সময়ের শ্যাওলা-ধরা পাথর। স্রোতস্বিনীর তীরে সেই কবে থেকে পড়ে আছে কেউ জানে না। পাথরটা শ্যাওলার সঙ্গে এমন ভাবে জড়িয়ে যে তাকে গান গাইতে হয়, যে বাঁধনে বেঁধেছ, পারি না তো…। হ্যাঁ, এই জায়গাটার নাম বারাণসী। হিন্দুত্ব ও বার্ধক্য তুলি দিয়ে এঁকে দেওয়া হয়েছে এর গায়ে। অনেক বুড়ো হয়েছে এ শহর, যত বয়স বাড়ছে, তত স্থানমাহাত্ম্যের চিক্কণ, বর্ধমান। কহানি কিস্সা তত বেশি জমা যাচ্ছে, ঘাটের আত্মকথা বর্ধিষ্ণু। আবার বেনারস ও বাঙালি-- যেন অনন্ত ও অন্তর। গল্প বলতে ও শুনতে তো বাংলা পটু। গল্পবলা পুতুলই তো সে, চাবি ঘোরালেই খেলনার বকবকম। নীলশ্রী বিশ্বাসের সাম্প্রতিকতম বইটি বারাণসীর গল্প বোনা আর যার সঙ্গে ফোটোগ্রাফি ইরফান নবি-র। দুটো আকাশ যেন একলপ্তে, এমনটা তাঁরা আগেও করেছেন কাশ্মীরে। সেই বইয়ের নাম অ্যালৌরিং কাশ্মীর দ্য ইনার স্পিরিট। আর, সাম্প্রতিক বইটির নাম, বেনারস: অফ গডস, হিউম্যানস, অ্যান্ড স্টোরিস। প্রকাশক নিয়োগী পাবলিকেশন।
Indianexpress.com-এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিশ্বাস এবং নবি জানিয়েছেন তাদের বারাণসী-কথা। বারাণসীতে তাঁরা কী খুঁজে পেয়েছেন, এই বইয়ের মাধ্যমে প্রাচীন জনপদে কী আলো ফেলেছেন তাঁরা? সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ প্রকাশ করা হল।
কেন আপনার মনে হয় বারাণসী সময়ের খাঁচাবন্দি নয়?
নীলশ্রী: নিরবধি বা নিরন্তর অথবা সময়হীন। এই ধরনাটার সঙ্গে শিব জড়িয়ে। যেহেতু বারাণসী শিব-নিলয়, আর শিব নিরন্তরের প্রতীক, তাই বিশ্বাস কাঠামোয় কাশী সম্পর্কে এই সময়াতীত পৌরাণিক ধারণা তৈরি হয়েছে। তা ছাড়া আমি বারাণসীর সঙ্গে জেরুজালেম, পিকিং, কায়রোর মতো প্রাচীন শহরের তুলনা করে থাকি। এরা কেউই সময়ের ঘেরাটোপে বন্দি নয়।
কাশীর দৃশ্যগুলি সময় পেরিয়ে বেরিয়ে আসার কথা বলে। নানা সময়ে নানা জন বারাণসীতে বিভিন্ন কিছু করেছেন, টাইমলেস এক রূপের জন্ম হয়েছে তাতে। তীরবর্তী সিঁড়িগুলো নামতে নামতে পুরাণ শহরের গর্ভে যেন অনন্তে হারিয়ে যায়।
বারাণসী এবং অন্যান্য প্রাচীন শহর, যা আপনি বললেন, তাদের মধ্যে সাদৃশ্য কী?
নীলশ্রী: প্রাচীন শহর বহু দিনের গল্প বলে। শহরগুলির আত্মা তাই গল্পমুখর, তার টানেই এসে হাজির হতে থাকেন পর্যটকরা। বিদেশি পর্যটকদের কাছে প্রাচীন জনপদগুলি সে কারণে চুম্বক।
বারাণসীর মতো শহরে ক্যামেরাবন্দি করার জন্য কী খোঁজেন?
