Advertisment

প্রান্তিক মানুষের ইতিহাস ও এক বিস্মৃত বই

দেশভাগ, উদ্বাস্তু মানুষ, এ রাজ্যে দীর্ঘদিন ধরেই রাজনীতির অন্যতম বিষয়। সে নিয়ে বাংলা ভাষায় চর্চা হয়নি তেমন নয়। কিন্তু অবহেলিত থেকে গেছে জরুরি কাজ। লিখছেন ইস্তাম্বুলের সাবাঞ্জে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
prabirendra 3rdPRANTIK MANUSHER ITIHASH - PRABIRENDRA 1-001

বিশ্বাস না হলেও এটা সত্যি কথা যে রাজ্যের বাইরে থেকে রাজ্যে শিল্পে বিনিয়োগ শুরু হয়েছিল সেই আশির দশকেই। (ছবি- চিন্ময় মুখোপাধ্যায়)

প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

Advertisment

 

“I have lived the better part of my life in the most refugee-concentrated area of West Bengal and I was associated with Dr. B.C. Roy in doing whatever I could for the educational upliftment of the refugees. But I was never aware of what was happening in the entrails of the vast and apparently moribund human mass around me. The book came to me like a revelation : even in the midst of suffering, starvation and death the human spirit remains imperishable.”  – Triguna Sen

যাকে বলে ক্যাথলিক কনফেসন- এ হল তাই। অথচ ত্রিগুণা সেন ছিলেন বিধান রায়ের সরকারে শিক্ষামন্ত্রী, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা যায় নিজের হাতে গড়ে তুলেছেন, কিন্তু কী আশ্চর্য তিনিও নাকি বলছেন যে এ বই পড়ার আগে তাঁরও সম্যক ধারণা ছিল না উদ্বাস্তু মানুষগুলি ঠিক কীভাবে আছেন। যে বইয়ের ‘foreward’ পড়েই এরকম ধাক্কা খেতে হয়, অনুমান করা উচিত যে সে বই রীতিমতন শোরগোল ফেলে দিয়েছিল বিদ্বজন মহলে, সাধারণ মানুষের কথা যদি ছেড়েও দিই। কিন্তু না, ‘Marginal Men’ কোনো আলোড়নই ফেলেনি কারণ বইটিকে পাঠকদের কাছে পৌঁছতেই দেওয়া হয়নি। অথচ স্বাধীনোত্তর পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে উৎসাহী যে কোনো গবেষকের কাছে এ বই হয়ে উঠতে পারত প্রামাণ্য দলিল;  ‘সুবর্ণরেখা’ কি ‘মেঘে ঢাকা তারা’ দেখে যদি কারোর ইচ্ছে করত ফেলে আসা সেই ভয়াবহ দিনগুলোকে আরেকটু ভালো ভাবে জানতে,  এ বই হয়ে উঠতে পারত রেডিমেড রেফারেন্স – কিন্তু তা হয়নি। ‘মার্জিনাল মেন’ স্রেফ কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। হাতে গোনা কিছু লোক জানেন এ বইয়ের অস্তিত্ব, তাঁদের অধিকাংশই লেখকের গুণমুগ্ধ ছাত্র কি সহকর্মী বা সহমর্মী। কপালজোরে তাঁদের সঙ্গে কখনো যদি আপনার দেখা হয়, তাঁরা বিস্তর আনন্দিত হবেন আপনার মুখে এ বইয়ের নাম শুনে; কেউ কেউ হয়তো শোনাতে পারেন অনেক না-জানা ষড়যন্ত্রের কাহিনী, কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যে সে যাচাই করাও হয়ত এখন সম্ভব নয়। কিন্তু একটা কথা নিয্যস সত্যি, আর তার জন্য হাঁড়ির খবর জানার দরকার নেই –  এ বই মস্ত অবিচারের শিকার, আর আমরা যারা পড়ে উঠতে পারলাম না এ বই, তাদের জন্য বাংলার ইতিহাস রয়ে গেল অনেকাংশেই অপঠিত।

