(বাংলা লিটল ম্যাগাজিনের পাতায় প্রকাশিত হয় অনেক সম্পদ, যা তত চোখে পড়ে না। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা সে সম্পদ আহরণের কাজ শুরু করেছে,বাছাই মণিমাণিক্য পৌঁছে দিচ্ছে আরও বেশি মানুষের দরবারে। এ লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ থেকে প্রকাশিত এবং অন্যকথা পত্রিকার বিশেষ দেশভাগ সংখ্যায়)
মুসলিম উদ্বাস্তু ও তাঁদের অভিপ্রয়াণ-বৃত্তান্ত: এক অন্য দেশভাগের গল্প
অনিন্দিতা ঘোষাল
১৯৪৭ সালে তথাকথিত স্বাধীনতা-লাভ বা ভারত-ভাগ হলেও, দেশভাগের পরবর্তী কয়েক দশকে দেশভাগের অভিঘাত এতোটাই বেশী প্রকট ছিল যে ঐতিহাসিক ও সমাজ বিজ্ঞানীরা এই বিষয়ে লেখালেখি প্রায় করেননি বললেই চলে। দেশ-ত্যাগী উদ্বাস্তুদের মতো নীরবতা অবলম্বনই তাঁরা বোধহয় শ্রেয় বলে মনে করেছিলেন। আসলে দেশভাগ পরবর্তী প্রজন্ম এক অদ্ভুত প্রজন্ম ছিল। উদ্বাস্তু হয়ে আসা অধিকাংশ মানুষ নতুন একধরনের জীবন-যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন যে, নতুন দুটি দেশের সরকারই খুব বেশী দিন তাঁদের নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাবেন না। ক্যাম্পে মাথা গোঁজার ও নিয়মিত সামান্য আহার্য পাওয়ার যে সুযোগটুকু তখনও পাওয়া যাচ্ছিল, তাও বেশিদিন চলবে না। ভারত ও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার যদিও প্রথম থেকে দাবী করেছিল, দু’দেশের দুটো সীমানার ক্ষেত্রে তারা একই রকম নীতির প্রয়োগ করবে এবং দু’দেশের উদ্বাস্তুরাই নির্দিষ্ট সুরক্ষা পাবে। কিন্তু, বাস্তবে তা হয়নি। উল্টে ভারত ও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার প্রথম থেকেই পশ্চিম সীমান্ত, বিশেষ করে পাঞ্জাবী উদ্বাস্তুদের নিয়ে আলাদা নীতি নির্মাণ করতে শুরু করেছিল। যদিও তার একটা কারন ছিল, পশ্চিম সীমান্ত পেরিয়ে আসা মানুষদের সরাসরি রক্তাক্ত দাঙ্গা-হাঙ্গামার অভিজ্ঞতা। ১৯৪৬ সালের পূর্ব-পরিকল্পিত দাঙ্গার ভয়াবহতার কথা বাদ দিলে, স্বাধীনতার পর পূর্ব-সীমান্তে ১৯৫০ সালের দাঙ্গার আগে দেশভাগের ফলে সরাসরি বিপর্যস্ত হওয়ার ঘটনা ছিল সত্যি বেশ কম। বরং ছিল অজানা এক আতঙ্ক, যাকে হৈমন্তী রায় বলেছেন, ‘routined violence’, আর অনেক ঐতিহাসিকই যাকে ব্যাখ্যা করেছেন ‘soft violence’ নামে। তাই, স্বভাবতই পূর্ব-পশ্চিম বাংলা থেকে আসা মানুষজনদের ক্ষেত্রে সরকার আলাদা নীতি গ্রহণ করতে শুরু করে। এর মুল কারণ যদিও ছিলেন নেহেরু স্বয়ং। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে, পূর্ব-পশ্চিম বাংলা থেকে ছিন্নমূল হয়ে উঠে আসা এই মানুষগুলো চিরস্থায়ী ভাবে এই দুটো দেশের কোনটাতেই থাকবে না। তাই বলা যায়, পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের শ্রেণি হিসেবেই আলাদা করে দেখার এক অদ্ভুত প্রবণতা শুরু হয়েছিল ১৯৪০ এর দশকের শেষের দিক থেকেই। সরকারি এই মনোভাব ও তার কারণে তৈরি হওয়া নীতির প্রভাব দু’বাংলাতেই পরেছিল ভয়াবহভাবে, যার জের এখনও চলছে।
কিন্তু আশ্চর্যয়ের বিষয় হল, পূর্ব পাকিস্তান বা বর্তমানের বাংলাদেশে দেশভাগ বা দেশভাগের প্রভাব নিয়ে এই স্বাধীনতা পরবর্তী ৭০ বছরে তেমন কাজ হয়নি বললেই চলে। তার একটা কারণ হয়তো ছিল, পূর্ব-পাকিস্তান আইনতঃ ‘পাকিস্তান’ নামক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এক নতুন জাতীয়রাষ্ট্র বা ‘স্বপ্নভূমি’র ১৯৪৭ সালে অংশ হয়ে উঠলেও, কখনই এক স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির অধিকার বা স্বাদ পায়নি। পাকিস্তান