Advertisment

শারদীয়া ছোট গল্প: 'মাস্টারমশাই'

শারদীয়া উপলক্ষ্যে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায় শুরু হয়েছে পুজোর বিশেষ গল্প।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Durga puja, durga puja 2022, durga pujo, durga puja, দুর্গাপুজো, দুর্গাপুজো ২০২২, দুর্গাপূজা

পুজোর বিশেষ গল্প

শারদীয়া উপলক্ষ্যে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায় শুরু হয়েছে পুজোর বিশেষ গল্প। আজকের গল্প 'মাস্টারমশাই'। লিখেছেন অনিন্দিতা মণ্ডল

Advertisment

ফুটপাতের অর্ধেক ঘিরে এই খুপরি দোকানগুলো। খাবার দোকান। চায়ের দোকান। কয়েকটা বইখাতা পেনের দোকানও আছে। তবে খাবার দোকানের ঝুপড়িগুলো সারাক্ষণ মাছি ভনভনে ভিড়। উলটোদিকের বিরাট গেট থেকে জনস্রোত রাস্তা ক্রস করে চলে আসে এদিকে। ফুটপাতে দাঁড়াবার স্থান সংকুলান হয় না। দোকানের ভেতরে আটইঞ্চি চওড়া বেঞ্চে যারা বসতে পারেন তারা মহাশয় মানুষ। ভাগ্যের জোর।

--এই সরে বোস। বসতে দে।

কয়েকজন ওর মধ্যেই চেপে বসেছে। এখন সকাল সাড়ে এগারটা বাজে। প্রতুলকে জায়গা করে দিতেই সকলে চেপে বসেছে। প্রতুলের গালে অযত্নের কাঁচাপাকা দাড়ি খোঁচা খোঁচা হয়ে আছে। মাথার চুলও তথৈবচ। চন্দন না তাকিয়েই এগিয়ে দিল চা। --এই নিন। তারপর অন্য কাজে হাত দিতে দিতে বলল—মেয়েটাকে পাঠাব কাল থেকে মাস্টারমশাই। কখন পাঠাব বলবেন।

প্রতুল একটু অন্যমনস্ক ছিল। বলল, পাঠিয়ে দিও। কথা বলে নেব।

সামনের রাস্তা পেরিয়ে উজ্জ্বল এক ঝাঁক ছাত্রদল এদিকে আসছে। ওদের কলকল কথা ঝরঝরে হাসি প্রতুলকে আনন্দ দেয়। এখনও পঁচিশ বছর আগে ফিরে যেতে পারা যায় ওদের জন্যই। স্বপ্নালু চোখের ছেলেমেয়েগুলো ফুটপাত দখল করে। নিজেদের মধ্যে নানা কথা বলতে থাকে। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ওরা ভাঙার কথা বলে। গড়ার কথাও বলে। প্রতুল চুপ করে শোনে। সত্যি বলতে এই সময়টা ও চন্দনের দোকানে এদের দেখতে আসে। কথাগুলো শুনতে আসে। শুনতে শুনতে মনে পড়ে যায়, পঁচিশ বছর আগের ছাত্রদিন। স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তাই অরুন্ধতী প্রতুলের হাত ছেড়ে দিয়েছিল। তেমন কোনও কথা দেওয়া ছিল না। একসঙ্গে থাকতেই হবে। পুরো জীবন একসঙ্গে কাটাতেই হবে, এমন কথা ওরা কেউ কাউকে দেয়নি। অথচ সবাই জেনেছিল, প্রতুল আর অরুন্ধতী অবিচ্ছেদ্য।

প্রতুলের ব্যর্থতা বেশি। পড়াশুনোটুকু ছিল বলে শেষ পর্যন্ত এই ব্যাচে পড়িয়ে রোজগার। এই দোকানে ওর প্রাক্তন ছাত্র থেকে বর্তমান, সকলেই কম বেশি আসে। দেখা হয়। একটা আলগা ভালো লাগার হাওয়া জড়িয়ে ধরে। সারাদিনের ব্যাচের মধ্যে যে ফাঁকটুকু পায়, চন্দনের দোকানে চলে আসে।

