রুখসানা কাজল
ঠা ঠা রোদচেতা দুপুর। হারুনমামাদের সজনেগাছের ছায়ায় ইশকুল ব্যাগ রেখে রুম্পি বিশাল চওড়া মাঠের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। আগুনমুখো রোদ্দুরে জ্বলে যাচ্ছে মাঠের সাদা বুক । মাটি পুড়ে রুদ্র হচ্ছে। বাতাসে ভেসে আসছে শূন্য শূন্য গন্ধ।বিভোর আবেগে রুম্পি দেখে রোদ্দুর কী করে আলোর বন্যা ছড়িয়ে উথাল পাথাল করে দিচ্ছে চেনাজানা মাঠটাকে।
হারুণমামার মা নানুয়া বলেছিল ঠিক এরকম রোদ টকটকে শুনশান সময়েই নাকি ঘটেছিল সেই অলৌকিক ঘটনাটা ! যদি ঘটনাটা আবার ঘটে!
দুচোখের দৃষ্টিকে ছিপ করে রোদ্দুরের বন্যায় তাকিয়ে থাকে রুম্পি।
নানুয়ার কছে গল্পটা শুনে শুনে, মাঠটা এখন অদ্ভুত লাগে ওর আছে। মাঝ বরাবর মাঠটা একদম ফাঁকা। ধুলো ধুলো, ফকফকে ঝিনুক বুক। কোথাও একটুকরো ঘাস নেই। কিন্তু মাঠের কিনারা ঘিরে চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে বিস্তীর্ণ ঘাসের সবুজ কার্পেট। নানুয়া বলেছে, মাঠের ওই সাদা অংশ, সেখানে, এরম ঝুম দুপুরে, সেদিন একটা রথ নেমে এসেছিল অই আকাশ থেকে। সেই রথের সোনারূপা বাঁধানো দরোজা খুলে কেউ একজন হাত বাড়িয়ে ডেকেছিল, এসো বসুধা !
ইশকুল ছুটি হলে রুম্পি এখন রোজ চলে আসে এখানে। এসে তাকিয়ে থাকে মাঠের দিকে। আশাভরা দুচোখ। মাঠের ধারে কাছে দূরে এই দুপ্পুরে কোনো মানুষ বা গরু ছাগল দেখা যায় না। শুধু দু একটা কাক সাঁ করে নেমে এসে ধাঁ করে উড়ে যায়। সিকদারদের বাগানবাড়ির আশোকফুলের ডালে বসে কা কা করে কিছুক্ষণ ডেকে নিজেই থেমে যায়। তারপর এদিক সেদিক তাকিয়ে পা গুটিয়ে ঘাড় গুঁজে ঝিমুতে ঝিমুতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে।
গেলো কাল দুপুরে খালি পায়ে ঘাসের উপর হেঁটে দেখেছে রুম্পি। ঘাসেদের অন্তরাত্মা যেন ধুঁকে ধুঁকে গরম নিঃশ্বাস ফেলছিল ওর পায়ের উপর। সবুজ নিঃশ্বাস। কেমন ঘেমে যাচ্ছিল ওর পা।
মিয়া মঞ্জিলের বড়ভাই দেখে, বকে না দিলে রুম্পি আরো কিছুক্ষণ ঘাসবনে হেঁটে বেড়াত। খুঁজে খুঁজে দেখত দুএকটা মুথোঘাস খয়েরি ফুল ফুটিয়ে কেমন পুড়ে যাচ্ছে চির আনন্দে। ঘাসের ফাঁকে গজিয়ে ওঠা কালোকেশী গাছ চিরল চিরল সাদাফুল ফুটিয়ে কেমন ঘেমে নেয়ে চুপসে আছে গরমে। কৃষ্ণ তুলসি আর ঝিমটির বন রোদ্দুর থেকে গিলে খাচ্ছে বেঁচে থাকার অতুল সূর্যশক্তি।
