Advertisment

রমনার বটমূল কেঁপে উঠেছিল বিস্ফোরণে

চৈত্র সংক্রান্তির মেলায় ছিল ধুলো মাখা জিলিপি। সে অনেক আগের কথা। ধুলোর স্বাদ তার অনেক বছর পরও পেয়েছিলেন পয়লা বৈশাখে। রমনার বটমূলে। মৃত্যু যখন চলে এসেছিল গায়ের সামনে। স্মৃতির ঝুলি খুললেন গৌতম ঘোষ দস্তিদার।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
bengali new year nostalgia goutam ghoshdastidar

প্রাণ হাতে করে বিদেশের মাটিতে দিক্‌ভ্রান্ত পালাতে-পালাতে ভাবছি, শেখ মুজিবুর রহমান প্রায়-সপরিবার প্রাণ দিয়েছেন একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশগড়ার লক্ষ্যে (ছবি চিন্ময় মুখোপাধ্যায়)

জীবনের পড়ন্ত বেলায় অকিঞ্চিৎকর ছেলেবেলার সবটাই খুব মায়াবী ও ঝকঝকে মনে হয়। সে দুর্গাপুজোর সামান্য নীলরঙা সুতির হাফপ্যান্ট বা হলুদরঙা সস্তার জামা বা পদ্মপুকুরের কালো বুটজুতোই হোক, বা পয়লা বৈশাখে হাতখরচের সিকি-আধুলি। সবটাই ছিল আমাদের কাছে যখের ধন। আমাদের বাঙালবাড়িতে ওই হাতখরচের পরিভাষা ছিল ‘থোউলা’। শব্দটি সম্ভবত ‘থলে’ থেকে এসে থাকবে আমাদের পিতা-পিতামহর বুলিতে। তখন পঞ্চাশ পয়সাকে আধুলি বা আট-আনাই বলত সকলে। ষোলো-আনায় একটাকা। আমরা তখন লক্ষ্মীর ভাঁড়ে তামার এক-নয়াপয়সাও জমিয়েছি। সিকি বা আধুলি ক্বচিৎ হাতে আসত। আমার বাবা ছিলেন বড়-ছাপাখানার মাঝারি কর্মী। পাঁচ ভাইবোনের জন্য অতটুকু করতেই হাঁফ উঠে যেত তাঁর। কিন্তু,  আমাদের আহ্লাদের একটুও খামতি হত না তাতে। কেননা, আমাদের পরিসরে সকলেরই প্রাপ্তি ছিল সমানুপাতিক। বড়লোক বসাকবাড়ির ছেলেমেয়েদের নতুন জামাজুতোও তেমন আলাদা ছিল না আমাদের চেয়ে। কিংবা, হয়তো, পরিমাপের বা প্রতি-তুলনার মাপকাঠিটিই তৈরি হয়নি তখন।

Advertisment

    সেই-যে থোউলা, তা যে কেবল আমরা ছোটরাই পেতাম, তা নয়। এন্টালির এক বারো-ঘর-এক-উঠোনে থাকতেন আমার বড়পিসি-ছোটপিসিরাও। পয়লা বৈশাখের দিন দুপুরবেলা স্নান করে বাবা যেতেন তাঁদের প্রণাম করতে। তাঁরাও বাবাকে দিতেন দুটি করে আধুলি বা এক-টাকার একটি কড়কড়ে নোট। তখনও টাকার মুদ্রা আসেনি টাঁকশালে। ঘরে ফিরে বাবা তাঁর প্রাপ্তিটুকু দিতেন মায়ের হাতে। মা রেখে দিতেন সিঁদুর মাখিয়ে ঠাকুরের আসনে। সেই দৃশ্যটি অবিনশ্বর হয়ে আছে।

poila boishakh remembered goutam ghosh dastidar একবার মায়ের চুলের কাঁটা দিয়ে বাণ বানিয়ে জিভে বেঁধানোর চেষ্টা করে রক্তারক্তি কাণ্ডই বাধিয়েছিলাম। (ছবি চিন্ময় মুখোপাধ্যায়)

   এন্টালির বাসাবাড়ি থেকে মফস্‌সলে নিজেদের বাড়িতে চলে আসার পরেও চালু ছিল সেই প্রথা। আমরা সেই একটি-দুটি আধুলি নিয়ে যেতাম কাছের চড়কমেলায়। চৈত্রসংক্রান্তির সেই মেলা বেশ-কদিন চলত। মেলার ধুলোমাখা জিলিপির স্বাদ কি আর-কখনও পেয়েছি জীবনে! বানফোঁড়া দেখে সে কী উত্তেজনা আমাদের। পিঠের ত্বকে বঁড়শির মতো বাঁকানো লোহার শিক ফুঁড়ে চড়কগাছের উঁচু থেকে বনবনিয়ে ঘুরত ভক্ত্যারা।  আমরা হাঁ করে ঊর্ধ্বমুখী দেখতাম সেই কুহক। আমি একবার মায়ের চুলের কাঁটা দিয়ে বাণ বানিয়ে জিভে বেঁধানোর চেষ্টা করে রক্তারক্তি কাণ্ডই বাধিয়েছিলাম। কী হাঁদারামই না ছিলাম আমরা!

