ভূপেশ গুপ্ত একবার পথ হারিয়েছিলেন। বা, ব্যাকরণের দিক থেকে ঠিক হবে বললে যে প্লেন হারিয়ে ছিলেন। ১৯৬৭-র বিখ্যাত ভোট যখন বামপন্থীরা ও কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে আসা অজয় মুখার্জির বাংলা কংগ্রেস একটা ফ্রন্ট তৈরি করতে না পেরে দুটো আলাদা ফ্রন্টে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়ল। সি-পি-আই(এম)-এর রাজ্য সম্পাদক ও পোলিটব্যুরোর সদস্য প্রমোদ দাশগুপ্ত ঘোষণা করে দিয়েছেন ঐ ভোট সি-পি-আইকে তুলে দেয়ার ভোট ও ঢাকুরিয়া কেন্দ্রে সোমনাথ লাহিড়ীর জামানত জব্দ করতে হবে। বামপন্থীদের নিজেদের মধ্যে লড়াই সেই শুরু। কিন্তু ভোটাররা বামপন্থীদের পরস্পরের সঙ্গে লড়াই অনুমোদন করলেন না। তাঁরা কংগ্রেসবিরোধী ভোট দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার তৈরির রায় দিলেন। ফলে, ভোটের প্রচার হয়ে দাঁড়াল, রাজনীতির ভাষায়, ইনার পার্টি স্ট্রাগল।
আমি তখন জলপাইগুড়িতে। সি-পি-আই-এর প্রার্থী ছিলেন নরেশ চক্রবর্তী—তিনিই ঐক্যবদ্ধ পার্টির প্রার্থী হয়ে এসেছেন ৫৭-র ভোট থেকে। সিপিআই(এম)-এর প্রার্থী ছিলেন সুবোধ সেন— না-ভাঙা পার্টির জিলা সম্পাদক ছিলেন বোধহয় ৫২ থেকে। সিপিআই-এর শেষ প্রচারসভায় বক্তৃতা করলেন ভূপেশ গুপ্ত।
দেবেশ রায়ের এই কলামের সব লেখা পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে
জলপাইগুড়ি শহরে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সভা-সমিতির দুটো বড় মাঠ ছিল। একটা আর্যনাট্য সমাজ প্রাঙ্গন। আর-একটা টাউনের মধ্যে কদমতলার মাদ্রাসা ময়দান। ভূপেশ বাবুর সভা মাদ্রাসাতেই হবে। সেই মত খুব ভাল করে মঞ্চ তৈরি হয়েছে।
জলপাইগুড়ি থেকে কলকাতায় একটা অনিয়মিত মালবাহী ডাকোটা প্লেন যাতায়াত করত। সেটাতে যাতায়াতে সময় বাঁচত। তখন ফোনে কলকাতার সঙ্গে কথা বলতে এক্সচেঞ্জে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হত। নরেশ চক্রবর্তী, সি-পি-আই-এর প্রার্থী ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী সমিতির সভাপতি। সেই সুবাদে কলকাতায় কথা বলে জানা গেল ভূপেশ বাবু ঐ পাঙ্গার প্লেনে সভার দিন জলপাইগুড়ি নামবেন। যে গ্রামের মাঠটাতে ঐ ডাকোটা প্লেন নামত তার নাম ছিল পাঙ্গা—পাশের একটা শীর্ণ নদীর নামানুসারে। কলকাতা আফিসের নির্দেশ অনুযায়ী একটা গাড়ি গেল পাঙ্গায় ভূপেশবাবুকে টাউনে আনতে।
যথাসময়ে সেই গাড়ি ফিরে এল কিন্তু সে-গাড়িতে ভূপেশ বাবু নেই। ব্যাপারটা কী? ফোনাফুনি অনেক সময়েই বা বেশির ভাগ সময়েই কাজ করে না। ভূপেশ বাবু আসবেন, দুপুরে খেয়ে একটু বিশ্রাম করে মিটিঙে আসবেন। মাদ্রাসার মাঠে সজ্জিত মঞ্চ তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে। সব দিক থেকে এক অনিশ্চিত অবস্থা। একটু হাস্যকরও বটে। ভোটের একেবারে মুখে এমন হাস্যাম্পদ হওয়ার বিপদ অনেক। একটা বিকল্প ব্যবস্থা ভাবা হল। স্থানীয় কোনো বক্তা বক্তৃতা করবেন। তাঁকে প্রস্তুত হতে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হল। এ ছাড়া তো কোনো উপায় নেই। ভুপেশ বাবু কোথায় সে-খবর নেয়ার কোনো উপায় নেই।
দেবেশ রায়ের কলাম ‘নিরাজনীতি’: সব পর্ব পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে
এমন সময় কোনো একজন অচেনা ব্যক্তি ভূপেশ বাবু সহ তাঁর গাড়ি নরেশ চক্রবর্তীর বাড়ির সামনে দাঁড় করালেন। জানা গেল কলকাতা-অফিস ভূপেশ বাবুকে বলে দিয়েছিল—কলকাতা থেকে উড়বেন, জলপাইগুড়িতে নামবেন। নো ব্রেক জার্নি। সেই নির্দেশ অনুযায়ী প্লেন থেকে নেবে ভূপেশ বাবু আবিষ্কার করেন সেটা কুচবিহার। তখন তিনি একটা ট্যাক্সির জন্য খোঁজাখুঁজি করছেন। তিনি ভূপেশ বাবুকে চিনে অনুরোধ করেন তাঁর গাড়িতে আসতে।
পরে তত্ত্বতালাশে জানা গিয়েছিল—দোষ হয়তো ভূপেশবাবুর কানের নয়, কলকাতা-অফিসেরও নয়। ঐ মালবাহী প্লেনের কুচবিহারে নামার কথাও ছিল না। কিন্তু একটা মাল শেষ মুহূর্তে এসে যাওয়ায় একটা কুইক ট্রিপ করেছিল।
জলপাইগুড়িতে তখন জানুয়ারির ঠান্ডা। ভূপেশ বাবুর গায়ে একটা লংক্লথের পাঞ্জাবি। ওঁর ঠান্ডা লাগছে বুঝে একজন তাঁর গায়ের চাদরটা তাঁকে দিলেন। সেই চাদরটার সামান্য একটু পাড় ছিল। ভূপেশ বাবু নিলেন না। আর-একজন কেউ তাঁর গায়ের তুষটা দিলেন। সেটা তিনি নিলেন ও সেটা গায়ে জড়িয়েই বক্তৃতা দিলেন। পুরনো কমিউনিস্টরা একটু গান্ধীবাদীও ছিলেন না কি?
----------