Advertisment

"আমিই কবিতার কথা শুনে চলি"

নবনীতা দেবসেনের প্রয়াণ যুগাবসান, বিভিন্ন প্রেক্ষিত থেকে, আঙ্গিক থেকে। তাঁকে নিয়ে লিখলেন তাঁর স্নেহধন্যা, সহগামিনী, কবি চৈতালী চট্টোপাধ্যায়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Nabaneeta Dev Sen

ছবি- দেবস্মিতা দাস

কার ওবিচ্যুয়ারি লিখব আমি? নবনীতা দেবসেনের? আমার নবনীতাদির জন্য আমাকে স্মরণকথা লিখতে হবে... পাগল নাকি! যিনি সারাক্ষণ অক্সিজেন-সিলিন্ডার প্রায় ভ্যানিটি ব্যাগে নিয়ে ঘোরার মতো, সঙ্গে করে এরোপ্লেন চাপেন। ড্যাংড্যাং করে সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দেন যখনতখন, সর্বোপরি যাবতীয় মৃত্যু ও নশ্বরতাজনিত ভীতি এবং নাকিকান্নার নাকে ঝামা ঘষে দিয়ে লেখেন:

Advertisment

"দেবতারা সর্বশক্তিমান, তবু তারা মহাকাব্যের হিরো হয় না কেন বলতে পারিস? কেননা তাদের মৃত্যু নেই। মৃত্যুর মূল্যেই মানুষ হিরো হয়। জীবনের কাছে দাম পায়। বুঝলি? যে মরে না, মরবে না তার তো শোক বিরহ যন্ত্রণা কিছুই নেই। সে ইন্টারেস্টিং পার্সোনালিটি হবে কেন? ঋষিরা কেন যে অমরত্বের বর চাইত, আমি বুঝতে পারি না। মৃত্যুই মানুষকে মহত্ব দেয়। অমরত্ব জীবনকে বড় খেলো করে দেয়। তাই না? চিরজীবী হওয়াটা কোনো কাজের কথা নয়!"
("খুদা - ঈ - খিদমতগার"; নবনীতা দেব সেন)

আরও পড়ুন, ‘সই’ থাকবে, কিন্তু সইদের মহীরুহ যে আর নেই

তাঁর জন্য বড়জোর এ আমার শ্রদ্ধা ও আদর! হ্যাঁ,আদরেরই তো সম্পর্ক ছিল। ওঁর সমুদ্রপ্রমাণ প্রজ্ঞা ভুলে গিয়ে আমি মান-অভিমান, ঝগড়াঝাঁটি করতাম। প্রশ্রয় কাড়তাম,অগাধ। ভালো-বাসা বাড়িতে তো সার্কাস বসত। রোজ। নবনীতাদি আর আমার কথোপকথনের টুকরো:
- একদম চলে যা! তোর মুখ দেখব না। এত পাজি হয়েছিস!
- বেশ। যাচ্ছি তাহলে।
- চুপ করে বসে থাক এখানে। কানাই, ওকে মিষ্টি দেবে না। সুগার আছে। নোনতা কিছু দাও। তখন থেকে খাই খাই মুখে চেয়ে আছে...
শুধু আমি বলে নয়, সকলের সঙ্গেই এমন ঝড়-বৃষ্টি-রোদ্দুর।
তাঁর কবিতায় সরস বৈদগ্ধ্য। অসম্ভব ভার্টিকালও বটে। তাই গাঢ় প্রেমের কবিতা লিখতে গিয়েও লেখেন, অনিশ্চয়তা।

পাণিগ্রহণ

কাছে থাকো , ভয় করছে, মনে হচ্ছে
এ মুহূর্ত বুঝি সত্য নয়, ছুঁয়ে থাকো।
শ্মশানে যেমন থাকে দেহ ছুঁয়ে একান্ত স্বজন
এই হাত, এই নাও, হাত।
এই হাত ছুঁয়ে থাকো, যতক্ষণ
কাছাকাছি আছো, অস্পৃষ্ট রেখোনা।
ভয় করে। মনে হয় এ মুহূর্ত বুঝি সত্য নয়।
যেমন অসত্য ছিল, দীর্ঘ গতকাল।
যেমন অসত্য হবে অনন্ত আগামী।

(নবনীতা দেবসেন, ১৯৮৮)

আর, সারাক্ষণ লিখে চলেছেন। গরম চায়ে ঠান্ডা জল ঢেলে খাচ্ছেন সেই পানীয়, সমান তালে।
বছর পনেরোরও আগে, মেয়েদের লেখালেখিতে নিষেধাজ্ঞা, তা সমাজেরই হোক কিংবা নিজেদের, নিয়ে ওয়ার্কশপ হল। পরে ঘটা করে যার নামকরণ, গার্ডেড টাংগ্। ওখানেই নবনীতাদি বললেন, 'চল, আমরা সবাই মিলে লেখিকাদের সংগঠন করি একটা। বাংলা ভাষায় মেয়ে-লেখকদের নিজেদের কথা আলোচনার জন্য একটা জায়গা থাকা দরকার!' সেই থেকে সই!
কবি নবনীতাকে জানি। নবনীতাদির গদ্য যা পড়ে আট থেকে আশি বছরের সবাই হেসে লুটোপুটি খাই,সে-ও জানি। কিন্তু,তার বাইরেও তো অনেক সিরিয়াস প্রবন্ধ। উপন্যাস। হোমোসেক্সুয়ালিটি আছে, নানান এক্সপেরিমেন্ট আছে। জীবন নিয়ে। এইডস্ নিয়ে। বহির্বিশ্বের বাঙালি,বাংলাদেশি, এমনকি পুয়ের্তোরিকোর উদ্বাস্তু মানুষদের নিয়েও উপন্যাস আছে।

অসংখ্য স্কলারলি কাজ। অ্যাকাডেমিক কাজ। যা, কম্পিউটারবন্দি। সময় বিভাজন না করে উঠতে পেরে, শরীরের কারণে, ফরমায়েশি লেখার চাপ ও নানাবিধ আহ্লাদের কারণে যা ভীষণভাবে অবহেলিত হয়। ভারত থেকে একমাত্র মানুষ যিনি অক্সফোর্ডে রাধাকৃষ্ণণ বক্তৃতামালা দিতে গেছিলেন। এ'খবর জানে ক'জন! রামায়ণ নিয়ে কাজ করেছেন। তাঁর চন্দ্রাবতী রামায়ণের ইংরেজি অনুবাদ এই এতদিনে বই হয়ে প্রকাশ পেল। অক্সফোর্ড লেকচার্স নিয়ে  বই করার জন্য চেয়ে-চেয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস।

নবনীতাদি ভ্রমণে থাকেন। বাইরে, ঘরের মধ্যেও, এমনকী। এবারও এই একটু হাওয়াবদলে গেলেন। আমার সঙ্গে দেখা হবে দু'দিন আগে কিংবা পরে। এইমাত্র!

Advertisment