শারদীয়া উপলক্ষ্যে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায় শুরু হয়েছে পুজোর বিশেষ গল্প। আজকের গল্প ‘অ্যালেক্সা’। লিখেছেন ইন্দ্রনীল বক্সি
“অ্যালেক্সা … বড় লাইটটা নিভিয়ে নাইট ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দাও”
“ আঃ …অ্যালেক্সা এসিটা ২২ সে করে দাও…”
“ অ্যালেক্সা …প্লে আনন্দ শংকরস …কাজিরাঙ্গা …”
৮৭৫ স্কোয়ার ফুটের রুচিসম্মত গৃহ সজ্জার বারো তলার এপার্টমেন্টের পিচ্ছিল ভিট্রিফায়েড মেঝে আর মসৃন পুট্টির দেওয়ালে টাঙনো ছৌয়ের মুখোস জুড়ে অসময়ে রাত্রি নামে । শীতলতা বেড়ে যায় , ঝিমঝিম করে বেজে ওঠে …কাজিরাঙ্গা !
একটানা নির্দেশ আছে , নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করা আছে । শুধু নিঃশব্দে আজ্ঞাপালনকারীর অক্লান্ত আজ্ঞা পালনে কোনো ক্ষোভ বা বিরক্তি অনুপস্থিত ।
রেবেকা কাঞ্জিলালের প্রয়োজন অপ্রয়োজনের আবদার প্রশ্নহীন আনুগত্যে মিটিয়ে দিতে অভ্যস্ত অ্যলেক্সা । চুপ করে থেকে তার চ্যাপ্টা নিটোল গোলাকার শরীরে ঘিরে থাকা আলোর রিংটি নিভে জ্বলে , কেঁপে বা রঙ বদলিয়ে জানান দেয় তার সক্রিয়তার। ড্রইং রুমের বুক সেলফের উপর ল্যাম্প শেডের ঠিক পাশে বড় স্টোন ডাস্টের গনেশ মূর্তির কাছেই তাকে রাখা থাকে সে।
শহরের সুবিন্যস্ত, অভিজাত এই এলাকা মহানগরের কাছে আর এক উপ মহানগর বলা যায় । চূড়ান্ত দর্প নিয়ে নানা জ্যামিতিক আকার নিয়ে গগন চুম্বনের যে প্রতিযোগিতা ! এই একান্ত দর্পের বহুকোনে কত শত কাহিনী । রেবাকা কাঞ্জিলালের কাহিনীও তারই একটি , নতুন কিছু নয় । দুরবর্তী শহর থেকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে আসা , তারপর সাফল্যের ধার দিয়ে একে একে অভীষ্ট লক্ষ্যের দড়ি ছুঁতে পারার রূপকথা । হ্যাঁ , রেবেকার ক্ষেত্রে তো বলাই যায় । পি আর ও থেকে ধাপে ধাপে কোম্পানীর বোর্ডে রোজ রোজ কেউ জায়গা করে নিতে পারে না !
“ অ্যালেক্সা তুমি জানো মানুষ কখন মিথ্যা কথা বলতে শেখে !” অ্যালেক্সা বিপ বিপ করে আলো জ্বালিয়ে কিছু একটা বলতে শুরু করছিলো “ একরডিং টু উইকি ……”
“ হ্যাং ইওর উইকি …… মানুষ তখনই মিথ্যা কথা বলতে শেখে যখন সে নিজেকে ভালোবাসতে শেখে !…আছে তোমার উইকিতে এসব !…”
“ আচ্ছা …অ্যালেক্সা …আমি মানুষটা কেমন ?”