   নববর্ষের দুপুরে বাঙালদের খাওনদাওন ছিল তুলনাহীন। মায়ের হাতের মাছের মাথা দিয়ে কচুশাক বা কচুলতি বা চিতলমাছের মুইঠ্যা পৃথিবীর কোনও পাঁচতারা হোটেলের শেফ রাঁধতে পারবে না। এই বিশ্বাসে আমি আজও অটল। বিকেলের দিকে বাবার সঙ্গে কেবল আমিই যেতাম হালখাতায়। ছোটবেলা থেকে ওই পয়লা বৈশাখের সূত্রেই বোধহয় মির্জাপুরের কাগজ-কালির দোকান, বৈঠকখানার দফতরিঘর, বা কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ার প্রেমে পড়ি আমি। দোকানে-দোকানে বরফায়িত রঙিন সরবত খেয়ে পেট জয়ঢাক হয়ে যেত। বাড়ি ফিরতাম গুচ্ছের মিষ্টির বাক্স আর ক্যালেন্ডারের বোঝা নিয়ে। বাবা জেনে যাননি, আমিও বহুমুদ্রিত হয়েছি শেষে।

আরও পড়ুন। আমাদের পহেলা বৈশাখ: বাংলাদেশ থেকে বলছি

   কীভাবে যেন সেবার গিয়ে পড়েছিলাম ঢাকার নববর্ষে। ১৪০৮ সন। আহা, সকালবেলার সেই হৃদচঞ্চল শোভাযাত্রা! রবীন্দ্রনাথের গানে কেমন উদ্বেলিত হয় একটি জাতি, একেবারে ধর্মনিরপেক্ষভাবে, তা দেখে-দেখে আঁখি আর ফিরছিল না যেন। শোভাযাত্রার সঙ্গে, কবিবন্ধুদের সঙ্গে পৌঁছেছিলাম রমনার বটমূলে। তখনও আলো ফোটেনি চারদিকে। গ্রীষ্মের স্নিগ্ধ সমীরণ। ডাকছিল কোকিলও। মানানসইভাবে সারা-দেশ যেন পদ্মার মতো উত্তাল সেই বিখ্যাত বটমূলে। শাড়ি আর পাঞ্জাবিতে সুশোভন দশদিক। দুই-বাংলার সুবিদিত রবীন্দ্রগবেষক ও রবীন্দ্রগায়িকা সন্‌জীদা খাতুনের ‘ছায়ানট’-এর সে এক সাড়ম্বর জাতীয় উৎসব। তখন পঁচিশে বৈশাখ আমাদেরও এমন প্রভাতী অনুষ্ঠান ছিল রবীন্দ্রসদন-প্রাঙ্গণে। তখনও ব্যক্তিগতভাবে চিনি না সন্‌জীদা খাতুনকে। পরে তিনি আমারও ‘সন্‌জীদাদি’ হবেন, তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করব, তাঁর সম্পাদনায় ছায়ানটের অভিজাত পত্রিকা ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ ছাপবে আমার একের-পর-এক সামান্যতর রচনা।

   সপ্রাণ আড্ডা ও গানের পটভূমিতে চকিতে কেঁপে উঠেছিল বটমূল। নিমেষে হাজারো শ্রোতা ছত্রভঙ্গ শক্তিশালী বোমা-বিস্ফোরণে। একটির পরে আর-একটি। মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে মানুষ। সকলেই দৌড়চ্ছে প্রাণভয়ে। বন্ধুরা কে কোথায় ছিটকে গেছে। ধোঁয়ায় জ্বলছে চোখ। মৃত্যুর সামান্য ব্যবধানে থমকে আছি। তারপর প্রাণ হাতে করে বিদেশের মাটিতে দিক্‌ভ্রান্ত পালাতে-পালাতে ভাবছি, সেই কবে আকবরবাদশা ইসলামি হিজরি-বর্ষগণনার বদলে প্রচলন করেছিলেন এই বঙ্গাব্দ, শেখ মুজিবুর রহমান প্রায়-সপরিবার প্রাণ দিয়েছেন একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশগড়ার লক্ষ্যে, আর, আজ, ধর্মচিহ্নবিহীন জাতীয় উৎসব বানচাল করে মৌলবাদীরা সেই স্বপ্নকেই তর্জনী দেখাল।

 মৃত্যু যদি সেদিন টেনে নিত আমাকেও, তাহলে নিহতের সংখ্যা বেড়ে হত এগারো।

poila baisakh nostalgia
Advertisment