স্কুলের শেষ পিরিয়ডে এসেছিল ফোনটা। তখনো ছুটির ঘণ্টা বাজতে পনেরো মিনিট বাকি। শেষ পিরিয়ডে ক্লাস ছিল না বলেই তটিনী ফোনটা অন করেছিল। আর তখনি ফোনটা ঢুকেছিল। তটিনী নিজেই নম্বরটা দিয়েছিল চারমাস আগে। সেবার কাকতালীয় ভাবেই দেখাটা হয়েছিল ওদের।
লোকটা যে নম্বরটা রাখবে আর ওকে ফোন করবে ভাবেনি কখনো। কিন্তু হাসপাতাল থেকে ফোন কথাটা শুনে চুপ করে বসে থাকতে পারেনি আর। বড়দিকে বলে ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল। বাইরে তখন অভিভাবকদের ভিড়, ছুটি হবে। মায়েদের জটলার পিছনে বেশ কিছু বাবাদের দেখতে পায় তটিনী। ঘড়িতে দু টো চল্লিশ, এ সময় কাজকর্ম বাদে এই বাবারা সময় পায় বাচ্চাদের নিতে আসার!! অবাক লাগে ওর। এই বাবারা কি প্রতিদিন আসে? চাকরী বা ব্যবসার ফাঁকে সন্তানের জন্য এই সময়টুকু ওঁরা কী করে রেখেছেন? হঠাৎ তটিনীর মনে হয় এই বয়সে এসে সে কি হিংসুটে হয়ে পড়ল! সারা জীবন কারপুলের ভরসায় স্কুল গেছে যে মেয়ে তার কি এসব ভাবতে আছে!
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায় প্রকাশিত সব ছোট গল্প পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে
অটোতে পাঁচ মিনিটেই পৌঁছে গেছিল সরকারি হাসপাতালে। ফিনাইল ওষুধ আর রোগের গন্ধ মিলেমিশে একাকার, নাকে রুমাল চেপে এগিয়ে যায় তটিনী। পনেরো মিনিট ধরে খোঁজার পর বারান্দার এক কোনে নোংরা বিছানায় চোখ যায়। রুগ্ন ক্ষয়াটে শরীরের মধ্যে ধুকপুক করছে প্রাণবায়ুটা, বহুদিন আগের চেনা ছবিটার সাথে মেলাতে পারে না ও। চোখের কোনটা ভিজে ওঠে কি একটু!! স্যালাইনের বোতল থেকে শিরা ওঠা হাতের ফাঁকে সূচ গুজে জলীয় তরল প্রবেশ করছে শরীরে। কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে ডাক্তারের খোঁজে এগিয়ে যায় তটিনী। আজ কথা হবে না আর। পরদিন সকালে আসতে বলে নার্স মেয়েটি। অবস্থা বিশেষ ভালো নয় জানিয়ে দেয়।
আরেকবার বিছানার পাশে এসে দাঁড়ায় তটিনী। একবার ভাবে ডাকবে? তারপর মনে হয় কী দরকার! এতগুলো বছর যখন পার হয়েই গেছে আর মায়া বাড়িয়ে কী লাভ! সে তো কোনোদিন ডাক খোঁজ করেনি। পায়ে পায়ে বেরিয়ে আসে সে। একটা বুড়ো লোক এগিয়ে আসে, একেও সেদিন দেখেছিল স্কুলে। লোকটা বলে -''শেষ অবস্থা, আমরা একসাথে থাকতাম। ওকে সাহায্য করতাম কাজে।''
তটিনী কথা বলার উৎসাহ দেখায় না তেমন। কী হবে আর কথা বাড়িয়ে!
*******
-''এবার আমরা একসাথে ঠাকুর দেখতে যাবো তো পূজায়?'' ছোট্ট মেয়েটা আদুরে গলায় বলে ওঠে।
-''তুমি তো জানো টিনী বাবা কত ব্যস্ত থাকে ঐ দিন গুলো। আমরা মামা বাড়ি যাবো। কেমন ?'' ভাতের দলাটা ওর মুখে গুজে দিয়ে মা বলে ওঠে।
-''একদম না, এবার বাবা আমি তুমি একসাথে পুজোয় ঘুরবো। '' দৌড়ে পাশের ঘরে চলে যায় মেয়েটা। লোকটা কাগজ কেটে রঙিন ফুল বানাতে ব্যস্ত। মেয়েটা সামনে গিয়ে বলে -'' বলো, এ বার পুজোয় আমায় অনেক ঠাকুর দেখাবে ?''