এ বইয়ের লেখক প্রফুল্ল চক্রবর্তী ছিলেন পেশায় শিক্ষক-গবেষক। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত আগে থেকেই যে অজস্র উদ্বাস্তু পশ্চিমবঙ্গে এসে আশ্রয় খুঁজছিলেন, তাঁদের হাল-হকিকত জানার জন্য ব্যস্ত ছিলেন বহুদিন থেকেই। ১৯৭৮ সালে তিনি উদ্বাস্তু শরণার্থীদের নিয়ে বই লেখার সিদ্ধান্ত নেন এবং স্বভাবতই প্রথমে খোঁজ পড়ে প্রামাণ্য রেফারেন্সের। বলা বাহুল্য যে, পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু সমস্যা সত্তরের দশকেই প্রথম দেখা দেয়নি, স্বাধীনতার পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তান থেকে বহু শরণার্থী চলে আসতে শুরু করেন। অথচ প্রায় তিরিশ বছরের ইতিহাসকে জানার জন্য তাঁর কাছে সাকুল্যে রেফারেন্স ছিল তিনটি – ১) হিরণ্ময় ব্যানার্জ্জী, শরণার্থী ত্রাণ বিভাগের পুনর্বাসন কমিশনার হয়ে কাজ করার সময়ে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন, তার অবলম্বনে লিখেছিলেন ‘উদ্বাস্তু’, ২) ১৯৪৮ সালের তথ্য অবলম্বনে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইন্সটিউট থেকে প্রকাশিত একটি সমাজতাত্ত্বিক গবেষণা ‘The Uprooted’, যার লেখক ছিলেন কান্তি পাকড়াশী এবং ৩) উদ্বাস্তু কলোনির ইতিবৃত্ত নিয়ে লেখা ‘পশ্চিম বাংলার জবরদখল উদ্বাস্তু উপনিবেশ’ (অনিল সিনহা)। কিন্তু এগুলোর কোনোটিকেই প্রামাণ্য রেফারেন্স বলা চলে না, এবং সব কটি একত্রে ধরেও সার্বিক চিত্র ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। এমত অবস্থায় একজন গবেষক কী করতে পারেন? উত্তর পাওয়া সহজ নয়। কিন্তু প্রফুল্ল চক্রবর্তী যা করলেন সেটা ভাবাটাও বেশ দুষ্কর ব্যাপার – বারো বছর ধরে উনি চষে ফেললেন সারা ভারত, পূর্ববঙ্গ থেকে আগত শরণার্থীরা যেখানে যেখানে আশ্রয় খুজেছেন তার প্রায় প্রতিটা জায়গায় তিনি গেলেন। দণ্ডকারণ্য হোক কি উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি হোক কি বিহার, বসবাস-অযোগ্য প্রত্যেকটি জায়গায় উদ্বাস্তুদের লড়াইয়ের সাক্ষী থেকেছেন তিনি। নিছক গবেষণার টান থেকে কি এহেন পরিশ্রম বা সাধনা সম্ভব? হয়ত, হয়ত নয়, কিন্তু নিছক গবেষণা থেকে মানবসংগ্রামের এক মরমী দলিলে এভাবেই উত্তরণ ঘটেছে  ‘মার্জিনাল মেন’-এর।

