হঠাৎ করে ‘বৃষ্টিচ্ছায়’ মনে এল কেন। সেটাই তো এই লেখাগুলোর একমাত্র রহস্য—করে কখন কী মনে পড়ে, সেটার গল্প বলা। গল্প বলা মানে স্মৃতি খোঁজা। ‘বৃষ্টিচ্ছায়’ কী করে মনে পড়ল সেটাই তো একটা গল্প।
আমি যেখানে বসে এই লেখাটি ও এর আগের লেখাটি লিখছি সেটা একটা আবাসনের ১৯ তলার টাওয়ারের ১৭ তলার একটা ঘর দিল্লির সীমান্তে, দিল্লিরই সম্প্রসারণ। এখান থেকে মাইল কয়েক দূরে নয়ডা বিখ্যাততর। আমার বাঁ হাতে একটা দিগন্ত খোলা জানলা আছে। ও সেই জানলার ওদিকে আকাশের নীচে একটা বারান্দা আছে ও অত উঁচু বারান্দা থেকে যাতে কোনো হঠাৎ-বিপদ না ঘটে, সেই কারণে উঁচু ও চওড়া একটা দেয়াল আছে—রেলিঙের মত। মজাটা হচ্ছে—আমার ঘর থেকে এই রেলিংটা খুব বেশি হলে ৫/৭ পা দূরে। আমি যদি ঘরে বসে দেখি তা হলে শুধুই আকাশ দেখা যায় যাতে এমন বিভ্রম ঘটে যেন আমরা আকাশেই আছি, সে আকাশের কোনো দিগন্ত নেই। আমি যদি দাঁড়াই তা হলে দিগন্ত খানিকটা চোখে পড়ে কতগুলি সমোচ্চ লম্বা বাড়ির মাথার ভিতর দিয়ে। আমি যদি ঐ ৫/৭ পা হেঁটে রেলিংটায় বুক ঠেকিয়ে দাঁড়াই, তা হলে দেখি: মাটির ওপর কিছু নির্মীয়মাণ বাড়ির গঠন, তারপর বনজঙ্গল-মত একটা নিরুদ্দেশতার ভিতর দিয়ে যাওয়া একটা পায়ে হাঁটা পথের বয়ে যাওয়া ও এই সব পথের যেমন চলা, তেমনই চলতে হারিয়ে যাওয়া। সেই হারিয়ে-যাওয়ার পর একটা কুয়াশাচ্ছন্ন অস্পষ্টতা। তারও ওপারে বাড়িঘর দেয়া একটা শহর। এই উচ্চতা থেকে এই দৃশ্য আমার অনেক দিনের দেখা। বেশ ক-বছর আগে আমি বার তিনেক ঐ পায়ে হাঁটা পথ বেয়ে ঐ শহরটাতে গিয়েছি। যে-জায়গায় আমার সতের তলার ঘর, ও-শহর তার চাইতে অনেক অনেক পুরনো। যে-রাস্তায় গিয়ে ওটা যায়, সে রাস্তা হরিয়ানার দিকে চলে গেছে।
এত বিবরণ এই কারণে দেয়া, যে বোঝাতে চাইছি—আমার বসা, দাঁড়ানো, পাঁচ-সাত পা হাঁটার মধ্যে দৃশ্যের এমন বদল ঘটে—মধ্যগগন থেকে মাটির এক বিস্তার পেরিয়ে। যেন কোনো নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে ওপারকে দেখছি। এই টুকু মাত্র তফাৎ যে সেই ওপরটা খাড়া নামছে, যাকে বলে আনুলম্বিক। আকাশ থেকে মাটিতে।
এত কথা বলছি-জানাতে যে এই বিস্তারে বৃষ্টি যখন আসে, ও আমার এখানে আসার গত প্রায় মাসখানেক জুড়ে ঘন-ঘনই আসছে, দিনের ও রাতের নানা প্রহরে তখন ঐ দূরের নগরের ওপর কাল মেঘের একটা পর্দা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়। আমার সতের তলার পাঁচ-সাত-পা দূরত্বে সেই মেঘগুলি কেমন ভেঙে-ভেঙে বৃষ্টি ছড়াচ্ছে সেটা চোখের সামনে ঘটতে দেখতে পাই ও আকাশ পর্যন্ত যে-আকাশ তা লুপ্ত হয়ে যায়।
এক মাস ধরে ঘন-ঘন বৃষ্টি হচ্ছে। ঐ মাটির বিস্তার জুড়ে। সে-বৃষ্টি আমারও বৃষ্টি। কিন্তু তার বাহার এই উচ্চতার দূরত্ব থেকে মনে হয়—আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
একেই বলে বৃষ্টিচ্ছায়। বৃষ্টি তো ভেজায়, বৃষ্টি তো ভাসাতে পারে না। অথচ বৃষ্টিচ্ছায় শব্দটিতে মনে হয় বৃষ্টি যেন একটা ছায়া দিচ্ছে। ছায়া মানে গাছের ছায়ার মত। ছায়া মানে ঘরের ছাউনির মধ্যে থাকার মত। বৃষ্টিচ্ছায় মানে বৃষ্টি ছেয়ে ফেলছে—শুধু নয়। বৃষ্টিচ্ছায় মানে বৃষ্টিই একটি জীবন্ত প্রক্রিয়া।
শুনেছি, পৃথিবীতে এমন কিছু জায়গা আছে, প্রধানত অরণ্য আছে, যেগুলিকে রেইন ফরেস্ট বলে। আমজনিয়া, কঙ্গো, সানাবালু, ইত্যাদি।
কিন্তু যে-সবের মধ্যে জলপাইগুড়ির ডুয়ার্সের নাম নেই। জলপাইগুড়ি ডুয়ার্স এমনই এক বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চল।
এখন দিল্লির সন্নিহিত জাতীয় রাজধানী অঞ্চলে নতুন-নতুন উঁচু বাড়ি তৈরি হচ্ছে। সেই কারণে আমি সতের তলার উচ্চতা থেকে একমাস ধরে এই বৃষ্টিচ্ছায়া দেখেই যাচ্ছি। এ-জায়গা তো বৃষ্টির জন্য বিখ্যাত নয়, বরং বৃষ্টির অভাবের জন্যই এর বদনাম।
গত একমাস সেই জায়গা কেমন করে বৃষ্টিচ্ছায় হয়ে উঠল ও আমাকে আমার লালনভূমি জলপাইগুড়ির ডুয়ার্সে নিয়ে গেল। যেন মনে হচ্ছে জলপাইগুড়ির ডুয়ার্সকে এখানে আকাশ থেকে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু ভুল করে ফ্রেমের চওড়া দিকটাকে মাথার দিকে আর সরু দিকটাকে পায়ের দিকে দিয়ে।
একবার যখন মনে পড়েছে তখন বৃষ্টিচ্ছায়ের আরো রহস্যের ভিতরকথাও বলা যাবে।
-----------