কবিতা - ১
রোজ যেটুকু বিকেল দিয়ে আমি হেঁটে যেতে চাই, সেখানে পরাবসন্তের আওয়াজ শুনতে পারি, শাল শিমূলের ন্যাড়া কাঠি হাত গুলো নেড়ে
নেড়ে গল্প করে মাত্রই কোনো ছুঁয়ে যাওয়া বেওয়াফা বাতাসের...
সদ্যজন্ম কোনো শিশুর নরম চুলের মতো ছুঁয়ে থাকে কাপড়ের খুঁট... পাহাড়... আমেরিকান ম্যাকাও...
বাবা ডিউটি যাওয়ার আগে ঘুমন্ত আমি'র কপালে হাত রাখত... উত্তরের শীতে বাবার স্নানশেষের ঠান্ডা আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে সেই ভোর ভোর
সকালে আমি ডাল ভাতের গন্ধ পেতাম... বাবার একটা খাকি রংয়ের সোয়েটার ছিল... আমি ঘুম ঘুম চোখে দেখতাম বাবার আবছায়া ছুঁয়ে
থাকে দরজার আলোর ওপাড়া.... পাহাড়... আমেরিকান ম্যাকাও...
কালিপোখরির জলে আমি বৌদ্ধ পতাকা ডুবতে ভাসতে উড়তে দেখেছি, তখন ঠান্ডা আর রাত লাফিয়ে পারদ নামার আগেই- মন্ত্রদের
বলতে শুনেছি "সব পেতে নেই কখনো, ফিরে আসতে গেলে বাকি রাখতে হয় খানিক"... এরপর এসে বসেছিলাম খাদের কিনারে, যেখানে
মেঘে পাহাড় নামে, ডিভিশন বেল বেঁধে ঘোড়া গরু ঘাস খোঁজে পাহাড় তটে... ওদের টুংটাং শব্দে লালবলের মতো সন্ধে গড়ায়, আবার
গাছেরা গন্ধ ছাড়ে, নির্জন তটে আমি বাবার গৃহস্থালি হাতের গন্ধ পাই, ডাল ভাতের... কয়লা রেখে হাত সেঁকে নিই, কয়লার গন্ধ ছুঁয়ে থাকে
রডোডেনড্রন... পাহাড়... আমেরিকান ম্যাকাও...
রাত বিরেতে সীমান্তে গিয়ে বসি, আদর মানুষদের ছাঁপিয়ে চাঁদ কাঁচুলি হয়ে যায় কাঁটাতারে, আর দুটো শরীরে ... আমি ভারতের শেষ গ্রামেএক চাষাবৃদ্ধের গল্প মনে করি, "আগার ইয়ে দো দেশ এক হোতা, তো কিতনে গীত, কিতনে সংস্কৃতি, কিতনে লোগ, কিতনে খানা খাজানা
রেহেতা হামেরা পাস"... কাঁটাতারের ওপাড়ে ঘুরন্ত আলো জ্বলে, পাহাড়ে জাহাজ নামে না কখনোই... কাঁটাতারের ওপাড়ে তারস্বরে ডেকেযায় কোনো পাহাড়ি কুকুর... বিনবিনে রাস্তা পেরিয়ে গভীর শীতে আবিষ্কার করি আমার একটা বুক চাই, দরকারী... সে সবটুকু কসমকশবেয়ে আমি নেমে আসি আল ধরে... শুকনো শীতের গন্ধ মেখে থাকে উড়ে এসে হুরমুরিয়ে পড়া মন্ত্রের ঝাঁক-".....বাকি রাখতে হয় খানিক...."বুকের বিনিময় প্রথা গড়াতে গিয়ে এসে ধাক্কা খায় সিপির বারান্দায়, আমি জীবন দেখি, দুহাতের তালুতে আঁজলা করে চুমু এঁকে রাখি
মুহুর্তে... বেহত ব্যথা দলছুট হয়ে নেমে যায় মাঠে ঘাটে... আবার শুনি ডিভিশন বেল, ঘরে ফিরতে ফিরতে গুঁতো গুঁতি করে... শরীর ঝুঁকিয়ে খুঁজে নিই দাগ গুলো, ক্র্যাশ ব্যারিয়ারে বসে পা নাচাই... বুকের বিনিময়ে যদি কড়ে আঙ্গুল টুকুও পেতাম, দুহাত জড়িয়ে দেখাতাম সব পেয়ে যাওয়ার পর শূন্যতায় একটা গোটা ব্ল্যাকহোল ঢুকে পড়ে, দেখাতাম ওরা সব আলো গিলে নেয়, পাহাড়, বাবার গন্ধ, টমের পুরানো বাড়ি বই সব গিলে নেয়... সব... সব... সব... আর উগড়ে দেয় রডোডেনড্রনের বীজ চারা গাছ.. ছায়া.. সারা বসন্তে রডোডেনড্রন আসলে ব্ল্যাকহোলের গল্প শোনায়...
মনে আছে, তোর আমার রডোডেনড্রন জন্ম দিয়ে আসার কথা ছিল....?
কবিতা- ২
আমরা যখন খুব কাছে থাকি কিছু মানুষের, শ্বাসে প্রশ্বাসে তার শরীরী অন্তঃস্থলের গন্ধ পেয়ে যাই লমহেতেই, ঘাড়ের গলার সন্ধিগ্রন্থের গন্ধ, নোনা সমুদ্রের ভিজে বাতাসের মতো সেই গন্ধের ঠিক সেইটুকুতে সুখ খুঁজে নিই ... ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে খোঁজা কোনো মুখের চিন্তার ছাপ থাকে সিগন্যালে দাঁড়ানো কোনো রাস্তার পাশে, সেই তো চেনা রাস্তা, পুকুর, দোকানপাট, গেরস্থালি...
জানি সমুদ্রগন্ধওয়ালা যুবক শরীর চায় কেবল... বরণডালার ওপর প্রদীপ জ্বেলে পুড়তে পুড়তে থাকার মতোন শরীর মেলে ধরি... কানের কাছে ফিসফিসানি সামাজিক যতকিছু উপেক্ষায় যে দেওয়াল ভাঙতে চেয়েছিলাম , সেই দেওয়ালের ঠোঁটের কাছে ঠোঁট রেখে বলে ফেলি "পাহাড় যাবি একবার....?" ওপাশে তখন কোরাসে বেজে যায় গর্জন, রিম্বিকে যেটুকু চাঁদ দেখা যায়, চাঁদের ষোড়শী তন্বী জলপদ্মের রেণু বানায় সুতো জুড়ে জুড়ে....
শহর থেকে ট্রাম উঠিয়ে নিলে কী হবে জানো, সমুদ্রগন্ধওয়ালা ছেলের?
বকেদের মতো ওরাও একদিন ফুল হয়ে যাবে... আর... আর... কোনো এক দুপুরে স্কুল ফেরত কোনো সন্তানের ভাতের থালায় আটপৌড়ি কোনো কুলবতী নারী হাতের চুড়ি নেড়ে সেই ফুলের বড়া ভেজে দেবে.... সমুদ্রগন্ধওয়ালা ফুলের বড়া...
তারপর আর সমুদ্রে গন্ধ থাকবে না... কোনোদিন