আরও পড়ুন, হত্যা হাহাকারে – অপরাধসাহিত্যে বিনির্মাণ ও আধুনিকতা

দলিলটি অনেক কারণেই অবিস্মরণীয়, অন্যতম প্রধান কারণটি হয়ত রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা। বইটি যখন (১৯৯০) প্রকাশিত হয়, বামফ্রন্ট সরকার তখন পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন, দিল্লীর মসনদ থেকে কংগ্রেস সদ্য ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে (যদিও কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকাকালীনই প্রফুল্ল চক্রবর্তী ইউ-জি-সি থেকে আর্থিক সাহায্য পেয়েছেন বইটি লেখার ব্যাপারে) কিন্তু কোনো দলকেই লেখক রেয়াত করেননি, সত্যি কথাগুলো খুব সহজে বলেছেন। স্বাধীনতার প্রায় পর থেকেই রাজ্য এবং কেন্দ্র দুই সরকারই বহুদিন এক অলীক আশায় দিন গুনছিলেন যে উদ্বাস্তুরা এক সময়ে আবার দেশে ফিরে যাবেন; তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল ঘোষ এবং প্রধানমন্ত্রী নেহরু দু’জনেই এখানে দূরদৃষ্টি দেখাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এমনকি স্বাধীনতার প্রায় এক বছর পরেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কোনো পুনর্বাসন দফতর ছিল না। অথচ এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে তৎকালীন বহু নেতাই বিপদের সময় রক্ষাকর্তা হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন পূর্ববঙ্গীয় সংখ্যালঘুদের – সাতচল্লিশের আগে থেকেই । যাই হোক, সেই অলীক আশা ঘুচে যাওয়ার পর কী হল? লেখক এখানে রীতিমতন আক্রমণাত্মক “Nehru’s reply to Dr. Roy’s letter was a mixture of callous indifference to the East Pakistan refugees and special pleading for refugees from West Pakistan” –  বিধান রায় বারংবার চিঠি লিখেও যে নেহরুর কাছ থেকে প্রায় কোনো সাহায্যই পান নি সে কথা আজ বহু চর্চিত।

prabirendra 3rdPRANTIK MANUSHER ITIHASH - PRABIRENDRA-002 সিপিআই-এর সৎ এবং পরিশ্রমী নেতা বিজয় মজুমদারকে কংগ্রেসি সাজিয়ে পাঠানো হয় লেক ক্যাম্প কলোনিতে। (ছবি- চিন্ময় মুখোপাধ্যায়)

কম্যুনিস্ট পার্টির ভূমিকাও কম বিস্ময়কর নয় – পূর্ব পাকিস্তানের কমরেডদের রীতিমতন ম্যান্ডেট দেওয়া হয় ভারতবর্ষে না আসার ব্যাপারে। কিছু কমরেডকে পাঠানো হয় পশ্চিম পাকিস্তানে, পূর্ব পাকিস্তানে যাঁরা থেকে যান তাঁদের অনেককেই রাজনৈতিক শত্রুতায় জেলে যেতে হয় আর পার্টির ম্যান্ডেট অগ্রাহ্য করে যারা প্রাণের দায়ে ভারতে আসেন তাঁদের প্রায় সবাইকে বহিষ্কার করা হয়। কেন? সব থেকে সহজ উত্তর – ধর্মভিত্তিক দাঙ্গাকে অস্বীকার করার ফল। তবে একথা সত্যি যে নেতারা ঠেকে শিখেছিলেন তাই দীর্ঘ চৌত্রিশ বছরের রাজত্বে ধর্মভিত্তিক দাঙ্গা দমনে কম্যুনিস্টদের সাফল্য চোখে পড়ার মতন। কিন্তু এই জবরদস্তি অস্বীকার বেশিদিন করা যায়নি। প্রফুল্ল চক্রবর্তী দেখিয়েছেন ৪৮ সালে মানিকতলার বহু কারখানার মালিকরা শ্রমিক ধর্মঘট চলার সময় বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে বহু কম টাকায় চাকরি দিতে থাকেন উদ্বাস্তুদের। স্বভাবতই, ধর্মঘট বিফলে যাওয়ার আশঙ্কায় কম্যুনিস্ট পার্টি নড়েচড়ে বসে। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহকে প্রায় একটা পলিটিক্যাল থ্রিলারই বলা যায়। উদ্বাস্তুদের মধ্যে  কম্যুনিস্টদের প্রতি চরম বৈরীভাব কাটানোর জন্য একটা স্ট্র্যাটেজি ঠিক করতেই হত; সি-পি-আই এর সৎ এবং পরিশ্রমী নেতা বিজয় মজুমদারকে কংগ্রেসি সাজিয়ে পাঠানো হয় লেক ক্যাম্প কলোনিতে (কম্যুনিস্ট হিসাবে পাঠালে বিজয়বাবুর উদ্বাস্তুদের নিয়ে কাজ করাই সম্ভব হত না)। ছ মাসের মধ্যে বিজয় মজুমদার উদ্বাস্তু আন্দোলনের ওপর থেকে কংগ্রেসী আধিপত্য হটিয়ে কীভাবে র‍্যাডিকাল মুভমেন্ট শুরু করেন, তার এক অনবদ্য ইতিহাস উঠে এসেছে ‘মার্জিনাল মেন’-এর পাতায়। মানিকতলা শ্রমিক ধর্মঘট বানচাল হওয়ার মাত্র এক বছরের মধ্যে , ১৯৪৯ এর লক্ষ্মীপুজোর দিনে তৈরি হয় বৃহত্তম কলোনি – যার নাম রাখা হয় ‘বিজয়গড়’ (সর্বপ্রথম কলোনিটি অবশ্য তার আগেই তৈরি হয়েছে সোদপুরের কাছে দেশবন্ধুনগরে)। ১৯৫০-এর জানুয়ারি থেকে মে’র মধ্যে দক্ষিণ শহরতলিতে তৈরি হয় আরো একাধিক  কলোনি – পোদ্দারনগর, বাঘা যতীন, বিদ্যাসাগর, রামগড়। কিছু জায়গাতে কংগ্রেসি নেতারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিলেও কম্যুনিস্ট নেতাদের প্রভাব ছিল চোখে পড়ার মতন। দেশবন্ধুনগরে সি-পি-আই, বাঘা যতীন এবং বিদ্যাসাগরে আর-এস-পি, রামগড়ে ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতারা একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার শুরু করেন।

