খুব ছোটবেলার কথা, বাবা বইমেলায় নিয়ে যাবে, আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। ধীরে ধীরে অভিমানের পারা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। যখন শেষ পর্যন্ত বেরোবার সময় এল, তখন তার উচ্চতা এভারেস্টকে করুণা করতে সক্ষম। নেহাৎ বইমেলা, তাই সেই শিখর অতিক্রান্ত হয়েছিল সহজেই, আর পাঁচটাকার এক স্বপ্নাতীত মূলধন নিয়ে সেই স্বপ্নের জগতে পা রাখা আমার শৈশবের এক অনন্য সুখস্মৃতি। তার সাথে এও বলে রাখা ভালো যে ওই পাঁচটাকায় অন্তত তিনটি চমৎকার বই সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছিল সেই সময়। কি সেই বই, তা আর স্মৃতিতে নেই।
স্মৃতি নিয়ে কথা ক’টা বলার আগে জানিয়ে রাখি যে আমার জীবনে স্মৃতি ও শক্তির সমন্বয়ের কথা আমার স্মৃতিতে নেই। বিস্মৃতির বিস্তৃতিতেই আমার বিচরণ। আমার বন্ধুরা (বিশেষত যাঁরা আমার শ্রেনীকক্ষে প্রদত্ত বক্তৃতা সহ্য করার মত মহা দুর্ভাগ্যের শিকার) এক কথায় মানবেন যে আমার স্মৃতিশক্তির উপর ভরসা করা ঐতিহাসিক ভুল। সুতরাং তথ্যভিত্তিক তত্ত্বকথার আশা পাঠক করবেন না। এই বিস্মৃতিচারণ নিতান্তই রোমন্থনের শখ থেকে।
আরো পড়ুন: বইমেলা: যেখানে নৈতিকতার হিসেব অন্যরকম
অভিমান ভাঙ্গা সেই বইমেলার ঠিকানা ছিল রবীন্দ্রসদনের উল্টোদিকে, এখন যেখানে মোহরকুঞ্জ। যেদিকে তাকাই শুধু বইয়ের দোকান। সেই বয়সেও স্বর্গের এক প্রকার ধারণা ছিল অমর চিত্রকথা আর চাঁদমামার কল্যাণে, কিন্তু আমার কাছে স্বর্গের সঠিক সংজ্ঞা ছিল ওই ধুলোয় ভরা মাঠখানা। সেই সংজ্ঞা পরের তিন দশকেও পালটায়নি। ক্রমে দুই বইমেলা এক হল - সরকার আর গিল্ডের মিলনে আয়তনে বাড়লো এই শীতকালীন উৎসব। আর গড়ের মাঠ হয়ে উঠলো বহু মানুষের কেতাবী তীর্থক্ষেত্র। টিকিটের বিরাট লাইন পার হয়ে মেলায় ঢোকার উত্তেজনা ছিল আলাদা মাত্রার। যদিও আধঘণ্টার মধ্যে লাইন কলেবরে ক্ষীণ হয়ে যেত, কিন্তু দুটো বাজলেই যে ঢুকতে হবে! দেরী অন্য জায়গায় সম্ভব, এই মেলার প্রতি দায়বদ্ধতা সম্পূর্ণ আলাদা।
তারপর এল লেখনীর যুগ। ছাপার অক্ষরে দেখলাম নিজের নাম। (কম্পিউটার ও প্রিন্টারের যুগের প্রজন্ম এই শিহরনে বঞ্চিত।) আর তার সাথে এল 'পাস' নিয়ে ঢোকার আনন্দ। মনে আছে দরজা পেরিয়ে ঢোকার সময় হঠাৎ মনে হওয়া যে লক্ষ লক্ষ লেখকের মধ্যে আমিও একজন - তা যতই অলক্ষ্যে ও অখ্যাতিতে থাকি না কেন।
বইমেলায় স্টলে এবং লিটল ম্যাগাজিনের টেবিলে দাঁড়িয়ে বই বিক্রি করা শিখিয়েছিল মেলার অন্য এক পরিচয়। আত্মীয়সম প্রকাশনায় স্বেচ্ছাসেবা দেখিয়েছে বইমেলা কেমন পিকনিকও বটে। ক্রেতা কেবল খদ্দের নয়, সে বইপ্রেমে আমার সহমর্মী, বইয়ের মাধ্যমে তার সাথে আমার সম্পর্ক নিবিড়। তার সাথে সাথে মাঠে মাদুর পেতে বসে ছবি ও গ্রিটিংস কার্ড বিক্রী করা। মেলাকে মাটির প্রেক্ষিত থেকে দেখার সে আর এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা! ওদিকে পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে বেগম আখতারের ‘জোছনা করেছে আড়ি’ আর সেই বিখ্যাত ঘোষণা – "মহিলা পকেটমার হইতে সাবধান"!