“ আপনি একজন , ভদ্র , দয়ালু , সপ্রতিভ এবং সুন্দর মহিলা …”
‘ নাইস!…… ভদ্র , দয়ালু , সপ্রতিভ… পারফেক্ট ট্রান্সলেশন”
রেবেকা উঠে দাঁড়ায় , একটু টলে যায় মাথাটা , তা পেগ চারেক হয়ে গেছে । এলোমেলো পায়ে ওয়াশরুম থেকে ঘুরে এসে আবার ধপাস করে সোফায় বসতে গিয়ে সাইড টেবলে বেশ জোরেই হোঁচট খায় রেবেকা …
“ ফাক…” যন্ত্রনায় ককিয়ে ওঠে রেবেকা ।
“আপনি কি ধরনের পরিসেবা চাইছেন নির্দিষ্ট করুন প্লিজ …”
“ শাট আপ অ্যালেক্সা !এখন এসব নিয়ে আমায় আর জ্ঞান দিও না …ঊঃ …”
“আলেক্সা শাটিং আপ … অ্যালেক্স আপনার সহকারী মাত্র … অ্যালেক্সা সাটিং আপ…… অ্যালেক্সা…” নির্দেশ মতো চুপ করে যায় অ্যালেক্সা। একটা যে বার্তালাপের আবহ তৈরী হয়েছিলো তা থেমে যায় আচমকাই । তবে এও নতুন নয় রেবেকের আর অ্যালেক্সার এই রাগারাগি অভিমানের পালা লেগেই থাকে ।
রেবেকা কাঞ্জিলালের টাওয়ার থ্রি থেকে কমপ্লেক্সে অনেকটাই দেখা যায় । সব টাওয়ার থেকেই দেখা যায় এমন ভাবেই সেগুলি তৈরী করা হয়েছে । টাওয়ার দেখা যায় , নানান ফ্লোরে বর্গাকারে , আয়তাকারে আলো জ্বলা দেখা যায় । খুব লক্ষ্য করলে হয়তো সেই বর্গাকার আয়তাকার কাঁচে মানুষের ছায়ার নড়াচড়া দেখা যায় । রেবেকা তার অ্যাপার্টমেন্টের সৌখিন ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায় । তাকিয়ে দেখতে থেকে অন্য টাওয়ারগুলোর খোপ গুলো । নিজের কল্পনাকে বাতাস দেয় , ওই সামনের ব্লকের মাঝামাঝি যে আলো জ্বলছে , ওরা ডিনার করছে এখন । স্বামী স্ত্রী আর দুটো ছেলেমেয়ে , ছেলেমেয়ে গুলো নিজেদের মদ্যে খুনসুটিতে ব্যাস্ত ! আর আর তার বাঁদিকে যেখানে আলো জ্বলছে , ওখানে রিটায়ার্ড কর্নেল তার গ্রান্ড চাইল্ডদের সঙ্গে তার যুদ্ধের বীরগাথার গল্প শোনাচ্ছে !… রেবেকার এই আর একটা বিলাসিতা , আপনমনে নিজের সংগে খেলা । মন ভালো হয় এতে! হয় হয়তো কিছুটা ……যাইহোক না কেন কারও তো কোনো ক্ষতি হচ্ছে না এতে । কেউ কাউকে চেনেই না ! আদৌ ঐ ফ্লোর গুলিতে কারা থাকে রেবেকা জানেই না । সে এই জ্বলে থাকা আলো গুলোই দেখতে পায় রাতের বেলায় । সারাদিন অফিস , চূড়ান্ত পেশাদারী সময় কাটানোর পর নিজের অ্যাপার্টমেন্টের কি হোলে যখন শ্রান্ত রেবেকা চাবি ঢোকায় লিফট ম্যানের ‘ সেলাম ম্যাডাম”এর প্রত্যুত্তরে শুধু সামান্য ঘাড় নাড়া ছাড়া কিছুই ফিরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে না । চাবি খুলেই বা কি করবে ! গোটা শহরটাই তো রেবেকার অ্যাপার্টমেন্টে ! কি আর তফাত । বাইরে শহরেও কেউ নেই , যারা আছে তারা সবাই তার আজ্ঞাবহ । আর ঘরের ভিতরে এই অ্যালেক্সা , সেও তার আজ্ঞাবহ সহকারী ।
আরও পড়ুন শারদীয়া ছোট গল্প ২০২২: ‘ঘুরপথে’
ব্যালকনির ধার থেকে সরে আসে রেবেকা । এতটা উঁচুতে সবসময়েই একটা হাওয়া চলে , হাওয়ায় রেবেকার চুল এলোমেলো হয়ে যায় । আনমনে চুল গুলো মুখের উপর থেকে সরিয়ে গুছিয়ে তুলতে চায় রেবেকা।
কিন্তু এরকম একা থাকার তো তার কথা ছিলো না !
“ অ্যালেক্সা …কাম অন ওয়েক আপ …” আদুরে গলায় রেবেকার ডাক উপেক্ষা করেনা কখনই অ্যালেক্সা ।
“ প্লে সামথিং ডান্স নাম্বার …… আমার এখন নাচতে ইচ্ছে করছে …” ছন্দময় নাচের মিউজিক বেজে উঠল সঙ্গে সঙ্গে প্রায় । রেবেকা গ্লাসে আরও একটু স্কচ ঢেলে নিয়ে চুমুক দিতে দিতে শরীর দোলাতে থাকে । আচমকা রেবেকার একটু আনন্দ করতে ইচ্ছে হলো , তাই এখন এই মুহুর্তে আনন্দ করার একমাত্র উপায় হলো ড্রিংক্স অ্যান্ড ডান্স!