আরও পড়ুন, নিঃসঙ্গতার একশ বছর

পঞ্চাশের শুরুতে একাধিক উদ্বাস্তু কলোনি গড়ে উঠেছিল ঠিকই কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থীদের অবিরাম স্রোতকে ঠাঁই দেওয়ার জন্য এইসব কলোনিতেও স্থান ছিল তুলনামূলকভাবে অপ্রতুল। উপরন্তু ষাটের মাঝামাঝি সময় থেকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষও ধৈর্য হারাতে শুরু করেন, সব মিলিয়ে ১৯৬৭-র নির্বাচনে শরণার্থী সমস্যা একটা বড় ইস্যু হয়ে ওঠে। কংগ্রেস তখনো ক্ষমতায় এবং মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেনের কাছে সরাসরি কোনো উত্তর ছিল না; পাঠকদের মনে করিয়ে দেওয়া ভালো যে এই এক সমস্যা দেখা দিয়েছিল ১৯৪৭-এও এবং আরেক কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ-ও রাজ্যবাসীকে নিতান্ত নিরাশ করেছিলেন। রাজ্য সরকারের থেকে কোনোরকম সাহায্য বা প্রতিশ্রুতি না পেয়ে মাথা গোঁজার তাগিদে উদ্বাস্তুরাও ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানাকে উপেক্ষা করতে থাকেন, ফলত রাজ্য জুড়ে গড়ে উঠতে থাকে একাধিক জবরদখল কলোনি। যে উদ্বাস্তুরা স্বাধীনতার পর পরেই কম্যুনিস্টদের সহ্য করতে পারতেন না, তাঁদের মধ্যেই ১৯৫১ থেকে ১৯৬৭ এর মধ্যে অভূতপূর্ব  সমর্থন খুঁজে পান বামপন্থীরা – প্রথমে সি-পি-আই এবং পরে সি-পি-আই-এম। শ্রমিক শ্রেণির মধ্যেও উদ্বাস্তুরা মিশে যেতে শুরু করায় কংগ্রেসি INTUC এর বিকল্প হিসাবে উঠে আসতে থাকে AITUC, CITU এবং UTUC । বামপন্থীদের জন্য সমর্থন আসতে থাকে অন্য আরেক গোষ্ঠী থেকেও – উত্তরপ্রদেশ, বিহার এবং উড়িষ্যা থেকে আগত অসংখ্য গরীব কৃষক জমিদারদের শোষণ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কলকাতা এবং পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য শিল্পাঞ্চলে কাজ নিতে শুরু করেন, একটা সার্বিক মুক্তির স্বপ্ন ছিল এদের চোখেও।

