Advertisment

লিটল ম্যাগাজিনের পাতা থেকে: জারি বোবাযুদ্ধ

জারি বোবাযুদ্ধ পত্রিকার সর্বশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত চলচ্চিত্র সমালোচক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের আঁদ্রে বাজাঁকে নিয়ে লেখার পুনঃপ্রকাশ।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

অলংকরণ- অরিত্র দে

(বাংলা লিটল ম্যাগাজিনের পাতায় প্রকাশিত হয় অনেক সম্পদ, যা তত চোখে পড়ে না। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা সে সম্পদ আহরণের কাজ শুরু করেছে,বাছাই মণিমাণিক্য পৌঁছে দিচ্ছে আরও বেশি মানুষের দরবারে।)

Advertisment

Little Magazine, Little Magazine Cover পত্রিকার প্রথম ও শেষ প্রচ্ছদ

বাস্তবের অলৌকিকতা: আঁদ্রে বাজাঁ

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

হয়তো ছায়াছবি বিনোদন বা তাৎক্ষণিক করতালির পাতাল থেকে উঠে আসা ব্রাত্যসুন্দরী বলেই তাকে শিল্প হিসাবে মেনে নিতে আমাদের সময় লেগেছে। চলমান চিত্রমালার আবির্ভাবের পরে পরেই মনস্বী শিল্পী সমাজ এই মাধ্যম এবং প্রকরণের সৌজন্যে কোনও সৃজনশীলতার সম্ভাবনা প্রায় উপেক্ষা করেছিলেন। সংক্ষেপে নাম করা যায় ম্যাক্সিম গোর্কি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মার্সেল প্রুস্ত ও পল ভলেরির। অথচ সময় তাঁকে ডেকে নিল ভবিষ্যকথনে। সিনেমা, আজকে ওয়াল্টার বেঞ্জামিন প্রমুখ মহাজনের সাহায্য না নিয়েও বলতে পারি শিল্পসভ্যতার গণতান্ত্রিক বাতাবরণের শ্রেষ্ঠ পন্থা। সমগ্র সময়বলয় বিশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই দৃষ্টিশাসিত।

ফরাসি দেশে গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকেই মূলত কবি গিয়োম আপলিনেয়ারের প্ররোচনায় মনে করা শুরু হয় যে চলমান চিত্রমালার কটাক্ষের অপার সম্ভাবনা। অন্যদিকে রুশ বিপ্লবের আগুনে আবিষ্কার করা গেল এই চলমানতা সরস্বতীর মতো জননী হতে পারে। সুতরাং ছবি আর নেহাত ক্রীড়াকৌতুক রইল না। তার স্বপক্ষে মনীষার নানা কারুকাজ প্রকাশিত হতে শুরু করল। এতদিন পর খানিকটা অবাক হয়েই বলতে হয় আমাদের মূল অন্বিষ্ট ছিল চলচ্চিত্রকে অন্তত শিল্পের সামাজিকতায় স্থাপন করায়। ফলে চল্লিশের দশকের সমস্ত তাত্ত্বিক, কী রুশ দেশে, কী মার্কিন দুনিয়ায় কী ইয়োরোপে প্রমাণ করতে চেয়েছেন বাস্তবতার উপচে পড়া ফেনপুঞ্জ সত্ত্বেও চলচ্চিত্র একটি শিল্পমাধ্যম। আর্নহাইম, মুনস্টেমবার্গ, বা লিন্ডসে প্রমুখ তাত্ত্বিক ছবিকে, বলা ভাল ছবির বাস্তব উপাদানকে এক্তি পরোক্ষ অর্থে উন্নিত করতে চেয়েছেন। আর সে জুগের যিনি ভাষাচার্য , সেই অদ্বিতীয় প্রতিভা আইজেনস্টাইন মন্তাজ বিষয়ক রচনা তো চলচ্চিত্রের প্রত্যক্ষ বাস্তবতাকেই নস্যাৎ করে এবং উপমারহিত পাণ্ডিত্যে দেখায় যে বাস্তবতা নয়, বরং বাস্তবতার নির্মান ও বিন্যাস চলচ্চিত্রকে শিল্পে উত্তীর্ণ হতে সাহায্য করে। ঠিক যেমন কাব্যে শব্দের বদলে শব্দের বিন্যাস অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আসলে আইজেনস্টাইন সহ সমস্ত তাত্ত্বিকই ভরসা রেখেছিলেন শিল্পের রহস্যময়তায়, এই আশঙ্কায়, যেন বাস্তব শুধুই জনপদবধু, যেন শুধুই সে প্রগলভা রূপসী।