আমলে বরং তার নতুন অস্তিত্বের জানান প্রতিফলিত হয় ধর্মীয় এক জনপ্রিয় শ্লোগানে, যাকে বর্তমান বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞানী সাঈদ ফেরদৌস উল্লেখ করেছেন ‘land of eternal Eid’ হিসেবে। তাই, প্রথম থেকেই পূর্ব-পাকিস্তান নির্দিষ্ট ভৌগলিক অঞ্চল যা ধর্মের ভিত্তিতে গঠিত, পাকিস্তানের এক অঙ্গ বা অধীনের একটা রাষ্ট্রে পরিণত হয়, যদিও শুরুতে পূর্ববঙ্গের রাজনীতিবিদ বা বুদ্ধিজীবীরা সেটা পুরোপুরি বুঝতে পারেননি। কেন্দ্রীয় সরকার ও তার সবকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দায়িত্বের জায়গাগুলো পুরোপুরি পশ্চিম পাকিস্তানীদের করায়ত্ত ছিল। পাঞ্জাবিদের আধিপত্যই মূলত ছিল সর্বস্তরে। সেনাবাহিনীতে তো বটেই, অর্থনীতি ও সমাজিক স্তরের অন্যান্য সব গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতেও পাঞ্জাবি ও সিন্ধিদের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনের লড়াইয়ে প্রথম থেকেই বাঙালি মুসলমানের ‘ঠাঁই নেই’ দশা ছিল। এমনকি প্রাদেশিক স্তরেও বাঙালি শিক্ষিত, যোগ্য ও কৃতী মুসলমানরা যথেষ্ট সম্মানজনক পদে আসীন হতে পারেননি। এর একটা কারণ ছিল, প্রথম থেকেই পূর্ববঙ্গকে পশ্চিম পাকিস্তানের ‘colony’ বা উপনিবেশ হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা। আর, ভাষাগত বৈষম্য, সাংস্কৃতিক বৈপরীত্য ছাড়াও অর্থনৈতিক শোষণ এর সবচেয়ে বড় দিক ছিল। এই সবগুলো কারণ পরে একসাথে মিলে-মিশে ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদ’ এর মুল ভিত্তি ভেঙে দিয়ে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ এর ভিত্তি-প্রস্তর স্থাপন করে। পূর্ববঙ্গ, যা ১৯৫৬ সালের সংবিধান অনুযেয়ী পূর্ব-পাকিস্তান নামে সরকারী কাগজপত্রে অভিহিত হয়, তাতে পাকিস্তান বিরোধিতার বীজ বপন হতে শুরু করেছিল তথাকথিত স্বাধীনতার ঠিক পরবর্তী দশক থেকেই। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, ১৯৭১ পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বিক ইতিহাস লেখা এবং তার কারণ-ফলাফল ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন স্তরে তো বটেই, ইতিহাসেও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ মুখ্য ভূমিকা নিয়েছে। সেই তুলনায় ১৯৪৭ এর দেশভাগের অভিঘাত নিয়ে গবেষণা হয়নি বললেই চলে। তার পেছনে একটা কারণকে যুক্তি হিসেবে খাড়া করা যায়। খুব সম্ভবত ১৯৭১ পরবর্তী বাংলাদেশ, বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী এবং সামগ্রিক ভাবে বাঙালি মুসলমান সমাজ পাকিস্তান অধিকৃত সময়কালকে বিস্মৃতির আড়ালে রাখতে চায়। আর, এই সময়কালকে মনে করাকে খানিকটা তাদের নিজস্ব আবেগের ফসল যে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ এর অবমাননা হবে বলে মনে করে। কারণ, তথাকথিত ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদ’ এর বিরোধিতা করেই পাকিস্তান নামক এক রাষ্ট্রযন্ত্রের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে তারা, মুক্তিযুদ্ধে জয়ের মাধ্যমে পেয়েছে এক নতুন রাষ্ট্র, ‘বাংলা’ নামের দেশ গড়ার মাধ্যমে বিশ্বকে দিতে পেরেছে তাদের নিজস্ব অস্তিত্বের জানান।
স্বাধীনতা-পরবর্তী পূর্ববঙ্গ
