উপন্যাস যদি দলিলের থেকেও প্রামাণ্য হয় তবে বাস্তবতার আর কোন মুখোশের দরকার আছে! গার্সিয়া মার্কেজের একশো বছরের নিঃসঙ্গতা নামে অলীক আখ্যান পড়ার পর আমরা উত্তর পেয়ে গিয়েছিলাম। প্রায় উল্টোদিক থেকে গত এক দশকে যে তথ্য পরিবেশিত হচ্ছে তাতে রূপকথার রাক্ষসের পায়ের আওয়াজ, ভয় ও নিষ্ঠুরতা। ভারতীয় ইতিহাসে যেমনভাবে গুপ্তযুগ হয় তেমনই, যেভাবেই দেখা হোক না কেন, মোদী যুগ এসে গেছে। এখন আর মেঘদূত লেখা হবে কিনা স্বতন্ত্র প্রশ্ন কিন্তু অর্থনীতি বা ব্যাঙ্কিং শাস্ত্রের অবসাদে, স্বাস্থ্যনীতি ও ধর্মের বিচিত্র অনুশাসনে আমরা এক সম্পূর্ণ অজ্ঞাত পরিসরে, উদ্বেগ ও আশঙ্কায়, হয়তো নতুন প্রত্যাশাতেও। এখন আর পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ছায়াতলে গ্রাম থেকে সত্যজিতের অপূর্বকুমার রায়ের মত কোন গ্রামীণ কিশোর মহানগরীতে পা রাখবে না। ক্রয়ক্ষমতার সমানুপাতে তার সঙ্গী হবে মোগাপলিসের শ্বাসরোধকারী সৌন্দর্য ও ডিজিটাল কথকতা- ফ্লাইওভার ও শপিং মল!
এরকম পরিপ্রেক্ষিতে গুরুচণ্ডালি প্রকাশনার তিনটি পুস্তিকা অসম্ভব জরুরি মনোপরিসর নিবেদন করেছে। এমন নয় যে তারা অসামান্য প্রজ্ঞানপ্রসূত. বরং আয়তনে কৃশকায় এই রচনাত্রয় অনেকটাই চিরকুটের মতন ক্ষণিকের, তবু যেন সময়ের শ্রাবণসন্ধ্যায় দ্রুত, সংক্ষিপ্ত বিদ্যুল্লেখ। "মোদীনমিক্স" মৈত্রীশ ঘটক ও উদয়ন মুখার্জি নিবেদিত একটি নিবন্ধ। মূল রচনা ইংরেজিতে। কিন্তু ঝরঝরে এই অনুবাদে তাঁদের বক্তব্য বুঝতে আমাদের কোন অসুবিধে হয় না। লেখক দুজন মোদীর অর্থনৈতিক মানচিত্রে প্রতিশ্রুত ভূমি কীভাবে মায়াবী মরীচিকা সদৃশ হয়ে গেল তা আমাদের মত সরল ও গোলা মানুষজনকে বোঝাতে লেখকেরা যুক্তির দৈন্য দেখাননি। এই যে গুজরাত মডেল, যা আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ হয়ে একদিকে বিপুল কর্মসংস্থান, অন্যদিকে নেহরু যুগের গণতান্ত্রিক সমাজবাদ ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে বেসরকারি পুঁজির লাগামহীন আধিপত্যর স্বপ্ন দেখিয়েছিল। নিরন্ন নিম্নবর্গীয় প্রান্তিক মানুষও ভেবেছিল এবার বুঝি ঘরে ঘরে লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ পড়বে- তা যে কীভাবে মুখ থুবড়ে লক্ষ্মীর বাহনের মতো গোমড়ামুখ হয়ে আছে, স্বাস্থ্য শিক্ষা থেকে উন্নয়নের সর্বস্তরে, এই পুস্তিকা সে বিষয়ে একটি ক্ষুদ্রায়তন সড়কনির্দেশ। ভাবতে ভালো লাগে মাত্র কিছু শব্দের করে তথ্য ও পরিসংখ্যানসহ স্বপ্নের উত্থান ও পতন চমৎকারভাবে বিশ্লেষণ করেছেন।
পড়ুন আরেকটি রিভিউ, সময়ের আঁচড়
তেমভাবেই ডাঃ পুণ্যব্রত গুণ ও সত্য শিবরামনের সম্পাদনায় "মোদিকেয়ার" আমাদের স্বাস্থ্যসুরক্ষার ক্ষেত্রে শ্রী নরেন্দ্র মোদী সরকারের নীতিসমূহ জনসাধারণ না বহুজাতিক সংস্থা কার সেবা করতে অধিকতর মনোযোগী সে প্রশ্ন তুলেছে। মাত্র কয়েকটি ছোট লেখার উত্তোলিত তর্জনী দেখিয়ে দেয় তথাকথিত স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্পসমূহ কেন যথার্থ কল্যাণমূলক দৃষ্টিভঙ্গির বদলে মুনাফা