আর এই মুহূর্তক্ষণেই আঁদ্রে বাজাঁর আশ্চর্য ভূমিকা। চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি থেকে অর্থাৎ যুদ্ধোত্তরকালে তিনি মায়াবী কিন্নরের মতো বিড়ম্বনাকে সম্পদে রূপান্তরিত করলেন। বাস্তব হয়ে উঠল স্বপ্নের শিখর। নব্য ইতালীয় সিনেমার থরে থরে সম্পদ, অরসন ওয়েলেসের প্রবল অভিঘাত ও জঁ রনোয়া কিম্বা রবের ব্রেসঁ-এর ঈশ্বরতুল্য অভিব্যাক্তি প্রকাশ করার সময় বাজাঁ বাস্তবকেই গায়ত্রীমন্ত্র ভাবলেন। নবতরঙ্গের আধ্যাত্মিক পিতা এমন কী তারকোভস্কি বা কিয়ারোস্তামির মেধার উৎস ভেবে তাকে বর্ণনা করা যায়। প্রকৃতপ্রস্তাবে ধরিত্রী যেমন পাহাড় ও স্থলাভূমিতে বিভাজিত, চলচ্চিত্রবিদ্যাও একদিক থেকে আইজেনস্টাইন এবং বাজাঁর মধ্যে বিভাজিত হয়ে রয়েছে।

একজন কৃশকায় ফরাসি চিন্তক যার আয়ু মাত্র চল্লিশ বছরের, যিনি সিনেমার ইতিহাসে প্রায় সোক্রাতেসের মতো, লিখেছেন কম, অবিরত বলে গেছেন, যিনি নিজের জীবনে কোনও শট নেননি, তিনি কোনও মন্ত্রবলে রোসেলিনি রনোয়া সহ সমগ্র চলচ্চিত্র দুনিয়ার প্রনম্য হয়ে রইলেন তা আবিষ্কার করা শতবর্ষের মুহূর্তে আমাদের কর্তব্য ছিল। এই শহরে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আমরা ক্রফো গোদার ও রেনেকে নিয়ে কত না শব্দ ব্যয় করি, কিন্তু ভুলে যাই, বাজাঁর মতো দার্শনিক পথপ্রদর্শক না থাকলে ন্যুভেল ভাগ ভূমিষ্ঠই হতো না।