দেশভাগ নিয়ে ভারত, পাকিস্তান ও গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে যত গবেষণাধর্মী কাজ হয়েছে, তার মধ্যে পূর্ববঙ্গ / পূর্ব-পাকিস্তান বা বাংলাদেশে ১৯৪৭ এর বিভাজনের প্রভাব বা তার প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা / সমালোচনা ইত্যাদি, সবসময়ই কোন একটা আনুষঙ্গিক বিষয়কে নিয়ে আলোচনার প্রেক্ষিতে উঠে এসেছে। কিন্তু, সীমান্তরেখার অন্তর্বর্তী / পার্শ্ববর্তী বাকি সব অঞ্চলের মত এই অঞ্চলেও কিন্তু দেশভাগ বা উদ্বাস্তু অভিপ্রয়ানের খতিয়ান ছিল চোখে পড়ার মত। কিন্তু ঠিক স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে নতুন রাষ্ট্র গড়ে তোলার আনন্দে বাঙালি মুসলমানরাও ছিল উদ্বেলিত। যেমন শুধু প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে ঢাকা শহরই নয়, অন্যান্য মফস্বল শহর যেমন বড়িশাল, সিলেট, ময়মনসিং এবং রাজশাহী ইত্যাদি শহরেও মধ্য আগস্টে স্বাধীনতা উদযাপনের অনুষ্ঠান ছিল রীতিমত চোখে পড়ার মত। তাজউদ্দিন আহমেদ ১৯৪৭ সালের ১৪ অগাস্টে সেই সময়ে তাঁর ডায়েরিতেও বিশদভাবে লিখেছেন, হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের ও মিলিত উদযাপনের এক অভূতপূর্ব চিত্রের কথা। প্রায় গোটা ঢাকা শহরই সেজে উঠেছিল স্বাধীনতার অনুষ্ঠানের আনন্দে। মুল অনুষ্ঠানটি হয়েছিল ঢাকার রমনা পার্কে, যেখানে ঢাকার নবাব ছাড়াও বিশেষ অতিথি এবং বক্তা ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দিন। মোহাম্মদ আলি জিন্নার নির্দেশে প্রথম এই দিনে পাকিস্তানকে এক ধর্ম-নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরা হয়, সংখ্যাগুরু / সংখ্যালঘু ও প্রান্তজীবী সব শ্রেণির মানুষ যেখানে সমান অধিকার পাবেন। পাকিস্তানের এই মনোভাবের কারণ ছিল, বহির্বিশ্বের কাছে নিজস্ব এক উদার ও অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি তুলে ধরা। সমস্ত বিশ্বকে বোঝানো যে, সব শ্রেণি, জাতি ও ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে তাঁরা একই নীতি গ্রহণ করছেন এবং সমস্ত নাগরিকরা যেন এই নতুন রাষ্ট্রকে ‘নিজের দেশ’ হিসেবে ভাবে। শুধু তাই নয়, তাঁরা এও ঘোষণা করলেন যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের সমর্থন নেই, সংখ্যালঘু ও বিভিন্ন প্রান্তজীবি শ্রেণিগুলোর অভিপ্রয়াণেও। এমনকি কেন্দ্রীয় আইনসভায় সেই মর্মে বিলও পাশ হয়, স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম অধিবেশনে। কিন্তু, আপাতচোখে শাসকশ্রেণির এই বদান্যতার ও উদারতার ছবি বেশিদিন টিকে থাকেনি। পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের মাত্র 2 বছর পর থেকেই (মূলত ১৯৪৯ সাল থেকে বাংলা ভাষা নিয়ে বিতর্ক ও টানাপোড়েনের জেরে) বাঙালি অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গে বিরোধিতার বীজ বপন হতে থাকে। ১৯৫২ র ভাষা আন্দোলন প্রথম এমন এক ঘটনা ছিল, যা আভ্যন্তরীণ শাসন-শোষণের আসল চিত্রটা বিশ্বের দরবারে তুলে ধরে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, পূর্ববঙ্গের বাঙালি ভাষা-ভাষী মানুষদের কাছে তাদের মুখের ‘ভাষা’ শুধুমাত্র আবেগের প্রকাশ ছিল না। বরং তা ছিল তাদের নিজস্ব অস্তিত্বের বার্তাও। যে কারণে প্রথম থেকেই তারা এমনকি নিজের দেশের শাসক-গোষ্ঠীর বিরোধিতা করতে, রুখে দাঁড়াতে ভয় পায়নি।
