ফসলি সন ১৪২৬ শেষ হল। এ বছর ছিল ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সার্ধদ্বিশতবার্ষিকী। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে বাংলার ১/৩-ভাগ লোক মারা যায়। বাংলার নিজস্ব শিল্প, যা ১৭৫৭ অবধি কিছু ক্ষেত্রে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উৎপাদনব্যবস্থা ছিল, প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়, গণশিক্ষা ও গণস্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ে এবং সচ্ছল স্বয়ংম্পূর্ণ গ্রাম ছেড়ে দিয়ে কৃষককে ভূমিহীন পরিযায়ী শ্রমিকের বংশানুক্রমিক পরিচিতি বেছে নিতে বাধ্য করে। এই মন্বন্তরটির মতন বিপর্যয় আধুনিক ইতিহাসে আর কোনও জাতির উপর আর কখনও নেমেছে কী না সন্দেহ! আড়াইশ বছর পরেও এই মন্বন্তরের প্রভাব আমাদের জাতির সমাজ-অর্থনীতি-পরিবেশ সহ সমস্ত আঙ্গিকে ব্যপ্ত হয়ে আছে।
দুর্ভাগ্যবশত ব্রিটিশ শাসকদের হাতে ঘটে যাওয়া এই জাতীয় বিপর্যয় নিয়ে আমরা প্রায় কেউই সচেতন নই। ঐতিহাসিকভাবেই আমাদের শিক্ষিত সমাজ 'মেকলেখোর' এবং ব্রিটিশ আগমনকে সে তার শ্রেণিমুক্তির আশীর্বাদ হিসেবে দেখে এসেছে। গত আড়াইশ বছর ধরেই এদেশের বহু মানুষের মনে এই ধারণা প্রোজ্জ্বল থেকেছে যে মধ্যযুগের বাংলা ছিল ইসলামি ধর্মান্ধ শাসকের অপশাসনে জর্জরিত, ব্রাহ্মণ-সমাজপতির কুসংস্কারে আচ্ছন্ন, অনুন্নত কৃষি নির্ভর এক অন্ধকারের দেশ- ব্রিটিশরা আধুনিক শিল্পপণ্য, বিজ্ঞান শিক্ষা, চিকিৎসা ও রেল চলাচল দিয়ে যে দেশকে উদ্ধার করেছে।
দেবী সরস্বতী বাক্যের দেবী, তিনিই দণ্ডনীতি সৃষ্টিকারিণী
উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগেও শিক্ষিত বাঙালিও সেইরকমি ভাবত, বিশেষতঃ তাদের শিক্ষা সমস্তটাই ব্রিটিশদের প্রতিষ্ঠানে হওয়ায়, সাম্রাজ্যবন্ধুতা তাদের স্বাভাবিক অর্জন ছিল। আমরা সিপাহি বিদ্রোহের সময়ে এই শিক্ষিত বাঙালি সমাজের ভূমিকা স্মরণ করতেই পারি। ব্রিটিশ শাসনের কল্যাণময়তার মিথ থেকে তাদের সম্ভবত প্রথম বের করে আনলেন, আই সি এস রমেশচন্দ্র দত্ত, তাঁর ইকনমিক হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া (দুই খণ্ডে) বইটির মধ্য দিয়ে। বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ রমেশচন্দ্র দত্ত-র সম্পর্কে বলেছিলেন- "he not only wrote history but created it"! তাঁর মতে উক্ত বইটির মধ্য দিয়ে রমেশচন্দ্র প্রাক-ব্রিটিশ বাংলার শিল্পসুষমার যে ছবি তুলে ধরেছিলেন এবং তার উল্টোদিকে ব্রিটিশ লুণ্ঠনের যে তথ্যসমূহ দিয়েছিলেন, সেগুলিই গণমানসকে বয়কট আন্দোলনে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