আরও পড়ুন, লিটল ম্যাগাজিনের পাতা থেকে: আরেক রকম

একটি ফরাসি সিনেমা পত্রিকা উঠে যাচ্ছিল। মালিকপক্ষ এই অসম্ভব উৎসাহী মানুষটিকে শেষ চেষ্টা হিসেবে পত্রিকার হাল ধরতে অনুরোধ করলেন, বাজাঁ সম্মত হলেন। না, তিনি কোনো নামি দামি লেখককে অধিকতর উপঢৌকন দিয়ে নিয়োগ করেননি, বরং ডেকে নিয়েছিলেন নিতান্ত অপরিচিত অনামি কয়েকটি ছোকরাকে। আর তাঁদের তুখোড় ও স্বাধীন দৃষ্টিপাত বদলে দিল সিনেমা দেখার, বোঝার এবং বানানোর প্রক্রিয়া। ভাবলেও শিহরণ হয়, এই পত্রিকার পাতায় মাত্র ২১ বছরের এক তরুণ ১৯৫৪ সালের জানুয়ারি মাসে এমন একটি প্রবন্ধ লিখলেন যা সপ্তসিন্ধুদশদিগন্তে অনতিকালের মধ্যেই 'অতর' তত্ত্বের জন্ম দেবে। হে পাঠক! আমি ফ্রাসোয়া ক্রফোর কথা বলছি। এই অগ্রজের প্ররোচনাতেই অনুত্তর ২৫ জঁ-লুক গোদার লিখবেন সেই বিখ্যাত প্রবন্ধ 'মন্তাজ আমার প্রণয়িনী'। চল্লিশ দশকের ফরাসি ছবির প্রতিষ্ঠান উপহসিত হবে , আর ক্রমেই বাজাঁর মরণোত্তীর্ণ প্রেরণা দখল করে নেবে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র মেধার সদর দফতর। কিন্তু এবার আমাদের ছোট করে বলতে হবে যে বাজাঁ বাস্তবকে কেন 'অ-বিকৃত' রাখতে চেয়েছিলেন? কেন আইজেনস্টাইনের খণ্ডীকরণের ধারণার বিপরীতে তিনি সামনে এনেছিলেন অন্টোলজিকাল হোলনেস অব রিয়ালিটির ধারণা। ছোট করে জবাব দেওয়ার এই যে তিনি মনে করেছিলেন পৃথিবীতে আলোকচিত্রই একমাত্র প্রতিশ্রুতি যা নশ্বরতার বিরুদ্ধে একমাত্র পার্থিব ইন্সিওরেন্স। অর্থাৎ ইমেজে সময়ের দাঁত বসে না। 'দার্শনিকও হিম হয়, প্রণয়ের সম্রাজ্ঞীর হবে না মিলন?' এই প্রশ্ন শব্দের প্রভু হিসেবে জীবনানন্দ দাশ করতেই পারেন। কিন্তু আলোকচিত্র সহজেই অনুমেয় একজন মেরিলিন মনরো অথবা মার্লন ব্র্যান্ডোকে সময়দূষণ থেকে রক্ষা করতে পারে। আলোকচিত্রই রেনেসাঁ পরবর্তী কালে নশ্বর মানুষের সঙ্গে নিয়তির সেই দেহ জড়বৎ হলেও অস্তিত্ব সাকার থাকে। এই ধারণার বিপদ সম্পর্কেও বাজাঁ অবহিত ছিলেন না, তা নয়। তিনি জানতেন মানুষের সৌন্দর্য ক্রমেই এই বিপজ্জনক আত্মপরীক্ষায় লিপ্ত হয়ে চলেছে। যে কারণে নির্দ্বিধায় ঘোষণা করতে পেরেছিলেন- 