শনিবারে দুপুর, রোদ উপেক্ষা করে সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্ক তথা বইমেলা প্রাঙ্গণে তখন যেন মহানবমীর জনপ্লাবন। নামী-অনামী প্রকাশনীর স্টলের ভিতরে গিজগিজ করছে কালো মাথার ভিড়। স্টলের বাইরেও দীর্ঘ লাইন। তা সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন নিরাপত্তারক্ষীরা। ভিড় ঠেলে এক স্টল থেকে আরেক স্টলে যেতে অনেকটা সময় লাগছে। তাও উৎসাহিত বইপ্রেমীদের ঢল বাড়তে থাকল ক্রমেই। মেলার ভিড় যতই বাড়ল, রাস্তার ট্রাফিক সামলাতে ততটাই কালঘাম ছুটল বিধাননগর পুলিশের পদস্থ আধিকারিক থেকে সিভিক ভলান্টিয়ারদের।
কোভিড কারণে গত বছর মেলা হয়নি। তাই শহরবাসী এবার তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছেন বইমেলা। শুধু ভিড় নয়, উল্লেখযোগ্যভাবে ২০২০ সালের মেলায় বই কেনার প্রবণতাকে টেক্কা দিচ্ছে এবারে মানুষের আগ্রহ। গিল্ডের পক্ষ থেকে এক সাংবাদিক বৈঠকে সেকথা জানান সম্পাদক ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় ও সভাপতি সুধাংশুশেখর দে। সুধাংশুবাবু জানিয়েছেন, সেবার প্রথম পাঁচদিনে আড়াই কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছিল।
গিল্ডের হিসেব বলছে, চলতি মেলায় ইতিমধ্যেই প্রায় ১১ কোটির মাইলফলক ছাড়িয়েছে। এটা একটা রেকর্ড। এদিনও আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়েছে লক্ষাধিক মানুষের কাছে ‘উইকএন্ড হ্যাং-আউট প্লেস’ হয়ে উঠতে চলেছে কলকাতা বইমেলা। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের স্টলের সামনে সেলফির হিড়িক নজরে এসেছে। ইদানিং তরুণ প্রজন্মকে একটা বদনাম প্রায়ই শুনতে হয়, তাঁরা নাকি মোবাইলে বুঁদ হয়ে থাকেন। তবে এবার যেন অন্য ছবি বইমেলায়। সেই তরুণ প্রজন্মই বই হাতে বুঁদ। জাগো বাংলা স্টলের বাইরে কালো মাথার ভিড়।
আরও পড়ুন ঝাঁ-চকচকে নয়, তাই বইমেলায় স্টলেও ভিড় নেই, লিটল ম্যাগাজিনে আগ্রহ হারাচ্ছে পাঠক!
রাতদিন ইউটিউবে ডুবে থাকেন যে কলেজ ছাত্রী তিনিও গিয়ে উলটে পালটে দেখছেন বইয়ের মলাট। চোখও কিছুক্ষণের আটকে যাচ্ছে সেই বইতে। এরপর বই কিনে বাড়ি ফেরা। মুখে তৃপ্তির হাসি। আর সেই হাসি ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বইমেলা জুড়েই। আগরপাড়া থেকে বইমেলায় এসেছেন তিন্নি দত্ত। বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়েন তিনি। এসেছেন বন্ধুদের সঙ্গে। হাতে অবশ্যই স্মার্টফোনে। স্মার্টফোনের যুগে বই পড়তে কতটা ভাললাগে, এই প্রশ্ন করতেই তিন্নির সাফ জবাব, 'নেটে একটু আধটু বই-টই পড়া হয়। তবে বইমেলায় এসে বই না কিনলে মন ভরে না মনে হয় কী একটা যেন অপূর্ণ থেকে গেল'। ভালবাসেন কবিতার বই পড়তে সেই সঙ্গে বইমেলার পরিবেশ এটাই তাকে বেশি আকৃষ্ট করে মেলা দেখতে।
আরও পড়ুন বইয়ের কোনও ধর্ম নেই, অর্ধ শতক ধরে সম্প্রীতির বার্তা দিয়ে চলেছে ‘হরফ প্রকাশনী’
এবারই প্রথম ভার্চুয়াল মাধ্যমে সম্প্রচারিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা। সেখানেও ভালই প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে বলে গিল্ড সূত্রে খবর। সম্পাদক বলেন, দেশ-বিদেশের বহু মানুষ দেখছেন। পরিসংখ্যান বলছে, ফেসবুক, ইউটিউব মিলিয়ে মোট ৩০ থেকে ৩৫ লক্ষ মানুষ দেখেছেন বইমেলার ভার্চুয়াল সংস্করণ। মোবাইলের সর্বগ্রাসী হানার মধ্যেও প্রিয় বইয়ের জন্য বইমেলায় ভিড় জমিয়েছেন অনেকেই। গিল্ডের তথ্য অনুসারে এখনও পর্যন্ত ১৩ লক্ষ মানুষ বইমেলায় এসেছেন। সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। আর বুধবার পর্যন্ত প্রায় ১১ কোটি টাকারও বেশি বই বিক্রি হয়েছে কলকাতা বইমেলায়। হিসাব বলছে গত ৪৫ বছরে এত বই এর আগে বিক্রি হয়নি। কার্যত বই বিক্রির নিরিখে গত ৪৫ বছরের রেকর্ড ভেঙে দেওয়ার পথে এবারের বইমেলা। আগামীকাল রেকর্ড ভিড় এবং রেকর্ড বিক্রির আশায় বুক বাঁধছেন প্রকাশকরা। দেবসাহিত্য কুটিরের দেবাশিস চট্টোপাধ্যায় বইমেলা প্রসঙ্গে বলেন, “এতদিন ধরে স্টল দিচ্ছি, এত সাফল্য আগে দেখা যায়নি”।