Advertisment

পিতৃতন্ত্র ও যৌনতা: প্রাচীন বাংলা কাব্য থেকে উনিশ শতকের পরম্পরা

রাধা বললেন, ঝম্পি ঘন গরজন্তি সন্ততি~ ভুবন বরিখন্তিয়া, কান্ত পাহুন কাম দারুণ, সঘন খরশর হন্তিয়া। প্রকৃতি রাজ্যে এই মিলনের উৎসব, অথচ আমার গৃহ শূন্য। রাধা তখন নিজের জন্য এক নতুন স্বপ্নলোক বুনলেন।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Patriarchy in Old Bengali Text, Sexuality in Old Bengali Text

হ্লাদিনীশক্তি, পরা শক্তির অন্যতমা, স্বকীয়া।

বসন্তরঞ্জন রায় সম্পাদিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের তাম্বুলখণ্ডে বড়াই এর মুখে রাধিকার বর্ণনা একাধারে তীব্রভাবে পিতৃতন্ত্রের বদ্ধমূল ধারণায় যৌনতার ইঙ্গিতে পূর্ণ। অন্যদিকে অভিভাবক হওয়া সত্ত্বেও কৃষ্ণের কাছে রাধার এমন রূপকীর্তন অসংগত এবং অনৈতিক ও বটে।  শিরীষ ফুলের মতো কোমল তাঁর যৌবন, তাঁকে পাহারা দিতে এলেন কুট্টিনীসদৃশ বড়াই। বৃদ্ধা, শনের মতো চুল, কোটরে ঢোকা দুই চোখ, পাকা ভ্রূ, দেহ শিথিল। রাধা তাঁর নাতনি হন। সেই তিনি রাধার রূপজ মোহ জিইয়ে রেখে লম্পট রাখাল যুবককে বাধ্য করলেন রাধাকে ফুল তাম্বুলসহ প্রেমপ্রস্তাবে। আর ওমনি লাথি মেরে সমস্ত ফেলে দিলেন রাই। পিতৃতন্ত্র হুড়মুড়িয়ে এসে পড়ল। এত স্পর্ধা এই যুবকের। রাধা মনে করিয়ে দেন, তিনি সম্পর্কে মাতুলানী, আইহন তার স্বামী। তিনি বীর নির্ভীক। না, টলাতে পারলেন না। মাঝ যমুনায় প্রাণভয়ে ভীত বা অভিনয়ে যেন ভীত রাধাকে জোর করে ভোগ করলেন কৃষ্ণ। এতে কোনো অভিনবত্ব নেই, দু একটি পোয়েটিক ইমেজ ছাড়া। কিন্তু গোলমাল হল অন্য জায়গায়।

Advertisment

রাধা এই লাম্পট্যের পর নিজেকে আবিষ্কার করলেন যুবকটির যৌনস্তবে। নিজের চোখে অদেখা দ্বীপের মতো জেগে উঠলো তাঁর মনস্তাত্ত্বিক কামুকতার নিহিত অবচেতন। তাঁর দুটি উত্তোলিত বাহুডোর, স্তনশোভা, কনকপদ্মের কোরকের মতো তার আভা, কাহ্ন বিবশ এ হেন রূপে। এমন লালসার কাব্য নারীকে সাবজেক্ট হিসাবে জবরদস্ত্ ব্যবহার করলো। কানাই তাঁর মদন মহোৎসবে রাধা নামের এই বিবাহিতা অথচ কুমারী কন্যার মধ্যে বাসনার এক পুত্তলি গড়লেন। এবার আসা যাক বিদ্যাপতির সেই বহুচর্চিত পদটিতে।

আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের স্মৃতিকথন সিরিজ মনে পড়ে কী পড়ে না