কিন্তু, বাংলা ভাষা নিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের আকার ও প্রকার বাস্তবে ঠিক কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে, সে সম্পর্কে পশ্চিমী ধর্মান্ধ, জাতি গৌরবে মগ্ন, নতুন এক বুর্জোয়া তথা প্রশাসনিক শ্রেণির কোন ধারণাই ছিল না। তাঁরা এমনকি পশ্চিমারা বাঙালি মুসলমানদের উর্দু ভাষাকে ‘রাষ্ট্রভাষা’ করার বিরোধী আন্দোলনের মধ্যে তখনও অভিপ্রয়ান না করা কিছু হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের হাত দেখেছিলেন। তখনকার ইংরেজি সংবাদপত্র Morning News যেমন সরাসরি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হিন্দুদের দিকে আঙ্গুল তুলে ও সন্দেহ প্রকাশ করে বলে যে, ‘Dhotis roaming in the streets’. আসলে বাঙালি যুবা / ছাত্রদের নেতৃত্ব ও ব্যাপক অংশগ্রহণে উর্দু-বিরোধী আন্দোলন যে পরবর্তী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে কতটা গতি প্রদান করতে পারে বা সেই আন্দোলন ঠিক কতটা ব্যাপকতা বা গতিলাভ করতে পারে, সে সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকজাতির স্পষ্ট কোন ধারনা ছিল না। সেখানে আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও শুরু হয়েছিল এক অসম ক্ষমতা-দখলের তীব্র লড়াই, যেমন প্রশাসনে অবিভক্ত উত্তরভারত প্রদেশের বিভিন্ন জাতি-শ্রেণির মিশ্র অংশগ্রহণ থাকলেও, সেনাবাহিনী প্রথম থেকেই ছিল পাঞ্জাবিদের দখলে। আবার আদমজীদের মত বাবসায়ী পরিবার গুলো স্বাধীনতা ও দেশভাগের অনেক আগে থেকেই মুসলিম লীগ ফান্ড বা জিন্না ফান্ডে টাকা দিয়েছিল, পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হওয়ার পর বাবসায়িক ভাবে বিশেষ সুযোগ-সুবিধে পাওয়ার জন্য। তাই বলা যায়, বিরোধের পাল্লা যে শুধু পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যেই ছিল, তা নয়। পশ্চিম পাকিস্তানের ভেতরকার অবস্থানগত বিরোধ, নীতি-নির্ধারণ, ক্ষমতার ভারসাম্যের জন্য নতুন শক্তি-পরীক্ষা, সবই আবার একই সঙ্গে একইরকমের জটিল ছিল। জিন্নাহ-এর মৃত্যু অব্দি আপাত বিরোধিতার চিত্র খুব একটা বাইরে বেরোতে পারেনি। কিন্তু, জিন্নাহ এর মৃত্যুর পর একসঙ্গে ইসলামীয়-করণ ও অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধে পাওয়ার জন্য পূর্ববঙ্গকে ব্যবহারের যে উদ্দেশ্য প্রথম থেকেই লীগ নেতাদের ছিল, সেই ছবিটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পাকিস্তানদের আইনসভায় পূর্ব-বঙ্গের মনোনীত প্রতিনিধি, যেমন ভুপেন্দ্র কুমার দত্ত, শ্রীশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত বার বার বিরোধিতা করেছেন, যে কোন রকম সামন্ততান্ত্রিক প্রথা প্রবর্তনের বিরুদ্ধে এবং আধুনিকতা আনয়নের সপক্ষে। কিন্তু, পাকিস্তান তৈরি হয়ে যাবার পর তাঁদের মতকে আর গুরুত্ব দেয়া হয়নি।
উদ্বাস্তু আগমনের আখ্যান
এই আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, পাকিস্তানের দুটি শাখার মধ্যে কলহ ও বৈপরীত্য, এবং সার্বিক শঙ্কার ছবির মধ্যে উপস্থিত হতে শুরু করল বিরাট সংখ্যক বাঙালি ও অবাঙালি মুসলমান উদ্বাস্তুরা। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, বাঙালি ছিন্নমূল মুসলমান উদ্বাস্তু সম্প্রদায় সেই সময়ে মূলত তিন রকম মনস্তাত্ত্বিক অবস্থান থেকে উঠে এসেছিল। প্রথম দলের অবস্থা ছিল অপেক্ষাকৃত ভাবে ভাল। অধিকাংশই ছিলেন তুলনামূলক ভাবে বেশ উচ্চপদে আসীন সরকারি চাকুরে, যারা ‘অপশন’ প্রথার মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্ববঙ্গে চলে আসেন। এঁরা ছিলের অপেক্ষাকৃত ভাবে বেশ ভাগ্যবানও। কারণ ভারত-পাকিস্তান সবরকম ভাগাভাগি সংক্রান্ত অব্যবস্থার মধ্যে এঁরা যথাসম্ভব সরকারি সাহায্য ও সহায়তা পেয়েছিল। তাই, স্বাচ্ছন্দ্যের আপাত খামতি থাকলেও খাদ্য, বাসস্থান বা নিয়মিত মাইনে, এই কোনটারই বিশেষ অভাব এই শ্রেণি বোধ করেননি। বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণিটি ছিল শহুরে শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত এক নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মানুষ। এই মানুষগুলোও প্রায় প্রথম থেকেই অন্তত পেশাগত ভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। হয়ত তাঁরা সরকারকে একরকম বাধ্য করেছিলেন এঁদের যথার্থ পুনর্বাসন প্রদানে। তাঁরা নিজেরা যে শুধুমাত্র অভিপ্রয়ানে সিদ্ধান্তে সর্বার্থেই লাভবান হয়েছিলেন, তা নয়। ব্যাপক পরিমাণ হিন্দু শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি এপারে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসায় যে সাঙ্ঘাতিক শূন্যস্থান তৈরি হয়েছিল তৎকালীন পূর্ববঙ্গে, সেই সমাজের মধ্যে নতুন সামাজিক স্থিতিশীলতা আনয়ন ও সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণেও সাহায্য করেছিল এই শ্রেণি। মহিলা অভিপ্রয়াণকারীরা শুধু নিজেরা উদ্বাস্তু সত্তা নিয়ে যাননি। তাঁরা নিয়ে গেছিলেন তাঁদের শিক্ষা, সংস্কৃতি। এমনকি নতুন ধরনের রান্নার প্রণালী শিক্ষাপ্রদান, উদারনীতিক নীতি প্রবর্তনে উৎসাহ দেয়া এবং বিশেষত পোশাক পরিচ্ছদে আধুনিকতা আনয়ন ইত্যাদি বিষয়েও সাহায্য করেছিল এই উদ্বাস্তু শ্রেণি। কিন্তু, আসল ‘উদ্বাস্তু’ বা যথার্থ অর্থে ‘বাস্তুহারা’ ছিল তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি। তৃতীয় শ্রেণির উদ্বাস্তুরা ছিলেন অধিকাংশই কৃষক বা শ্রমিক শ্রেণির, অথবা নির্দিষ্ট কোন নিম্নশ্রেণির / নিম্নমানের পেশার সঙ্গে যুক্ত। এঁদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত সমস্যাসঙ্কুল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এঁরা আশ্রয় নিয়েছিলেন মফস্বল বা নতুন সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে। রাষ্ট্র / সমাজ তাঁদের শুধুমাত্র বোঝা হিসেবে দেখেছিল। এছাড়াও, ভাষাগত অমিলের জন্য এরা পাকিস্তান আমলে কখনই সেরকম পেশাগত সুরক্ষা বা পুনর্বাসন পাননি।
চতুর্থ বা শেষ শ্রেণিটি ছিল অবাঙালি মুসলমান উদ্বাস্তুদের নিয়ে তৈরি, যাঁদের বর্তমানের বাংলাদেশে এখনো ‘বিহারী’ বলে অভিহিত করা হয়। এঁরা ছিলেন ১৯৪৬-৪৭ এর পরিকল্পিত দাঙ্গার ফলে বিহার থেকে অভিপ্রয়ান করে, কলকাতা হয়ে, পূর্ববঙ্গে চলে আসা আরেক অসহায় উদ্বাস্তু শ্রেণি। এঁদের দলের সঙ্গে যোগ হয়েছিল কলকাতা দাঙ্গার সময় টার্গেট হওয়া বিপুল সংখ্যক বহুদিনের কলকাতার বাসিন্দা বিহারীরাও। অবাঙালি বিহারী মুসলমান এই উদ্বাস্তুরা প্রায় সবাই কিন্তু চেয়েছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে পাকাপাকি ভাবে বাসস্থান গড়তে। কিন্তু, দাঙ্গা বিধ্বস্ত, আতঙ্কিত ও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভীষণ গরিব এই মানুষগুলো ওই কঠিন সময়ে সিদ্ধান্ত নিতেও দেরি করে ফেলেছিল। আর, যতক্ষণে পুরোপুরি পাততাড়ি গুটিয়ে পাকিস্তান যাওয়ার জন্য মনস্থির করে, ততক্ষণে ভারত / পাকিস্তান দু’দেশের মধ্যে পশ্চিম বর্ডার পেরিয়ে অভিপ্রয়াণের সুযোগ প্রায় শেষের পথে। কারন, নতুন দুটো দেশের কেন্দ্রীয় সরকারই পাঞ্জাবে রক্তাক্ত দাঙ্গার ঘটনায় শঙ্কিত হয়ে সরকারি ভাবে ‘জন-বিনিময়ের’ সিদ্ধান্ত নেন। যে কারণে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়কালে ঐতিহাসিক ও সমাজ বিজ্ঞানীরা যতই নেহেরু সরকারকে দোষ দিন না কেন, আসলে পাঞ্জাবের দেশভাগের ঘটনাক্রম ও গতিধারা ছিল আসলেই আবিভক্ত বাংলা থেকে একদমই আলাদা। কিন্তু, বিহারীদের পশ্চিম সীমান্ত অতিক্রম