শনিবার এক বিশেষ বিবৃতি জারি করা হয়েছে। বিবৃতি ঠিক নয়, আহ্বান। বইমেলার ৪৮২ নং স্টলের সামনে জমায়েত, সন্ধে ৬ টায়। শনিবার সারাদিন বন্ধ ছিল কলকাতা বইমেলার ৪৮২ নং স্টল। শুক্রবার অবশ্য সে স্টল খুলেছিল যথারীতি। বিকিকিনিও হয়েছিল সেদিন।
আরও পড়ুন, ব্যবসা থাক, খিদেও পাক, কিন্তু রাজত্ব হোক বইয়ের
আজ থেকে দু আড়াই দশক আগে, ভাষাতাত্ত্বিক প্রয়াত কলিম খান, যিনি পরবর্তীকালে অ্যাকাডেমিয়ার বাইরে থেকে শব্দের ক্রিয়ার্থবিধি নিয়ে আলোচনা করে এবং সে সম্পর্কিত অভিধান রচনা করে বহু প্রতর্কের সূচনা করবেন, তাঁকে লেখার স্থান দিয়েছিল 'একালের রক্তকরবী' পত্রিকা। প্রয়াত অরূপ রতন বসুর প্রথম উপন্যাস 'হলোগ্রাম' প্রকাশিত হয়েছিল সে পত্রিকাতেই। 'একালের রক্তকরবী' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এরকম বহু আখ্যান, প্রবন্ধ- যা যে কোনও লিটল ম্যাগাজিনের অসূয়া অথবা অহংকারের বিষয় হয়ে উঠতে সক্ষম। পরবর্তীকালে, 'একালের রক্তকরবী' প্রকাশনার হাতবদল হয়। ঊর্বী নামের প্রকাশনা সংস্থা শুরু করেন প্রদীপ ভট্টাচার্য। এবারে বইমেলায় ৪৮২ নং স্টল ঊর্বীর।
শুক্রবার রাত ৮টার কিছু পরেই, মেলা শেষের নির্ধারিত সময়ের আগেই শরীর খারাপ লাগায় স্টল বন্ধ করেন প্রদীপ ভট্টাচার্য। মেলার মাঠেই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। যথাসাধ্য চেষ্টার পরেও আর সুস্থ হননি প্রদীপ। কিছুক্ষণ পরেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
প্রদীপ ভট্টাচার্যের মৃত্যুতে বহু বইপ্রেমী মানুষ ভেঙে পড়েছেন, শনিবারের মেলায় তেমন ইঙ্গিত মেলেনি। যাঁরা পুরনো সময়ের খোঁজ রাখেন তাঁরা অবশ্য হা হুতাশ করেছেন, কিন্তু মনে রাখতে হবে, 'একালের রক্তকরবী' পত্রিকার অবদান তেমন ফলাও প্রচার পায়নি, দেশ বিদেশের অ্যাকাডেমিয়াখ্যাতরা তাঁদের অ্যাকাডেমিক জার্নালে না-ছাপাতে-পারা লেখাসমূহ দিয়ে সে পত্রিকাকে "ঋদ্ধ" করে তোলেনি। প্রদীপ ভট্টাচার্য সে ব্যাপারে খুব উৎসাহীও ছিলেন না। পরবর্তীকালে ঊর্বী প্রকাশন চালানোর সময়েও এরকম ধরনের নিশ্চিত-ব্যবসাদায়ী প্রকল্প সম্পর্কেও তাঁকে লোভাতুর হতে দেখা যায়নি। এই বইমেলাতেও তাঁর স্টলে রাখা ছিল প্রয়াত রবিশংকর বলের প্রথম উপন্যাস 'স্বপ্নযুগ'। রাখা ছিল অরূপরতন বসুর 'আর্কিমিডিসের লাঠি' নামক গল্প সংকলন। এই উদাহরণসমূহই তাঁর জনপ্রিয় প্রকাশক বা নামকরা সম্পাদক না-হয়ে ওঠার যথেষ্ট প্রমাণ।
প্রদীপ ভট্টাচার্য মারা গিয়েছেন। আর না-মরতেই মরার গুজব ছড়িয়ে গিয়েছে এই বইমেলা চলাকালীন, সুবিমল মিশ্র সম্পর্কে। বাংলা সাহিত্যে আপাদমস্তক প্রতিষ্ঠানবিরোধী বলে যদি কাউকে চিহ্নিত করা যায়, তিনি সুবিমল মিশ্র। যতদিন তিনি সুস্থ ছিলেন, বইমেলায় টেবিলে বসতে দেখা যেত তাঁকে। প্রথমে একটি পত্রিকাগোষ্ঠীর হয়ে, পরের দিকে আরেকটি পত্রিকাগোষ্ঠীর সঙ্গে, মধ্যের একটি বড় সময়ে একা, নিজের বই নিয়ে একটি টেবিলের সামনে চেয়ার পেতে বছরের পর বছর নিজের বই বিক্রি করে গেছেন সুবিমল। বিক্রি শব্দটা সম্ভবত ঠিক হল না। তাঁর বইয়ের পাঠক যেমন হওয়া উচিত, তেমন নয়, কোনও ভ্রান্তিবশত তাঁর বই কিনছে, এমন তরুণ পাঠককে বুঝিয়ে তাঁর বই কেনা থেকে নিরস্ত করেছেন সুবিমল মিশ্র, এই প্রতিবেদক তেমন ঘটনারও সাক্ষী। যাঁরা সুবিমল মিশ্রের লেখা থেকে ছাপানো হয়ে বিক্রি- এই প্রকল্পকে দেখেছেন, তাঁরা জানেন, সুবিমল মিশ্রের বইয়ে দামের জায়গায়, একটি নির্দিষ্ট মূল্যের কথা যেমন লেখা থাকত, তেমনই লেখা থাকত- অথবা আপনি যা মনে করেন। বাস্তবিকই পকেটশূন্য কিন্তু সম্ভাব্য পাঠককে দু-পাঁচ টাকাতেই বই দিয়ে দিয়েছেন সুবিমল মিশ্র। তিনি বাজারজাত নন বলে সারা জীবন নিজেকে বিজ্ঞাপিত করেছেন, এবং হাতে কলমে তা যথাসাধ্য করে দেখিয়েছেন।
আরও পড়ুন, বইমেলা, বিভ্রম
বিশ্বাস মোতাবেক কাজ করে যাওয়ার উদাহরণ রেখে যাওয়া এই দুই মানুষ, প্রদীপ ভট্টাচার্য এবং সুবিমল মিশ্র- এঁদের দুজনের মৃত্যু এবং মৃত্যুরটনা- একই বইমেলা চলাকালীন, আপতিক বটে, কিন্তু এসব কাকতালের পিছনে কোনও আশ্চর্য কার্যকারণ কাজ করে বলে মনে হয়।