধার শরীরের সব জায়গায় রাখে তবু জেগে ওঠে না সে।

Advertisment

পরের দৃশ্যে দেখা যায়, রোবটটি ঠিক আগের মতোই রোজের কাজগুলো করছে একা একা। গাছে জল দেওয়া থেকে ক্ষেতের কাজ, ঘরদোর মোছা সবকিছু। তারপর সূর্যাস্তের সময় সেই পশ্চিমমুখী বারন্দায় এসে বসেছে সূর্যাস্ত দেখবে বলে। পাশে সেই বৃদ্ধার খালি চেয়ারটি। এমন সময় রোবটটি বুঝতে পারে তারও চার্জ শেষ হয়ে আসছে। আবছা হয়ে আসছে চারপাশের সবকিছু। কিন্তু তাকে ব্যাটারি পাল্টে রিচার্জ করার মতো কেউ নেই। রোবটটি তার শেষ অবস্থায় হ্যালুসিনেশনে চলে যায়। দেখতে পায় তার সেই মাতৃসম বৃদ্ধা পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর এক হাতে দুটি সার্কাসের টিকিট, অন্য হাতটি বাড়িয়ে দেন রোবটের দিকে। তারপর দুজনে হাত ধরাধরি করে হাঁটতে থাকে বিশাল মাঠের মাঝখানে এক সার্কাস তাঁবুর দিকে। ক্যামেরা লং শট থেকে ফেডআউট হতে থাকে। আর মনটা কেমন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।

ছবিটা দেখছিলাম ল্যাপটপে। আর ল্যাপটপ বারবার ওয়ার্ন করছিল আমাকে যে তার চার্জও ফুরিয়ে এসেছে। শিগগিরি যেন তাকে চার্জে বসাই। ছবি শেষ করে ল্যাপটপ চার্জে বসানোর পর ছবিটা এক বন্ধুকে জানাতে গিয়ে দেখালাম মোবাইলেরও চার্জ রিমেইনিং বিলো ফিফটিন পার্সেন্ট দেখাচ্ছে। এক্ষুণি চার্জে বসানোর হুকুম দিচ্ছে আমাকে। মোবাইল চার্জে বসিয়ে বন্ধুকে ফোনে জানালাম ছবিটার কথা। কথা বলতে বলতেই কানেকশন কেটে গিয়েছিল। অতএব আবার রিচার্জ।

সেদিনটায় মজা লেগেছিল বেশ। মনে পড়ছিল আমাদের ছোটবেলায় চার্জ দেওয়া শব্দটা খুব একটা শুনিনি। বড়জোর শুনতাম ঘড়িতে ব্যাটারি বদলাতে হবে। তারপর চাইনিজ টর্চ এল। প্লাগে গুঁজে চার্জ দিলে আবার ফুল লাইট। আমার পৈতের সময় মেজোজেঠু উপহার দিয়েছিল। সেকি সাংঘাতিক উত্তেজনা। ব্যাটারি পালটাতে হবে না। শুধু  সুইচবোর্ডের প্লাগে গুঁজে দিলেই হবে। তখনও জানি না একদিন এই জীবনটা চার্জ সর্বস্ব হয়ে উঠবে, সারাদিনের একটা প্রকাণ্ড অংশ কেটে যাবে এই ভাবনায় যে, সবকটা গ্যাজেট চার্জে আছে তো? নইলে পৃথিবী ভেঙে পড়া বিপর্যয়। মোবাইল, ল্যাপটপ, ইনভার্টার, আইপড, ডিজিক্যামের রিচার্জেবল ব্যাটারি আরও আরও অনেক কিছু। এখন তো চার্জে চলে এমন অনেক গাড়ি, বাইকও বেরিয়ে গেছে। আর কদিন পর হয়ত বড় বড় বাস কিংবা রেলগাড়িও চলবে। শুধু...। শেষে আসছি 'শুধু'-র কথায়।