'পশ্চিমি চিত্রকলায় পরিপ্রেক্ষিত ব্যবস্থা হল আদি পাপ'। বলা বাহুল্য, এই পাপের শ্রেষ্ঠ কুসুম চলমান চিত্রমালা। বস্তুত খ্রিস্টীয় ঐতিহ্য সম্পর্কে গবেষণার সময়ে জার্মান দার্শনিক ফয়েরবাখ যেমন ভেবেছিলেন যে আধুনিকতা ক্রমশই 'প্রতিফলন'কে মূল বস্তুর থেকে গুরুত্ব দেবে। পরবর্তী কালে সুজান সোনটাগ মেনেও নিয়েছেন যে ফয়েরবাখই প্রথম যিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে প্রতিরূপায়ণ রূপের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, জলছবি ছবির চাইতে জরুরি। যুদ্ধোত্তর কালে বাজাঁ এই সত্যকে আড়াল করতে চাননি বরং রণকৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। চল্লিশের দশকের পর থেকে রক্ত, মৃত্যু ও কোলাহলে ইউরোপে যখন খ্রিস্ট নিরুদ্দিষ্ট হলেন, আপাতভাবে মতাদর্শের ভূমিকা ছেঁড়া চিরকুটের অতিরিক্ত আর কিছু রইল না, তখন বাজাঁ আলোকসামান্য প্রজ্ঞায় দৃশ্যকে দ্রষ্টানিরপেক্ষ অবস্থান দিতে চেয়েছিলেন। প্রজাপতির মতোই তিনি আসন্ন নবতরঙ্গে তাঁর শিষ্যদের জানিয়েছিলেন 'চক্ষুতে এই যে পুরুষ দৃষ্ট হন, ইনিই আত্মা'। বাজাঁ বাস্তবের খণ্ডতা অস্বীকার করলেন। আর কারিগরি স্তরেও সিনেমাকে বিশেষণ করতে তিনি প্রথম পর্যায়ে আগ্রহী ছিলেন না। চলচ্চিত্র ভাষার ইতিহাস তাঁর কাছে মতটেই সবাক বা নির্বাক যুগ হিসেবে জরুরি নয়, তিনি বরং দেখেন চোখের পলক কীভাবে পড়ে। দেখার রকমফের কাকে বলে, বুঝতে চেষ্টা করলেন। ফ্ল্যাহার্টি, স্ট্রোহাইম বা তাঁরই স্বদেশবাসী রনোয়া যে দীর্ঘ অপলকভঙ্গি বজায় রাখেন তাতে তিনি উল্লসিত হন এই ভেবে যে ভাস্তব সততই ধৃত রূপে অনস্ত। আর তিনি সেই চলচ্চিত্রেরই পক্ষপাতী হলেন যাতে বাস্তবের আয়তন অবিকৃত রেখে বাস্তবের বিন্যাসটুকু পালটে দেওয়া যায়। সোজা কথায় এতদিন পর্যন্ত যা ছিল নির্মাণের মহিমা, ছিল মন্তাজের গঠনরহস্য, তা প্রতিস্থাপিত হল স্থান বা স্পেসের প্রকল্প দিয়ে। এই রূপান্তরের পুরোহিত ছিলেন আদ্রেঁ বাজাঁ। গোদার যখন সামার উইথ মোনিকায় হ্যারিয়েট অ্যান্ডারসনের লংটেক ক্লোজআপের মধ্যে বোদলেয়ারীয় মহিমা খুঁজে পান, তখন বোঝা যায় তার দীক্ষাগুরু কে?

