আমি তো জলপাইগুড়ির ছেলে। সেই আমার ছ-সাত বছর বয়স থেকে। ১৯৭৫-এ একটা চাকরি নিয়ে কলকাতায় আসি। তিন বছরের জন্য। সেটাই ছিল চাকরির শর্ত। কিন্তু আমি জানতাম, আর বাড়ি-ফেরা হবে না। দু-একজন বলেও ছিলেন, কেন যাবেন। তাঁদের বলেছিলাম, ‘ঘুরে আসি একটু’। কলেজ তিন বছরের অবেতন ছুটি দিল নিয়মমাফিক। আমি জানতাম, ফেরা আর হবে না। কলকাতাতেও তো আমার কত অকাজের কাজ আছে। জলপাইগুড়িতে একবার কলকাতা থেকে এক প্রাদেশিক ছাত্রনেতা গিয়েছিলেন, রাজনীতির কাজে। আমাকে বলেছিলেন, ‘কী করে থাকেন এখানে দাদা, কী করেন সারা দিন, সময় কাটান কী করে?’ আমি তাঁকে পালটা বলেছিলাম—‘বলেন কী! একটা দিনরাত ২৪ ঘন্টার বেশি হলে তো সুবিধে হত। মাত্র তো ২৪ ঘন্টা!’
কলকাতায় পৌঁছুনোর পর আমার মেজ ভগ্নীপতি, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক, একদিন আমার নতুন চাকরির মাইনেপত্র শুনে ও কলেজের মাইনেপত্র শুনে হিশেব কষে বললেন, ‘তুমি আইল্যা ক্যান? তোমার তো কত লস! কলকাতার স্ট্যান্ডার্ড অব লিভিং আর জলপাইগুড়ির স্ট্যান্ডার্ডে তো কত তফাৎ! আর তুমি তো চাকরি কইরব্যা সাউথ ক্যালক্যাটায় আর থাইকব্যা এইখানে বেলেঘাটায়। রোজ যাতায়াতের খরচা পইড়ব কত?’
আমি উত্তরে বলেছিলাম, ‘আপনিও তো বেলেঘাটা থেকে যাদবপুর যাতায়াত করেন। আমার যা লস হবে সেটা আপনার ওপর দিয়ে মেক-আপ করব’।
আরও পড়ুন, পিতৃতন্ত্র ও যৌনতা: প্রাচীন বাংলা কাব্য থেকে উনিশ শতকের পরম্পরা
শুনে উনি খুব হসলেন, ‘তাইলে তো তো তোমাকে ছেলে-বৌ নিয়্যা এইখানে থাইকতে হয়। তা চইল্যা আসো। এই ফ্ল্যাটটাতে তো দুইটা ঘর। তোমার চাকরি না কইরলেও লাভ’। বলে আবার প্রাণখোলা হাসলেন।
আমি তো জলপাইগুড়ির আনন্দ চন্দ্র কলেজ থেকে বি-এ পাশ করে কলকাতায় এম-এ পড়তে এসে টানা দুই-আড়াই বছর কলকাতায় থেকেছি মাত্র। জলপাইগুড়িতে কলেজে পড়ার সময়ও মাঝে মধ্যে নানা ছুতোয় কলকাতায় আসতাম। এই আসা-যাওয়া ও থাকার সময় কলকাতার কোথায় যে থাকতাম তার কোনো লিস্ট আমি করতে পারব না। মেটেবুরুজে এক ইউনিয়নের অফিস ঘর থেকে বরানগর-আলমবাজারের এক লাল মেঝের শাবেকি বাড়ি পর্যন্ত সর্বত্র। তাই কলকাতাও আমার নিজের, একেবারে নিজের। এত রকম করে চেনা যা কলকাতার কোনো আদিপুরুষেরও নয়। সেই কলকাতায় চাকরি করতে এসে আমি জলপাইগুড়িকে চিনলাম। যাঁরা আমার কোন গল্প, কোন উপন্যাস কোথায় লেখা তা নিয়ে যদি তালাশ করেন, তা হলে সম্ভবত দেখবেন, আমার মনে হয়, জলপাইগুড়িতে থাকার সময় আমি কলকাতার গল্পই বেশি লিখেছি আর কলকাতায় আসার পর জলপাইগুড়ির গল্প।
সেই জলপাইগুড়ির যে-পাড়ায় আমরা ১৯৫২-৫৩ পর্যন্ত থেকেছি, কদমতলায়, সেই পাড়ায় যে-বাড়িতে থাকতাম, তারই গায়ে-গা-লাগানো উত্তরদিকে ছিল তবলাদের বাড়ি। সেই তবলার মেয়ে এণাক্ষী এখন কলকাতায় থাকে ও জলপাইগুড়ি নিয়ে গল্প লেখে। সে আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে জানাল যে আমাদের পাড়ার যে দুর্গাপুজো হত, সেটার এবার ১০০ বছর হল। কদমতলার পুজো। তোমার কি কিছু মনে আছে?