লোকটা অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়, বলে -''ঐ কদিন তো আমি ব্যস্ত থাকবো মা। আচ্ছা দেখছি।''
পড়ুন, বুক রিভিউ: পরিচয়ের আড্ডা ও একটি মিমিক্রি
ততক্ষণে মা এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়, একটু কর্কশ কণ্ঠে বলে -''একটা দিন কি মেয়ের কথা ভেবে শো বন্ধ রাখা যায় না? কী এমন শো তোমার ? কটা লোকেই বা দেখে!!''
চোখ নামিয়ে নেয় লোকটা। বলে -''এই কটা দিন একটু লোক হয়, শো দেখে, সারা বছর তো আজকাল ঘরে বসেই কাটে। ''
তটিনী জানে তার বাবা ম্যাজিশিয়ান, কয়েকবার বাবার ম্যাজিক শো দেখতেও গেছে। রঙিন জোব্বা পরে মাথায় পাগড়ী বেঁধে বাবা যখন খেলা দেখায় বাবাকে অন্য গ্ৰহের মানুষ মনে হয় ওর। কিন্তু বাবা আজকাল বড্ড মনমরা হয়ে থাকে। এক বছর হল ওর মা শহরে চাকরী করতে যায়। তারপর থেকে বাবা আরও চুপচাপ হয়ে গেছে। বাবার তো রোজ শো থাকে না। তখন বাবা টিনী কে পড়ায়, গল্প করে। ইদানীং মা কে সাহায্য করার জন্য বাবা বাসন ধুয়ে রাখে, সবজি কেটে রাখে, কখনো রান্নাও বসিয়ে দেয়। ছোট্ট তটিনী ভাবে তার ম্যাজিশিয়ান বাবা ম্যাজিক করেই তো কাজগুলো করতে পারে। ম্যাজিক করে মিষ্টি চকলেট বা ডিম সেদ্ধ কতবার এনেছে ওর বাবা। তটিনী খেয়েও দেখেছে, একদম আসল। তাহলে এভাবে রান্না করে কেনো?
******
রাতে বাবা মায়ের ঝগড়ায় ঘুম ভেঙ্গে গেছিল তটিনীর। মা কেঁদে কেঁদে বলছিল -''ভালো স্টুডেন্ট ছিলে। পড়াটাও শেষ করলে না। চাকরীও করলে না। মেয়ে বড় হচ্ছে। খরচ বাড়ছে। কতদিন চলবে এভাবে?''
-''চাকরী আমার ভালো লাগে না। আমি নিজের মত করে বাঁচতে চেয়েছিলাম মেধা। '' বাবার গলা ভেসে আসে।
-''সে চেষ্টা তো করলে এতদিন। কি হল? আজকাল ম্যাজিক কেউ দেখেই না। আমি দাদার সাথে কথা বলেছি। তুমি ওর সাথে দেখা করো। '' মা আস্তে আস্তে বলে।
-''শ্বশুর বাড়ির দয়ায় বাঁচতে বলছ!! বৌয়ের পয়সায় তো খাচ্ছিলাম এতদিন। এবার শালার দয়ায়.....''
