শীতকাল এসে গেছে কলকাতায়। পরিযায়ী পাখিদের আর দেখা না মিললেও, এক অজানা উড়ন্ত বস্তু আজকাল খুব উড়ে বেড়াচ্ছে চতুর্দিক। কলকাতা শহরেও দুপা হাঁটলেই তার দেখা মিলবে। যার নাম লিটারারি ফেস্টিভ্যাল।
এই লিটারারি ফেস্টিভ্যাল নামক অদ্ভুতুড়ে বকচ্ছপটি বিধাতার এক অপূর্ব আবিষ্কার। এর মধ্যে সাহিত্য একেবারে নেই তা নয়, কিন্তু মূল কথা হচ্ছে গ্ল্যামার। সাহিত্যিকরা ঐতিহাসিকভাবেই মূলত টেকো, মোটা ও বেঁটে হন। এক-আধজন ঝুম্পা লাহিড়ির মতো ঝক্কাস হননা তা নয়, কিন্তু বেশিরভাগেরই চুল থাকলেও পাকা, দাঁত থাকলেও নড়বড়ে। শো-কেসে এই বস্তাপচা জীবদের এক-আধটাকে পুরে রাখা অবশ্যই যেতে পারে, কিন্তু লেখালিখি নিয়ে অনন্ত ভ্যাজর-ভ্যাজরের কোনো টি-আর-পি নেই।
তাই এদিক সেদিক থেকে ঝাঁক-বেঁধে তুলে আনা হয় গ্ল্যামারাস নট ও অপ্সরাদের, সাহিত্যের সঙ্গে যাঁদের সম্পর্ক নিশ্চয়ই কিছু আছে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি আছে দেখনদারির সঙ্গে। ফলে এই সব উৎসবে নারীবাদ নিয়ে বক্তব্য রাখেন বলিউডি নায়িকা, ভারতের সাম্প্রতিক সাহিত্য নিয়ে জ্ঞানবাণী দিতে আসেন লন্ডনের মণীষী, সঙ্গীতের ভবিষ্যৎ নিয়ে লেকচার দিতে বম্বে থেকে উড়ে আসেন মিউজিক অ্যারেঞ্জার।
কিন্তু সে নিয়ে কিছু বলা যাবেনা। বলতে গেলেই, 'কেন, নারীবাদ কি সাহিত্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, নাকি বলিউডি নায়িকা বলে মানুষ নয়, নাকি লন্ডনের ভূমিপুত্র বলে ভারতীয় সাহিত্য নিয়ে কিছু জানতে পারেনা?' জাতীয় কঠিন ও কূট যুক্তি দৌড়ে আসবে।
এ সবই ঠিক, 'আলপনা শিল্পের ভবিষ্যৎ' থেকে শুরু করে 'একটি ওয়াইনের আত্মকথা' পর্যন্ত মুড়ি থেকে চালকুমড়ো অবধি নানা বিষয়ে আলোচনা তথা গ্ল্যামার প্রদর্শন সবই খুব উচ্চমার্গের জিনিস, তা নিয়েও কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কথা হল, এসবই একটা প্যাকেজে পুরতে গেলে ঠোঙাটার নাম ফালতু 'সাহিত্য উৎসব' দেওয়া কেন, 'হরেকরকমবা' কিংবা 'বিরাট বিচিত্রানুষ্ঠান' রাখলেই হয়।
কিন্তু এহ বাহ্য। এর চেয়েও প্রলয়ঙ্কর ব্যাপার হল এই উৎসবের ট্যাঁশত্ব। বাংলার মাটিতে হলেও, এর উপর থেকে নিচ পর্যন্ত 'আমি কিন্তু ইংরিজিতে কথা বলতে পারি' বিজ্ঞাপন। সবাই জানে, এ কিছু মাধ্যমিকের ইংরিজি পরীক্ষা নয়, তবু কী আপ্রাণ চেষ্টা নিজেকে প্রমাণ করার, কেউ যেন ভেবে না ফেলে এরা ইংরিজিতে কাঁচা।
তাই বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে হোর্ডিং পর্যন্ত, অনুষ্ঠানসূচি থেকে শুরু করে ঘোষণা অবধি, সবই বিশুদ্ধ ইংরিজিতে। ইদানিং বাংলা সিনেমার নায়িকাদের টিভির পর্দায় দেখা যায়, যে, বেশিরভাগই আস্ত একটা বাক্যও বাংলায় বলতে পারেননা (সেই কারণেই সম্ভবত সিনেমার পর্দায় আধো-আধো বাক্য বলেন) -- এ যেন তার সামনাসামনি সংস্করণ।
এখানে বাংলা কোণঠাসা বললে নেহাৎই কমিয়ে বলা হয়, এক আধটা রাখতে হয় তাই রাখা, যেমন তারকাদের ভিড়ে এক-আধটি প্রান্তিককে গুঁজে দিলে ব্যাপারটার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে। 'হুঁহু বাওয়া আমরাও বাংলা বলি'। তবে সেখানেও বিদগ্ধরা কেউ-কেউ পারলে 'রবীন্দ্রনাথ ওয়াজ অ ভেরি গুড কবি' ধরণের বাংরেজিতে পুরোটাই বলে দেন। সব মিলিয়ে বস্তুটা শুধু 'আমি কিন্তু ইংরিজি জানি'ই নয়, 'আমি কিন্তু বাপু বাংলা পারিনা'র এক উন্মত্ত ও নির্লজ্জ প্রদর্শন।
আজ থেকে তিরিশ বছর আগে হলে এই বস্তুকে নির্দ্বিধায় উপনিবেশের-আদেখলাপনা বলা হত। বিপ্লব টিপ্লব লাগতনা বামফ্রন্টই এসে 'মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ' বলে ঠুসে দিত। কিন্তু এখন দিনকাল বদলে চৌতিরিশ। মাথার উপরে মোদী, পৃথিবীর সম্রাট ট্রাম্প। গ্লোবালই এখন আপ্তবাক্য, ও না হলে কল্কে মেলেনা। এখন আর চোখে আঙুল দিয়ে কে বলবে, ইংরিজি বলা এমন কিছু হাতিঘোড়া ব্যাপার নয়।
আমেরিকার চাষা-ভুষো-দিনমজুর সক্কলেই গড়গড়িয়ে ইংরিজি বলে, যেমন মেক্সিকোয় বলে এসপ্যানিওল। এর মধ্যে আলাদা করে গর্বের কিস্যু নেই। বরং বাংলার কথাকথিত সাহিত্য কর্মশালায় বাংলা না থাকাটা এবং বাঙালির বাংলা না বলতে পারাটাই অগৌরবের।
(সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় গুরুচণ্ডালি ওয়েব ম্যাগাজিনের সম্পাদক, মতামত ব্যক্তিগত।)