বামপন্থীদের জন্য এর থেকে ভালো প্রেক্ষাপট কী-ই বা হতে পারত? এর সঙ্গে জুড়ুন ষাট দশকের খাদ্যশস্য এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর জোগান সংকট, সত্তরের দশকে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের জনবিরোধী দমননীতি – সাতাত্তরের নির্বাচনফল ছিল অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু উদ্বাস্তুদের জন্য সাতাত্তরের নির্বাচন কোন খবর নিয়ে এল? সে উত্তর দেওয়ার আগে আরো দু’চার কথা বলা দরকার পরিপ্রেক্ষিতটা খুঁটিয়ে যাচাই করতে। ২০১১ তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ক্ষমতায় আসার সময়ে বহু চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়েছিল ভূতপূর্ব সরকার রাজ্যের অর্থনীতির কি হাঁড়ির হাল করে ছেড়েছিল সেই বিষয়ে। সেই একই কথা হয়ত প্রযোজ্য জ্যোতি বসু সরকারের আগে যাঁরা ছিলেন তাঁদের জন্যও। প্রফুল্ল চক্রবর্তী দেখাচ্ছেন আশির দশকের মাঝামাঝি রাজ্যে রুগ্ন শিল্প সংস্থার সংখ্যা আড়াইশ হাজারের-ও বেশী, শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা পঁয়তাল্লিশ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এর সমস্ত দায় বামফ্রন্ট সরকারের নিশ্চয় নয়, পশ্চিমবঙ্গের অনর্থনীতির ইতিহাস দীর্ঘদিনের। কিন্তু উত্তর খুঁজতে হত বামফ্রন্ট সরকারকেই, সুতরাং বিশ্বাস না হলেও এটা সত্যি কথা যে রাজ্যের বাইরে থেকে রাজ্যে শিল্পে বিনিয়োগ শুরু হয়েছিল সেই আশির দশকেই। ধর্মভিত্তিক দাঙ্গা, সন্ত্রাসবাদ এসব না থাকার ফলে কলকাতা তথা বাংলা আশির শুরুতে কিন্তু গন্তব্যস্থল হিসাবে নেহাত ফেলনা ছিল না, সুতরাং বামফ্রন্ট সরকারের সবুজ সঙ্কেত পেয়ে বহু অবাঙালি শিল্পপতিই উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করলেন রাইটার্সের চত্বরে।  ফল? রিয়াল এস্টেট বুম! জমি বাড়ির দর হল আকাশছোঁয়া, যে প্রসঙ্গে তখন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত অবধি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন “একটা অর্থনৈতিক ভাবে রুগ্ন রাজ্যে রিয়াল এস্টেটের এই বিশাল দামের যুক্তিগ্রাহ্য কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না”। কিন্তু এহেন শর্ট টার্ম ক্ষতি বহু রাজ্য বা দেশই মেনে নিয়েছে লং টার্ম লাভের খাতিরে। বহু বছর অপেক্ষা করেও কেন সেই লাভের মুখ আমরা দেখলাম না সেটা অন্য প্রসঙ্গ। আমরা বরং ফিরে যাই উদ্বাস্তু শরণার্থীদের কাছেই।