বিদ্যাপতির মাথুরের একটি বহু পরিচিত পদ, এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর। রবীন্দ্রনাথ আপত্তি করে বলেছিলেন, সখীকে কি রাধা তবে দুঃখের পরিমাণ বোঝাচ্ছেন এভাবে বলে, নাকি পর পুরুষের প্রতি বিরহের বোধ আসলে সুখের। সুখ এবং দুঃখ দুই ই। অর্থাৎ প্রেমের তীব্র না পাওয়াও একরকম এণ্ডরফিনের সন্ধান দেয়, এক গভীর আত্মকেন্দ্রিকতা মুক্তি পায়, আহ্লাদ হয় অনুভবনের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কারের। তখন হ্যাপি হরমোনের কারণে সুখমিতি বা দুখমিতি বা। এর উৎস হল এই বিরহের পদটি। বলা যায়, রবীন্দ্রনাথের পরিণত আত্মদর্শনের ক্রিয়েটিভ ইউনিটি র তত্ত্বটি এর ওপর দাঁড়িয়ে আছে।

রাধা বললেন, ঝম্পি ঘন গরজন্তি সন্ততি~ ভুবন বরিখন্তিয়া, কান্ত পাহুন কাম দারুণ, সঘন খরশর হন্তিয়া।
প্রকৃতি রাজ্যে এই মিলনের উৎসব, অথচ আমার গৃহ শূন্য। রাধা তখন নিজের জন্য এক নতুন স্বপ্নলোক বুনলেন। মনে পড়বে আলব্যর কামু র সেই বিবাহিত মহিলার নিশাচরবৃত্তি। এ হেন অ্যাডাল্টেরি ১৫,১৬ শতকের মহিলাকে সাজে কিনা তা ভাবার অতীত। কিন্তু বিদ্যাপতি রাধাকে বিন্দাস একক আত্মরতিতে মগ্ন করে সুখানুভবে ব্রতী দেখালেন। হয়ত কবির অন্তরে কবির সচেতন দৃষ্টি তখনো সক্রিয়তা শেখেনি। এ হল সেই অর্ধমাগধী, যা তোমার আছে আর যা নেই ~ দুইই। ভাষার বা শব্দের সিগনিফায়ার ও সিগনিফায়েড দুইই কবির অপুষ্ট অবচেতনের সংকেতজনিত। এ ভাষা তাই আজও পারিনি আমরা ডিকোড করতে। ফ্রয়েডের পিতৃতান্ত্রিক ভুল দিয়ে একে পড়া সমীচীন নয়। কারণ, যিনি কলম ধরেন, তিনি এখানে একমাত্র ভাবয়িতা নন। মনের অনেক আয়না। সর্বোপরি, প্রেয়সীর অসহায় অস্বীকার, সামাজিক নিষেধ, নিজেকে নিষেধ, এ সবই এখানে বহুস্তরীয় মননশীলতার গতিস্পন্দ তৈরি করেছে। তাই যাকে রাধা বলে ডাকা হল, সে আসলে এ সবের মিলিত একটি বাসনাপূরণের ডিল্ডো। সেক্স টয়। সেমিওটিক বিশ্বে হয়ত এই আমাদের প্রাচীনতম সাংকেতিক পুনর্বাসন। পৃথিবীর সেরা নিষিদ্ধ বস্তু বা ট্যাবু। তাই পলিঅ্যান্ড্রিকে ১৭ ও ১৮ শতকে গৌড়ীয় দর্শনের সাহায্য নিয়ে আমরা বৈধ করে নিলাম। আর নষ্ট করলাম আমাদের ইমপারফেক্ট্ যৌনতার প্রকৃত প্রমাণ। দস্তখত মিটিয়ে দিলাম চৈতন্যচরিতামৃত দিয়ে। চতুর্থ পরিচ্ছেদ আদিলীলা ও ৮ম মধ্যলীলায় বারংবার বলতে হল, আসলে রাধা হলেন কৃষ্ণের একটি শক্তি। হ্লাদিনীশক্তি, যা ত্রি শক্তির মূল নিয়ন্ত্রী। তিনি পরা শক্তির অন্যতমা, স্বকীয়া। পরকীয়া নন।