রমেশ চন্দ্র দত্ত ছিলেন ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে (আইসিএস) যোগ দেওয়া দ্বিতীয় ভারতীয় অফিসার। ১৮৭১-১৮৯৭ অবধি তিনি এই কাজে বহাল থাকেন। অবসরের পর তিনি লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজে ভারতীয় ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯০৪ সালে ভারতে ফিরে বরোদা রাজ্যের রাজস্বসচিবের কাজ করেন। লন্ডনে অধ্যাপনাকালে ভারতের দুর্ভিক্ষ এবং ব্রিটিশরাজত্বের করব্যবস্থা নিয়ে ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান কাগজে ধারাবাহিকভাবে চিঠি লিখেছেন এবং এই সময়েই তিনি ইকনমিক হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া বইটি লেখেন। উল্লেখ্য, মহাভারত রামায়ণের ইংরিজি অনুবাদসহ আরও বিভিন্ন বিষয়ে তিনি লিখেছেন। এ-ও উল্লেখ্য, রাজনৈতিক জীবনে রমেশ্চন্দ্র দত্ত ছিলেন পুরোদস্তুর নরমপন্থী। তিনি বহুবার স্পষ্ট করে বলেছেন যে তিনি কোনও মূল্যেই ভারতে ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ চান নি, বরং শাসনব্যবস্থায় ভারতীয় প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণই তাঁর কাছে কাম্য ছিল।
ইকনমিক হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া বইটি দুইখণ্ডে লেখা। প্রথম পর্বে ১৭৫৭ থেকে ১৮৩৭ অবধি বৃটিশ শাসনের শুরু পর্যায় বর্ণিত হয়েছে। রমেশচন্দ্র তাঁর ইতিহাস কথনে মৌখিক ইতিহাস বা অসমর্থিত সূত্র সম্পূর্ণ বর্জন করেছেন এবং প্রাথমিক ভাবে নির্ভর করেছেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও বৃটিশ পার্লামেন্টের দলিল দস্তাবেজগুলির উপর। ফলে তাঁর সূত্রগুলি বৃটিশ শাসকদের নিজস্ব বয়ান থেকেই নির্মিত, কিন্তু সেই আলোচনার মধ্য থেকেও শাসনের অকল্যাণকর ধ্বংসাত্মক দিকটি ফুটে উঠেছে।
রমেশচন্দ্র লক্ষ্য করছেন যে প্রায়-স্বশাসিত বাংলার সমাজগুলির স্বাতন্ত্র্য 'মুসলিম' শাসকদের আমলেও রক্ষিত হচ্ছিল, কিন্তু বৃটিশ শাসনের শুরু থেকেই সেগুলি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বাংলা এবং বাকি ভারতের ভূমিসম্পর্ক মূলত সামাজিক অধিকারে নিয়ন্ত্রিত হতে, বংশানুক্রমিক জমিদাররা বস্তুত নবাব বা মুঘল শাসকদের কাছে খাজনা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বটুকুই নিতেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির খাজনার দাবি এই ভূমিসম্পর্ককে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত করে ফেলে।
সাহিত্য অকাদেমি ঠিক কোন ভাষার জন্য?
রমেশচন্দ্র দেখাচ্ছেন, যেখানে বাংলার ভূমিরাজস্ব টোডরমলের সময় থেকে সুজা খানের সময় অবধি দেড়শ বছরের সময়কালে চল্লিশ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল, সেইখানে পলাশী যুদ্ধের পরে ১৭৬২ থেকে ১৭৬৬ সালের মধ্যে মাত্র চার বছরে ২৫০ গুণ খাজনা বৃদ্ধি পায়। পুরোনো জমিদাররা তাদের সনাতন প্রজাশাসন পদ্ধতিতে এই খাজনা তুলতে অপারগ হওয়ায় নিলামে উটকো জমিদারদের হাতে জমি যেতে থাকে, যারা প্রজাদের উপর নিরন্তর অত্যাচার করে এবং মানুষ ভূমিছাড়া, ভিটেছাড়া হতে থাকে এবং শেষ অবধি ৭৬-এর মন্বন্তর সংঘটিত হয়।