আরও পড়ুন, মার্ক্সকে ‘মার্ক্সবাদী’দের বিকৃতি থেকে বাঁচাতে হবে

সারা কলকাতা জুড়ে জমির চড়া দামের জন্য নতুন শরণার্থীদের জন্য নতুন কোনো কলোনি বানানো সম্ভব হল না, এমনকি পুরনো কলোনিগুলোর কাছাকাছিও তাঁদের মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করা গেল না। বহু বহু উদ্বাস্তুদের জায়গা হতে শুরু করল রেললাইনের লাগোয়া জমি। বহু বছর ধরে উত্তর এবং দক্ষিণ শহরতলির রেললাইনের পাশে অগুন্তি ঝুপড়ি দেখে দেখে যদি অবাক হয়ে থাকেন, জেনে রাখুন ওনাদের অধিকাংশই উদ্বাস্তু। বলা বাহুল্য যে, ভোটের খাতিরে ক্ষমতাসীন দল এনাদেরকে রীতিমতন আগলে রাখতে শুরু করল; মনে হতেই পারে যে এরাই তো পঞ্চাশের দশকেও শরণার্থীদের দেখেছিলেন, সুতরাং এমনটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই দেখা আর এই দেখার মধ্যে পার্থক্য আছে। আগেরবারও ভোটের চাহিদা ছিল কিন্তু তারপরেও উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য একটা আন্তরিক তাগিদ ছিল। সত্তরের শেষে কিন্তু সেই তাগিদ আর দেখা গেল না। কুড়ি বছর ধরে একই সমস্যা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকলে তাগিদ কমা স্বাভাবিক কিন্তু আরো কিছু কারণ আছে, যেমন সত্তরের রাজনৈতিক সন্ত্রাস। নকশালদের মোকাবিলা করার জন্য কংগ্রেস এবং সি-পি-এম দু দলই  গোটা সত্তরের দশক ধরে ক্যাডার তৈরি করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। নকশাল আন্দোলন মিলিয়ে গেলেও দুই দলের মধ্যে সংঘর্ষ চলতেই থেকেছে, আর সত্তরের শেষ থেকেই কলেজ পড়ুয়া তরুণ রাজনৈতিক কর্মীদের জায়গায় ক্যাডার হিসাবে আসতে শুরু করেছে তথাকথিত ‘রিফিউজি’ রা। স্বভাবতই যে রাজনৈতিক আদর্শ থেকে পঞ্চাশের শুরুতে গড়ে উঠেছিল একাধিক কলোনি, সেই আদর্শ সত্তরের শেষে আর ছিল না  – ফলত বহু শরণার্থীই রাজনৈতিক কারণেও রেললাইন সংলগ্ন ঝুপড়ি থেকে আর বেরিয়ে উঠতে পারেননি।

শহরের বাইরে আবার সমস্যাটা অন্য। পঞ্চাশের শুরুতে মূলত হিন্দু শরণার্থীরা আসতে শুরু করেছিলেন; সত্তরের শেষে কিন্তু ধর্ম নির্বিশেষে মানুষ সীমানা টপকেছেন। মূলত দুটি কারণ – প্রথমত, পশ্চিম পাকিস্তানের সেনারা নির্যাতন করার সময় ধর্ম দেখেনি, বাঙালি মাত্রেই পাশবিক ভাবে অত্যাচারিত হয়েছেন। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের মাপকাঠিতে ভারত এবং পূর্ব পাকিস্তানের বিভেদ দিন আনি – দিন খাই মানুষরাও ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছেন। ভালোভাবে বাঁচার তাগিদে বিমূর্ত ধর্মবিশ্বাস বা প্রচলিত ধর্মাচার ত্যাগ করতে বেশি সময় লাগে না হয়ত – সুতরাং, বহু মানুষই নিশ্চুপে সীমানা টপকে বাংলাতেই আশ্রয় নিয়েছেন। যারা অতটা সহজে মিশে যেতে পারেননি, তারা ঘুরপথে ছড়িয়ে পড়েছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে – আসাম থেকে দিল্লি, ত্রিপুরা থেকে মুম্বই। কিছুটা ভোটের তাগিদ, কিছুটা ম্যানেজমেন্ট ফেলিওর – শরণার্থী সমস্যা চরমে পৌঁছচ্ছে জেনেও বাম নেতারা বিশেষ কিছু করে উঠতে পারছিলেন না। এতে যেমন বহু আদি পশ্চিমবঙ্গীয়ই (মূলত সীমান্ত এলাকায়) নিজেদের নিজভূমে পরবাসী ভাবছিলেন, বহু উদ্বাস্তু গোষ্ঠীর সঙ্গে রাজনৈতিক সংযোগসূত্রও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল (শুধু ভোটের তাগিদে যে কথাবার্তা চলে বলাই বাহুল্য যে তা কোনোদিনই পুরোদস্তুর রাজনৈতিক আন্দোলনের বিকল্প হতে পারবে না।)