আর কেউ রোদ্দুর দেখতে পায় কি না ও জানে না। রুম্পি দেখতে পায়। ও জানে কখন রোদ্দুর সোজা হয়ে আছড়ে পড়বে মাঠের ভেতর। কখন বাঁকা হয়ে শুষে নেবে ঘাসেদের প্রাণ। কখন সরে গিয়ে সামান্য ছায়া ফেলতে দেবে আকাশের জলহীন সাদা মেঘকে।
মাঝে মাঝে তো রোদ্দুর ডাক দেয়, আয় রুম্পি আমরা নাচি! রুম্পি যায় না। সূর্যরথ দেখবে বলে ঠায় বসে থাকে সন্ধ্যামালতীর না-ফোটা ফুলের বনে।
হারুণমামাদের সজনে তলায় সন্ধ্যামালতী ফুলের গাছ ঝাড় ধরে গজিয়ে উঠেছে । রুম্পি কেডস খুলে তার ভেতর মোজা গুঁজে বইয়ের ব্যাগসহ ঢুকিয়ে রাখে সেই ঝোপে। রোদ্দুর ওকে টানে। উতুলপুতুল ধবল রোদ্দুর। তার একপিঠে ভেসে যাচ্ছে রূপালি ময়ূরপঙ্খী নাও। আবার অন্যপিঠে ছুটে বেড়াচ্ছে বেনীআসহকলা রঙের সপ্তঘোড়ার রথ ।
যদি আবার একবার সপ্তঘোড়ার রথ এসে নামে অই মাঠের সাদা বুকের জমিনে! যদি আরো একবার কেউ সোনারূপা বাঁধানো দরজা খুলে ডাক দেয়, এসো রুম্পি!
সন্ধ্যামালতীর পাকা বীজ তুলে নিতে নিতে রুম্পি ভাবে, যদি ডাকে ও কি যাবে?
দিদা যে বলেছে যাওয়া খুব সোজা রে রুম্পি। কিন্তু ফিরবি কী করে? একবার গেলে যে আর ফিরে আসা যায় না সোনা । কিছুতেই না। কাঁদলেও না।
মুথো ঘাসের মাথার উপর গুনগুনিয়ে উড়ছে নানারঙের ছোট ছোট মাঠ প্রজাপতি । মাঝে মাঝে নীচু জমি থেকে এক পশলা হঠাত বাতাস এসে দুলিয়ে দিচ্ছে রোদ্দুরকে। আর তখন রোদ্দুর বাঁকা হয়ে খেলতে শুরু করে ঘাসেদের সাথে। কিছুটা লম্বা মুথোঘাস মাথা নুয়ে চুমু খায় বুনো ঘাসের মুখে। আবার ভেসে ওঠে। তারপর রোদ্দুর ছুঁয়ে হেসে ফেলে খয়েরি লজ্জায়।প্রজাপতিগুলোও বাতাসের সাথে ঝাঁক বেঁধে একই সাথে নুয়ে যায়, আবার ভেসে ওঠে। ঘাস, রোদ্দুর, প্রজাপতি হেসে খেলে দুলে দুলে ঢলে যাচ্ছে খলখলিয়ে। এই দুপুরের গায়ে কোনো মৃত্যু গন্ধ নেই। রক্তের ছিটে নেই। রুম্পি ত কতদিন এসে বসে থাকছে এখানে। কই কোনো মৃত্যু তো তাকে ডেকে নিচ্ছে না !
তবু কেন যে মা ঝাঁপিয়ে পড়ল ছাদ থেকে !