"চলচ্চিত্রভাষার ক্রমবিকাশ" নামের প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে বাজাঁ দেখাতে পেরেছিলেন যে সিনেমা তার অন্তর্গত ঐশ্বর্যকে অস্বীকার করে বা না জেনে ক্রমশই নিমিত্তবাদের বশীভূত হয়ে আছে- তার প্রধান কারণ বাজাঁর মতে, স্থানের সারুপ্যতা, যার ফলে চরিত্রের অবস্থান পূর্ব নির্ণীত , এমনকি যদি পরিবেশসজ্জা সরিয়ে নেওয়া যায়, তাহলেও। আর দ্বিতীয়ত, সম্পাদনার মূল উদ্দেশ্যই পূর্ব নির্ধারিত যে হয়, তাকে নাটকীয় নয়তো মনস্তাত্ত্বিক নিষ্পত্তিতে পৌঁছতে হবে। এর প্রতিপ্রস্তাব হিসেবে বাজাঁ ডেপথ অব ফিল্ড বা ভূমির গভীরতা বিষয়ে তাঁর প্রসিদ্ধ তত্ত্ব পেশ করলেন এবং দাবি করলেন যে এই পদ্ধতি শুধুই নির্মাণকৌশল নয় বরং 'It is a capital gain in the field of direction - a dialectical step forward in the history of film language'. আরও বিশ্লেষণ করে বাজাঁ দেখালেন ডিপফোকাস ফোটোগ্রাফি দর্শককে তুলনামূলকভাবে ঐহিক জগতের থেকেও বেশি ইমেজের কাছাকাছি নিয়ে আসে। তার ফলে বিষয়নিরপেক্ষ ভাবেই ইমেজের বাঁধুনি বেশি বাস্তববাদী হয়। যদি তাই-ই হয়, তাহলে দর্শক অনেক সক্রিয় মানসিকতায় ইমেজের আত্মীয়তা খুঁজে পায় আর ইমেজ প্রবাহকে নিজে ব্যখ্যা করার সুযোগ পায়। বাজাঁর মতে মন্তাজের বিশেষণাত্মক পদ্ধতি আসলে অনুবর্তন। পরিচালক দর্শকের হয়ে চিন্তা করেন বা পথপ্রদর্শকের কাজ করেন। পরিচালকই নির্ধারণ করেন দর্শক কী দেখবে আর কী দেখবে না। তাত্ত্বিক ভাবে অন্তত ডিপফোকাস ফটোগ্রাফি দর্শককে দেখার স্বাধীনতা দেয়। আর দেয় বলেই মন্তাজ যখন সত্যের একক ও সংহত অর্থ উপস্থিত করে, তখন ডিপফোকাস অন্তত বহুমাত্রিকতার পরিসর উন্মুক্ত রাখে। বলা বাহুল্য, এ ব্যাখ্যার এ প্রবণতা ফরাসি দার্শনিক সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ প্রভাবিত। কিন্তু নির্বাচনকে নিম্নরেখ করে বাজাঁ দর্শককেও একধরনের স্রষ্টা করতে চাইলেন। যে ছিল ইতিহাসের ফলভোগী, সময়ের দাস, সে সীমা পার হয়ে সৃজনের আকাশে ডানা মেলার সুযোগ পেল। এই জন্যই বাজাঁ নব বাস্তব্বাদকে এত গুরুত্ব দিয়েছিলেন যে তা মৌল অর্থ বিষয়ে মাথা ঘামায় না। এমনিতে একটা সাইকেল চুরি কোনও ঘটনাই নয়, কিন্তু সেইদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখলে ফ্যাসিবাদের যাবতীয় দম্ভের চাইতে বড় হয়ে ওঠে মানুষের পাপ ও পুণ্য। রোমের রাস্তায় শাপগ্রস্ত ইশ্বরকে যদি সন্তানের হাত ধরে হাঁটতে দেখা যায় তাহলে এমনকি সিনেমার তুচ্ছ দর্শকও ইতিহাসকে নিবিড়ভাবে হৃদয়ে পুনরাবিষ্কার করে। এমনকি জঁ রনোয়াকে, বিশেষভাবে তাঁর আবিশ্বে বন্দিত ছবি 'লা রেগলে দ জু' (খেলার নিয়ম) ছবিটিকে, তিনি যখন বাস্তবের শীর্ষারোহণ বলে প্রচার করেন, তখন কখনোই বলেন না যে তা বাস্তবের নকলনবিশি। এমনকি চরিত্রাভিনেতাদের চিত্রনাট্য থেকে সরে যাওয়ার প্রবণতা বা অভিনেতা যখন তার নির্দিষ্ট চরিত্রে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা না করে অন্যত্র চলে যান যাকে গড়পড়তা ভাষায় কাস্টিং এরর বলে, বাজাঁ রনোয়ার সেই কার্যক্রমকে সমর্থন জানিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন:  'This style is added to the script like rich paint liberally applied to a line drawing : often the colour obscure and spill over the lines.' এই যে রেখচিত্র থেকে তেলচিত্রে পৌঁছনোর এই পদ্ধতি, এই যে গোপন সুড়ঙ্গপথ যা ব্যাকরণকে আবছা করে দেয়, তা-ই বাজাঁর আলোকাভিসার। বাজাঁ যখন বাস্তবের কথা বলেন সেই বাস্তব আসলে দেখার নির্মলতা। উপনিষদে দেবতারা যে রকম দেখে থাকেন।