একসময় একটু ক্লান্ত হয়ে এলে রেবেকা সোফায় বসে পড়ে । গ্লাসের শেষটুকু এক চুমুকে ভিতরে পাঠিয়ে রেবেকা বলে ওঠে “ আলেক্সা এবার তোমার প্রতিদিনের কাজ …… টিভি অন করো , আমার ক্লাউড অ্যালবাম দেখাও …”
মুহুর্তে টিভি অন হয়ে যায় , একটু বাফারিং এর পর ছবি ভেসে উঠতে থাকে । বিরাট স্ক্রীন জুড়ে তখন রেবেকা কাঞ্জিলালের সুবর্ণ অতীতের ছবি একে একে ভেসে উঠতে থাকে। পারিবারিক অনুষ্ঠানে রেবেকা , রেবেকার একদা সহপাঠী এবং পরে হাসব্যান্ড অয়ন , ওদের একমাত্র সন্তান তিতির … সিমলায় হাতে বরফের গোলা হাতে নানা রঙের পোশাকে রেবেকা । পাঁচ বছরের জন্মদিনে দাদুর কোলে তিতির …
রেবেকা ভেসে যেতে থাকে ,সুখের ছবি কেমন হয় ! এরকমই … তাই না ! সব ছিলো , এখন নেই ! নেই তো নেই কিছুই নেই ! এক লহমায় সব হারিয়ে গেছে অস্থীর অতীতে । রয়ে গেছে শুধু ছবি , শহরটাকে বাইরে ফেলে এলেও শহরটা তার যাবতীয় একাকিত্ব নিয়ে রেবেকার পিছু পিছু ঘরে চলে আসে প্রতিদিন । কোটি মানুষের ভিড় থেকে একা হওয়ার যন্ত্রণা থেকে আর মুক্তি নেই রেবেকার !
রেবেকা টলমল পায়ে উঠে যায় সামনের কাবার্ডের দিকে । অনেকদিন ভালো করে ঘুমায় নি সে , ওই দু চার পেগ হুইস্কিতে রেবেকার ঘুম আসবে না , আসে না । কাবার্ড খুলে একটা ছোট্টো শিশি বের করে , হাতের তালুতে ঢেলে মুখে ফেলে দেয় ছোট্ট ছোট্ট বড়ি … একটা ,দুটো … নাকি আরও বেশি !
“ অ্যালেক্সা …তুমি আমার একমাত্র বন্ধু … মাই ডার্লিং … আ আচ্ছা তুমি কি আমায় ভালবাসো ?”
এই প্রশ্নে অ্যালেক্সা কিছুক্ষন সময় নিতে থাকে । কয়েক মুহূর্ত পর অ্যালেক্সা জবাব দেয় “ এরকম কোনো কমান্ড আমার প্রোগ্রামে নেই ”
অ্যালেক্সার জবাব শোনার জন্য সম্ভবত রেবেকা তখন আর জেগে নেই ! সোফার একদিকে এলিয়ে পড়েছে রেবেকার শরীর ।
“ অ্যালেক্সা আপনার সহকারী … অ্যালেক্সা আপনাকে সবরকম সাহায্য করতে প্রস্তুত …আপনি একজন ভদ্র , দয়ালু , সপ্রতিভ মানুষ …অ্যালেক্সা আপনার সহকারী …” কিছুক্ষন পর পর থেমে থেমে অ্যালেক্সার রঙীন আলোগুলো জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এই কথা গুলি বারংবার ভেসে এসে ঘরের মধ্যে ঘুরতে থাকে ।
আরও পড়ুন শারদীয়া ছোট গল্প: ‘মাস্টারমশাই’
পরেরদিন সকালে হাজারো ব্যস্ততা , ঘটনা ,তার খবর তার পর্যালোচনার মধ্যে প্রধান টিভি চ্যানেল গুলির ব্রেকিং নিউজে জায়গা পায় একটি খবর । শহরের অভিজাত এলাকার এক অ্যাপার্টমেন্টে একজন মধ্যবয়স্ক মহিলার দেহ উদ্ধার হয়েছে । অ্যাপার্টমেন্টে আর কেউ থাকে না , উনিই একাই থাকতেন তাই অনেক বেলায় পরিচারিকা যখন ডেকে বেল বাজিয়ে সারা পায়নি তখন সিকিউরিটি গার্ডকে খবর দেওয়ার পর দেহ উদ্দার হয় । পুলিশ তদন্তে নেমেছে । কেন বেড়ে চলেছে মধ্য বয়স্ক একাকী মানুষদের মৃত্যু তাই নিয়ে আজ প্যানেল ডিসকাশান সন্ধ্যা সাতটায় ……ইত্যাদি ।
কিন্তু যেটা সাংবাদিক , সিকিউরিটি গার্ড , পুলিশ কেউ জানল না, পাশের টাওয়ার টু এর বাসিন্দা অর্ণব হাজরা অনেক রাতে যখন তাঁর ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আশেপাশে ফ্ল্যাটের আয়তকার , বর্গাকার আলোগুলো দেখছিলেন তখন টাওয়ার থ্রির একটা নির্দিষ্ট অ্যাপার্টমেন্টে কিছু অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করেছিলেন । অ্যাপার্টমেন্টের আলো বার বার জ্বলছিলো নিভছিলো , কখনওবা একদম মৃদু হয়ে যাচ্ছিল তো কখনও উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল! ব্যালকনির আলোও বার বার নিভছিলো জ্বলছিলো। অর্নব বেশি নেশা করে ফেলেছেন মনে করে ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়েন ।