পাড়া-ক্রিকেট ও স্মৃতির যৌথভাণ্ডার

সীমানাহীন সেইসব বাড়ি টপকে টপকে ছড়িয়ে পড়ত আনন্দের রং, আবির বিছানো সেইসব পথে হুটোপাটি খেত খয়েরি শালিখ। দুই শালিখ। সেসব যেন প্রাগৈতিহাসিক সময়ের জলছবি।

সীমানাহীন সেইসব বাড়ি টপকে টপকে ছড়িয়ে পড়ত আনন্দের রং, আবির বিছানো সেইসব পথে হুটোপাটি খেত খয়েরি শালিখ। দুই শালিখ। সেসব যেন প্রাগৈতিহাসিক সময়ের জলছবি।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

অলংকরণ- অরিত্র দে

বিরাট কোহলি তো কাল-বিহানের ছেলে, সৌরভ গাঙ্গুলিরই তখন জন্ম হয়নি। টিভি নেই। নেই কম্পিউটার।  সাইবার জাল আসতে ঢের দেরি। গত শতকের ছয়ের দশক। বহুদিন হল কেটে গেছে স্বাধীনতার ধুনকি। দারিদ্র, বেকারি, যুদ্ধ আর দাঙ্গা-হাঙ্গামার চোরাস্রোতে তলিয়ে যাচ্ছে দেশকাল। মুঘল-ই-আজম পৃথ্বীরাজ কাপুরের বিরুদ্ধে গলা তুলছেন মধুবালা, পেয়ার কিয়া তো ডরনা কেয়া! বাতাসে ক্রমশ বিদ্রোহ আর বারুদের বদবু। অবদমন চূড়ান্ত পর্যায়ে। মাতৃগর্ভে আর থাকতে না-পারলেই ভূমিষ্ট হয় শিশু। প্রসব-বেদনা শুরু। ক্ষেত্র প্রস্তুত। দুদিন পরেই শুরু হবে নকশালবাড়ী। আপাতত তাল-কেটে-যাওয়া সময়। সেই বেতালা সমারোহে আপাত নিস্তরঙ্গ মফঃস্বলের বেকারবাহিনীর অন্যতম বিনোদন পাড়া-ক্রিকেট।

Advertisment

সেইসব দুপুর শীতার্ত, খড়িওঠা কিন্তু কমলালেবুর মতো উজ্জ্বল। আখাম্বা একটা ব্যাট আর তিনটে অভিজ্ঞ উইকেট কাঁধে এ-পাড়া থেকে ও-পাড়া ক্রিকেট খেলার দিন। মহানগর থেকে দূরে মফঃস্বলে, জীবনে তখনও ভরপুর ‘স্লোনেস’, উদযাপিত হয় সেই অপেশাদারিত্ব।

আরও পড়ুন, গুপ্তচরদের রাজপুত্রের ইতিহাস নাকি জীবনের রূপকথা?

Advertisment

ইস্টবেঙ্গল ভার্সাস মোহনবাগান, আমেরিকা ভার্সাস রাশিয়ার পাশাপাশি আরও অনেক কুচো ভার্সাসও ছিল। যেমন তরুণ ব্যায়াম সমিতি বনাম নবীন সংঘ। কালীপুজো থেকে ক্রিকেট মাঠ, হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পাশে চোরা ঠাণ্ডা লড়াইও ছিল।

এ সেইসময়ের কথা যখন, চার্লি গ্রিফিথ, ওয়েস হল বা ফ্রেড ট্রুম্যানরা গাঁক-গাঁক করে ফাস্ট বোলিং করলেও ব্যাটসমানের মাথায় হেলমেট ছিল না। চার্লি গ্রিফিথের আগুনে বোলিং-এ, ওয়েস্ট ইণ্ডিজ সফররত ভারতীয় দলের অধিনায়ক নরি কন্ট্রাকটর আহত হলে, কাপ্তেনির ভার পড়ল একুশ বছরের টাইগারের পতৌদির কাঁধে। ভারতে ক্রিকেট তখনও নবাব-টবাবদের দখলে, মোটমাট বড়লোকদের খেলা। কিন্তু ডিউজ বল আর প্যাড-গ্লাভসের ধরাচূড়া এড়িয়েও উপভোগ করা যায় ক্রিকেট। সে সুযোগ ছাড়বে কেন ক্রীড়ামোদী গরীব জনতা। পাতি ক্যাম্বিস বলেই তাই ম্যাচের পর ম্যাচ। মহকুমা শহর বা জেলা সদরে অবশ্য ডিউজেও খেলা হয়। চূর্ণি নদীর গা-ঘেঁষা রানাঘাট মহকুমা শহরেও হয় বাৎসরিক ক্রিকেট লিগ। ক্যাম্বিস বল বা ডিউজ, ঘুরে ফিরে খেলে সেই একই খেলোয়াড়ের দল।

