Advertisment

‌অনাবৃত ৩৩: গোয়েন্দার সন্দেহের তালিকায় মুকুর কেন এক নম্বরে?‌

সেদিন তো ফ্রেমটা নজরে পড়েনি!‌ মেহুল মেয়েটি কি এখান থেকেই ফটোটা চুরি করে নিয়ে যায়?‌- প্রচেত গুপ্তের ধারাবাহিক উপন্যাসের ৩৩ তম পর্ব প্রকাশিত।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Pracheta Gupta, Anabrito

অলংকরণ- অরিত্র দে

চারদিন ধরে বসন্ত সাহা একটা নোট তৈরি করেছেন। মুকুরের সিক্রেট ডায়েরিতে পাওয়া বিভিন্ন কথা, পুলিশের খোঁজ খবর এবং অল্প কিছু জিজ্ঞাসাবাদ থেকে এই নোট তৈরি হয়েছে। সবসময়ই এই নোটটা চোখের সামনে খুলে রেখেছেন বসন্ত সাহা। কখনও একটা পয়েন্ট কাটছেন, কখনও দুটো পয়েন্ট জুড়ছেন।

Advertisment

সুনন্দ এবং মেহুল দুজনের মোবাইল ফোনই সিজ্‌ করা হয়েছে। সেদিন যারা আমন্ত্রিত ছিল, তাদের সকলকেই  বারণ করা হয়েছে শহর ছাড়তে। কাজটা  জটিল। পুলিশ যখন কাউকে শহর ছাড়তে বা এলাকা ছাড়তে বারণ করে, তার মানে তাকে সন্দেহ করা হচ্ছে। কারও পক্ষেই এটা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। ধাক্কার মতো লাগে। রাগ, ভয়, অপমান অনেেকরকম রিঅ্যাকশন হতে পারে। এই রিঅ্যাকশনকে প্রায় কোনও পুলিশ অফিসারই গুরুত্ব দেয় না। রুটিন কাজ মনে করে। বসন্ত সাহা তা করেন না, গুরুত্ব দেন। বিশেষ করে যেসব ক্রাইমের পিছনে তথাকথিত ভদ্রলোকেরা থাকেন, তাদেরবেলায় তো বটেই।

আরও পড়ুন, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ছোটগল্প: গয়ানাথের হাতি

এখানে এই কাজটা করেছে সাগ্নিক। সকলের রিঅ্যাকশন রেকর্ড করা হয়েছে। কেউই জানতে পারেনি। মোবাইলে কথা বলার সময় রেকর্ডার অন করা হয়েছে। একমাত্র মুকুরের কাছে সারসরি বসন্ত গিয়েছিল। তার সঙ্গে শান্ত ভাবে কথা বলতে হয়েছে। শুধু  পারিবারিক ভাবে পরিচিত বলে নয়, সে একজন সদ্য স্বামী হারানো একজ মহিলা। স্বামীর মৃত্যুটাও মর্মান্তিক।