-''বেকার ঘরে বসে থাকার থেকে তো ভাল। আমিই ভুল করেছিলাম তোমার সাথে বেরিয়ে এসে। ফল ভুগছে মেয়েটা। '' মা ঝাঁঝিয়ে ওঠে। ভয় পায় ছোট্ট তটিনী। এক অন্যরকম ভয়। চাদরটা মুড়ি দিয়ে কানে বালিশ চাপা দেয় ও।
পূজার দিন কটা মুখ বুজে মামা বাড়িতে কাটায় বাচ্চা মেয়েটা। ভাল লাগে না এখানে। মামাতো ভাই রেয়ান খুব পেছনে লাগে। ওর দামি জামা জুতো খেলনা এসব দেখায় সব সময়। মামি ভালো কিছু খেতে দিয়েই বলে -''খেয়ে নে টিনী, ওখানে তো এসব পাবি না। তোর বাবা তো কিছুই দেয় না তোদের। '' আর মা শুনেও এসব শোনে না, দেখেও দেখে না। তটিনীর মনে হয় এক ছুটে যদি সে নিজের বাড়ি চলে যেতে পারত !! এমন কোনো ম্যাজিক যদি বাবার থেকে শিখে নিতে পারত... যাতে সব বদলে ফেলা যায়.... ভালো হত খুব।
পড়ুন লিটল ম্যাগাজিনের কথা প্রতিরোধের সিনেমা: চলার পথে ছ’টা বছর
বাবা মায়ের ঝগড়া বাড়তে বাড়তে একদিন মা ওকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল। ছোট্ট একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে মা একাই থাকতে শুরু করেছিল। বাবা আসেনি। টিনীর জন্যও আসেনি। দু বার স্কুলে এসেছিল ওকে দেখতে।
শেষবার টিনী বলেছিল -''বাবা তুমি ম্যাজিক করে অনেক টাকা আনতে পারো না? তাহলেই আমরা একসাথে থাকতে পারবো। ''
ছোট্ট মেয়েটাও কোন জাদুমন্ত্রে বুঝতে শিখে গেছিল টাকাই সব অশান্তির মুল। আবার টাকাই শান্তি ফেরাতে পারে। কিন্তু এরপর লোকটা স্কুলেও আর আসেনি কখনো।
মা ওকে বুঝিয়েছিল লোকটা দায়িত্ব নিতে ভয় পায়। কাপুরুষ, ভিতু। যে বৌ বাচ্চাকে ছেড়ে পালিয়ে বেড়ায়। বড় হওয়ার সাথে সাথে টিনীর মাথায় মায়ের কথা গুলোই ঢুকে গেছিল ধীরে ধীরে। ছোটবেলায় ওর বাবা ম্যাজিশিয়ান এটা ছিল ওর গর্ব। বড় হতে হতে বুঝেছিল এটা আসলে লজ্জার।
একবার ওর বন্ধু প্রিয়ার জন্মদিনে এক ম্যাজিশিয়ান এসেছিল খেলা দেখাতে। কয়েকটা সাধারণ খেলা দেখিয়েই কত হাততালি পেয়েছিল লোকটা। তটিনী সেদিন বন্ধুদের বলে ফেলেছিল ওর বাবাও ম্যাজিশিয়ান।আরও ভালো খেলা দেখায়। কিন্তু শুনে সবাই হেসেছিল। প্রিয়ার বাবা মা প্রিয়াকে আর মিশতে দেয়নি ওর সাথে। সেদিন ছোট্ট মেয়েটা বুঝেছিল ম্যাজিশিয়ানের মেয়েকে কেউ ভালো চোখে দেখে না।
এরপর বাড়ি বদলে মায়ের হাত ধরে ওরা শহরের ছোট্ট দু কামরার ফ্ল্যাটে এসেছিল। অন্য স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। পড়াশোনায় তটিনী বরাবর ভালো। সেখানেই সব মনোযোগ দিয়েছিল ছোট মেয়েটা। ঐ বয়সেই বুঝেছিল নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, মাথা উঁচু করে বাঁচতে হবে। বাবা শব্দটা ওর কাছে ম্যাজিকের মতই এক অলীক কল্পনার দুনিয়ায় হারিয়ে গেছিল। মা একাই কষ্ট করে ওকে মানুষ করেছিল।
*******
কলেজে পড়ার সময় বন্ধুদের সাথে একবার শান্তিনিকেতন যাচ্ছিল ও। তখন একবার লোকটাকে দেখেছিল ট্রেনে ম্যাজিক দেখাতে। কেউ সে ভাবে দেখছিল না। লোকটা ওকে চিনতেও পারেনি। কিন্তু ঐ রঙ চটা নীল ভেলভেটের চুমকি বসানো পোশাক আর জাদুর লাঠিটা তটিনীকে একবার সেই মায়াময় ছোটবেলায় টেনে নিয়ে গেছিল। জোর করে বাইরের দিকে তাকিয়েছিল ও। মনে মনে চাইছিল লোকটা চলে যাক। কিন্তু লোকটা নেমে যেতেই কেমন একটা কান্না দলা পাকিয়ে উঠেছিল বুকের কাছে। একেক সময় বন্ধুদের বাবাদের দেখলে হিংসা হত। কেন ওর বাবা এমন হল ? কেন আর পাঁচটা মেয়ের বাবার মত হল না? ওর তো ইচ্ছা করত মেলায় ঘুরতে বাবার সাথে। পূজার ভিড়ে বাবার সাথে রোল বা ফুচকা খেতে। রঙিন বেলুন কিনে বাবার হাত ধরে বাড়ি ফিরতে। এসব স্বাদ যে ও পেল না কখনো।
******
ফোনটা এসেছিল ভোর বেলায়। সব শেষ। ম্যাজিশিয়ান বাবার জীবনের ম্যাজিক থেমে গেছিল। ফোনটা রেখে রান্নাঘরের দিকে তাকিয়েছিল তটিনী। চায়ের কাপে চিনি গুলতে গুলতে মা বলেছিল -''এত সকালে কার ফোন টিনী?''
