কলকত্তে কা জো জিকর কিয়া তু নে হম-নশীঁ;
এক তীর মেরে সীনে মে মারা কি হায় হায়।।
গালিবের লেখা চিঠি পড়ি আর কলকাতায় ঘুরি। সাহেবদের শ্বেত নগর থেকে দেশীয়দের কৃষ্ণ শহর। রাস্তায় পড়ে পটলডাঙ্গা, ঘুরে গেলে মারাঠা খাত। গালিব বাড়ি ভাড়া নেন শিমুলিয়া বাজারে। একতলা সেই হাভেলিতে গালিব বহুদিন বাস করেছেন। পাশেই গোল তলব। এখনকার হেদুয়া পার্ক।
বছর দুই তিন আগে লখনউর অবধ শাসকদের নানা কাহিনি পড়তে পড়তে দেখেছিলাম, গালিব সেখানে যাচ্ছেন শিয়া-সুন্নির বহেসে অংশ নিতে। তর্ক যখন শিখরে, তখন শিয়া-গালিবের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুললেন ধর্মীয় নেতাদের একটি অংশ। তাঁরা অভিযোগ করলেন, শিয়া গালিব সুন্নি মুঘল সম্রাটের নুন খান বলে তাঁদের হয়ে কথা বলেন। তিনি রাজভক্ত। গালিব মনে মনে হাসেন। সব কথার জবাব হয় না। যুক্তিতে না পারলে ব্যক্তিগত আক্রমণ, এও তো এই দেশের মন্দ তমুদ্দুন। ভালটা নেব, আর মন্দকে দূর-ছাই করব, তাই হয় নাকি! সেই আসাদুল্লাহ খাঁ গালিবকে পাওয়ার পর ছুটি, আরও আরও গালিবকে পাওয়ার জন্য। গালিব মানে হল সর্বোচ্চ।
আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের নিরাজনীতি (পর্ব ১৩)
কবি কলকাতায় এসেছিলেন ১৮২৮ সালে। কেন? পেনশনের জন্য। তখন কলকাতা ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজধানী। স্বয়ং বড় লাট আমহার্স্ট বসে থাকেন সদর দফতরে। বিরাট যুদ্ধবাজ রুস্তম তিনি। গালিবের পিতামহ কউকান বেগ তুরস্ক থেকে যখন হিন্দুস্তানে আসেন তখন দিল্লির তখতে মুহাম্মদ শাহ সদা রঙ্গিলা। পিতামহ ছিলেন যোদ্ধা। পিতা আবদুল্লাহ বেগ খাঁ প্রথমে চাকরি নেন লখনউর নবাব আসফ-উদ-দৌলার অধীনে, পরে চলে যান হায়দরাবাদ। তৃতীয় চাকরি যখন করছেন আলওয়ারে সেখানে তিনি এক ছোট্ট জঙ্গে নিহত হন। গালিবের বয়স তখন পাঁচ। চাচা নসরুল্লাহ বেগ তাঁদের দায়িত্ব নেন। গালিবরা দু ভাই, এক বোন, আর আম্মিজান। আগ্রাতে বাস। চাচা আগ্রার সুবেদার, তিনি মারাঠাদের খুব বিশ্বাসভাজন সেনাকর্মী। হঠাৎ চাচাজান ফিরিঙ্গিদের পক্ষে চলে যান। আব্বা মারা যাওয়ার চার বছরের মাথায় চাচাজান হাতির পিঠ থেকে পড়ে গিয়ে ইন্তেকাল করেন। গালিবরা দুই ভাই ও এক বোন আবার এতিম হয়ে যান। চাচার পরিবারও অনাথ হয়। পিতামহের ছিল এক জায়গির, সারা জীবনের জন্য। ওই জায়গির থেকে বাৎসরিক রোজগার হত এক লক্ষ টাকার বেশি। আব্বা ও চাচার ইন্তেকালের পর লর্ড লেক সাহেব ওই জায়গিরের বদলে গালিবদের বছরে দশ হাজার টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। ওই টাকা চাচাজানের সংসারে ও গালিবদের সংসারে সমান ভাবে ভাগ হত। তাঁরা তখন নাবালক, তাই এই বাঁটোয়ারার ও পয়সা পৌঁছে দেওয়ার জন্য যাকে মাতব্বর করলেন লর্ড লেক সাহেব, তাঁর নাম নবাব আহমদ বখশ খান—লোহারুর নবাব। তিনি দশ হাজারের বদলে বদলে বার্ষিক তিন হাজার টাকা দিতেন। গালিব ভাগে পেতেন ৭৫০ টাকা। কালে কালে তাও বন্ধ হল। এটা ঠিক পেনশন