জীবনস্মৃতি লেখার একটি অধ্যায়ে রবীন্দ্রনাথ যেখানে তাঁর তরুণ বয়সের নিশাচরবৃত্তি র কথা বলেছেন, তার সূত্রেই ঘর ও বাহির এর তত্ত্ব, একটি শেলি র স্কাইলার্ক আরেকটি ওয়র্ডসওয়ার্থের। কেন্দ্রগ ও কেন্দ্রাতিগ। লক্ষ্মী ও উর্বশী। আর যখন বাস্তবের অনুষঙ্গকে নতুন নির্মাণে মানসীমূর্তি তৈরি হয়েছে, তিনি ই কবির অন্তরের কবি , জীবনদেবতা। লেখার জীবনের মধ্যে কবির জীবন সম্মিলন খুঁজে পাচ্ছে। তাই চারুর জীবনে নষ্টনীড় এর ট্রমা , কিন্তু ভূপতির কাছে সেটাই উত্তরণ ও আবিষ্কার। ত্রিভুজের দুটো হাত এভাবেই অবচেতনলোক থেকে বৈধবিশ্বে পা রাখল। কিন্তু বিমলার জীবন ছারখার হল। চতুরঙ্গের দামিনী তার যৌন অবদমনের প্রক্রিয়া থেকে বেছে নিল বুকের ব্যামো, জীবদ্দশায় লেখক তাকে পথ দেখাতে অপারগ।

রাধার হ্যাং ওভার তার আগেও ছিল বঙ্কিমের শৈবলিনীর মধ্যে। প্রায়শ্চিত্ত বা নরকদর্শন সত্ত্বেও সে কি বাল্যবন্ধুকে ভুলতে পেরেছে! অপ্রকৃতিস্থ নারী তার স্বামীকে জিজ্ঞেস করেছিল, এক শাখায় আমরা দুইটি ফুল ফুটিয়াছিলাম, ছিঁড়িয়া পৃথক করিয়াছিলেন কেন। চন্দ্রশেখর উত্তর দিতে পারেননি। ভাগীরথীতীরে জলকল্লোলে কান পেতে তাদের প্রণয়ের সূত্রপাত প্রায় অপৌরুষেয়। কিন্তু বিবাহ নিষিদ্ধ। ফ্রয়েড, গিরীন্দ্রশেখর, লাকাঁ যা বলবেন, বঙ্কিমচন্দ্র তা প্রয়োগ করলেন শৈবলিনীর অবচেতন জগৎকে বোঝাতে। প্রশ্ন হল, শৈবলিনীর পরকীয়া কার সঙ্গে, প্রতাপ না চন্দ্রশেখর! প্রতাপ যখন জানলেন, বিবাহ সম্ভব নয়, তিনি একসঙ্গে জলে নিমজ্জিত হয়ে পরলোকে যৌথ জীবন দাবি করলেন। সম্মত হল না মেয়েটি। তার মনে হল, প্রতাপ আমার কে! সে ফিরে গেল। শুরু হল তার সামাজিক যুদ্ধও কিন্তু স্বামীকে সে স্বেচ্ছায় গ্রহণ  করেনি। তাই একদিন সে স্বামীকে ত্যাগ করে ঘর ছাড়ল। এই ওপেন এন্ডেড ন্যারেটিভ নতুন বাঁক নিল অগাধ জলে সাঁতার নামক পরিচ্ছেদে। প্রতিটা শব্দ এখানে মেয়েটির স্বপ্ন সম্ভাবনার। যা ক্ষণিকতাকে মেনে নিয়ে মুহূর্তের, এবং ফলত চিরন্তন। কিন্তু সেই স্বর্গ ভেঙে গেল প্রতাপের হীন শর্তারোপে। পিতৃতন্ত্রের দাঁত নখ বেরিয়ে এল। গোটা গল্পের অমিত সম্ভাবনা তছনছ হয়ে গেল একপাক্ষিক লিনিয়ারিটিতে।
কবিবল্লভ বললেন, সখি আমার অনুভবের কথা কী বা জানতে চাও ...সে পিরিতি ভাষায় বলতে বলতে তা তিলে তিলে নতুন হয়ে ওঠে। এর মানে বুঝতে হাজার বছর অতিক্রান্ত হল। প্রথমে তার অনুভব , স্থায়ী ভাব ও রসের প্রতিষ্ঠা। দ্বিতীয় স্তরে এল তাকে বাচ্যে প্রকাশ। সময়ের টান এখানে পৃথকমুখী ও জটিল। কারণ যা অনুভবনের মুহূর্ত, তা বলার সঙ্গে এক নয়। একটি অপরিকল্পিত, অপৌরুষেয়। অন্যটি ভিন্ন সময়ের তাগিদে পুনরুন্মীলন। আবার নতুন করে বলতে বলতে অনুভবন। এবার তা আরো পরিধি সঞ্চার করে বিরাট ও অতলস্পর্শ মনে হয়েছে, কারণ ভাষা একান্ত তার পরিচিত অন্বয় ও আয়তনে , প্রথায় ও সংস্কারে সীমাবদ্ধ। তার  বসন ভূষণ সমস্ত তামাদি। তাই তিলে তিলে উচ্চারণে তা ঘনীভূত সান্দ্র হয়ে অপরিমিত এক গভীরতার তল পাচ্ছে। এবং লক্ষ্য করুন এর ক্রিয়াবাচক কাল ~ রাধা বল্লেনঃ

