Advertisment

মেলা আছে, আছে লিটল ম্যাগাজিনও, কিন্তু...

সন্দীপ দত্ত একে "ছাত্রবন্ধু" প্রবণতা বলে উল্লেখ করলেন। তিনি বলেন, এগুলো লিটল ম্যাগাজিন হয়ে ওঠে না। এগুলোর পিছনে একটা দুষ্টু ব্যবসায়ী বুদ্ধি কাজ করছে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

লিটল ম্যাগাজিন মেলা, জোড়াসাঁকো

শহরে তৃতীয় লিটল ম্যাগাজিন মেলা শুরু হয়েছে। এ মেলা নবীন, মাত্র দু বছর বয়স। এ মেলা শুরু হওয়ার পিছনে রয়েছে রাগ-ক্ষোভ-দ্রোহ। প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লিটল ম্যাগাজিনের যেমনটা হওয়ার কথা ছিল বা থাকে, সে সবের প্রকাশ হয়েছে মেলার আয়োজনে।

Advertisment

গত বছর থেকে রাজ্য সরকারের উদ্যোগে লিটল ম্যাগাজিন মেলা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সল্ট লেকের রবীন্দ্র ওকাকুরা ভবনে। তার আগে পর্যন্ত মেলা হত নন্দন চত্বরে। স্থানাভাব ও অন্যান্য কারণ প্রদর্শন করে মেলা সরানোয় ক্ষুব্ধ হন অনেকেই। সেই ক্ষোভ থেকেই গত বছর রবীন্দ্র ওকাকুরায় আয়োজিত মেলা চলাকালীনই দুদিনের মেলা আয়োজিত হয়েছিল ভারতসভা হলে। এ বছর অবশ্য রবীন্দ্র ওকাকুরার মেলা এবং কলেজ স্কোয়ারের লিটল ম্যাগাজিন মেলা শেষ হওয়ার পর দুদিনে ধরে মেলার আয়োজন করা হয়েছে জোড়াসাঁকোয়। গত বছরের মতই এ বছরও এই মেলাতে যোগ দিয়েছেন বেশ কিছু পত্রিকা গোষ্ঠী। এর মধ্যে কেউ কেউ আবার সরকারের মেলা ও সরকার বিরোধী মেলা - দুয়েই যোগ দিয়েছেন।

এ ব্যাপারে এই বিদ্রোহী মেলার অন্যতম সংগঠক মিতুল দত্তকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, "এ নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। কী আর বলতে পারি?" মিতুল ব্যক্তিগতভাবে চান, "রবীন্দ্র-ওকাকুরায় যখন মেলা হবে, তখনই এই মেলা হোক। আমরা প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলাম, একই সময়ে সমান্তরাল মেলা করলে সে প্রতিবাদটা অনেক জোরদার হবে। ঠিক কতজন আমাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, কতজন পাঠক আসছেন। পাঠকই তো মেলার উদ্দেশ্য!"

আরও পড়ুন, বইমেলায় লাখ টাকার বই পুরস্কার, পিনাকী ঠাকুর প্যাভিলিয়ন, বিশেষ অ্যাপ

১০ বছর আগে বন্ধ হয়ে গেছে 'বিষয়মুখ' পত্রিকা। যে পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক ছিলেন প্রয়াত লেখক রবিশংকর বল। সে পত্রিকার আরেক সম্পাদক বিকাশ গণ চৌধুরী বললেন, "সবাই একজোট থাকলে একটা লড়াই হয়, আন্দোলন জোর পায়। এই মেলা ভাঙাভাঙির ঘটনা দুঃখজনক।"

লিটল ম্যাগাজিনের অনেক মেলা হচ্ছে বটে, কিন্তু যে উদ্দেশ্য ছিল লিটল ম্যাগাজিনের, তা এখন অনেকটাই বদলে গেছে। এমনটাই মনে করেন গল্পকার কণিষ্ক ভট্টাচার্য। মূলত ছোট পত্রিকার এই লেখকের ভাবনায়, "সময় পাল্টেছে, সময়ের সঙ্গে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের অভিমুখও পাল্টেছে। প্রতিষ্ঠান বিষয়টা আর আগের মত একমাত্রিক নেই।" কণিষ্ক বলছিলেন, "বুদ্ধদেব বসু যে সময়ে পত্রিকা করছিলেন, আর এখন পিওডি (প্রিন্ট অন ডিম্যান্ড) এসে যাওয়ার পরে, প্রতিষ্ঠানের চরিত্র বদলে গেছে অনেকটাই।" ঠিক কেমন সে বদল? ধোঁয়াশার কথা বললেন 'দশমিক' পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত  তরুণ কবি পৃথ্বী বসু। তাঁর মতে, লেটার প্রেসে যখন ছাপা হত পত্রিকা, তখন একটা সময় ছিল। দারিদ্র্য ভর করে থাকত পত্রিকায়, তার চিহ্ন ফুটে উঠত প্রকাশিত পত্রিকার গায়ে। "এখন লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক হন অধ্যাপক বা কোনও ব্যবসায়ের মালিক। তাঁদের প্রকাশনার ছিরিছাঁদ অনেক বেশি আধুনিক, উন্নত মানের। তবে এ সব করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার কনটেন্ট জোলো হয়ে উঠছে, তফাৎটা ক্রমশ মুছে আসছে।"