তখন বইমেলায় আধ্যাত্মবাদ থেকে অনুবাদের চাহিদা বেশী, বিতর্ক কোনো প্রকাশনার 'ক্রীতদাসীর মূর্তিস্থাপন' নিয়ে। ভ্রমণকাহিনীর রমরমা, কিন্তু ভ্রমণপত্রিকার বিকাশ সীমিত। আর সেই সময় দূর থেকে দেখা আমাদের প্রাতঃস্মরণীয় বৃদ্ধ শিক্ষকমশাই আর তাঁর স্ত্রীর হাত ধরাধরি করে নিবিড় পথচলা। আজকের দিন হলে তা হয়ত #RomanceGoal হয়ে হারিয়ে যেত, কিন্তু তখনও আমরা মনের কথা মন ও মননে রাখতে ভালোবাসতাম, মুখগ্রন্থে তাকে সম্প্রচার করার কথা ভাবতে শিখিনি। যোগাযোগ তখন মানুষে মানুষে, যন্ত্রের যন্ত্রণা তখনও সুদূরে। তখন নিবিড় যোগাযোগ অন্য স্বেচ্ছাসেবক ও বিক্রেতাদের সাথে। বিভিন্ন বাড়ি থেকে আসা বিভিন্ন আহার্য - আলুরদম থেকে শুরু করে পাটিসাপটা - বইমেলাকে অন্যভাবে আত্মস্থ করার সুযোগ এনে দিত। তখনও খাবারের দোকান কিছু ছিল। কিন্তু মানুষের খাইখাই ভাবটা বেশী ছিল বইয়ের প্রতি।
আর তার মাঝে লাগলো আগুন। শোনা যায়, খাবারের দোকান থেকেই। মনে আছে (মানে আমার ধারণা মনে আছে) বাস থেকে নেমে দেখতে পাওয়া দুটো ধোঁয়ার স্তম্ভকে। গুজবের হাওয়া বলে উড়িয়ে দেওয়া খবর তখন চোখের সামনে জাজ্বল্যমান! হাঁচড়পাঁচর করে পাঁচিল টপকে গিয়ে দেখলাম - না, আমার পরিচিত মানুষ ও বই সুস্থ আছে। শুনলাম চারশো স্কোয়ার ফিটের ব্যবসায়ীরা দোকানে তালা মেরে বইহত্যা দেখেছেন অবলীলায়। কেউ যেন এই সুযোগে বই চুরি না করে। একটা বই চুরি মানে একটা বিক্রি কম! সুতরাং পুড়ুক বই, ব্যবসায়ীর কপাল না পুড়লেই হল। আর বীমা কি বিনা কারনে! বই পড়া আর বই পোড়া - ব্যবসার নির্বিকার দৃষ্টিতে সবই এক।
তারপর হঠাৎ একদিন শুনলাম ময়দানে মেলা সমস্যা। ময়দানের সর্বনাশ প্রকল্পে নাকি মেলাওয়ালারা উদার হস্তে দান করছেন। মিলিটারির ময়দান ময়লাদানের আখড়া হয়ে উঠেছে। আর মেলার আয়োজকরা প্রাঙ্গণ পরিষ্কারের আয়োজনে ব্যর্থ। অপরিণত বয়স তখন কু-জন প্রচারিত কুকথায় বিশ্বাস করে ফেললো! লাভের লোভে নাকি ময়দান সংরক্ষণে সামান্য লগ্নীতেও আয়োজকরা নারাজি! এই নিয়ে তর্ক তখন তুঙ্গে। গিল্ডের অর্থাভাব নিয়ে ব্যঙ্গ আর বইপ্রেমীদের পার্ক স্ট্রিট প্রীতির বিতর্কের বাস্তবিক ফলাফল মেলার কলকাতার ফুসফুস থেকে বিতাড়ন। ধূম্রপায়ী বুদ্ধিজীবীগণ বুঝতেই পারলেন না যে দূষণ কিভাবে শহরকে আক্রান্ত করছিল। আর কেউ কেউ বললেন গিল্ড তো অন্তত মূল্য ধরেও দিতে পারতো। কিন্তু মূল্যবোধের তারতম্যেই বোধহয় সমাধানের সন্ধান পাওয়া গেল না।
