/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/06/anabrito-1-759.jpg)
অলংকরণ- অরিত্র দে
এক
হৈমন্তী এখন নগ্ন। পুরো নগ্ন নয়, তার গায়ে লেগে রয়েছে জলের গুঁড়ো। তাতে নরম আলো চিক্চিক্ করছে। তাকে দেখাচ্ছে রহস্যময়ী।
কিছু সৌন্দর্য আছে ধোঁয়ার মতো। সরে গেলেও মনে হয়, রয়ে গেছে। এই সৌন্দর্যকে বলে ‘স্মোকড্ বিউটি’। হৈমন্তীর সৌন্দর্য হল সেই ‘স্মোকড্ বিউটি’। সামনে থেকে চলে যাওয়ার পরেও মনের ভিতর খানিকক্ষণ ঘোর থেকে যায়। ছোটোবেলা থেকেই সে সুন্দর। যত বয়স বেড়েছে এই ‘সুন্দর’-কে সে যত্ন করেছে। ঘসে মেজে ঝকঝকে রেখেছে।
হৈমন্তীর বয়স খুব কম নয়। চৌত্রিশ বছর দু’মাস। দেখলে বোঝা যায় না। দু’মাস আগে সে কলিগদের নিয়ে জন্মদিনে পার্টি করেছে। পার্টিতে নানা ধরনের মজা ছিল। যেমন আর পাঁচটা পার্টিতে থাকে। ডংকি ডান্স, মিমিক্রি, হাউ টু প্রোপোজ। এইসব খেলা খুব জমেছিল। হৈমন্তী আরও একটা খেলা যোগ করে দিল। ‘গেস দ্য এজ’। বয়স আন্দাজ করতে হবে। যে হৈমন্তী সেনের বয়স ঠিক বলতে পারবে সে পাবে প্রাইজ। প্রাইজ হল একটা রেড ওয়াইনের বোতল আর সঙ্গে একটা চুমু। কেউ পারল না। হৈমন্তী মজা এখানে শেষ করতে দেয়নি।
‘"ওকে বয়েজ অ্যান্ড গার্লস, আমি আমার বয়স দু’বছর কমিয়ে নিলাম। এবার বলো।" তখনও হলো না। হৈমন্তী মিটিমিটি হাসল।
"আচ্ছা, আরও দুই কমাচ্ছি।"
তারপরেও কেউ আটাশের বেশি উঠতে পারল না।
হৈমন্তী বলল, "আরও দুই কমাব? নাকি এক বাড়াব?"
মনানি নামের একটা মেয়ে কদিন হল অফিসে জয়েন করছে। মহারাষ্ট্রের মেয়ে। সে খানিকটা ভাবনাচিন্তা করে বলল, "ম্যাডাম, আমার মনে হচ্ছে, আপনাকে আরও সিক্স মান্থস বাড়াতে হবে। নো, সিক্স মান্থস্ অ্যান্ড টু উইকস্।"
ছ’মাস শুনে সবাই ‘হো হো’ করে হেসে উঠল। এতো নির্দিষ্ট করে কেউ উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেনি। একেবারে মাস, সপ্তাহের হিসেব।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/06/anabrito-part-1-inline.jpg)
"উত্তর ঠিক হয় নি, কিন্তু ইওর এফর্ট ইজ ভেরি অনেস্ট। তাই মনানি, তোমাকেই প্রাইজ দেওয়া হবে।"
শ্যাম্পেনের বোতল হাতে দিয়ে, মনানির গালে চুমুও খেয়েছিল হৈমন্তী। মনানি বসের চুমুতে আপ্লুত।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার, পার্টির খেলায় চুমুর ব্যবস্থা ছিল বলে হৈমন্তীকে হালকা ধরনের মেয়ে ভাববার কোনও কারণ নেই। বাইরে সে একরকম, আবার কাজের জায়গায় খুব কড়া বস। তার ব্যক্তিত্বের কারণে ডিপার্টমেন্টে সবাই তাকে সমঝে চলে। এমনকি তার ওপরে যারা আছে, তারাও সমীহ করে। বুঝে শুনে কথা বলে। আগের অফিসে সে তার জেনারেল ম্যানেজারকে জোর শায়েস্তা করেছিল। সেই গল্প কারও জানার কথা নয়। তারপরেও কীভাবে যেন নতুন অফিসের অনেকে জেনে ফেলেছে। কপোর্রেটে খবর চাপা থাকে না।
ঘটনা খুবই মজার। একই সঙ্গে দুটো হৈমন্তীকে পাওয়া যাবে। একজন ঠান্ডা মাথার, অন্যজন খুব তেজি।
বছর পঁয়তাল্লিশের সেই জেনারেল ম্যানেজার একদিন হৈমন্তীকে ঘরে ডেকে একথা সেকথা বলবার পর নিচু গলায় বলেছিল, "আজ তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে হৈমন্তী। শুধু সুন্দর নয়, ভেরি অ্যাট্রাকটিভ। খানিক আগে তোমাকে করিডোরে দেখেই আই ফেল্ট লিটল বিট্ এক্সাইটেড।’