ছন্দা জিগ্যেস করেছিল, ‘‌আমি কি তোমার সঙ্গে যেতে পারি?‌’‌
বসন্ত সাহা বলেছিলেন,‌ ‘‌না। এটা অফিসিয়াল। তুমি আলাদা যেও।’
ছন্দা বলেছিল, ‘‌মুকু‌রের সঙ্গে তুমি অফিসিয়াল হতে পারবে?‌’‌
বসন্ত সাহা বলেছিলেন,‌ ‘‌তুমি তো জানো ছন্দা এই ঘটনায় আমি কত বড় আঘাত পেয়েছি। মুকুর একজন চমৎকার মেয়ে। খুব লাইভলি। যেটুকু মিশেছি ওকে  তোমার মতোই পছন্দ হয়েছে। তবে কী জানও মানুষের চরিত্র অত সহজে বোঝা যায় না।’‌
ছন্দা চমকে উঠে বলে, ‘‌তুমি কি মুকুরকেও সন্দেহ করছো নাকি?‌’‌
বসন্ত সাহা শান্ত ভাবে বললেন, ‘‌সন্দেহ সকলকেই করছি। আমাদের কাজের সেটাই যে নিয়ম তা তো তুমি জানো ছন্দা। মানুষের মন খুব জটিল। পুলিশি কায়দা কানুন দিয়ে তাকে চেনা খুব শক্ত। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট, এভিডেন্স, ক্লু, চেজ, সার্চ, ইন্টারোগেশন এসব দিয়ে কি আর সেই জটিল মন চেনা সহজ?‌ তারপরেও চেষ্টা করি।’‌
ছন্দা বলল, ‘‌তুমি সত্যি মনে করো মুকুরও বিষ মেশাতে পারে?‌’‌
‘‌এখনই বিশ্বাস করছি না। তবে এই কাজ করবার জন্য ওর পক্ষে যুক্তি আছে।’
ছন্দা কঠিন গলায় বলল, ‘‌কী সেই যুক্তি জানতে পারি?‌’‌
‌বসন্ত সাহা সামান্য হেসে বললেন, ‘জেনে কী করবে?‌ যুক্তি খণ্ডন করবে?‌’
‘‌চেষ্টা তো করব। অমন ভাল একটা মেয়ে, শান্ত ভদ্র প্রানবন্ত, তাকে তোমরা পুলিশি নিয়মে সন্দেহের তালিকায় রাখবে আর আমি মেনে নেব তা তো হয় না। পুলিশ না হতে পারি আমাদেরও তো কিছু বুদ্ধিসুদ্ধি আছে। তোমাদের মতো গায়ের জোর না থাকুক, মাথার জোর তো রয়েছে।’‌
বসন্ত সাহা বললেন, ‘‌বুঝতে পারছি রেগে গেছ, আমি মুকুরকে সন্দেহের তালিকায় রাখায় বিরক্ত হয়েছ। কিন্তু কোনও উপায় নেই যে ম্যাডাম। তুমি শুনলে আরও রেগে যাবে, এখন পর্যন্ত তার ওপর আমার সন্দেহ সব থেকে বেশি।’‌
ছন্দা বলল, ‘‌সেকী!‌ কী বলছো এসব!‌’
‌বসন্ত সাহা গম্ভীর মুখে বললেন, ‘খুব দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, কিন্তু সন্দেহ থেকে তো বেরোতে পারছি না। ছন্দা, সুনন্দর এই মৃত্যু আমাকে নাড়া দিয়েছে খুব বেশি। মেহুল মেয়েটিকে আমি পারসোনালি চিনি না। তাই তার দুঃখজনক মৃত্যুকে প্রফেশনালি দেখছি। একজন গোয়েন্দা অফিসার হিসেবে। কিন্তু সুনন্দকে তো চিনতাম। আমাকে বাইরে থেকে দেখে বোঝা যাচ্ছে না। বই পড়ছি, ছবি দেখছি, গান শুনছি ঠিকই, কিন্তু ভিতরে ভিতরে খুবই ডিসটার্বড। আবার মনে মনে শক্তও হচ্ছি। সবথেকে বড় আপশোসের বিষয় কী জানো ছন্দা?’‌
ছন্দা ভুরু কুঁচকে বলেছিল, ‘‌কী ‌?‌’‌
বসন্ত সাহা বললেন, ‘ঘটনাটা আমার সামনে ঘটল। বারবার মনে হচ্ছে, যে কাজ করেছে তার কাছে এটাই অ্যালিবাই ছিল। একজন সিনিয়র পুলিশ অফিসারের সামনে কী করে খুন হবে?‌ এত বড় বোকামি কে করবে?‌ সুতরাং এটা কোনও ক্রাইম নয়, নিছকই একটা দুর্ঘটনা। একথাটাই সে বোঝাতে চেয়েছে। ফুড পয়েজনিং তো হতেই পারে। কতই তো হয়। সুনন্দর হার্ট উইক ছিল বলে সামলাতে পারেনি। এই যুক্তি সাজাবে বলেই খুনি এই পার্টিকে বেছে নিয়েছিল। যদি অনুকূলবাবুর সঙ্গে আমার দেখা না হত, যদি উনি সালফিউরিক অ্যাসিডের গন্ধের কথা না বলতেন, আমি কোনও সন্দেহই করতাম না। অটপসি রিপোর্টের কথা ভাবতামও না। রুটিন চেক হয়ে বেরিয়ে যেত। তারপরে মেহুল নামের মেয়েটির মৃত্যুও আমাকে অ্যালার্ট করত। তাও করত না যদি সেদিনের গেস্টদের মধ্যে আরও কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়ত। জেনারেল ফুড পয়েজনিং। তা হয়নি। তবে?‌ একটাই উত্তর। খুনি ভেবেচিন্তে জায়গাটা বেছেছিল। সেটা ভেস্তে গেছে। আর.‌.‌.‌আর, ভাবতে খারাপ লাগছে, এই কাজটি করবার সবথেকে বেশি চান্স  মুকুরের। সে নেমন্তন্ন করেছে। গেস্টদের তালিকায় আমাকে রেখেছে। ’‌