মেলা তখন বেরিয়ে পড়ল বাসার সন্ধানে। যুবভারতী মেলাঙ্গন হয়ে শেষে আশ্রয় মিলল মিলন মেলায়। সবাই ভাবল মেলা পেল স্থায়ী আস্তানা। কিন্তু মানুষের চাহিদার কি অন্ত আছে? সেই মেলা নিয়েও কথার খেলা জারি রইল। যাতায়াতে প্রাণপাত নিয়ে আলোচনায় মত্ত হল শহরবাসী। ব্যাপারটা বাসি হতে না হতেই মিলনস্থলে দেখা গেল মেলবন্ধনের অভাব। কুচক্রী মানুষদের বক্তব্য, এই ক্ষেত্রেও সমস্যাটা এক – মেলা-চালকরা অর্থের বিভাজনে অপারগ। "মেলার বেলায় রাজী, মেলা ফুরোলেই পাজী" – এই জাতীয় কথা বলা শুরু করলেন কিছু দুর্মুখ দুরভিসন্ধিকারী। মেলা চলল বহুদূর। শোনা গেল, সুদূর রাজারহাটে বসবে আমাদের বইয়ের হাট। কেঁপে উঠলো ভ্রমণপ্রেমী বাঙালীহৃদয়। কিন্তু সে গুড়ে দেখা গেল লবণহ্রদের বালি। মেলা এল সেন্ট্রাল পার্কে। জোড়ায় জোড়ায় পাখি ও মানুষ ও পাখিমানুষ হয়ত যারপরনাই বিরক্ত হলেন। লবণহ্রদের নির্জনতা ভেঙে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সারা রাজ্যের মেলা মানুষ।
কিন্তু এই সবের মাঝখানে বইমেলাটা কি একটু ম্রিয়মাণ হল? বই-তরণী কি এগিয়ে এল বইনাশের আর একটু কাছাকাছি? অনেকেই খাদ্যবিক্রয়কে খাদ মনে করে থাকেন। কিন্তু খাদ্য ছাড়া মেলা হয়? আর 'খাওয়া-পড়া' তো চিরদিনই পরস্পরের অনুরাগী। তবে মেলার মধ্যে অলঙ্কারের কেলেঙ্কারি বা টেলিভিশনের বিভীষণ আর আচারের অনাচার কি সামান্য হলেও দৃষ্টিকটু নয়? সেই সব কারণে, অথবা হয়ত অত্যধিক রোমান্টিকতার তাড়নায়, আমার মত লোকেদের মেলার প্রতি ভালোবাসা কি কিঞ্চিৎ মলিন?
নাকি বইয়ের আস্ত অ্যামাজন জঙ্গল হাতের কাছে থাকায় সেই পুরনো প্রেম নতুনের কাছে পরাজিত? সেই অধীর আগ্রহ বা উত্তাল উত্তেজনা, বইমেলার ধুলোয় গুপ্তধন পাওয়ার আনন্দ কি আজও আছে? যুগলে (বই)প্রেমের স্থান কাল পাত্রপাত্রী কি পালটে গেছে? নাকি আর পাঁচটা মেলার মত বইমেলাও হয়ে দাঁড়িয়েছে নির্ভেজাল ব্যবসা? বই ও পাঠকদের মিলনের তীর্থক্ষেত্রটি বোধহয় এখন বাকি অনেক তীর্থক্ষেত্রের মতই - কেবল দক্ষিণা আর প্রণামীর প্রতি আসক্ত।
বইমেলার ব্যবসায়িক দিক তো থাকতেই হবে। কিন্তু বই সেখানে মুখ্য ভূমিকায় থাকাটাই বাঞ্ছনীয়। যুক্তি যদি বলে বর্তমান প্রজন্ম বইবিমুখ, তাহলে বইমেলার দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়। কলকাতার বইমেলা, শোনা যায় পৃথিবীর বৃহত্তম, আমাদের সংস্কৃতির এক অনন্য অঙ্গ। বাঙালির পরিচয়ের এক ভিত্তি এই বইমেলা। আর কথাসাহিত্য ও চারুকলার এই চরম দুর্দিনে বইমেলা এক আন্দোলন। মানুষের ভাবনার জগতকে, অন্যধারার চিন্তার সম্ভাবনা ধরে রাখার পীঠস্থান এই মেলা। আশা করি মেলা বিবর্তিত হবে, কিন্তু বজায় রাখবে তার ঐতিহ্য ও বৈভব।