ইরফান: বারাণসীকে নিয়ে যে কাজ এখনও পর্যন্ত হয়েছে, তা আমায় আপ্লুত করে না। আমি এই জনপদটিকে দেখতে চেষ্টা করেছি কোনও পূর্ব-ধারণা ছাড়া। আমি সেখানে যাওয়ার পর তার ঐতিহ্য, তার সংস্কৃতির সঙ্গে অনেকটা সময় কাটিয়েছি। সূক্ষ্মতা এবং অসীমতাকে বুঝতে চেষ্টা করেছি। ঘাটগুলিতে গিয়ে, গঙ্গাকে দেখলাম। এর অন্ধিসন্ধিতে পৌঁছে গেলাম। বুঝতে চাইলাম মানুষের ধারাকে, যা এক ঐকতান তৈরি করেছে, শহরকে অমরত্ব দিয়েছে।
আসলে আমি বারাণসীকে নিখুঁত ভাবে দেখার চেষ্টা করেছি। যাঁরা কাশী ঘুরেছেন, তাঁদের সঙ্গে এই শহর সম্পর্কে আলোচনা করেছি বিস্তারিত। লক্ষ লক্ষ মানুষ এই শহরকে পূর্ণতা দিয়েছে। আপাত ভাবে মনে হবে আমার ছবিতে কিছু চলন্ত মুহূর্ত যেন 'পজ' হয়ে রয়েছে।
মুঘল ও বারাণসী-- কী বলবেন?
নীলশ্রী: হুমায়ুন প্রথম এই শহরের দিকে নজর দেন। দানধ্যানও করেছিলেন তিনি। হুমায়ুনপুত্র আকবর এ দেশটাকে ভাল বুঝতেন। তাঁর দরবারে অনেকেই ছিলেন, যাঁরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী, তাঁদের অনেকের সঙ্গে বেনারসের নিবিড় যোগ ছিল। সর্বধর্ম সমন্বয়ের চেতনা ছিল আকবরের, তিনি এই শহরের জন্য অর্থ খরচ করেন, সময়ও খরচ করেন। বারাণসীর সাংস্কৃতি এবং শিক্ষার পরিবেশ যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে, সেই চেষ্টা তাঁর ছিল। টোডর মল, মান সিংহের মাধ্যমে আকবর এ সব করেছিলেন। তাঁরা দু'জনেও বারাণসী গঠনের শরিক হয়ে যান। টোডর মল একটি প্রশাসনিক শাখাও এখানে তৈরি করেন। নিজের জন্য একটি প্রাসাদও তৈরি করান। একদম নগরের মাঝে। এখন যাকে চক বলা হয়, সেখানে। মান সিংহ কাশী বিশ্বনাথের মন্দির পুননির্মাণ করেছিলেন। পরে যা ধ্বংস করেন অওরঙ্গজেব। মহারাণী অহল্যাবাই হোলকার মন্দির ফের তৈরি করান। বলা যায়, প্রায় সব মুঘল শাসকেরই দাক্ষিণ্য পেয়েছে বেনারস। এখানকার শৈবদের জমি-অর্থ দিয়েছেন তাঁরা। পৃষ্ঠপোষক যখন রাজা, তখন তো বহু শিল্পী-কারিগর আসবেই, এসেছেন বহু পণ্ডিতও। তাঁরা নগর গড়ার কাজে জড়িয়ে পড়েছেন।
বেনারসে বহু বিদেশি পর্যটক আসেন। যাঁরা এই শহরকে আধ্যাত্মিক রাজধানী হিসেবে দেখেন। আপনি কী মনে করেন?
নীলশ্রী: ভারতের আধ্যাত্মিক রাজধানী। বারাণসী সম্পর্কে এই ধারণা তেমন পুরনো নয়। উপনিবেশিক আমলে গড়ে উঠেছে। এখানে এসেছেন জেমস প্রিন্সেপ, রেভারেন্ড শেরিংয়ের মতো জ্ঞানীজন, এসেছেন উইলিয়াম হজেস, ড্যানিয়েলস, মার্ক টোয়েনের মতো লেখক-শিল্পীরা। এই শহর সম্পর্কে তাঁদের ভাবনাচিন্তাই নানা ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে পরে।
ধরা যাক, জেমস প্রিন্সেপের কথা। তিনি ছিলেন টাঁকশাল সংক্রান্ত দলে। এই শহরের পরিকাঠামো-উন্নয়নে তাঁর বিরাট ভূমিকা ছিল। তিনি মনে করতেন, বেনারস প্রাথমিক ভাবে একটি হিন্দু শহর। এর প্রকাশ রয়েছে তাঁর স্কেচগুলিতে। তিনি এখানকার নানা কিছু সম্পর্কে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। বার্ধক্য, মুঘল উৎসব, চন্দ্রগ্রহণ, ঘাট, এবং আরও অনেক কিছু। হিন্দুত্বের লেন্সেই সব কিছু দেখতে চেয়েছেন তিনি। তাঁর মতে, এই শহরের হিন্দু-বৈশিষ্ট অসাধারণ। হজেসও প্রাচীন গৌরবের নিরিখে একে দেখেছেন, ভ্রমণ-বর্ণনায় যা বলেছেনও। এই শহর সম্পর্কে পশ্চিমিদের বহু লিথোগ্রাফ, স্কেচ এবং আরও নানা সৃজন এই ভাবে হিন্দুত্বের নিরিখে বারাণসীকে বোঝানো হয়েছে। ক্রমে সে সব ইউরোপ পৌঁছেছে, ফলে সেই মতো এ নগর সম্পর্কে ধরণা তৈরি হয়েছে পাশ্চাত্যে। বারাণসী হয়ে উঠেছে আধ্যাত্মিক ভারতের প্রতিমা। আবার অন্য দিকে ম্যাক্সম্যুলারের লেখায়, এবং তার অনেক পরে প্রোফেসর ডায়না একের (Diana L. Eck)লেখায় গঙ্গা এবং পবিত্র ভৌগলিকতা গুরুত্ব পেয়েছে। পশ্চিমের বহু ভারত-তাত্ত্বিকের কাছে আমাদের দেশ তাই গঙ্গা-ভূমি।
আপনি বলেছেন অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে বেনারস বা বারাণসী হয়ে উঠেছিল এই উপমহাদেশের অর্থনৈতিক রাজধানী। সেটা কী করে সম্ভব হল?