ক্রিকেট তো কেবল ক্রিকেট নয়, সাদা পোশাক রঙিন হয় হরেক গল্পে। জীবনের গল্প। লাইব্রেরিতে বইয়ের ভাঁজে রেখে-দেওয়া প্রেমপত্রের গল্প, যে গল্প এসে মেশে আবার সেই ক্রিকেটের পিচে। ব্যাটসম্যান শ্যামল, বেচাদা আর পূর্বপাড়ার সেরা মেয়ে শেফালির গল্প। ম্যাচের দিন মাইকে অনর্গল ‘আঁখো-দেখা-হাল’ সবিস্তার ধারাবিবরণী দেওয়া ‘রিলেম্যান’ বলরামের মজাদার রিলের গল্প। কেওয়াইসি মানে কামারপাড়া ইউুথ সংঘের ছুঁড়ে-বল-করা গোপাল আর দুঁদে আম্পায়ার নরেনের গল্প।

কল্যাণগড়, বাজারপাড়া, টাইগার সংঘ সব বাঘা বাঘা ক্লাবের পৃষ্ঠপোষণা করে ব্যবসায়ীরা। তারা চাঁদা না-দিলে ‘বড়লোকের খেলা’ ক্রিকেট খেলা হবে কী করে! নিউ নবীন সংঘের কর্ণধার চালের আড়তদার নবীন গরাই, তার ‘সমাজসেবা’র গল্পও শুরু হয় ক্রিকেট মাঠেই। এই পাড়া-ক্রিকেটের ধারাবিবরণী শুনিয়েছেন জয় গোস্বামী তাঁর ‘গল্পের পাড়া ক্রিকেট’ বইয়ের পাতায়। খেলার নিপুণ ডিটেলিং-এর পাশাপাশি স্বভাব-দক্ষতায় প্রতি বর্ণনাতেই অনুভবী আঁচড় টেনেছেন প্রেম-অপ্রেম, রেষারেষি, বিষাদ আর অকারণ আনন্দ দিয়ে। ফলত প্রতিটি ধারাবিবরণীই হয়ে উঠেছে এক-একটি পূর্ণাঙ্গ গল্প।

মূলত ছয়ের দশক ভ্রমণ করে, সাতের দশক ছুঁয়ে লেখক ‘দুই বিশ্বকাপ’ গল্পে ফেলেছেন নিজস্ব নোঙর। ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসের বাঁকবদলের রাত সেদিন। কপিলদেবের নেতৃত্বে তিরাশির বিশ্বকাপ জয়। তার পর থেকেই ক্রিকেট নামক খেলাটা বদলে গিয়ে একটা সাংস্কৃতিক চেহারা নিল ভারতবর্ষে। সেই রাতে চারদেওয়াল ছেড়ে নেমে এসেছিল রাস্তায় ছেলে-বুড়ো-মহিলা সকলে। শুরু হয়েছিল নগরকীর্তন। বিনয় উরফ বেনে চিৎকার করেছিল, বিশ্বকাপ মাঈ কী জয়! সকলে গলা মিলিয়ে বলেছিল, জয়!

আরও পড়ুন, প্রথম ভারতীয় ভাষা হিসেবে বাংলাকেই বেছে নিল অ্যামাজন-ওয়েস্টল্যান্ড

সবজে শাড়ী-পরা মানু বেনেকে পরে একদিন বলেছিল, বিশ্বকাপ কি দুগ্‌গাঠাকুর না কালীঠাকুর? বিশ্বকাপ কারও মা হতে পারে? বেনে বলেছিল, আলবাৎ পারে! বিশ্বকাপ মা, বিশ্বকাপ বাবা, বিশ্বকাপ ঠাকুরদাদা, বিশ্বকাপ ঠাকুমা। বিশ্বকাপ সব হতে পারে। বেনের ওই জেদি কথা শুনে মানুর সেকি হাসি। মানুর সেই হাসির দিকে তাকিয়ে বেনে ভাবতে লাগল, এই যে আমি মানুকে হাসতে দেখছি, হাসলে যে মানুষকে এত সুন্দর লাগে, এত সুন্দর লাগে, এতে আমার যা মনে হচ্ছে, বিশ্বকাপ হাতে কপিলদেবেরও কি এত আনন্দ হয়েছিল? এতখানি? বেনে নিশ্চিত, এত আনন্দ হয়নি।

