Advertisment

রবীন্দ্রভারতী, রোদ্দুর রায় ও ইন্টারনেটের খাপ বিশেষজ্ঞরা

যাঁরা 'এদের মুন্ডু কাটো' বা 'এন-আর-সি থাকলে এদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিতাম' বলে লাফাচ্ছেন, তাঁরা সরাসরি গণতন্ত্রবিরোধী, অথবা প্রখর গাম্বাট। অবশ্য দুটো একসঙ্গে হলেও কেউ আটকাবেনা।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Rabindra Bharati, Roddur Roy

মেয়েটির বা মেয়েদের খোলা পিঠ তাদের, তারা কী লিখবে তাদের ব্যাপার।

প্রশ্নটা রোদ্দুর রায়ের গান ভালো কি ভালো নয় সে নিয়ে একেবারেই নয়। প্রশ্নটা এই নিয়েও নয়, যে, ওই ইশকুল-কলেজের মেয়েগুলি প্যারডি গেয়ে বা খোলা পিঠে তথাকথিত অপশব্দ লিখে মহৎ শিল্প করেছে কিনা। রোদ্দুর রায়ের গান কারও অত্যন্ত খারাপ, এমনকি অশালীন লাগতেই পারে। মেয়েগুলির কাজকর্ম দেখলেও 'ছ্যাছ্যা-ছিছি/ একি রুচি / একি রুচি' বলে হাত ঘুরিয়ে রবীন্দ্রনৃত্য নাচার ইচ্ছেও হতে পারে। সেসব কেউ আটকাবেনা, আটকানোর প্রশ্নও নেই। কিন্তু কথা হচ্ছে থানা-পুলিশ-গার্জেন কল এবং মুচলেকা নিয়ে।

Advertisment

এসব নিয়ে যে কাণ্ড ঘটে গেল, যাকে নাটক বললে নাটকের এবং যাত্রা বললে যাত্রার অপমান হয়, তাতে, পরিষ্কার বোঝা যায়, যে, বাকস্বাধীনতা খায়, না পশ্চাদ্দেশ মুছে ফেলে দেয়, এই জ্ঞানগম্যিটুকুও ইন্টারনেটের খাপ বিশেষজ্ঞদের নেই। সেই কারণেই বহুশ্রুত কথাগুলো আরও একবার বলে ফেলা যাক। আপনার ভিডিওতে কোনো বস্তু শুনলে গা জ্বলে যেতে পারে। কোনো কথা শুনলে কাউকে চাবকাতে ইচ্ছে হতে পারে। কোনো গান শুনলে ব্রহ্মতালুতে আগুন জ্বলে যেতে পারে। নরম অনুভূতিতে ছানা কেটে যেতে পারে। সবই হতে পারে। আপনি সেসবের বহিঃপ্রকাশও ঘটাতেই পারেন।

“দাদুর প্রতি আমার অসীম প্রেম আছে”: রোদ্দূর রায়ের একান্ত সাক্ষাৎকার

অনুভূতিতে ছানা কেটে গেলে বাণীর সন্দেশ তৈরি করুন। 'এগুলো গান না নর্দমার জল?' বলে তেড়ে গাল দিন। ব্রহ্মতালু খুব গরম হয়ে গেলে লাগান ঘৃতকুমারী। বা বাথরুমে ঢুকে বসে থাকুন। যা খুশি আপনি করতেই পারেন। কিন্তু স্রেফ আপনার অনুভূতিতে লেগেছে বলে কাউকে পুলিশের বাটাম দিতে পারেননা। জেলে পুরতে পারেনই না। আপনার যা পরম পূজ্য মনে হয়, তা অন্য কারোর দুচ্ছাই মনে হতেই পারে। আবার আপনি যা দুচ্ছাই করেন, তা অন্য কেউ মাথায় তুলে রাখতেই পারে।

উভয় পক্ষকে বলতে দেবার নামই হল বাক স্বাধীনতা। সংখ্যাগরিষ্ঠ যা পছন্দ করছেনা, তাও বুক বাজিয়ে বলতে পারার নামই হল গণতন্ত্র। সেই অধিকার যদি কাউকে দিতে আপনি না পারেন, তাহলে গণতন্ত্র টন্ত্র চুলোয় গেছে, ওসব আপনি মানেননা পরিষ্কার বলে দিলেই হয়। তাই যাঁরা, 'এদের মুন্ডু কাটো' বা 'এন-আর-সি থাকলে এদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিতাম' বলে লাফাচ্ছেন, তাঁরা সরাসরি গণতন্ত্রবিরোধী, অথবা প্রখর গাম্বাট। অবশ্য দুটো একসঙ্গে হলেও কেউ আটকাবেনা।