হৈমন্তীর এই কথা একেবারেই পছন্দ হল না। তারপরেও নিজেকে সামলে হাতের মোবাইলটাকে নাড়াচাড়া করতে করতে বলল, "থ্যাঙ্কু স্যার। আমাকে কী জন্য ডেকেছেন যদি দয়া করে বলেন।"
জেনারেল ম্যানেজার এই কথায় কান দেয় না। উঁচু পিঠের চেয়ারে হেলান দিয়ে বলে, "যদি চাও তুমি আজ আমার সঙ্গে বাইরে লাঞ্চ করতে যেতে পারো। শর্ত একটাই, মুখোমুখি নয়, বসতে হবে পাশাপাশি। উইথ সাম টাচেস। তোমার মতো সুন্দরীর স্পর্শ পাওয়া ভাগ্যের।"
হৈমন্তীর মাথায় রক্ত ওঠে। সে মোবাইল ফোন হাত বদল করে বলে, "স্যার, সরি।"
জেনারেল ম্যানেজার এবারও সে কথায় গুরুত্ব না দিয়ে বলে, "তারপর যদি মনে করো, আমরা লং ড্রাইভে যেতে পারি। বারুইপুরের কাছে একটা বাগান কিনেছি। যাবে নাকি? তোমার মতো একজন সুন্দরী আমার বাগান অ্যাপ্রিশিয়েট করলে খুব খুশি হব। ওখানে একটা গেস্ট হাউস করেছি। মাটির দেওয়াল, খড়ের চালা। তবে ভিতরের এভরি অ্যারেঞ্জমেন্ট ইজ ভেরি মর্ডান। ইচ্ছে করলে সেখানে খানিকটা বিশ্রাম নিতে পারবে।"
হৈমন্তী বলল, "থ্যাঙ্কু স্যার। কিন্তু...।"
জেনারেল ম্যানেজার স্বর গাঢ় করে বলল, "কোনও কিন্তু নয়। প্লিজ হৈমন্তী। তোমার প্রোমোশন প্রোপোজাল আমার হাতে। কালই ছেড়ে দেব।"
হৈমন্তী ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে হতাশ গলায় বলল, "সবই ঠিক আছে, লাঞ্চ, বাগান, গেস্টহাউস, আমার প্রোমোশন, তারপরেও সরি স্যার। আমি সুন্দরী, কিন্তু আপনি যে খুবই বিশ্রী। এত আগলি যে আমার পক্ষে আপনার পাশে বসে লাঞ্চ করা অসম্ভব। আপনার বাগানে বেড়াতে যাওয়া বা গেস্ট হাউসে বিশ্রাম নেওয়ার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না।"
জেনারেল ম্যানেজার চোখ মুখ লাল করে বলে, "এটা কি একটু বেশি হয়ে গেল না হৈমন্তী?"
হৈমন্তী শান্তভাবে বলেছিল, "না স্যার, বেশি হয় নি। এই ধরনের ইনডিসেন্ট প্রোপোজাল কীভাবে ট্যাকল্ করতে হয় আমার জানা আছে। আপনি যদি এখনই আমাকে সরি না বলেন, আমি ব্যবস্থা নেব এবং তখন আপনি বুঝতে পারবেন বেশি হওয়া কাকে বলে।"
জেনারেল ম্যানেজার রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলেছিল, "কী ব্যবস্থা নেবে?"
হৈমন্তী আরও শান্তভাবে বলল, "প্রপার ফোরামে কমপ্লেন করব।"
জেনারেল ম্যানেজার চেয়ার ছেড়ে উঠে হুংকার দিয়ে বলে ওঠে, "যেখানে খুশি কমপ্লেন করো। আমিও বলব, ব্ল্যাকমেইল করছ। তোমার মতো মেয়েদের আমার জানা আছে। শরীর দেখিয়ে অফিসে সুযোগ নাও। আমিও বলব বিছানায় যেতে রাজি হই নি তাই...আমি তোমাকে...তোমাকে সাসপেন্ড করব।"
হৈমন্তী বলল, "শান্ত হোন স্যার। প্রেসার বাড়বে।"
জেনারেল ম্যানেজার দাঁতে দাঁত চেপে বলে, "ইউ স্কাউন্ড্রেল...।"
হৈমন্তী বড় করে নিঃশ্বাস টেনে বলল, "স্যার, ভেবেছিলাম সরি বললে ভুলে যাব। কিন্তু এখন তো আর পারব না। শাস্তি একটু বাড়াতে হচ্ছে। আপনি হাত জোড় করে আমাকে সরি বলবেন। নইলে ছাড় পাবেন না। ছোটো বিষয়টাকে আপনি বড় করলেন। ছোট্ট একটা সরি’তে মিটে যেত। আপনি মিটতে দিলেন না। নিন এবার হাত জোড় করে ক্ষমা চান।"