ছন্দা বলল, ‘‌মোটিভ কী?‌’‌
বসন্ত সাহা অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, ‘অনেক। সম্পত্তি থেকে প্রেম সব কিছু হতে পারে। আর একটা তো রয়েছেই। মুকুরের মা হওয়া নিয়ে সমস্যা ছিল।’
‌ছন্দা খানিকটা অবাক হয়ে বলল, ‘‌ছিল বলছো কেন?‌ এখনও তো রয়েছে।’‌
বসন্ত সাহা থমথমে মুখে বললেন, ‘‌না, এখন আর সমস্যা নেই।’‌
ছন্দা বলল, ‘‌মানে!‌’‌
বসন্ত সাহা বললেন,‘ মুকুর ইজ প্রেগন্যান্ট। আমার কী সন্দেহ হচ্ছে জানো ছন্দা?‌ সন্দেহ হচ্ছে, ফ্ল্যাটের ওয়ান ইয়ার সেলিব্রেশন নয়, এই সুখবরটাই সেলিব্রেট করতে চেয়েছিল মুকুর।’‌
ছন্দা বলল, ‘‌কী বলছো এসব? তাহলে তো ঘোষণা করত।‌’‌
বসন্ত সাহা বললেন, ‘আর যদি এমন হয় ঘোষণা করা না যায়। সন্তানের পিতাটি কে তাই নিয়ে যদি সংশয় থাকে?‌’‌
ছন্দা খানিকটা গলা চড়িয়ে বলল, ‘‌চুপ করো, চুপ করো। আমি এসব বিশ্বাস করি না। মুকুর একটা সুন্দর স্বভাব চরিত্রের মেয়ে। বাচ্চা হওয়ার জন্য ও চিকিৎসা করছিল। নিশ্চয় সেটার রেজাল্ট পেয়েছে।’‌
বসন্ত সাহা সামান্য হেসে বললেন, ‘বিশ্বাস করছো না করতে চাইছ না?‌ আমিও করতে চাইছি না। নিজের সন্দেহ  আমাকে নিজেই নিরসন করতে হবে। ‌সেই কার‌ণেই আমি মুকুরের কাছে যাচ্ছি। ওর সঙ্গে কথা বলব।’‌

মুকুর বিধ্বস্ত, কিন্তু নিজেকে বাইরে থেকে শক্ত করে রেখেছে। নিজের হাতে কফি করে নিয়ে এল। বসন্ত সাহা একবার ভাবলেন, বারণ করি। তারপর ভাবলেন, না থাক। যতটা স্বাভাবিক ভাবে থাকতে চায় থাকুক। মুকুর কারও সঙ্গেই দেখা করছে না। কোনও ফোনও ধরছে না। আত্মীয়স্বজন কয়েকজন এসে থাকতে চেয়েছিল, অ্যালাও করেনি। শুধু স্কুলের কলিগরা এসেছিল, তাদের সঙ্গে কথা বলেছে।

আরও পড়ুন, ধুলামাটির বাউল: কচিদিদার প্রজ্ঞা

বসন্ত সাহা কফির মগে হাতে নিয়ে একবার থমকালেন। বিষের কথা মনে পড়ে গেল। মনে পড়তেই দ্রুত চুমুক দিলেন।
‘‌তোমার বউদিও আসতে চাইছিল। আমিই বারণ করেছি। মুকুর, আমি এসেছি ডিউটিতে।’‌
মুকর একটা হলুদ রঙের সুতির শাড়ি আর সাদা ব্লাউজ পরেছে। প্রসাধনহীন মুখে বিষণ্ণ, খানিকটা ক্লান্তও। চুলে তেল শ্যাম্পু কিছু দেয়নি। বসেছে সোফার এক কোনায়।

‘‌বসন্তদা, আমি জানি আপনি ডিউটিতে এসেছেন। ঘটনার দিন আমরা যখন হাসপাতালে, আপনি এসে বাড়ি সার্চ করেছেন।’‌
বসন্ত সাহা চমকে উঠতে গিয়েও নিজেকে সামালেন। এই মেয়ে বু্দ্ধিমতী। সাধারণ বুদ্ধি নয়, বেশি বুদ্ধি। একে কিছু লুকিয়ে লাভ নেই।
‘‌প্লেস অব্‌ অকারেন্স তো এটাই মুকুর। যত তাড়াতাড়ি একবার দেখে নেওয়া যায় তত ভাল। তাও তো খাবারের কোনও নমুনা সংগ্রহ করতে পারা যায়নি।’‌
মুকুর বলল, ‘সেদিন রাতে কেটারারকে সব খাবার নিয়ে যেতে বলি।’‌
বসন্ত সাহা বললেন, ‘‌স্বাভাবিক। আমিও তাই করতাম। আচ্ছা, মুকুর এই অকেশনটা তুমি কেন অ্যারেঞ্জ করেছিলে?‌ শুধুই কি ফ্ল্যাটের এক বছর উপলক্ষে?‌’‌
মুকুর নিচু গলায় বলল, ‘‌না। এই ফ্ল্যাটে যখন আসি তখন অনেককে বলতে পারিনি। তাদের নিয়ে একটা গেটটুগেদার করবার জন্যই এটা করি। এখন মনে হচ্ছে, সব কিছুর দায়ী আমি। আমি যদি এই অকেশনটা না করতাম, কিছুই হত না।’‌

কথা শেষ করে নিচু হয়ে মুখে হাত চাপা দিল মুকুর। আর তখনই মাথার ঠিক পিছনের দেয়ানে নজর পড়ল বসন্ত সাহার। দেয়ালে কিউরিও সাজানোর তিনটে তাক। মাঝের তাকে একটা শূন্য ফটোফ্রেম। পোস্টকার্ড মাপের একটা ফটো ঢুকে যাওয়ার মতো ফ্রেম। চমকে উঠলেন বসন্ত সাহা। সেদিন তো ফ্রেমটা নজরে পড়েনি!‌ মেহুল মেয়েটি কি এখান থেকেই ফটোটা চুরি করে নিয়ে যায়?‌
————

Anabrito
Advertisment