আরও পড়ুন, কার্ল মার্ক্সের মূল অর্থনৈতিক মতবাদের পূনর্মূল্যায়ন

আর এই প্রেক্ষাপটের ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে দণ্ডকারণ্য এবং মরিচঝাঁপি ট্র্যাজেডি। ১৯৬১ সালে বিধান রায় বহু উদ্বাস্তুকেই দণ্ডকারণ্যে পাঠাতে চেষ্টা করেন। প্রায়, দশ হাজারের মতন মানুষ সেই নির্দেশ অগ্রাহ্য করে থেকে যান পশ্চিমবঙ্গেই। বিধান রায় আর্থিক এবং অন্যান্য সহায়তা বন্ধ করে দিলেও তাদেরকে বাংলাচ্যুত করার চেষ্টা করেননি। প্রফুল্ল চক্রবর্তী মনে করিয়ে দিয়েছেন দণ্ডকারণ্যে যাঁরা গেলেন এবং যাঁরা গেলেন না, তাঁদের অধিকাংশই মূলত নমশূদ্র কৃষক; এঁদের অনেকেই স্বাধীনোত্তর পূর্ববঙ্গে নমশূদ্র আন্দোলন গড়ে ওঠার সাক্ষী (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কয়েক বছর আগে দেবেশ রায় একটি পূজাবার্ষিকীতে এই নমশূদ্র আন্দোলনের পুরোধাকে নিয়ে উপন্যাস লিখেছিলেন ‘বরিশালের যোগেন মন্ডল’, দে’জ সম্প্রতি সেটি বার করেছে বই আকারে) – বাংলার নরম মাটি আর জলের মধ্যে থাকতেই এরা অনেক বেশী স্বচ্ছন্দ। সুতরাং, শ্বাপদসঙ্কুল দণ্ডকারণ্য বা রুক্ষ রাজস্থান থেকে এঁরা চলে আসতে চাইবেন সে আর আশ্চর্যের কথা কী! বিহার বা উড়িষ্যাতেও যারা গেছিলেন স্থানীয় মানুষদের প্রবল বিরোধিতার মধ্যে পড়তে হয়েছে এনাদের বারবার। সত্তরের শেষাশেষি এঁরাই ফিরে আসতে শুরু করেন, আশ্রয় নেন সুন্দরবনের মরিচঝাঁপিতে। মরিচঝাঁপির মানুষদের বামফ্রন্ট সরকার কীভাবে উৎখাত করার চেষ্টা করেছেন, তাতে কত মানুষের রক্ত ঝরেছে, কত মানুষ নির্যাতিত হয়েছেন সে কথা আজ নতুন করে বলার নেই। কিন্তু ‘মার্জিনাল মেন’ এর লেখক অবধারিত প্রশ্নটি তুলতে ভোলেননি – দণ্ডকারণ্য থেকে আগত শরণার্থীদের ভোটাধিকার থাকলেও কি ঘটনাপ্রবাহ একই খাতে গড়াত? রেললাইনে ঝুপড়ি বানিয়ে যাঁরা থেকে গেলেন বা নিছক অর্থনৈতিক কারণে যাঁরা সীমানা পেরিয়ে মিশে গেলেন মূল জনস্রোতের সঙ্গে, তাঁদের কে রূঢ় বাস্তব বোঝানোর কোনো প্রয়াসই শাসকদল করেননি কারণ এই মানুষগুলির ভোটাধিকার ছিল। আর এই সময় থেকেই জাল পাসপোর্ট কি জাল র‍্যাশন কার্ডের যে রমরমা শুরু হয় তা এখনো অব্যাহত।

বিশ্বজুড়ে শরণার্থী সমস্যা ফের প্রকট হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক কারণেই পশ্চিমবঙ্গেও নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে শরণার্থী প্রসঙ্গে, যাতে ইন্ধন জুগিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল বরকতের হিসেব, “১৯৬৪ থেকে ২০১৩ র মধ্যে এক কোটির বেশি বাংলাদেশি হিন্দু দেশ ছেড়েছেন”। সংখ্যার হিসাবে যাঁরা রইলেন আর যাঁরা রইলেন না, অর্থনীতির হিসাবে যাঁরা শোষক আর মানবিকতার হিসাবে যাঁরা শোষিত, বাংলায় বসে এনাদের সবার ইতিহাসকে জানতে হলে ‘Marginal Men’ এর থেকে ভালো বই এ মুহূর্তে খেয়াল পড়ছে না।

আরও পড়ুন, উত্তর সত্য, সাংবাদিকতা এবং আমরা

Advertisment