তরুণ পৃথ্বী যা বললেন, তারই প্রতিধ্বনি শোনা গেল লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের পুরোধা সন্দীপ দত্তের কথায়। "প্রতিষ্ঠান আর আগের মত নেই", বললেন লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্রের কর্ণধার। "ছয় বা সাতের দশকে যেভাবে প্রতিষ্ঠানকে আমরা চিনতাম, এক-আধটা বৃহৎ পত্রিকাগোষ্ঠী যেভাবে নিজেদের লেখকগোষ্ঠীকে দিয়ে লেখাত এবং তাদেরই পুরস্কৃত করে চলত - সেই ধরনটা আজ আর নেই। এখন অনেক কিছুই বদলেছে, এমনকি সিলেবাসেও ঢুকে পড়তে শুরু করেছেন অন্য ধরনের লেখকরা।"

লিটল ম্যাগাজিন মেলায় অনেক টেবিলেই দেখা গেল, পত্রিকার চেয়ে বইয়ের আধিক্য বেশি। গত বইমেলা থেকে ২০১৯ বইমেলা পর্যন্ত এক বছর সময়কালে দশটিরও বেশি বই প্রকাশ করছেন, কিন্তু একটি মাত্র পত্রিকা প্রকাশ করছেন, জোড়াসাঁকোর মেলায় হাজির এমন এক প্রকাশক গোষ্ঠীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পত্রিকা প্রকাশ অনেক বেশি মেহনতের কাজ বলে মনে করছেন তাঁরা। "একটা বই প্রকাশ করতে গেলে তেমন কিছু লাগে না, বইটি নির্বাচন করা ছাড়া। কিন্তু একটা পত্রিকা প্রকাশ করতে গেলে লেখা জোগাড় করার কাজ করতে হয়, যাতে অনেক বেশি পরিমাণ শ্রমের প্রয়োজন হয়। সেই শ্রমসাধ্য কাজ করার জন্য যে লোকবল প্রয়োজন তা আমাদের নেই। তবে এটা আমরা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি, বছরে অন্তত একটা পত্রিকা প্রকাশ করার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।"

শ্রম-পাঠ-মেধায় ফাঁকি রয়ে যাচ্ছে বলে সন্দেহ বিকাশ গণ চৌধুরীর। বলছিলেন, "একটা লেখা সবাই ভাল বলছে, কিন্তু যারা ভাল বলছে, তারাও লেখাটা নিয়ে কোনও কৌতূহল প্রকাশ করছে না। সন্দেহ হয়, আদৌ কি পড়ে ভাল বলছে তারা?"

হাওড়ার কথাকলি 'আচমন' নামের একটি ছোট পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। তিনি নিজে ঠিক কী ধরনের পত্রিকা পড়তে পছন্দ করেন, সে প্রশ্নের উত্তরে এমএ পাঠরতা কথাকলি জানালেন, যে ধরনের পত্রিকা কোনও একটি নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক রিসার্চের কাজ করে, সেগুলি তাঁর নিজের কাজে লাগে। ঠিক এই জায়গাটাতেই আপত্তি করছেন বিকাশ গণ চৌধুরী-সন্দীপ দত্তরা। বিকাশের বক্তব্য, "লিটল ম্যাগাজিন এরকম কোনও বিষয় স্থির করে নিয়ে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করতে পারে। বা মাঝে মাঝে এরকম হতে পারে যে কোনও একটা লেখা নিয়ে একটা সংখ্যা। 'এক্ষণ' পত্রিকা করেছিল, অমিয়ভূষণের উপন্যাস দিয়ে একটা সংখ্যা, আমরাও করেছি কৃষ্ণগোপাল মল্লিকের একটা লেখা নিয়ে 'বিষয়মুখের' একটা সংখ্যা। কিন্তু তেমনটা তো ক্কচিৎ।"

সন্দীপ দত্ত একে "ছাত্রবন্ধু" প্রবণতা বলে উল্লেখ করলেন। তিনি বলেন, "এগুলো লিটল ম্যাগাজিন হয়ে ওঠে না। এগুলোর পিছনে একটা দুষ্টু ব্যবসায়ী বুদ্ধি কাজ করছে। বিষয়ভিত্তিক কাজ হতেই পারে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের বাজে নোট না ছেপে সিরিয়াস কাজকর্মও কিন্তু হচ্ছে। আবার পাশাপাশি আর একটা জিনিসও দেখা যাচ্ছে, ইউজিসি-র অনুদান নিয়ে কাগজ করা, যারা সিলেবাস ওরিয়েন্টেড কাজ করছে। এগুলো মোটেই লিটল ম্যাগাজিনের কাজ নয়।"

লিটল ম্যাগাজিনের আরেকটি বিষয় নিয়ে নেহাৎই ক্ষুব্ধ বিকাশ গণ চৌধুরী। সেটা হল গোষ্ঠীকেন্দ্রিকতা। "নিজেরাই গোষ্ঠী তৈরি করে নিয়ে শুধু নিজেদের বন্ধুবান্ধব-পরিচিতদের লেখা প্রকাশ করছে কোনও কোনও পত্রিকা। এরকম কিন্তু নয় যে তারা কোনও আন্দোলন করছে, যেমনটা হয়েছিল শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলনের সময়ে। সেখানে একটা নির্দিষ্ট ম্যানিফেস্টো ছিল। কিন্তু তাঁরাও অন্য কেউ ওই ভাবাদর্শের লেখা লিখলে সেগুলো ছাপতেন। এখানে কিন্তু তেমনটা ঘটছে না।"

তবে এসব সত্ত্বেও হাল ছাড়তে নারাজ কণিষ্ক। তিনি লিটল ম্যাগাজিনকে এখনও আন্দোলন বলেই মনে করেন। "সারা পৃথিবীতে যেভাবে কনটেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং চলছে, একটি নির্দিষ্ট ধরনকেই সর্বজনমান্য বলে গছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, সেখানে বিকল্প হিসেবে লিটল ম্যাগাজিনের এখনও একটা জায়গা আছে।"

Bengali Literature
Advertisment