ওই রাস্তা পেরিয়ে আসা দলটার মধ্যেও মাঝে মাঝে চেনা গলা ডেকে ওঠে –প্রতুলদা। প্রতুল হাসিমুখে চোখ তুলে তাকায় –কিরে? খবর কি? চেনা গলাও হাসে –ভালো। আপনি ভালো আছেন? প্রতুল উত্তর দেয় না। এদের মুখের দিকে তাকিয়ে আনন্দ হয়। তারিয়ে তারিয়ে চা খায় প্রতুল।

চন্দনের মেয়েটা এসেছে। ক্লাস ইলেভেন। ওকে দু একটা প্রশ্ন করে জানা হয়ে যায় ঠিক কতটা ও ধারণ করে। আরও কতদূর পারবে। ওর জন্য সময় নির্দিষ্ট করে। ইলেভেনের একটা ব্যাচ সন্ধে ছটায় আসে।

ছাত্রছাত্রীরা যখন আসে, প্রতুল যেন অন্য মানুষ। যা কিছু সে জানে, যতদূর জানে, সবটুকু নিঃশেষে দিয়ে দেয় যেন। সময়ের খেয়াল থাকে না। ওরাই বলে, প্রতুলদা এবার আসি। পরের ব্যাচের ওরা বাইরে অপেক্ষা করছে। প্রথম প্রথম প্রতুল অস্বস্তি বোধ করত। তারপর প্রবেশ অবাধ। এক ব্যাচ অন্য ব্যাচের মধ্যেই ঢুকে আসতে শুরু করল।

এক একবার সতর্ক অভিভাবক কেউ অভিযোগ করেছেন। এতে পড়াশুনোর অসুবিধে হয়। প্রতুল কিছু বলেনি। আত্মরক্ষাও করেনি। ছাত্র চলে গেছে। সাফল্য এনে দেবার কোচিং সেন্টার ত কম নেই। প্রতুল নিজেকে বদলাতে পারেনি। অথচ কেমন করে যেন ওকে অনেকেই চেনে। পড়ার জন্য ছেলেমেয়েরা আসে। ভালোবাসে। এই যেমন চন্দনের দোকানে আসা রোজকার খদ্দের সব। ওদের মধ্যে অনেকেই ঠিক তেমন কিছু করে না। প্রতুল আন্দাজ করতে পারে, ওরা কেউ জুয়ো খেলে, কেউ দাদাদের ধামা ধরে দিন চালায়। নিজেদের মধ্যেও যথেষ্ট আকছাআকছি আছে। কিন্তু প্রতুলকে দেখলে সকলেই সম্মানজনক সুরে কথা বলে। এদেরও কেউ যে প্রতুলের কাছে একসময় পড়েছে।

গত দুটো সপ্তাহ প্রতুল ঘর ছেড়ে বের হতে পারেনি। সব ব্যাচ বন্ধ ছিল। কিছু কিছু অনলাইনে পড়িয়েছে। কিন্তু ছাত্ররা নিজে থেকেই বলেছে—এখন থাক। আপনি সেরে উঠুন। আমরা নিজেরা পড়ছি। পরে আপনি দেখে দেবেন। প্রবল জ্বর। সঙ্গে ঠাণ্ডা লাগা। মাথা তুলতেও কষ্ট। একা থাকার অনেক সুবিধে। কেউ কিছু বলার নেই। কিন্তু অন্য ঘরে মা আছেন। শয্যাশায়ী। মাকে দেখাশুনো করে গীতাদি। সেই সুযোগে প্রতুলেরও দেখাশুনো হয়ে যায়। তাই একা থাকার অসুবিধে ভোগ করতে না হলেও প্রতুল সুবিধে থেকে বঞ্চিত রয়ে যায়। সময়ে কেন সে খাবে না? এই প্রশ্ন নির্বাক চোখে ধরে রাখেন মা। ফলে, মায়ের সময় অনুযায়ী খেয়ে নিতে হয়।