ও বলতে পারেনি। যে মহিলার জীবন কুড়ি বছর আগেই বদলে গেছে তাকে নতুন করে কী আর জানাবে সে। কুড়ি বছরে ও মাকে কখনো দেখেনি বাবার খোঁজ নিতে। শাঁখা সিঁদুর মা ছেড়েই এসেছিল। তবে রঙিন শাড়ি মা এখনো পরে। যদিও একমাত্র তটিনী জানে মার জীবনটা ধুসর স্লেটের মত বর্ণহীন।
চা টা খেয়ে ও উঠে পরে, একবার যেতে হবে। লোকটা ওর নম্বর দিয়েছিল হাসপাতালে তাই ওরা ফোন করেছিল।
কয়েকমাস আগে ওদের স্কুলে এসেছিল লোকটা ম্যাজিক শোয়ের জন্য বলতে। প্রিন্সিপাল শুনেই বলেছিল আজকাল বাচ্চারা কম্পিউটার গেম খেলে আর বিদেশি সিনেমা দেখে। ওদের জীবন গতিশীল। মনোরঞ্জনের হাজারটা উপকরণ ওদের চারদিকে রয়েছে। মনে হয় না ওরা ম্যাজিক দেখবে। লোকটা তবু বলেছিল একটা শোয়ের সুযোগ দিতে। বিভিন্ন স্কুলে ম্যাজিক দেখিয়ে বেড়ানোই ওনার পেশা। সেই সময় তটিনী গেছিল প্রিন্সিপালের কাছে। ও চিনতে পারলেও সে মনে হয় না চিনেছিল। অবশেষে প্রিন্সিপালের উদ্যোগে দু দিন পর হলে হয়েছিল সেই অনুষ্ঠান। আর ম্যাজিক শুরু হওয়ার পর তটিনী বুঝেছিল তার ভেতর এখন সেই ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটা লুকিয়ে রয়েছে যে অবাক হয়ে সেই ম্যাজিক দেখছিল ঠিক ছোটবেলার মত।
শো শেষে একটু বোধহয় আবেগী হয়ে পরেছিল ও। লোকটার সামনেই প্রিন্সিপাল যখন ওকে তটিনী বলে ডেকেছিল লোকটা চমকে তাকিয়েছিল ওর দিকে। ম্যাজিশিয়ানের দৃষ্টি নয়, একটা চেনা মন কেমন করা নরম দৃষ্টি ছুঁয়ে গেছিল তটিনীকে। চলে যাওয়ার সময় নিজের নম্বরটা একটা কাগজে লিখে দিয়েছিল ও। ক্ষীণ একটা আশা ছিল মনের কোণে!