জনম অবধি হাম                    রূপ নেহারলুঁ
নয়ন না তিরপিত ভেল
সোই মধুর বোল                     শ্রবণহি শুনলুঁ
শ্রুতিপথে পরশ না গেল।।
নিজেকে খণ্ডবিখণ্ডে টুকরো করে প্রতি জন্মের অনুপান দিয়েও তৃপ্তি এল না। না বলতে পারা অনুভবনের কানা উঁচু রেকাবিগুলি আজীবন ভরেও পারলেন না রাধা। কী পারলেন না ~ পারলেন না স্পর্শ করতে। পারলেন না পাওয়া কে ছুঁচের অগ্রভাগে নিজের শ্রুতিকে বিদ্ধ করতে। লীন হয়ে রইলেন মগ্নতায়। তাই এ নিরুক্ত। অপাপবিদ্ধস্নাবির। কেবল আছে, আছে, আছে। এর কোনো রেখা টানা নেই, কেবল বৃত্ত। কেবল সুর, কেবল প্রয়াস, নিশ্চেতন দামাল এক ঘুমের মতো হয়েই চলেছে। কাম্যু র সিসিফাস।
কিন্তু পূর্ণতার কনসেপ্ট যে একটা পলিটিক্স, যা ফ্রয়েড শিখিয়েছিলেন। তার বহু আগে,যুগান্তে দাঁড়িয়ে কবিবল্লভ বলেছেন ~
লাখ লাখ যুগ                               হিয়ে হিয়ে রাখলুঁ
তব হিয়া জুড়ন না গেল।।

দ্য অ্যাবসার্ড ম্যান মাল্টিপ্লাইজ হিয়ার এগেইন হোয়াট হি ক্যানট ইউনিফাই। তোমারেই যেন ভালবাসিয়াছি শতরূপে শতবার, জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।
কিন্তু তফাত এটাই যে শেষ হয় নি, এই না পাওয়া অনুভবের ভেতরে যে অনন্তের ঘূর্ণি, তার ক্ষুধা মেটে নি। এই আমাদের প্রথম ভবঘুরেপনা। আদি যাযাবরবৃত্তি। এর কোনদিন কোনো সমাপ্তিবাক্য নেই, হয়ত ভাষাও নেই। নিরালম্ব সুর এখানে সলিটারি। না সো নমণ না হাম রমণী। অচিন্ত্যভেদাভেদের ধারণার প্রপাত এখান থেকে শুরু।

(বল্লরী সেন গোখলে মেমোরিয়াল গার্লস কলেজের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক)

Advertisment