এঁদের আজ অনুভূতিতে খুবই আঘাত লেগেছে, হতেই পারে। হতে পারে কেন, সত্যিই লেগেছে। কিন্তু তার পরেও যে বোধবুদ্ধিটুকু এঁরা হারিয়েছেন, তা হল আজ 'আমাদের অনুভূতিতে লেগেছে, দাও ব্যাটাদের বেনাগরিক করে' বলে যখন চেঁচাচ্ছেন, তখন, একটা বিপজ্জনক রাস্তা খুলে দিচ্ছেন। সেটা হল অনুভূতিতে আঘাত লাগলেই সত্যিই বা প্রতীকী ভাবে কাউকে কেটে ফেলা যায়। এবং এই বিপদ আপনাদেরও ছাড়বেনা। আপনাদেরও কোনো কথায় যেকোনোদিন কারো অনুভূতিতে লাগতে পারে।

অশ্লীলতার দায় বড় দায়, বিশেষত এ রাজ্যে

তখন আপনাদের 'মেরে ফেল কেটে ফেল ' বলে অন্য লোকেরা আওয়াজ তুললে, নিজেদের স্বকপোলকল্পিত দেবালয় একটুও টিকবেনা। তখনও আপনারা চেঁচাবেন নিশ্চয়ই, কিন্তু সেটা আর্তনাদ। সতীদাহের হরিবোলের মতো যে আর্তনাদ জনতার ফুর্তির ঢাকঢোলেই চাপা পড়ে যাবে। অবশ্য এঁরা বলতেই পারেন, আমরা কেন কারো অনুভূতিতে আঘাত দেব। আমরা তো সাতে পাঁচে থাকিনা, গোলমাল দেখলে বাথরুমে ঢুকে নিরাপদে বসে থাকি।

কিন্তু হিসেব যে অত সোজা নয়, আপনিও জানেন, আমিও জানি। প্রতিটি ব্যাপারেই খাটের নিচে সেঁধিয়ে যেতে পারলে আপনি এই নিয়েও হট্টগোল করতেননা। এঁরা না হয়, গণতন্ত্রবিরোধী, কিন্তু আশ্চর্যজনক এই, যে, আরেকদল আছেন, যাঁরা নারীশরীরের অধিকারের স্বঘোষিত মুখপাত্র, অর্থাৎ কিনা লিবারাল ও শাইনিং। তাঁরাও গলা তুলে বলতে পারছেন না বাকস্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের কথা। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলতে হচ্ছে, 'রবীন্দ্রগানে খিস্তিখাস্তাকে অশ্লীল বলছ, যখন দিল্লির মানুষগুলো লাশ হয়ে যায় একে একে, সেটা অশ্লীল লাগেনা? যখন একজন ছাত্রকে এন-আর-সি বিরোধী কথা বলার জন্য দেশছাড়া করা হয়, তখন তোমরা কোথায় থাক?'

মজা হচ্ছে, অন্যান্য সময়ে এই যুক্তিপদ্ধতিকে ওঁরাই তার-বেলা-পনা বা হোয়াটাবাউটারি বলে থাকেন। আমরা সেটা বলব না। কারণ এর প্রতিটি বক্তব্যই খুব জরুরি। কিন্তু এই ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক। এখানে প্রাসঙ্গিক যে কথাটা, সেটাই শুধু স্পষ্ট করে বলে দেওয়া যাক। মেয়েটির বা মেয়েদের খোলা পিঠ তাদের। তারা কী লিখবে তাদের ব্যাপার। অপছন্দ হলে নিশ্চয়ই নিন্দেমন্দ করা যেতে পারে। কিন্তু তারপরেও তারা নিজের পিঠে পুরুষাঙ্গের প্রতিশব্দ লিখে ঘুরতেই পারে। খিস্তি দিয়ে গানের প্যারডি করতেই পারে।

সেটাই গণতন্ত্র। সেটাই বাকস্বাধীনতা। সংখ্যাগরিষ্ঠের অনুভূতির প্লাবনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, নিজের অপছন্দের লোকের এই অধিকারটুকু রক্ষা করার কথা যদি আমরা বলতে পারি একআধজনও, তবেই গণতন্ত্র বাঁচার কিঞ্চিৎ সম্ভাবনা আছে।

আরও সব গুরুনিন্দা পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে

Guruninda Rabindranath Tagore
Advertisment