ছোটবেলার থেকে পুষে রাখা আশার চারাগাছটা জল না পেয়ে শুকিয়ে ছিল মনের গহীনে, হঠাৎ করে এক অকাল বৃষ্টিতে প্রাণ পেয়ে গাছটা নেচে উঠেছিল। যে ছোট্ট মেয়েটা মায়ের হাত ধরে বেরিয়ে আসার সময় মনে মনে ভাবত একদিন ঠিক ম্যাজিক করে বাবা সব আগের মত করে দেবে। আবার ওরা একসাথে থাকবে। সেই মেয়েটা বোধহয় সেদিন নম্বরটা দেওয়ার সময়ে এমন ম্যাজিক আশা করেছিল। কিন্তু সবচেয়ে বড় ম্যাজিশিয়ানের ইচ্ছার উপর কারো হাত নেই। সে যে কী চায় কেউ জানে না।
******
এসব ব্যপারে তটিনীর কোনো অভিজ্ঞতা নেই। হাসপাতালে পৌঁছে ঠিক কী করতে হবে ও জানত না। মেঝের নোংরা বিছানাটায় সাদা চাদরের পুটলিটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল এক মেয়ে, ভাবছিল ঐ ম্যাজিকের লাঠিটা ঘুরিয়ে কি দৃশ্যপটটা বদলানো যায় না!! হয়ত কাপড় সরিয়ে লোকটা এখনি উঠে বসবে। হয়তো এখনি বলবে -''ছুটি হয়ে গেছে, বাড়ি নিয়ে চল আমায়। "
নার্স এসে তাড়া দিতেই সম্বিত ফিরেছিল। কিন্তু একা সে কী করে কী করবে! ঐ আগের দিনের বুড়ো লোকটাকে দেখেছিল তখনি। হঠাৎ সেই শেষদিন ছোট্ট মেয়েটার বাবাকে বলা কথাটা আচমকা মনে পড়েছিল। টাকা, টাকা থাকলে বোধহয় সব হয়। ঐ লোকটা আর জমাদারের সাহায্যে ব্যবস্থা হয়েছিল সব। খবর দেওয়ার কেউ তেমন ছিল না। ওরাই নিয়ে গেছিল ভ্যানে করে শ্মশানে। তটিনী ভেবেই রেখেছিল মাকে আর জড়াবে না এসবে। একাই সব সামলে নিয়েছিল। স্কুলটা শুধু কামাই হয়েছিল।
চুল্লির গনগনে আগুনে যখন দেহটা শেষ বারের মত দেখা গেল ওর মনে হচ্ছিল এটাও একটা ম্যাজিক। নশ্বর দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাওয়াই জীবনের সব চেয়ে বড় ম্যাজিক। যার ড্রপসিন পড়ে গেল শেষ বারের মত।
ফেরার সময় বুড়ো লোকটা ওকে ডেকে নিয়ে গেছিল খালের ধারের একটা ঝুপড়িতে, বাবার সাথে ঐ থাকতো ওখানে। ঘরের দেওয়ালে কয়েকটা রঙচটা ফটো, ম্যাজিকের পোশাকে লোকটা, আর তার পাশেই একটা ফটোতে বাবা মায়ের সাথে ছোট্ট টিনী। জ্বালা করে উঠেছিল চোখটা। লোকটা একটা টিনের ট্রাঙ্ক বার করে খুলে ফেলেছে। বেশ কিছু ম্যাজিকের সরঞ্জাম আর তটিনীর পরিচিত সেই নীল ভেলভেটের জোব্বাটা।
-''আর তো কিছুই ছিল না ওর। এগুলো কী করবো ?'' লোকটার প্রশ্নর উত্তরে তটিনী কী বলবে জানে না। আচমকা চোখে পড়ে ম্যাজিকের সোনালী জাদুর লাঠিটার উপর। হাতে তুলে নেয় মেয়েটা। দেওয়ালটার দিকে তাকিয়ে ঘোরাতে ইচ্ছা করে। যদি ঐ দৃশ্যপটগুলোয় প্রাণ দিতে পারত! ম্যাজিক করে যদি একবার ঐ ছোটবেলাটায় ফিরতে পারত।
লাঠিটা হাতে নিয়েই বেরিয়ে আসে ও। ওর চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করে ও ম্যাজিশিয়ানের মেয়ে, ঐ জাদুর লাঠিটাই ওর বাবার স্মৃতি হয়ে থাকবে ওর কাছে। ওর হারিয়ে যাওয়া ছোটবেলার গন্ধ মাখা ঐ জাদু লাঠি যা ওকে মাঝে মাঝে নিয়ে যাবে এক ম্যাজিকের দুনিয়ায়। যেখানে ওর পরিচয় বলতে ও লজ্জা পাবে না, ওকে দেখে সবাই বলবে ও ম্যাজিশিয়ানের মেয়ে।