করে পাকিস্তানে পুনর্বাসন দেয়ার কথা কোন দেশের সরকারই বলেননি। যারা নিজের থেকে যাওয়ার কথা বলেছিলেন, তাঁদেরকেও সরকার যথাযথ সুযোগ করে দেননি। তাই, এই বিহারী উদ্বাস্তুরা ‘কাছের পাকিস্তান’ বা পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার জন্যই মনস্থির করতে বাধ্য হন। আর, সরকারি কাগজ-পত্রে যতই সব উদ্বাস্তুদের একই চোখে দেখা হবে, একই রকম সুযোগ-সুবিধা দেয়া হবে বলে দাবি করা হোক না কেন, আসলে ভাষাগত মিল বা অমিলকে প্রথম থেকেই প্রশাসনের কর্তারা ভিন্ন চোখে দেখতে শুরু করেছিলেন। যে কারণে, বাঙালি অফিসাররা ছিলেন বাঙালি উদ্বাস্তুদের প্রতি সহানুভূতিশীল। আবার পাকিস্তানের হিন্দিভাষী কেন্দ্রীয় সরকার, তাঁদের অফিসার ও কর্মচারীরা প্রথম থেকেই ছিলেন এই বিহারীদের প্রতি অনুভূতিপ্রবণ।
উদ্বাস্তুদের প্রতি নীতি ও মনোভাব
কিন্তু, ঘটনার পর্যায়ক্রমে পাকিস্তানের হিন্দিভাষী কেন্দ্রীয় সরকারের বিহারীদের প্রতি এই আপাত পক্ষপাতিত্বের নীতি আসলে প্রথম থেকেই পূর্ববঙ্গে তাঁদের অস্তিত্বকে এক সঙ্কটের মুখে ঠেলে দেয়। ঠিক অভিপ্রয়ানের পরে তাঁদের অবস্থা ছিল বাঙালি উদ্বাস্তুদের থেকে তুলনামূলক ভাবে অনেক ভাল। কারন অধিকাংশ বিহারী উদ্বাস্তু পরিবারই রেলওয়ে, পশ্চিম পাকিস্তানিদের অধিকৃত শিল্পকারখানা বা প্রশাসনের অপেক্ষাকৃত নিচু পদগুলোতে চাকরি পেতে শুরু করেছিল। শুধু তাই নয়, ঢাকার মিরপুর, মোহাম্মদপুর, গেন্দেরিয়া (খুব সম্ভবত Grand area শব্দ থেকে উদ্ভূত) ও বাণিজ্যনগরী চট্টগ্রামে তাদের জন্য বিশেষ করে সবচেয়ে প্রথম উদ্বাস্তু কলোনি তৈরি করা হয়। এমনকি পাকিস্তান সরকার ১৯৫০ সালের নেহরু-লিয়াকত চুক্তি বা দিল্লি চুক্তির মূল শর্তাদি না মেনে যখন হিন্দুদের ফেলে যাওয়া বাড়িগুলোকে অধিগ্রহণ করতে শুরু করে, তখনও বাড়ি বিলির মাধ্যমে সম্পত্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পেয়েছিল এই বিহারীরা। আসলে ভাষাগত মিলের দ্বারা প্রভাবিত হওয়া বা বিহারীদের প্রতি ক্রমাগত পক্ষপাতিত্বের উদাহরণ যে শুধুমাত্র সেই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদের ব্যাবহার ও নীতি-প্রণয়নের মাধ্যমেই সেই সময়ে প্রকট হয়েছিল তা নয়। ঢাকার পূর্বতন শাসক ‘ঢাকার নবাব’ এবং তাঁদের নিজস্ব বণিক গোষ্ঠী, যাঁদের ‘কুট্টি’ বলে অভিহিত করা হত, তাঁরাও ছিলেন এই অবাঙালি উর্দু ও হিন্দিভাষী বিহারীদের প্রতি অনেক বেশী সহানুভূতিশীল। তার তুলনায় বাঙালি মুসলমান উদ্বাস্তুরা তেমন বিশেষ কোন সুযোগ-সুবিধা পাননি বললেই চলে। ঠিক পশ্চিম বাংলার মত তাঁরা স্টেশন ওয়াগনের ভেতরে বসবাসে অভ্যস্ত হয়ে গেছিলেন। এছাড়া সরকারের তখনও অব্দি দখল না নেয়া বাড়িগুলোতে তাঁরা আস্তানা গড়তেন। ওয়ালীউল্লাহ যেমন তাঁর ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’ নামের ছোটগল্পে ঠিক এরকম সবে অভিপ্রয়াণ করা এক বাঙালি উদ্বাস্তু পরিবারের কাহিনি লিখেছেন। আসলে বাঙালি উদ্বাস্তুদের জন্য যখন সরকারি ক্যাম্পও তৈরি করা হয়, তা হয় ঢাকার শহরের বাইরে। এর যুক্তি হিসেবে দেখানো হয় যে, ঢাকা শহর ক্রমে অতিরিক্ত এই বিশাল জনসংখ্যার চাপ আর নিতে পারছে না। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, বাংলাদেশের আর্কাইভের কাগজপত্র অনুযায়ী, ঢাকা শহরে সেই সময়েই সবচেয়ে বেশি পরিমাণ বহুতল বাড়ি তৈরি হতে শুরু হয়, মূলত প্রশাসনিক কাজের কারণে ব্যবহারের জন্য। নাগরিক সুযোগ সুবিধে প্রদানের চেষ্টা তেমন ছিল না। যে কারণে কলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়া মানুষদের সবচেয়ে বেশি অসুবিধে হয়েছিল। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যেমন তাঁর জীবনীমূলক লেখা ‘দুই যাত্রার এক যাত্রী’ তে উল্লেখ করেছেন, তাঁর পরিবার অপশন দিয়ে চলে আসার পরও বহুদিন রেশন কার্ড পাননি।