নয়, হকের টাকা। আগ্রা ছেড়ে গালিব এলেন দিল্লি। দিল্লির রেসিডেন্টের কাছে প্রার্থনা করে কোনও লাভ হল না। গেলেন ফিরোজপুর, লখনউ। ব্যর্থ গালিব পটনা, বারাণসী হয়ে মুর্শিদাবাদ এলেন। মুর্শিদাবাদের নবাব তখন হুমায়ুন জাহ—যিনি হাজারদুয়ারি প্রাসাদ নির্মাণের জন্য খ্যাত। মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতা। সিমলে বাজারে থাকাকালীন নাকি গালিব নকুড়ের শ্বশুরের কাছে মিষ্টি খেতেন! মৌলালির মাজারে যেতেন মাঝেমধ্যে। মোলাকাত হয়েছে রাজা রামমোহন, প্রিন্স দ্বারকানাথ, রাধাকান্ত দেবদের সঙ্গে। সে কাহিনি অনেক।
একটি মুশায়েরায় গালিবকে নিমন্ত্রণ করা হল। তিনি গেলেন। তালতলার কাছাকাছি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া। বৈঠকখানা বাজার থেকে বছর খানেক আগে তা উঠে গিয়েছে তালতলার একটি বনেদি বাড়িতে। সেখানে মূলত আইনের পাঠদান করা হয়। গণিত, দর্শন ও তর্কবিদ্যার পঠনপাঠনের সঙ্গে সঙ্গে ইদানীং ব্রেটন সাহেবের উদ্যোগে সেখানে চিকিৎসাবিদ্যার পাঠ শুরু হয়েছে। সেখানেই তিনি পাঠ করলেন তাঁর বহুল বিতর্কিত শেরঃ
জুজব-এ অজ অলম বা অজ হামা ‘অলম বেশম।
হমচু মু-এ বুতাঁরা জমিয়ঁ বরখিজাদ।।
মির্জা কাতিলের শিষ্যরা ঝাঁপিয়ে পড়লেন গালিবের উপর। গালিব নাকি ফার্সি ব্যাকরণ জানেন না। তিনি সব ভুল বলছেন! মারমুখী হল জনতা। গালিবকে তারা কোতল করতে চায়। মুর্খরা তাই করে থাকে। কিন্তু যখন মৌলবি কারাম হোসেন বললেন, ‘হামা’ নামক আলফাজ ‘অলম’-এর পূর্বে বসবে না; যদি একান্তই বসাতে হয়, তবে ‘হামা’-র পরে একটি বিশেষ্য বহুবচন লাগানো প্রয়োজন। গালিব জিজ্ঞাসা করলেন, কোথা থেকে এই ব্যাকরণ শিখলেন মৌলবি সাহেব? উত্তর এল, কাতিল সাহেবের কাছে থেকে। গালিব বলেন, হাফিজ বড় কবি না কাতিল? তার পর উচ্চারণ করেন হাফিজের শের—
অজ জোশ-ই-দর্দ-ই-গম হামা অলম বাহাম জাদাম।
বোদম পিশ অজ হামা অলম বোদম মঁ অশেক-এ দিরিনা।
গালিব জানালেন, “ফার্সি ভাষা হল আমির খুসরু, শিরাজি ও ইস্পাহানিদের মাদার ই জুবান। আমি তাঁদের লেখা পড়ে ব্যাকরণ শিখেছি।” কিন্তু জনগণ বিতর্ক চায় না। তারা চায়, গালিবের মুণ্ড। গালিব বলেন, আরে ভাই! মুণ্ড কি একটা চাওয়ার মতো বিষয় হল!
কোনও ক্রমে সেখান থেকে চলে গেলেন গালিব। পোস্টার পড়তে লাগল মির্জার বিরুদ্ধে। গালিব বিমর্ষ হয়ে পড়লেন। এই কি তবে কলকাতা! এই কি সংস্কৃতির পীঠ!! বন্ধুরা বললেন, আসলে গালিবের প্রখরতায় জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যায় দু আনার পণ্ডিতরা। থামে না জাদুঘড়ি, যাকে বুজুর্গরা বলেন সময়। গালিবরা আসেন ঘোড়ায় চড়ে। আর ফেরেন না। মিশে যান অন্য কবিদের দেহে-মনে।
গালিবের কলকাতা সফর সুখের হয়নি। তিনি পেনশন পাননি। বরং জুটেছিল লাঞ্ছনা। কিন্তু কিছু বন্ধু পেয়েছিলেন। গালিবের সেই বন্ধুরা আজও শহরে বাস করেন।
কলকাতার এই গালিবকে নিয়ে না লেখাটা পাপ বলে মনে করি।
কলকাতায় গালিব/শামিম আহমেদ
দাম- ২০০ টাকা
অভিযান পাবলিশার্স