মনে থাকবে না কী করে? ওটাই তো ছিল আমাদের পুজো। কদমতলায় চৌমাথা থেকে তিন নম্বর গুমটির দিকে কয়েক পা হাঁটলেই ডান দিকে উকিল ও সাহিত্যিক সত্যেন্দ্রনাথ মৌলবিদের প্রাসাদতুল্য বাড়ি। বাঁ দিকে স্বাধীনতার পরে প্রথম মন্ত্রিসভার সদস্য মোহিনী মোহন বর্মনের বাড়ি। তাঁর ছেলে শান্তি ছিল আমার বন্ধু। শান্তিদের বাড়ির গা ঘেঁষে বেরিয়েছে আমাদের গলি। সেই গলির মধ্যে ছিল আমাদের পাড়া। সেই গলির মুখে বাঁ দিকে রমাপ্রসন্ন সরকার মশায়ের বাড়ি। বাড়ি তো নয়, প্রান্তর। সে বাড়ির বাইরের মাঠে ছিল সরকার মশাই-এর শেরেস্তা। বারান্দাসহ। আর ছিল ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়া যায় এমন একটি উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়—মেয়েদের। তা হলে কত বড় ছিল মাঠটা ভাবা যায়? সেই মাঠেই হত কদমতলার দুর্গাপুজো। মনে হয়, সরকার-মশাইয়ের শেরেস্তার বারান্দাটাকে কাজে লাগানো হত। আর মণ্ডপ বোধহয় বানানো হত স্কুলের বেড়া ও সরকার মশাইয়ের বাড়ির মাঝখানে। ঠাকুরের মুখ কোন দিকে থাকবে, তার তো শাস্ত্রীয় বিধান আছে।
তখন তো আমাদের একেবারেই বাল্য। এমন হতে পারে, যে সরকার মশায়ের শেরেস্তার বারান্দায় বোধ স্টেজটেজ বানিয়ে থিয়েটার-টিয়েটার মত। এই পুজোর কর্তা ছিলেন উল্টো দিকের রাস্তার কুমুদিনীকান্ত চক্রবর্তী মশায়দের পাড়ার ও বাড়ির লোকজন। কুমুদিনী চক্রবর্তী ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত ছাত্র ও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের আদর্শপ্রণিত।
সেই পুজোর ১০০ বছর!
আগে জানলে হয়তো যেতাম, যদি শরীর যেতে দিত।
শুধু মনে আছে—পুজোর ঐ খোলা মাঠে থিয়েটার দেখে বা যাত্রা দেখে রাত হত। জলপাইগুড়িতে ঐ সময় ঠান্ডা পড়ে। আমাদের ঠান্ডা লাগত। কালীপূজা আসতে-আসতে সর্দিকাশিজ্বর।
মাঝখানে কোজাগরীর পূর্ণিমায় পূর্ণ জ্যোৎস্নায় জলপাইগুড়ি ভেসে যেত দৈব আলোর বিভায়। অমন জ্যোৎস্না কোথাও কখনো দেখি নি—তিস্তার দিগন্তহীন চর ছাড়া।
সে-ও তো জলপাইগুড়িই।
এই সিরিজের সব লেখা পড়ুন এই লিংকে