রমেশচন্দ্র চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সমর্থক, যদিও আধুনিক ইতিহাসকাররা এই ব্যবস্থার সমস্যার দিকগুলি খুঁজে দেখিয়েছেন (উৎসাহী পাঠক বদরুদ্দিন উমর, রণজিৎ গুহ প্রমুখের লেখা পড়তে পারেন)। কিন্তু রমেশচন্দ্র দেখতে পাচ্ছেন কোম্পানির শাসনের সূচনায় খাজনার জন্য প্রজাদোহন এমন পর্যায়ে চলে গেছিল যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকেও রিলিফ মনে হয়েছিল। এর পাশাপাশি তিনি দেখাচ্ছেন যে ব্রিটিশদের ভারতে আর সকল যুদ্ধের খরচ তোলা হয়েছিল বাংলার কৃষকের কাছ থেকে অতিরিক্ত খাজনা আদায় করেই। ভারত থেকে ব্রিটেনে কত সম্পদ এবং অর্থ লুঠ হয়ে গিয়েছে এই পর্যায়ে তার হিসেবও রমেশচন্দ্র বিস্তারিত ভাবে দিয়েছেন।
যে লুন্ঠন, তাঁর বইয়ের দ্বিতীয় পর্বের ইতিহাসে, অর্থাৎ রানির শাসনামলেও একভাবে জারি থেকেছে। তবে রমেশচন্দ্রের লেখায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল বৃটিশ শাসনে বাংলার বিশিল্পায়নের ইতিহাস। চলতি ধারণার ঠিক বিপ্রতীপে তিনি দেখাচ্ছেন যে বাংলায় এক অতি-উৎপাদনশীল শিল্প-সমাজ ছিল। বাংলার শিল্পের মধ্যে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ছিল বয়ন শিল্প এবং আধুনিক শিল্পের থেকে এক ভিন্নতর মডেলে বহু মানুষের মধ্যে জীবিকা বণ্টন করে সেই শিল্প গড়ে উঠেছিল। মন্বন্তরের পরেও দেশে কয়েক লক্ষাধিক মহিলা চরকা-কাটানি ছিলেন যাঁরা চরকায় সুতো কেটে জীবিকা অর্জন করতেন। এঁরা ছিলেন এই শিল্পব্যবস্থার নিম্নতম আধার, এর বাইরেও প্রচুর তাঁত শিল্পী, রেশমশিল্পীরা ছিলেন। কিন্তু সমাজের নিম্নস্তর অবধি মানুষ (উল্লেখ্য মহিলারাও) সেই শিল্পে ব্যপ্ত ছিলেন যার বাজার ইউরোপ অবধি বিস্তৃত ছিল। খুবই সুচিন্তিত উপায়ে এই শিল্পের ধ্বংসসাধন করা হয় এবং তার ফলেই ম্যাঞ্চেস্টার-ল্যাঙ্কাশায়ারের কটন-মিলগুলি ভারতের বাজার ধরে এবং ভারত পরিণত হয় শুধুমাত্র তুলোসরবরাহকারী দেশে।
নওলাখা-তেলতুম্বে: অন্যায় ও নির্মমতার আরেকটি উদাহরণ
এই বিশিল্পায়নের বিষণ্ণ ইতিহাস বৃটিশরাজের বিভিন্ন কমিটির তৎসংক্রান্ত নোটগুলি ধরে বিশদে বর্ণনা করেন রমেশচন্দ্র। আমরা দেখতে পাই, কীভাবে ভারতের অন্তর্বাণিজ্য-বহির্বাণিজ্য সবই ধ্বংস হয় আর ভারত পরিণত হয় কেবলমাত্র কৃষি-নির্ভর এক দরিদ্রতম দেশে। রমেশচন্দ্র দত্তের ইতিহাসলিখন আসলে নিজেই এক নতুন ইতিহাসের জন্ম দিতে থাকে যখন বিলিতি-মিলের কাপড় বয়কট করে ভারতের রাজনৈতিক আন্দোলনের অভিমুখ হয় স্বদেশী বস্ত্রের প্রসার। বাংলা অগ্রণী হয় সেই আন্দোলনে, বাংলার জাতীয়তার প্রথম প্রভাষক চিত্তরঞ্জন ডাক দেন বিলিতি ধারার ইন্ডাস্ট্রিয়ালিজম বাদ দিয়ে গ্রামীণ শিল্পে ফেরার, শহর ছেড়ে স্বয়ং-সম্পূর্ণ গ্রামে ফেরার। তা আদতেই রমেশচন্দ্রের বর্ণিত ইতিহাসের ধারা ধরে, ম্যাঞ্চেস্টারের বৃহৎ-মিল থেকে বাংলার ঘরে ঘরে চরকা আর তাঁতে ফেরার ডাক।