আনিসুজ্জামান আবার উল্লেখ করেছেন তখনকার নগর ঢাকার কথা, নাগরিক সংস্কৃতির কথা। ঢাকা প্রাদেশিক রাজধানী হওয়া সত্ত্বেও জল ও পরিবহনের ক্ষেত্রে মোটেই সুবিধেজনক অবস্থায় ছিল না। দু’দেশের প্রশাসন মূলত অতি ব্যস্ত ছিল, দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পদ বণ্টনে। ‘Optee’ দের অবস্থা তবু ছিল তুলনামূলক ভাবে ভালো, কিন্তু সাধারণ উদ্বাস্তু পরিবারগুলো ক্যাম্পে বসবাসকালেও নজর রাখত ওই নির্দিষ্ট পাড়ার হিন্দু বাড়িগুলোর ওপর। কারণ তখনকার বিভিন্ন আত্মজীবনী মূলক লেখাগুলো পড়লে দেখা যায় যে, সেই সময়ে বেশিরভাগ হিন্দু পরিবার অধিকাংশ সময়ে রাতের অন্ধকারে তাদের ‘ভিটে’ ত্যাগ করত। তাতে ‘আনসার’ বাহিনীর লুটপাটের হাত থেকে তারা যে সবসময় রক্ষা পেত, তা নয়। কিন্তু, তা সত্ত্বেও তাঁরা এক অদ্ভুত বিশ্বাস নিয়ে দেশত্যাগ করতেন যে, কখনও হয়তো পারস্পরিক এই সব গণ্ডগোল ও অবিশ্বাসের বাতাবরণ সব মিটে যাবে এবং তাঁরা তাঁদের মাতৃভূমিতে ফিরে আসতে পারবেন। কিন্তু, দেশভাগ যেভাবে সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘু, নিজের দেশ, জমির মালিক ও ভাগীদার ইত্যাদি ধারণার জন্ম দিয়েছিল, তার ফলে পূর্ববঙ্গ ক্রমেই এক ব্যাপক উদ্বাস্তু নিষ্ক্রমণ এবং তার সঙ্গে উদ্বাস্তু আগমনের সংঘাতের স্থানে পরিণত হয়। নতুন সীমারেখা তৈরির পর সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোর অবস্থা হয়ে গেছিল আরও খারাপ। কারণ, পূর্ববঙ্গের ‘ভূমিপুত্র’ মুসলমানরা কখনোই এই অভিপ্রয়াণ করে আসা উদ্ভাস্তুদের ‘নিজের লোক’ ভাবতে পারেনি, শুধুমাত্র ধর্মীয় আবেগের একাত্মতার কারণে। বরং তারা এই ‘অদ্ভুত’ খাদ্যাভ্যাসের ‘বিজাতীয়’ উদ্বাস্তু গোষ্ঠীকে হিংসে করত এই ভেবে যে, এরা সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধে পাচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকার আবার স্থানীয় ধর্মান্ধ মৌলভিদের কাজে লাগিয়েছিল, ধর্মের নামে ভয় দেখিয়ে এদের ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ নামক এক ভূতের হাত থেকে দূরে রাখতে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার যেমন প্রথম থেকেই দু’প্রান্তের বাসিন্দা ছিল, ঠিক সেরকম ভাবেই চলেছিল বাঙালি - অবাঙালি, হিন্দু - মুসলমান, দেশজ - বিদেশি মানুষগুলোকে আলাদা করার কাজ। ১৯৫০ এর দশকে এই নতুন দ্বিধা-বিভক্ততার ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা অতটা জনপ্রিয়তা না পেলে বা সফল না হলেও, ১৯৬০ এর দশক থেকে তা চূড়ান্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৬৪ এর দাঙ্গার পর থেকে যে কারণে হিন্দু নিম্ন শ্রেণি এবং জাতিদের প্রতি ক্রমশ সরকারের সংযমের মনোভাব কমে যায়। যার স্পষ্ট বিবরণ পাওয়া যায়, নূরজাহান বোসের আত্মজীবনীমূলক লেখা ‘আগুনমুখার মেয়ে’ নামের উপন্যাসটা পড়লে। তিনি সংখ্যালঘু ও সংখ্যালঘু, ক্যাম্প ও কলোনিবাসি মেয়েদের দুরবস্থার কথা যেমন লিখেছেন, তেমনি পাকিস্তানের দুটো ‘wing’এ বিভিন্ন সময়ে আবার বসবাসের কারণে, সাধারণ মানুষের মনস্তত্ত্ব ও মনুষ্যত্ববোধ কীভাবে পালটে যাচ্ছিল ক্রমশ, তাও উল্লেখ করেছেন।
অস্তিত্বের জানান, নাকি নতুন অস্তিত্বের নির্মাণ?