তার আগে বলি, চার্জার শব্দটা এখন আর শুধুমাত্র কোনও একটি বস্তুর নাম নয়। এটা আসলে একটা কনসেপ্টের নাম। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের রুটিনে ঢুকে পড়েছে চার্জার। শুধুমাত্র ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেট ব্যবহারের জন্যই এই শব্দটা প্রয়োগ করা হয়না। জীবনের প্রায় প্রতিপদে বিভিন্ন অর্থে চার্জ কিংবা চার্জার শব্দটা ব্যবহার করা হয় এখন, আর সেটা টিনেজ থেকে ক্ষীন এজ সকলেই বলে থাকেন। যেমন আমার চার্জ (শক্তি, কর্মক্ষমতা) ফুরিয়ে এসেছে। তোর চার্জারে দম নেই (ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন), কিংবা আজ একটু বডিটা চার্জে বসাতে হবে (অনেক ক্ষেত্রে এর মানে আকন্ঠ মদ্যাপান বা অন্য কোনও নেশা), এমন চার্জার পেলে (সুন্দরী প্রেমিকা) সারাদিন অন থাকলেও ব্যাটারি ডাউন হবে না। এইসবই কয়েকটি নমুনা মাত্র এবং তার থেকেও বড়ো কথা এইসব কথাগুলো সবই রিচার্জের কথা।

চার্জ আর রিচার্জের মধ্যে পার্থক্যটা আমারা অনেক সময়ই গুলিয়ে ফেলি। যেসব জিনিসগুলোকে বার বার চার্জ দেওয়া যায় সেই ক্ষেত্রেই রিচার্জ শব্দটা ব্যবহার করি। দুটি একটি বাদ দিয়ে প্রায় সবকিছুই রিচার্জ করা যায় না শুধু... যাকে রিচার্জ করতে পারলে আর কিচ্ছু চাইনা আমাদের, সেই জীবন একবারের জন্যই চার্জ নিয়ে পৃথিবীতে আসে সে, তারপর ফুরোতে থাকে ফুরোতে থাকে, তারপর যখন চার্জ একেবারে ওয়ার্নিং পয়েন্টে চলে আসে যাহ, এখনও অনেক টকটাইম, অনেক আনইউজড ডেটা পড়ে রইল যে কিন্তু আর সময় নেই।

এ এমনই যন্ত্র যে রিচার্জ করার আর উপায় নেই। জীবনের অধিকাংশই অনর্থক ইউজড হয়েছে তখন খেয়ালই ছিল না। ফালতু কথা, ফালতু খেলায় কাটিয়ে ফেলেছি প্রাইমটাইম। আর উপায় নেই। শেষ মুহূর্তে এই ওয়ার্নিং পয়েন্টে কেউ কেউ শেষ চেষ্টা করেন একেবারে অফ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত ওই বাকি সময়টুকু কাজের কাজগুলো চটপট সেরে ফেলতে। কেউ কিছুটা পারেন, কেউ পারেন না, সবার ব্যাটারির ক্ষমতা তো সমান হয় না। তারপর অজান্তে অন্য কেউ ডাক দিলে 'দ্য পারসন ইউ আর ট্রাইইং টু রিচ ইজ নট রিচেবল অ্যাট দিস মোমেন্ট, প্লিজ কল লেটার'। আর পৌঁছানোর উপায় নেই তাঁর কাছে।

রিচার্জ নিয়ে লেখাটা এখানেই শেষ হতে পারত, কিন্তু খামোখা আবার একটা মজার চুটকি মনে পড়ে গেল শেষে। মধুরেণ সমাপয়েৎ-এর চেষ্টা। 

এক ভিখারি এক ভদ্র লোকের কাছে এসে বলল, 'স্যার দশটা টাকা দেবেন, ছোট রিচার্জ করে গার্লফ্রেন্ডকে ফোন করব?' শুনে ভদ্রলোক অবাক। বললেন, 'সেকি, তুমি ভিখারি হয়েও গার্লফ্রেন্ড বানিয়েছ?' ভিখারি উত্তর দিল, 'না স্যার, গার্লফেন্ডই আমায় ভিখারি বানিয়েছে।'

চুটকিটা পড়ে যদি একটু হাসি পায় তো হাসবেন, তারপরে আবার ভাববেন ওই ভিখারির মতো আসল চার্জের কথা ভুলে আমরা শুধুই নকল চার্জের কথা ভাবছি না তো সারক্ষণ? আপনার জীবন কিন্তু সত্যিই রিচার্জেবল নয়। আর কতটা চার্জ বাকি রয়েছে তা জানারও উপায় নেই, সুতরাং...।

Bengali Literature