আঠাশ বছর পরে ২০১১-তে ধোনির নেতৃত্বে ভারত আবার জিতল বিশ্বকাপ। বাইকে চেপে আনন্দে মাতোয়ারা ছেলেমেয়ের দল। অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক সৃজন চৌধুরী বেরিয়েছেন রাস্তায়। বাইক থেকে হঠাৎ নেমে একটি মেয়ে চকাস করে অধ্যাপকের গালে চুমু খেয়ে বলে, তুমি রাস্তায় বেরিয়েছ জেঠু! মা বাপি কিছুতেই বেরোলো না! মাই এভারগ্রীন জেঠু! উমম-আহহ্‌! এই বাচ্চাটিকে ছ-মাস বয়স থেকে তিনি চেনেন। এর নামকরণ করেছেন তিনি। নন্দিনী। মনে পড়ে যায় সেদিনের কথা। ২৫ জুন ১৯৮৩। নন্দিনী জানে না, ২৮ বছর আগে ওর বাবা-মাকেও এই আনন্দে ভাগ নিতে দেখেছিলেন। অপসৃয়মাণ মেয়েটির দিকে তাকিয়ে অধ্যাপক সৃজন চৌধুরীর মনটা ভরে যায় আনন্দে। তিনি জানেন আনন্দকে দু-চোখ ভরে দেখতে হয়।

গল্পগুলি পড়তে পড়তে, ডিপ ফাইন লেগ থেকে চুপিসাড়ে উঠে আসা ফিল্ডারের মতো, ঘাই মারবেই নস্টালজিয়া বয়স্ক চেতনায়। মনে হবে, একদা কী জমজমাট ছিল আমাদের পাড়া, তাহাদের পাড়া। সীমানা নিয়ে ঝুট ঝামেলা, পাতি হিংসাহিংসি, ঝগড়া-বিবাদ ছিল না, তা নয়, কিন্তু প্রতিটা বাড়ি ঘিরে স্বার্থপর অসুরের মতো পাঁচিল উঠে যায়নি। সীমানাহীন সেইসব বাড়ি টপকে টপকে ছড়িয়ে পড়ত আনন্দের রং, আবির বিছানো সেইসব পথে হুটোপাটি খেত খয়েরি শালিখ। দুই শালিখ। সেসব যেন প্রাগৈতিহাসিক সময়ের জলছবি। বস্তুত কৌম সেই ছায়াপথে পরস্পর বেঁধেবেঁধে থাকাটাই ছিল সম্মিলিত উল্লাস।

সেই উল্লাস স্তিমিত হয়েছে ক্রমশ। মহকুমা শহরে সরকারবাড়ির এলাকা বড় হয়েছে আর সঙ্কুচিত হয়েছে খেলার মাঠ, চূর্নি নদীর খাত। নবীন গরাইরা ক্রিকেট মাঠ থেকে ‘সমাজসেবা’ টেনে নিয়ে গেছে ক্রমশ রাজনীতির দিকে আর সীমানা মিলিয়ে পাঁচিল উঠতে শুরু করেছে বাড়িতে বাড়িতে! গোটা একটা অখণ্ড পাড়া খণ্ড খণ্ড বাড়িতে ভাগ হয়ে গেল কীভাবে, সেই হিসেব কেউই রাখিনি। এক শালিখ আর দুই শালিখের মধ্যবর্তী নো-ম্যানস-ল্যান্ডে নীরবে বড় হয়ে গেছে নবীন গরাইরা। তাদের সেই আস্ফালনের মুখে কোথায় সেই সম্মিলন, কোথায় সেই কৌমবাঁধন!

লেখক মূলত ছয়ের মাঝামাঝি থেকে কৌম-স্মৃতির ভাণ্ডারী। কৌম-স্মৃতি ভাণ্ডার আমাদের সম্পদ, একে ধরে রাখতে কোনও এক্সটারনাল হার্ড ডিস্কের দরকার পড়ে না। গোটা সমাজই ধরে রেখেছে সেই স্মৃতিযুথ। কেবল রিসাইকল বিন থেকে আলতো তুলে এনে এই যৌথতাকে পাঠকের চেতনার নাভিমূল স্পর্শ করাতে পারেন কেউ কেউ। যেমন জয় গোস্বামী। বস্তুত যৌথতা ভেঙে যেতেই তো আমরা স্মৃতিকাতর হয়েছি, আদরে-সংরাগে কেবলই ফিরে যেতে চেয়েছি গর্ভজলে। আমাদের মতো মাঝবয়েসী ‘অনাধুনিকেরা’ তো এভাবেই নিয়তি-নির্দিষ্ট। জোড়া-শালিখ আমাদের চেতনায় শুভ। কিন্তু এখন সব শালিখই যে একলা!

গল্পের পাড়া ক্রিকেট

জয় গোস্বামী

সপ্তর্ষি প্রকাশন

Book Review