আসলে শুধু বর্তমান সময়ে নয়। গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কখনই কোন দেশে উদ্বাস্তুদের জাতি-নির্মাণ বা নতুন ভাবে সামাজিক বিন্যাস তৈরির এজেন্ট হিসেবে দেখা হয়নি। পাকিস্তানে ফিরে যাওয়া মুসলমান বাঙালি ও অবাঙালি উদ্বাস্তুরাও ঠিক এই একই নেতিবাচক ব্যাবহার পেয়েছিল। প্রথমে মুসলমানদের জন্য পৃথক নিজস্ব জাতীয় রাষ্ট্র তৈরির প্রয়োজনের কথা বলে এদের সমর্থন আদায় করা হয়। তারপর প্রচার শুরু হয়, সত্যি এদের নিজেদের রাষ্ট্র তৈরি হলে কি কি অসম্ভব ভাল সুযোগ সুবিধে এরা পেতে পারে, সেই মর্মে স্বপ্নও দেখানো। কিন্তু, বাস্তবে সেই স্বপ্নপূরণের গল্প কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই স্বার্থক হয়েছিল। এদের কখনই আসল পাকিস্তানের বাসিন্দা বা ‘নিজের লোক’ হিসেবে দেখা হয়নি, বরং ‘ঘটি’ বলে ইচ্ছে করে আলাদা করে রাখা হয়েছিল। প্রথম থেকেই আসলে আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে এক দলভুক্তির ধারণা ছিল, পশ্চিম ও পূর্ব-পাকিস্তান, এই আপাত দু’দলের মধ্যে। যাতে অভিপ্রয়াণ করা উদ্বাস্তুরা বিশেষ স্থান পায়নি। তাই, প্রথম থেকেই আবার এক নতুন অস্তিত্ব নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু করতে হয়েছিল তাদেরকে। পশ্চিম পাকিস্তানে যারা আশ্রয় নিয়েছিল, সেই ‘মুহাজির’ দের সঙ্কটের চরিত্র ছিল আলাদা। কিন্তু পূর্ব-পাকিস্তান সেই সময় আরও অন্য অনেক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। উদ্বাস্তুদের নিজস্ব সমস্যা যে কারণে শাসকশ্রেণির কাছে খুব একটা বিশেষ উল্লেখযোগ্যও মনে হয়নি। একমাত্র খবরের কাগজের অল্প কিছু বিক্ষিপ্ত রিপোর্ট ছাড়া উদ্বাস্তুদের নিয়ে প্রায় কোন লেখা-লেখি না থাকায় পরবর্তীতে কেমন ঐতিহাসিকদের একটা ধারনা তৈরি হয় যে, আসলে পাকিস্তানে উদ্বাস্তু সঙ্কট তেমন ভাবে হয়নি। কিন্তু, বাস্তব চিত্রটা একেবারেই সেরকম ছিল না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ১৯৪৯ সালের ১৬ ই ঢাকা-প্রকাশ পত্রিকায় প্রকাশিত একটা রিপোর্টের কথা। যাতে স্পষ্ট লেখা হয়, ‘Dhaka, Pabna and Kusthia were flooded with the first few batches of refugees. They were literally bare-footed, behaving like beggars’। আবার ১৯৫০ সালের দাঙ্গার পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান অবসার্ভার পত্রিকা লিখেছিল যে, ‘Looked at from all angles the situation created by the influx of thousands and hundreds of refugees the erstwhile Indian citizens, is a serious one’।
১৯৫১ সালে আইনসভায় এক বিতর্কে উল্লেখ করা হয় ‘The Provincial Government obtained schemes of short-term rehabilitation of 850,000 refugees from 170,000 families’। উদ্বাস্তু সম্পর্কের ও সমস্যার বাস্তব গভীরতা এই খুব ছোট একটা তথ্য থেকেই বোঝা যায়। ১৯৫৯-৬০ সালে Department of Works, Housing and Settlement, Dacca থেকে প্রকাশিত একমাত্র রিপোর্ট Census of Un-rehabilitated Displaced Persons in Dacca and Narayanganj উল্লেখ করা হয় যে, ১৯৬০ অব্দি যতটুকু উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের কাজ করা হয়েছিল তা মোটেই খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। আসলে, ১৯৪৭ সালের পর থেকে হিন্দুদের ব্যাপক পরিমাণে ভারত রাষ্ট্রে চলে যাওয়া, ১৯৫০ সালের ‘দিল্লী চুক্তি’ র পর তার একাংশের আবার ফিরে এদেশে আসা, এবং আশাহত হয়ে আবার দ্বিতীয়বার অভিপ্রয়ান, তার মাঝখানে এই মুসলমান জনগোষ্ঠীর আগমন এবং তাঁদের আপাত সুরক্ষা এবং পুনর্বাসন প্রদান, তথাকথিত ‘minority’ দের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়ার মত ঘটনা গুলো যে বাংলাদেশের ইতিহাসে সেভাবে লেখা হয়নি, সেটা অবশ্যই দুঃখজনক। কিন্তু নতুন রাষ্ট্র পাওয়ার, সেই রাষ্ট্রে নিজের হবে এই স্বপ্ন দেখে ফিরে যাওয়া মানুষগুলো যে এখনো তাদের নিজেদের কথা নিজেদের মতো করে বলে না বা বলতে পারে না, সেটা আরও কষ্টের। স্বাধীনতার পরে প্রতি দশকে তাদের সমস্যার চরিত্র পাল্টেছে, কিন্তু তাদের সমস্যা কখনো ‘জাতীয় সমস্যা’ হয়ে উঠতে পারেনি। তাই, ১৯৭১ এর যোদ্ধারা পরবর্তিতে যে বীরের সম্মান পেয়েছেন, বাংলাদেশে ১৯৪৭ এর পর অভিপ্রয়াণ করা কিছু জাতীয়তাবাদী মুসলিম জনগোষ্ঠীও কিন্তু কখনো সেরকম সম্মানজনক কোন স্বীকৃতি পাননি। বামপন্থীরা তো অনেক সময় আবার আত্মগোপন করতেও বাধ্য হয়েছেন। তাই, ১৯৭১-এর পর থেকে শুরু হয়েছিল তাঁদের আরেক নির্দিষ্ট অস্তিত্ব নির্মাণের প্রক্রিয়া, যার জের এখনও চলছে।