ছান্দোগ্যপনিষদে ইমেজ বিষয়ে একটি চমৎকার প্রতর্কের অবতারণা করা হয়েছে। দেবরাজ ইন্দ্র ও অসুররাজ বিরোচন একবার প্রজাপতি ব্রহ্মার সম্মুখে 'আত্মার স্বরূপ' দেখার জন্য ব্যাকুল হন। প্রজাপতি তাদের দুজনকেই জলপাত্রে নিজেদের প্রতিবিম্ব দেখতে বলেন ও জানান ওই প্রতিফলিত বিম্ব-ই আত্ম-পুরুষ। বিরোচন প্রাকৃতজনের মতো বস্তুর রূপকে বস্তুর সত্তা ভেবে ভুল করেছিলেন। বলা বাহুল্য, ইন্দ্র ওই জলে বিম্বিত পুরুষকে আবিষ্কারের চেষ্টায় বহু সাধনান্তে উপলব্ধি করলেন একক দেখাই সর্বভূতে প্রকাশিত। আঁদ্রে বাঁজার চিত্রপ্রতিমার বাস্তবতা, বিশেষত রসেলিনি রনোয়া ব্রেঁস প্রসঙ্গে, এক আধ্যাত্মিক অভিযান।

হঠাৎ মনে পড়ে গোদারের 'পিয়েরো ল্য ফু' (১৯৬৫) ছবিটি। বেলমন্দো যেখানে কাঁধে একটি ব্রাজিলীয় কাকাতুয়া বসিয়ে ঘোরাফেরা করছেন - সে তো বন্দনা মাস্টারমশাইকে, প্রাণের পুরুষকে। ছোট্ট জীবনে আঁদ্রে বাঁজা একবার স্ত্রী জানিনকে সম্পূর্ণ হতবাক করে দিয়েছিলেন রিয়ো ডে জেনিরো থেকে কাঁধে একটা রঙিন কাকাতুয়া নিয়ে প্যারিসের উপকণ্ঠে পৌঁছে। এই রঙিন ম্যাকাও একাধারে প্যারিসের বর্ণবৈচিত্র্য, আবার সীমানা ভেঙে অনুন্নত 'দক্ষিণ'-এর সঙ্গে সংলাপ শুরু করার আহ্বানও। কী আশ্চর্য সব সমাপতন আধুনিকতার। আঁদ্রে বাঁজা জন্মাচ্ছেন, বিদায় নিচ্ছেন গিয়ম আপোলোনিয়র- ১৯১৮য়, প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হতে আরও এক বছর বাকি। বাজাঁ বিদায় নিচ্ছেন যখন, ত্রুফো 'ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ' ছবির শুটিং অর্ধসমাপ্ত রেখে শেষবারের মতো দেখতে পান তাঁর অন্তরতম প্রেরণার মুখ। এই অন্তর্বর্তী সময়ে চলচ্চিত্রভাষার যে বিবর্তন তা ঐতিহাসিকভাবে বাঁজা-র মননকর্মের ফলাফল।

তিনি যদি দীর্ঘ ও শ্রম ও মনীষায় কারখানার গেটে, রেস্তরাঁ থেকে রেস্তরাঁয় প্রায় অর্ধেকবয়সি বালখিল্যদের আড্ডায় নিজের ক্ষয়রোগ ও রুগ্নতাকে অতিক্রম করে সিনেমা নিয়ে অবিরত কথা না বলে যেতে পারতেন, তাহলে তার নবীন শিষ্যদল নব তরঙ্গের জন্ম দিতেই পারত না। বাজাঁই প্রথম গসপেলের মতো করে বোঝান যে স্টুডিও নামক কারখানাতে তৈরি হলেও মার্কিন ছবির অন্তর্জগৎ আছে। বস্তুত কী অবিশ্বাস্য বিস্ময়ে তিনি দেখতে পান ছবিতে কাহিনি অতিরিক্ত সিঁড়ি ও আসবাবের মহিমা! যেন হিন্দুদের সর্বাস্তিবাদ, যেন বোদলেয়ারের 'করেসপন্ডেন্স' নামের কবিতা, যা চরিত্র ছাড়িয়ে নিখিল বিশ্বকে বাঙ্ময় করে তোলে।

দূর কলকাতা থেকে আমরা সিনেমায় যখন তারকোভস্তি বা কিয়েরোস্তমির মত দার্শনিকের দেখা পাই, তখন বুঝি লংটেক কতদূর প্রসারিত। 'স্টকার' ছবির শট ডিভিশন বোঝার সময়ে আমি আঁদ্রে বাজাঁর লেখা তন্ন তন্ন করে খুঁটিয়ে দেখেছি - 'স্কাল্পটিং ইন টাইম' গ্রন্থে তারকোভস্কি যেখানে অগ্রজ আইনস্টাইনের সঙ্গে কলহে প্রবৃত্ত হয়েছেন সেই মতান্তর মূলত আঁদ্রে বাঁজার দর্শনপ্রসূত। অনুমিত সময় বা ইমাজিনারি টাইম অফ মন্তাজ কী মাত্রায় বিধৃত হবে তা নিয়েই তো আইজেনস্টাইন-বাঁজার ফারাক। 'মিরর' ছবির সূচনা দেখি, মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের গান - 'মেঘের পরে মেঘ জমেছে, আঁধার করে আসে। আমায় কেন বসিয়ে রাখ একা দ্বারের পাশে।' এই আকুল প্রতীক্ষাকে চলচ্চিত্র ভাষায় অনুবাদ করলে আঁদ্রে বাঁজার চিন্তাজগতের একটা হদিশ মিলতে পারে। আজ যখন সারা পৃথিবীতে চলচ্চিত্রবিদ্যার এত আয়োজন, তখন কেবলই মনে পড়ে জীবনে একবারও যিনি ক্যামেরায় লুক-থ্রু করেননি, সিনেমার দুনিয়ায় সন্তপ্রতিম আঁদ্রে বাজাঁর কথা। কী আশ্চর্য যে রক্তবমনের মধ্যে তিনি দেখতে পেরেছিলেন ফুটে উঠেছে বাস্তবের গোলাপসুন্দরী!

Bengali Literature Little Magazine
Advertisment