এই দুটো সপ্তাহ ধরে ছেলেমেয়েদের আসাযাওয়া নেই। চন্দনের দোকানে যাওয়া নেই। লোকজনের কথা শুনতে পাওয়া নেই। নিজের পঁচিশ বছর আগের জীবনকে ফিরে দেখার জন্য ওই বড় গেটের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা কলকল আওয়াজ নেই। প্রতুল যেন ঘুমিয়ে পড়তে থাকে।

মায়ের খোঁজ নেওয়া হয়নি কয়েকদিন। মা কেমন আছে? গীতাদি আগে সকালে এলেই প্রতুল মায়ের রাতের খবর দিয়ে দিত। গীতাদির থেকে জেনে নিত ওষুধপত্র কি কি আনতে হবে। মাসে একবার করে ডাক্তার রায়ের চেম্বারে যেতে হয়। প্রতুল নিজের অসম্ভব আলস্য ঝেড়ে উঠতে চায়। মায়ের ঘরে যেতে গিয়ে দেখে দরজা বন্ধ। ওর হাতের চাপে আওয়াজ হয়ে থাকবে। গীতাদির গলা ভেসে আসে—কে? দাদা? মাকে স্পঞ্জ করাচ্ছি।

প্রতুল ফিরে আসে। সামনের জানলা দিয়ে গলিটা দেখা যাচ্ছে। কী নিদারুণ উদ্দেশ্যহীন বেঁচে থাকা তাঁর। মা আছে তাই। নইলে সে আর কার জন্য বাঁচে। গলি দিয়ে কত লোক যে যাচ্ছে! সবার কত তাড়া! সকালবেলা যে কাজের সময়। গীতাদিও তো বলে—কী বলবেন তাড়াতাড়ি বলুন। হাতে অনেক কাজ। একমাত্র প্রতুলেরই বোধ হয় কাজ নেই। সে শুধু অবিচ্ছিন্ন পড়িয়ে চলে। আর কিছুই নয়।

একটা ভয় চোরাস্রোতের মতন নামতে থাকে সারা শরীরে। মা চলে গেলে? সে একা হওয়ার সুবিধে পাবে? নাকি অসুবিধেটাই বেশি?

খানিক পরে গীতাদি ডাক দেয়। “দাদা আসুন। মাকে দেখে যান। মা কী বলছেন।” প্রতুল মায়ের ঘরের দরজায় দাঁড়ায়। মা সেই একই রকম। শুধু চোখে উদ্বেগের ছায়াটুকু যেন সরে গেছে। প্রতুল ডাকল—মা। মায়ের চোখ একেবারে নির্বাক। মা কি তবে খাওয়ার জন্যও আর ইশারা করবে না?

নিজের ঘরে ফিরে এসে মায়ের প্রেস্ক্রিপশান ঘাঁটতে থাকে প্রতুল। অনেক ওষুধ। অনেক অনেক ওষুধ। এর মধ্যে কয়েকটা মারাত্মক। মা কি করে এগুলো হজম করে? হঠাত যেন একটা উপায় পাওয়া গেছে। প্রতুল অস্থির হয়ে ওঠে। সে মায়ের ঘরের দরজার কাছে আবার যায়। --মা, আমি একবার চা খেয়ে আসছি। মা এই ডাকে ফিরে তাকান। তাঁর চোখ নির্বাক নেই আর। স্থির দেখতে থাকেন ছেলেকে। গীতাদি এসে বলে—কোথায় যাবেন দাদা? আপনার শরীর দুর্বল। মা বারণ করছেন যে। প্রতুল হাসে। মা এখনও আছে। বলে—সাবধানে যাব। চিন্তা কোরো না। অনেকদিন কারুর সঙ্গে দেখা হয়নি। একটু কথা না বলতে পেরে হাঁপিয়ে উঠছি। ছেলেমেয়েগুলোকে ডাকব এবার। একটু ঘুরে আসি।

মাথাটা টলমল করছে। চন্দনের দোকানে এখন ভিড় একটু কম থাকে। প্রতুল বসতে পারবে নিশ্চয়। দোকানে পৌছলে চন্দন চমকে ওঠে।

--আপনি এত অসুস্থ শরীর নিয়ে কেন এলেন?