মাঠের বুক থেকে জেগে ওঠছে ছোট ছোট ধূলোর ঘূর্ণি। আকাশ ছুঁতে চেয়ে তারা হারিয়ে যাচ্ছে নীচু জমির সবুজ ক্ষেতে। পুরো মাঠটাকে রুপোর তেপান্তর বলে মনে হচ্ছে রুম্পির।
ও উঠে দাঁড়ায়। দমবন্ধ এক আনন্দে ওর ছোট্ট বুকটা ফুলে ওঠে। সবকিছু ঠিকঠাক। একদম গল্পে শোনা সেদিনের মত। সেই নিস্তব্ধ দুপুর। থমথম আগুন আগুন পরিবেশ। রোদগলা তেপান্তরের মাঠ। মাঠের পেছনে বৃদ্ধ আশোকের ডালে ঘুমন্ত দ্রোণকাক । রূপালি আভায় চকচক করছে তেলাকুচার সবুজ পাতা। হারুণের মা নানু তো এরকম দুপুরের কথাই বলেছিল রুম্পিকে। ঠিক এরকম এই সময়েই ত সেই সূর্যরথ নেমে এসেছিল মাঠের অই সাদা বুকে !
বুড়ি হারুণের মা তখন ঘুঁটে শুকাচ্ছিল গোয়ালঘরের পেছন উঠোনে। দুমাসের রুম্পিকে ঘুম পাড়িয়ে ওর মা ছাদের রেলিং থেকে তুলে নিচ্ছিল রুম্পির রঙিন জামাকাপড়গুলো। হারুণের মা আঁতকে ওঠে। দেখে কে যেনো হাত বাড়িয়ে ডাক দিলো সেই সপ্তরথ থেকে । আর রঙিন জামাকাপড় হাতে রুম্পির মা বসুধা এক লাফে রেলিং টপকে ছুটে যেতে চাইলো সেই রথের দিকে।
পাখা ছিল না। তাই তো পড়ে গিয়ে সে কী রক্তারক্তি মৃত্যু !
গল্পটা শুনে রুম্পি ওর দাদাভাইকে বলেছিল, মাকে কে ডেকে নিল দাদুন?
দাদাভাই সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলেছিল, মৃত্যু। সে এক একলা মেয়ে গো সোনা। মা নেই, বাবা নেই, ভাইবোন কেউ নেই। দিনের বেলায় সোনার রথে আর রাত্রিতে ময়ূরপঙ্খী নায়ে একা একা ঘুরে বেড়ায়। যখন ভয় পায় বা মন কাঁদে তখন কোনও মা, বাবা অথবা ভাইবোনকে ডেকে নেয় ওর কাছে ।
রুম্পি দাদাভাইয়ের হাঁটু ছুঁয়ে বসে পড়ে, ওর দাদুন দিদা নেই? চশমার কাঁচ মুছে দাদাভাই বলেছিল, না দিদিভাই। সে বড় অভাগী মেয়ে। এতিম। সর্বহারা। তাই না এমন রাতদিন একলা একলা ঘুরে বেড়ায়।
রুম্পির দুধে চকোলেট হরলিক্স মেশাতে মেশাতে দিদা বলেছিল, আঃ কী শুরু করলে! থামো তো তুমি ।
দাদাভাই অবশ্য না থেমে দিদাকে বলেছিল, সত্যিটা জেনে নিক। তাছাড়া আমিও তো পুরো সত্যিটা বলিনি। রঙঝাল মিশিয়েই বললাম। বড় হলে ও নিজেই জেনে নেবে। জেনে যাবে তোমার ছেলের কুকীর্তি কাহিনী।
রুম্পি তাই প্রতিদিন অপেক্ষা করে সেই সত্যিটা জানার জন্যে।
হারুণমামাদের গোয়ালঘরের পেছনে, সজনে গাছের ছায়ায় বসে, রোদ্দুর দেখে আর ভাবে এই বুঝি মাটিতে নেমে এলো সপ্তঘোড়ার রথ। এই বুঝি খুলে গেলো সোনারূপা বাঁধানো সেই দরজা! এই বুঝি কেউ হাত বাড়িয়ে ডেকে বলল, এসো রুম্পি! আমার কোনো বোন নেই গো। তুমি আমার বোন হবে !
রুম্পি কি যাবে? যদি ফিরে না আসতে পারে আর !
রোদের মায়ায়, রোদের খেলায় রুম্পির যে ভারি আনন্দ !