লক্ষ্যণীয় যে গান্ধীজি রমেশচন্দ্রের ঋণ বারম্বার স্বীকার করেছেন তাঁর লেখায়। দেশের উৎপাদক মহিলাদের জীবিকার চিহ্ন চরকা তিনি বেছে নেন নিজের রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে। রমেশচন্দ্র বিভিন্ন আলোচনায় এই পার্থক্যটা দেখাচ্ছেন, কীভাবে বৃটিশ লুণ্ঠন এদেশের সভ্যতার নিজস্ব ধারাকে ধ্বংস করছে। তিনি দেখাচ্ছেন রেলপথ নির্মাণের সময়েও এই তর্ক উঠছে রেলপথে ব্যবসার উন্নতির থেকে সেচব্যবস্থায় সেই অর্থ বিনিয়োগ শ্রেয়তর কী না এবং পরবর্তী কয়েকদশকের ইতিহাসে দেখাচ্ছেন রেল যত বিস্তৃত হয়েছে, সেচ তত উপেক্ষিত। এবং এভাবেই বড় শিল্পের বাজার তৈরি করার বৃটিশ উন্নয়নের ধারা ভারতের অধিকাংশ মানুষের জীবনে অভিশাপ বয়ে আনছে। বৃহৎ শিল্প এবং রেল জাতীয় উদ্যোগের সমালোচনায় গান্ধী-ভাবনাও যেন রমেশচন্দ্র দত্তের লেখা থেকেই নির্যাস আহরণ করে গড়ে উঠেছে। দ্বিতীয় পর্বেও তিনি দেখাচ্ছেন রানির শাসনেও ভারত কীভাবে বারবার মন্বন্তরের মুখোমুখি হচ্ছে, কীভাবে বিশিল্পায়ন অব্যাহত থাকছে এবং সার্বিকভাবে জনকল্যাণের দিকটি উপেক্ষিত থাকছে। প্রাকব্রিটিশ বাংলায় সমাজ গ্রামে গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় চালাত, জমিদাররা দায়িত্ব নিতেন আলাদা আলাদা দরকারে, আলাদা আলাদা জায়গায় পুকুর প্রতিষ্ঠা করে পানীয় জলের বিশুদ্ধতা বজায় রাখার, সংক্রমণ কমানোর। এই সমস্ত সামাজিক উদ্যোগ ধ্বংস হয়ে ব্রিটিশ শাসকের মুখাপেক্ষী এক দুর্বল দেশ হয়ে পড়ে বাংলা তথা ভারতবর্ষ। রমেশচন্দ্র দত্তর ইতিহাস তৎকালীন পাঠককে প্রাণিত করে শক্তিশালী দেশ অর্জনের কথা ভাবতে।
“দাদুর প্রতি আমার অসীম প্রেম আছে”: রোদ্দূর রায়ের একান্ত সাক্ষাৎকার
রমেশচন্দ্রের রাজনৈতিক অবস্থান কিন্তু ভিন্নতর ছিল। ১৮৯৯-এর লক্ষ্ণৌ কংগ্রেসে তিনি সভাপতিত্ব করেন এবং সেই কংগ্রেসে বোম্বের গভর্নর জেনারেল লর্ড স্যান্ডহার্স্টের বিরুদ্ধে নিন্দাপ্রস্তাব অনুমোদন করেন না। কারণ, কেবলমাত্র আবেদন-নিবেদনের মাধ্যমে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের থেকে ভারতবাসীর জন্য কিছু অতিরিক্ত সুবিধে আদায় করাই তাঁর অভিপ্রায় ছিল। কর্মজীবনেও সাম্রাজ্যের সেবায় প্রভূত উন্নতি করেছিলেন তিনি। বৃটিশদের কাছ থেকে কম্পানিয়ন অফ এম্পায়ার ইন ইন্ডিয়া খেতাব পান তিনি। এতদ্সত্ত্বেও, স্বাধীনতা আন্দোলনের এক ঋষির আসনেই তিনি অধিষ্ঠিত হয়েছেন, যিনি বাংলার বিপ্লবীদের থেকে আরম্ভ করে দেশবন্ধু-গান্ধীজি-নেতাজির চিন্তাধারার বিকাশে অসামান্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। দেশের আজকের দুর্দশার ঐতিহাসিক পর্যায়গুলি বুঝতে রমেশচন্দ্র দত্তর ইতিহাস-লিখন পুনর্পাঠ করার এখনও আবশ্যক।
(তাতিন বিশ্বাস পেশায় প্রযুক্তিবিদ)
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন