/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/11/IMG-20191108-WA0000.jpg)
এইমুহূর্ত অসত্য হলে সবচেয়ে ভালো হতো। অথচ তা হওয়ার নয়। চিবুক ছুঁয়ে আদরটুকু আলগা স্মৃতি হয়ে বুকের ভেতর নাড়া দেয়। 'সই'। মেয়েদের লেখালেখির দরবার। খুব বেশি যে থাকতে পেরেছি সই-তে, তা তো নয়। কিন্তু সই-য়ের কথা জানি তার জন্মদিন থেকে।
কেন মেয়েদের লেখা নিয়ে ভিন্ন আসর, সেকথা আজ ভাবতে ইচ্ছে করছে না। ভালোবাসায় ভরে দিতে পারে মেয়েরাই। আবার মেয়েরাই আঘাতে আঘাতে চূর্ণ হয়েও নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে আবারও ভালোবাসতে পারে। তাদের নিজস্ব পরিসর চাই। যেখানে ওলো সই, ওলো সই হয়ে তারা প্রাণের কথা বলাবলি করবে।
জ্ঞান হয়েছে ইস্তক 'ভালোবাসা' বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ। নিছক পান্ডিত্য কিছু দূরে ঠেলে দেয়। কিন্তু 'ভালোবাসা'-তে পান্ডিত্য ছিল (ছিল বলতে খুব অসুবিধে হচ্ছে) কমলহীরে। আর যতই ক্লিশে শোনাক, তার থেকে যে দ্যুতি বিচ্ছুরিত হতো, তা হল ভালোবাসা। সেইখানে নবনীতাদি তুলনাহীনা। মহীরুহ। মেয়েদের মহীরুহ হয়ে ওঠার পথে অনেক অসুবিধে থাকে। নবনীতাদি হাসতে হাসতে, কাঁধে দুটো তিনটে ঝোলা, একটা ব্যাগ, একটা ঝলমলে সংসার সামলে অনায়াসে মহীরুহ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। তিনি 'সই' গড়বেন না তো কে গড়বে?
বাহাত্তর হিন্দুস্তান পার্কের সেই বাড়ি, যার তিনতলায় আলো জ্বলছে দেখলেই মনটা একটা নিরাপদ আশ্রয়ের ভরসায় শান্ত হয়ে যায়, সেখানে উইমেন রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ ওয়েস্ট বেঙ্গলের জন্ম হলো। বেসরকারি উদ্যোগে মেয়েদের সৃষ্টিশীলতার জগত। সাল তারিখের কথায় যাওয়ার মতো মন নেই এখন। তবে 'সই' যথার্থই মেয়েদের সৃষ্টিশীলতার দরবার। হাসি, গান, কবিতাপাঠ, গল্পপাঠ, আবৃত্তি, আর তার সঙ্গে কানাইদা আর ঝর্ণাদি বাহিত সুখাদ্যের সম্ভার।
এ সংসারে এখনো মেয়েরা বড় কোণঠাসা। সংসার আর বাইরের হাজার ঝক্কি সামলে মেয়েরা লিখবে, নাচবে, গাইবে, প্রাণ খুলে মনের কথা বলবে, এমন পরিসর কোথায়? এই তো গত সই-তে তাঁর লেখা 'মধ্যরাতের ভয়ংকর' শ্রুতিনাটক ফর্মে পাঠ হলো। তখন অসুস্থতা বেশ কাহিল করেছে। এক মুখ হাসি নিয়ে শুনলেন। কিন্তু ষ্পষ্টভাষণ তাঁর স্বভাবজাত। রাধারাণী দেবীর ভূমিকায় যে পাঠটি হয়েছে, সে তাঁর পছন্দ হয়নি। বললেন, রাধারাণী দেবী অত্যন্ত ব্যক্তিত্বময়ী ছিলেন।তাঁর কথা বলার মধ্যে সেই ব্যক্তিত্ব থাকা চাই। কানাইদার ভূমিকায় পাঠটিও পছন্দ হয়নি তাঁর। কিন্তু তা বলে কি আদর ভালোবাসায় কিছু কম পড়লো?
ঐ যেন তাঁর নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে আছেন দিদি। ইনফেকশন যাতে না হয়, ডাক্তারের বারণ রয়েছে তাঁর খুব কাছে যাওয়ার। তবু প্রণাম আর ছবি তোলার হুড়োহুড়ি তো কম নয়। আর অসুখকে তিনি চিরকাল তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে অভ্যস্ত। ঐ তো দেখতে পাচ্ছি, ইন্দিরা গাইছেন আর শকুন্তলা নেচে উঠছেন। এক ঘর উজ্জ্বল নারী নিয়ে তাঁর ভরপুর সংসার হলো 'সই'। কোনো খটমটো ইংরেজি নাম দিয়ে তার ব্যাখ্যা হয় না।
'সই' যেমন সাহিত্য শিল্প ক্ষেত্রে মেয়েদের সইসাবুদের প্ল্যাটফর্ম, কারণ সই ছাড়া সৃষ্টি কোন অতলে তলিয়ে যায় কেউ জানে না, তেমনি আবার 'সই' মানে ইচ্ছে করে তোদের কাছে মনের কথা কই। সই মানে যশোধরা কবিতা পড়ছেন, শর্মিষ্ঠা গল্প পড়ছেন, দেবলীনা দৌড়াদৌড়ি করে আক্ষরিক ভাবে সই সংগ্রহ করছে, দীপান্বিতা গল্প পড়ছেন, সুস্মেলী এক কোণে আলো হয়ে বসে আছেন, তার মধ্যে পৃথাদি হাত ধরে বলে উঠলেন, "এই, তুমি কিন্তু আমার বাড়িতেও থাকতে পারো"।
কণাদি আপন মনে গান গেয়ে উঠলেন তো ঝর্ণাদি পিতলের বড় বাটিতে মুড়ি ভাজা আর চপ নিয়ে হাজির।কানাইদার হাতের রেকাবিতে সন্দেশ। এইসব রঙ ছড়ানো মুহূর্তের কোনও নাম হয় না। শেষপর্যন্ত নন্দনা এসে গেলেন বলে শ্রুতিনাটক আবার পড়া হলো। নাটকে তিনিও একটি চরিত্র কিনা, যার নাম টুম্পা।
এই যে মেয়েদের পায়ের তলায় সৃষ্টির জমিটুকু শক্ত করে তৈরি করে দেওয়া, আর নিজে সেই জমির ওপর ছাতা ধরে থাকা, এ বড় কঠিন কাজ। দিদি এক মুখ হাসি, কপালে একটা মস্ত টিপ নিয়ে অবলীলাক্রমে সমস্তটুকু সামলেছেন।সইমেলা হয়েছে। বইমেলাতে সইয়ের স্টলে সইরা পালা করে থেকেছেন। আর শত ব্যস্ততা আর মাঝেমাঝেই অসুস্থতার ঝোড়ো হাওয়াকে সরিয়ে ঠিক সমস্ত কিছুর খবর রেখেছেন। সইয়ের অনুষ্ঠানে ইসমত চুঘতাইয়ের জন্মশতবর্ষ পালিত হলো যেবার, সুদূর মালদা থেকে একটি দলকে নাটক করতে ডাক দিয়েছিলেন। "গল্প থেকে একটা নাট্যরূপ লিখে ফেল না।তারপর সেটা অভিনয় কর।" এ'কথা রাত একটার সময় তিনিই বলতে পারেন, তাঁর সার্থক রাতজাগা।
ঐ তো কফি খেতে খেতে রাত দুটোর পরেও লিখে চলেছেন।চোখ অপারেশনের পর দৃষ্টি সহজ। সই সেরে ওপরে উঠলেন লিফ্টচেয়ারে। শিবাণী আর সুস্মেলী ছিলেন। একথা সেকথা, গান ইত্যাদির পর বলেছিলেন, "আমি না থাকলেও সই যেন থাকে।" বিষাদের বাতাস ঘরে ওড়ে। উপস্থিত তিনজনের বুক কেঁপে ওঠে। তবু কর্কটের দংশন কাবু করতে পারে না তাঁর উজ্জ্বল হাসিটি।
"কিছু সলিড কাজকর্ম করতে হবে বুঝলি। হাল্কা হয়ে গেলে চলবে না। আচ্ছা পরের সইতে সব সইরা মিলে একটা গল্প লিখুক। একজন খানিকটা বললো। সেটা ধরে আরেকজন।তার পরেরটুকু আরেকজন।"
বললাম, "থিয়েটারে এমন হয় তো। সবাই মিলে একটা গল্প বানিয়ে অভিনয় হয়।" ভারি আশ্চর্য অবাক একটা দৃষ্টি মেলে তাকালেন। এইরকম থিয়েটারে হয়? প্রজ্ঞা আর সারল্যের এমন সমাহার আর দেখিনি।
"এমন একটা কিছু হোক সইতে যেটা যথার্থ সৃষ্টিশীল হয়।কাজ করতে হবে।" বারবার বলছিলেন সেদিন। শরীরে গভীর ক্লান্তি ছিল। মুখে একটা অনাবিল হাসি।
কবিতাতে যে গভীর বিষন্নতা চাপ চাপ হয়ে নেমে আসে, অমন বিষন্নতা নামে, আমি না থাকলেও সই যেন থাকে।
নবনীতাদি ওমনি করে থাকেন। আবার অবরুদ্ধ সময়ের গল্প তৈরির ডাক পড়ে। মেয়েরা তাদের বেদনার গন্ডি থেকে বেরিয়ে একটি কর্মমুখর উজ্জ্বলতার মধ্যে নিজেদের ব্যাপৃত রাখতে লিখুক, ঐ ঋজুতাই তো চেয়েছেন সারাজীবন। মেয়েরা হাসতে পারে এবং হাসির গল্প লিখতে পারে, এমন একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ করে গেলেন সিরিয়াস লেখার পাশাপাশি, তাঁর সইতে সেই ছাপ থাকবে না!
মালদা এসে গৌড়ে গেছেন। বেশ কিছু বছর আগে। কী অদম্য প্রাণশক্তি। গরমে যেখানে অন্যরা হাঁসফাঁস, দিদি চলেছেন সেই ঝকঝকে হাসি নিয়ে। সেদিন সভায় তাঁর গল্প পড়ার কথা। যাওয়ার আগে বললেন, "কোন শাড়ি পরব বল তো? বেছে দে।"
একটা লাল কটকি বাছা হল।
"এইটা? এইটা পরব আমি? হাসবে না তো কেউ?"
"পরবেন না কেন? স্যুটকেসে আছে যখন!"
তারপর শাড়ি পরে, "হ্যাঁ রে, আমায় ভালো দ্যাখাচ্ছে তো?" সভায় বসে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বললেন, "দেখুন না, আমাকে এই শাড়িটা পরিয়ে এনেছে। ভাল লাগছে?"
তারপর গল্প পড়ার দায়িত্বটি চাপিয়ে দিলেন। সীতা থেকে শুরু। দুটি গল্প। দর্শক গল্পের টানে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বসে থাকল। মেয়েদের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। যে মেয়ে বাঁচতে চায় সমস্ত বেদনাকে পিছনে ফেলে রেখে।
"আমাকে নেবাতে পারে এত শক্তি রাখে না সময়।
কখনো ভেবো না আমি সময়ের মুখ চেয়ে থাকি।
সময় আমার সঙ্গে খেলে যাক যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা।
যতই কাড়ুক শাড়ি, লজ্জাবস্ত্র ঠিক থাকে বাকি,
মন্ত্রবলে বেলা হয়ে যাবে সব, যা ছিল অবেলা।
ধর্মযুদ্ধে প্রতিবাদী চিরকাল দাঁড়ায় নির্ভয়
যেহেতু সপক্ষে তার ঈশ্বর সাধিত মহাকাল
স্বয়ং সারথি হয়ে সব ব্যূহ ভাঙে উত্তাল;
যতই দিক না যুদ্ধ, খন্ডকাল হবে পরাজিত
এই তো জেনেছি শাস্ত্রে, যতটুকু হয়েছে অধীত।
অখন্ডকালের পক্ষপাতধন্য আমি মহাশয়
আমাকে রাঙাবে চোখ, এত শক্তি রাখে না সময়
সই ঠিক এইকথাটিই বলে।
প্রতিবাদী হয়ে ওঠে প্রয়োজনে।"
দিদি বাংলার মেয়েদের একটা আশ্চর্য জমি দিয়ে গেলেন। তার উর্বরতার কোন শেষ নেই। তাঁর কবিতায় যে কালোমেঘ তুল্য বিষাদযাপনের স্পর্শ, গদ্যে তার বিপরীত। শাণিত, ক্ষুরধার। হাস্যরসে টইটুম্বর। আর সেই অনায়াস হাসির অন্তরলোকে গভীর জীবনদর্শন। সই-য়ের আসর শুধু হিসেব নিকেশ নয়। প্রাণবন্ত। আবার সই যেন হাল্কা অবসর বিনোদন না হয়ে যায়, সৃষ্টির প্রসার যেন শক্ত মাটি পায়, এই মহৎ উদ্দেশ্য সামনে রেখে অনাবিল হাসি, গান আনন্দের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলা, নবনীতাদির দূরদৃষ্টি।
সমস্ত খুঁটিনাটির দিকে কড়া নজর, সস্নেহ বকুনি দরকার হলে, আর কোমল অথচ ঋজু ব্যাক্তিত্বে সমস্ত আয়োজনকে পূর্ণ করে তুলতে তিনিই অপূর্ব, তিনিই অনন্যা। দরবারের প্রাণকেন্দ্র।
নব লক্ষ্মীর পাঁচালী পাঠ হয়েছিল সই-তে। গভীর মনোযোগে প্রতিটি লেখা শুনেছেন অসুস্থতাকে উপেক্ষা করে। সই তো নীরস পান্ডিত্যের জায়গা নয়। তাই সেখানে যে গুণীজন সমারোহ হয়, সৃষ্টিশীলতার চর্চা হয়, তার সমস্ততে তাঁর স্নেহদৃষ্টি। আলোচনা, সেমিনার, গান, কবিতাপাঠে সমৃদ্ধ সইয়ের বার্ষিক অনুষ্ঠান। যে দেশে 'মেয়ে' কবি বা 'মেয়ে' লেখকদের বিভিন্ন অন্যতর সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে সৃষ্টির পথে চলতে হয়, সেখানে 'সই' এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। সই মেয়েদের পরিচয়। মেয়েদের পরিচালনা। মেয়েদের লেখার প্রকাশনী। মেয়েদের প্রতিষ্ঠা।
সাহা টেক্সটাইলস তাঁর বাড়ির সামনে বেশ একটা অনুষ্ঠান করেছিল। তাতে সইরা শাড়ি উপহার পেয়েছিলেন। দিদির মুখে তখন কী হাসি! কে দূর থেকে এসেছে, কে তাড়াতাড়ি যাবে, এসব ভাবনাও তো ভাবতে হতো তাঁকে। কী করে যে সেদিন বসে থাকলেন অতক্ষণ, সবাই তাই ভাবছিলেন।
সব ভাবনার পালা মিটিয়ে, "ছিল, নেই, মাত্র এই" হতে যতটুকু সময়।
শূন্যতা গ্রাস করছে। আর দেখা হবে না। আর মাঝরাতে মেসেজ আসবে না, চলে আসিস। তাঁর সই থাকবে। শুধু সইরা অভিভাবকহীন হয়ে পড়ল। তাঁদের ওপর গুরুদায়িত্ব নবনীতাদির ভিশনকে বাঁচিয়ে রাখার, তাকে বড় করে তোলার। কবিতার বেদনা থেকে রম্যরচনা আর গদ্যের শক্তিময় প্রতিষ্ঠায় যে তুমুল রূপান্তর ঘটিয়েছিলেন ঐ মহীয়সী, তাঁকে প্রকৃত শ্রদ্ধার্ঘ্য তাঁর সৃষ্টিতে জলসেচন করেই সম্ভব।
"কাছে থাকো, ভয় করছে
মনে হচ্ছে এ মুহূর্ত বুঝি সত্য নয়।
এখন বড় বেদনার সময়। একদিন সময় সব সন্তাপ সারিয়ে দেবে জানি।"
তার অপেক্ষায় রইলাম। বাকিটা ব্যক্তিগত। অত আপন, অত আন্তরিক, অত গভীরকে ভাষায় ধরার মুহূর্ত এখন নয়।