নীলশ্রী: প্রাচীন কালে বেনারস কিন্তু সমৃদ্ধ নগরী ছিল। মুঘল শাসনে এটি হস্তশিল্পের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠল। যার সঙ্গে এখনও বেনারস জড়িয়ে। বেনারসি, জারদোসি, মসলিন, কাঠের কাজ, ধাতুর তৈরি শিল্প-সামগ্রী এবং আরও নানা কিছু এখানে তৈরি হত। গঙ্গার মাধ্যমে যা অন্যত্র নিয়ে যাওয়া যেত সহজে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপীদের প্রবেশ এখানকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের তাৎপর্য আরও বাড়িয়ে তুলল। ব্যবসায়ীদের বড় অংশই মারোয়াড়ি, অম্বর রাজবংশের শাসনকালে এখানে এঁদের অনেকেরই পূর্বজের অগমন ঘটেছিল। যখন রাজ-গুরুত্ব পাচ্ছে কোনও শহর, তখন স্বাভাবিক যে বহু ব্যবসায়ী এসে ভিড় করবেন।
আরেকটি বিষয়ও রয়েছে। সাধারণ ধর্মীয় ভাবনা থেকেও বহু মানুষ নিজেকে বারাণসীর সঙ্গে সম্পর্কিত করতে চান। এটা এই শহরের ব্যবসায়িক গুরুত্ব বাড়িয়েছে।
বেনারসের হিন্দু-প্রতিমা কি সচেতন কোনও প্রয়াস, না কি এটাই এই শহরের স্বাভাবিকত্ব?
ইরফান: এটা অস্বীকার করা যায় না, হিন্দু-পরিচয় হিন্দু-অলঙ্কারই এই শহরের প্রধান বৈশিষ্ট। আমি সমস্ত হিন্দু রীতিনীতির সঙ্গে পরিচিত নই, কিন্তু সেই সব দেখা এবং তার ছবি তোলা এক অতুলনীয় অভিজ্ঞতা। রীতিনীতি সম্পর্কে অজ্ঞনতা আমার আরও কাজে এসেছে, কারণ সব কিছু নতুন লেগেছে। আমার ছবিতে হিন্দু-সভ্যতা এবং বিশ্বাসের বেনারসকে ধরা হয়েছে।
আর যখন বেনারসের মুসলিমদের ছবি তুলেছি, তখন রাস্তাঘাটে, তাদের বাড়িতে কর্মব্যস্ততাকে ধরেছি। এক উদার মিশ্রণ তৈরি হয়েছে, আমার খুব ভাল লেগেছে।
মনে দাগ কাটার মতো ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান দেখলেন?
ইরফান: যখন আপনি মণিকর্ণিকা ঘাট পেরবেন। দেখতে পাবেন মৃতদেহ পুড়ছে, আবার ৫০ মিটার দূরে আর একটি ঘাটে গিয়ে দেখবেন কোনও শিশুর মুণ্ডন হচ্ছে, অথবা নববিবাহিত দম্পতি গঙ্গার আশীর্বাদ নিতে এসেছে। এই ভাবে জীবন-মৃত্যুর চক্র দেখা যায় এইখানে, এক সঙ্গে।