জেনারেল ম্যানেজার হিসহিসিয়ে বলল, "ইউ ডটার অফ আ বিচ্, গেট আউট ফ্রম মাই রুম।"
হৈমন্তী বলল, "আপনি আননেসেসারি ইস্যুটাকে বড় করে ফেললেন। আপনি ভাল করেই জানেন, আমি যদি কমপ্লেন করতে শুরু করি আপনার কেরিয়ার শেষ হয়ে যাবে। আমি কোনও ভীতু, নরম ধরনের মেয়ে নই। আমি যেমন সুন্দরী তেমন সাহসী ও কঠিন। তারপরেও আপনি আমার থেকে বয়সে বড়, পজিশনে বড়, সোশ্যাল প্রেস্টিজ রয়েছে, তাই আপনাকে লাস্ট সুযোগ দিচ্ছি। শাস্তিটাকে একটু বাড়িয়ে দিচ্ছি মাত্র। আপনি টেবিল থেকে বেরিয়ে এসে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসুন। তারপর হাত জোড় করে সরি বলুন। আমি ঘটনা ভুলে যাব, আপনিও ভুলে যাবেন। আপনাকে তাড়াহুড়ো করতে হবে না। আমি নিজের রুমে যাচ্ছি। মাথা ঠান্ডা করে ভাবুন স্যার। ভাবনা শেষ হলে আমাকে ডেকে পাঠাবেন। কেউ জানবে না। দরজার বাইরে বিজি আলো জ্বালিয়ে দেবেন। লাল আলো জ্বালিয়ে যদি কলিগকে শোবার প্রস্তাব দেওয়া যায়, হাঁটু গেড়ে বসে ক্ষমাও চাওয়া যায়।"
জেনারেল ম্যানেজার, "তুমি কি আমাকে স্কুলের ছেলে পেয়েছ?"
হৈমন্তী একটু হেসে বলল, "না স্যার পাইনি। স্কুলের ছেলে হলে কান ধরে পঁচিশবার ওঠবোস করতে বলতাম। লজ্জার কিছু নেই। কোনও মেয়েকে গেস্ট হাউসে নিয়ে যাব বলতে লজ্জা না করলে তার সামনে কান ধরে ওঠবোস করতে লজ্জা কী? আরও গালাগালি করলে কিন্তু তাই করতে হবে স্যার। যাক্, আপনি ভাবনা চিন্তা করুন, আমি ততক্ষণে কমপ্লেন রেডি করছি। ঠিক এক ঘন্টা অপেক্ষা করব।"
"প্রমাণ কী?"
হৈমন্তী হেসে বলল, "আপনি কথা শুরু করবার সময়েই, মোবাইলের রেকর্ডার অন করেছি। শুনবেন?"
পনেরো মিনিটের মধ্যে সেই জেনারেল ম্যানেজার হৈমন্তীকে আবার ঘরে ডেকে পাঠায়। বাইরের লাল আলো জ্বালিয়ে দেয়। একমাসের মধ্যে লোকটি কাজ ছেড়ে দেয়। ঘরের পিওনের মাধ্যমে খবর চাউরও হয়। সত্যি মিথ্যে মেশানো খবর। তারও এক বছর পর হৈমন্তী নতুন চাকরিতে চলে আসে।
একটি বিদেশি প্রসাধন কোম্পানি। বিভিন্ন দেশে তাদের অফিস এবং ল্যাবরেটরি। এদেশে হৈমন্তী চিফ্ কেমিস্ট। পুনেতে প্রসাধনের মতোই ঝকঝকে চকচকে তার অফিস। সঙ্গে ল্যাবরেটরি। সব মিলিয়ে তার ডিপার্টমেন্টে বারোজন কাজ করে।
আজ শনিবার। অফিস নেই। হৈমন্তী সময় নিয়ে স্নান করছে। জামা কাপড় খোলায় তাকে বেশি সুন্দর লাগছে। মেদহীন শরীর। যেখানে যতটুকু রূপ থাকা উচিত, তাই রয়েছে। কোথাও রয়েছে প্রকাশ্যে, কোথাও একটু আড়ালে। জলের গুঁড়ো মাখা হৈমন্তীকে যেমন রহস্যময়ী লাগছে তেমন মায়াময়ও লাগছে। সে একজন বাথরুমবিলাসী নারী। এই বাথরুমটাও সাজানো গোছানো। সব ধরনের আধুনিক আয়োজন আছে। বাথটব, শাওয়ার কিউবিকল্ তো আছেই, আছে বসে বই পড়া বা গান শোনবার ব্যবস্থা। আলোটাও সুন্দর। নীল ও নরম।
শাওয়ারের কিউবিকলে দাঁড়িয়ে স্নান করছে নগ্ন হৈমন্তী। চারপাশ থেকে জলধারা এসে তাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। কিউবিকলগুলোর এটাই মজা। সবদিকে শাওয়ার লাগানো। জলের কণায় কিউবিকেলের কাঁচ ঝাপসা। হৈমন্তীকে দেখাচ্ছে জল দিয়ে আঁকা ছবির মতো। একটা শরীর যা আছে, আবার নেইও।
(ক্রমশ)