অর্জনের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়াতে পারে, ব্রিটেন ও থাইল্যান্ড - এই দুটি দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর তিনটি আলোচনা যে অসামান্যভাবে প্রাসঙ্গিক তার কারণ চটজলদি রাজনৈতিক সাফল্যের থেকে যে সর্বজনীন সুরক্ষা জরুরি, সে বিষয়ে এই মুহূর্তে সত্যিই সর্বজনের চিন্তা প্রয়োজনীয়। আর এই লেখাগুলো সেই চাহিদা উসকে দেয়। পূর্ববর্তী স্বাস্থ্যবিমাগুলি সত্যিই ব্যর্থ কিনা আর মোদিকে কতটা উপযোগী হতে হবে, শ্রীমতী সুজাতা রাও তা নিয়ে একটি মনোগ্রাহী তর্কের পত্তন করেছেন। স্বাস্থ্য পরিষেবার ম্যানুয়াল হিসেবে এসব মন্তব্য সামাজিক মানুষের কাছে বড় উপহার। প্রথমত চেতনাবৃদ্ধিতে প্রচারপুস্তিকার ভূমিকা থাকেই। দ্বিতীয়ত যদি বা প্রকাসিত মতের ব্যাপারে আপত্তিও থাকে তবে প্রতিপ্রশ্ন করাতেও ঝিমিয়ে পড়া স্নায়ু সজীব হয় - লাভের গুড় পিঁপড়ে খেয়ে যায় না।
তৃতীয় সংকলনটির নাম "আচ্ছে দিন"। ভালো দিনের সন্ত্রাসের যে সব ক্ষতচিহ্ন, তা এখানে অন্তত দজন লেখকরে রচনায় ঝুড়ি নামিয়েছে। যে দেশ সংবিধানগতভাবে গণতান্ত্রিক, মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী, সেখানে আস্তে আস্তে মননপ্রক্রিয়া অবরুদ্ধ হল। "বিসর্জ্জী প্রতিমা যেন দশমী দিবসে" - গৌরী লঙ্কেশকে আমরা বিদায় জানালাম দু বছর আগে। ঠিক দু বছর করে ফ্ল্যাশব্যাকে গেলে প্রথম গোবিন্দ পানসারে, দ্বিতীয় নরেন্দ্র দাভোলকর রক্তাক্ত হয়ে লুটিয়ে পড়েন ২০১৫ ও ২০১৩ সালে। এই সমান্তর হত্যা আসলে আমাদের চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির হিসেবে স্বদেশকে চিহ্নিত করার অধিকার হরণ করেছে। কী চমৎকার আর নির্ভীক ছবি ফুটে উঠেছে গৌরীর- তাঁর সহযোদ্ধা কৃষ্ণপ্রসাদের কলমে! দেশপ্রেমের আখ্যান য়ে আর মহাকাব্য নয় বরং প্রকৃত ভাঁড়ামি- সে বিষয়ে সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়ের টুকরো হানাদারি আমাদের নজর কাড়ে। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি যেভাবে আক্রান্ত হয়েছে তার মলাট মুদ্রিত আছে স্বাতী মৈত্রের রচনায়। আর রবীশকুমারের রচনাটি তো আঁধারে একেলা ঘরের প্রথম আলোর চরণধ্বনি।
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের বইয়ের আলোচনা গল্প বলার অদলবদল
সত্যি বলতে কী এইসব টুকরো টুকরো লেখায় যা প্রকাশিত হয়েছে যে সব তথ্য সম্প্রচারিত হয়েছে তা আমরা জানতাম। কিন্তু জানতাম না আমাদের, বিশেষত নাগরিক বুদ্ধিজীবীদের মৌনতা কত বেদনাময় হয়ে উঠেছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই এই তিনটি ছোট ছোট সংকলন, ছোট ছোট তিনটি ঢেউ আছড়ে পড়ে মনের মধ্যবিত্ততায়, চেতনার অচলায়তনে ধাক্কা দেয়। সে টুকুই তো পাঠকের প্রাপ্তি।
মোদীনমিক্স- এক মায়াবী মরীচিকা- মৈত্রীশ ঘটক, উদয়ন মুখার্জী, ২০ টাকা
মোদিকেয়ার- সম্পাদনা ডাঃ পুণ্যব্রত গুণ ও সত্য শিবরামন, ৪৫ টাকা
আচ্ছে দিন- সম্পাদনা সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়, ৪৫ টাকা
গুরুচণ্ডালি