--বাড়িতে বন্ধ হয়ে থাকা যায়? প্রতুল মনে মনে হাসে। আজ যে এসেছে সে ত একটা অ্যাক্সিডেন্ট। ঘটনাটা ঘটাতে পারলে চন্দনের দোকানে আর কোনও দিন আসার দরকার পড়ত না।

একটা দোলাচল ছিল ত। মা বাইরে বেরোতে বারণ করছিল। প্রতুল ডুপ্লিকেট প্রেস্ক্রিপশানটা মুচড়ে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। বলে, সামনের সোমবার থেকে পড়ানো শুরু। মেয়েকে পাঠিও। চন্দন চুপ করে আছে। প্রতুল জিজ্ঞেস করে—কি হল চন্দন? মেয়েকে পাঠিও।

চন্দন এবার ঘুরে দাঁড়ায়। প্রতুলের সামনে চা রাখতে রাখতে বলে—প্রতুলদা, আমিও ত তোমার কাছে পড়েছি। আমি ত জানি তুমি কত ভালোবেসে পড়াও।

প্রতুল বুঝতে পারে না চন্দন কি বলতে চাইছে। চন্দন সামনের বড় গেটের দিকে দেখায়।

--ওই যে তোমার বন্ধু মাস্টারমশাই। তোমার সঙ্গে চা খেতে রোজ এখানে আসত। এসেই বলত, কই গো চন্দন বেকারি স্পেশাল বিস্কুট দাও? আমি ত বেকারি স্পেশাল বেচেই কাটিয়ে দিলাম, কিন্তু প্রতুলদা তোমার বন্ধু কেন পারল না? সে ত বড় মানুষ। কত কত মানুষের মাথায় ছাতা হয়েছিল। সে কেন পারল না? ছাতাটা সরিয়ে নিল!

কথাগুলো বলার সময় চন্দন নিজেই এত শোকে আচ্ছন্ন ছিল যে প্রতুলকে লক্ষ করেনি। প্রতুল চা মুখে তুলতেও ভুলে যায়। সফল বন্ধু তার। গেটের ওপারে বিশ্বের সেরা সেরা মানুষ তাকে ভালোবাসে। শ্রদ্ধা করে। আলোমাখা মুখের ছেলেমেয়েগুলো ত ওকে সবচেয়ে আপনজন মনে করে। কী করেছে সে?

চন্দন একটু সামলায়। তারপর বলে, আপনার বন্ধুকে একটু আগেই ওরা নিয়ে গেছে। কত লোক! ফুল আর গানে ভেসে গিয়েছে আপনার বন্ধু, প্রতুলদা।

প্রতুলের মনে হয় আবার জ্বর আসছে। খুব জ্বর। সফল মাস্টারমশাই চলে গেলেন কেন? প্রেস্ক্রিপশানটা গেল কোথায়? সে নীচু হয়ে ডাস্টবিন খোঁজে। রাগ হয় নিজের ওপরে। মারাত্মক সব ওষুধ ছিল। বাড়ি ফেরার রাস্তা ধরবে বলে ফুটপাত ছেড়ে নামতেই চন্দন হাত ধরে।

--প্রতুলদা, আমার মেয়েটা তোমার কাছে পড়ে ভালো আছে, জানো। ওরা তোমাকে খুব ভালোবাসে। আমাদের যত ভালোবাসে তার থেকে বেশি। তুমি সেটা জানো ত প্রতুলদা?

রাস্তাটা একদম ফাঁকা। এতক্ষণে প্রতুল বুঝতে পারে কেন আজ দোকানে কেউ নেই। প্রতুলের মনে পড়ে, আর কোনও দিন তার বন্ধু আসবে না। বেকারি বিস্কুট খেতে খেতে তাকে ছাত্রবেলার থিয়োরি শোনাবে না। বিশ্বের কোথায় কি ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে, সে আর জানতে পারবে না। ক্লান্ত দুটো পা টেনে প্রতুল গলির দিকে চলে যায়।

short story durga puja 2022
Advertisment