আমাদের সাহিত্যে কবিতা যে সবসময়ে খুব ভালো লেখা হয়েছে এমন নয়। হাজার বছরের বাংলা কবিতার ইতিহাসে মহৎ কবি বা সুকবি যেমন অনেকেই, অকবির সংখ্যাও অজস্র। আমাদের সংস্কৃতির শিরোভূষণ কাব্য হলেও জীবনানন্দকে লিখতে হয়েছিল "সকলেই কবি নয়- কেউ কেউ কবি"। উপন্যাস ও নাটকে আমাদের সাফল্য তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। পাহাড়চূড়ার বদলে ছোট ছোট টিলাই সেখানে বেশি। কিন্তু লিখিত সাহিত্যের মধ্যে আমাদের অনায়াস আয়ত্ত ছিল গল্প। বড়ো লেখকরা তো বটেই, এমনকি মাঝারিমাপের সাহিত্যকর্মী বা অখ্যাত তরুণ গল্প লেখা মাত্র তাঁর হাতে সোনার কলম তুলে দেওয়ার ইচ্ছে হত। চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের গল্পসমূহের দিকে তাকালে মনে হয় সোনালি বিকেল। কেন যে সন্ধ্যা এত দ্রুত নেমে এল! কেন যে আমাদের গল্প উপন্যাস ও রম্যরচনার ফাঁকে মুখ গুঁজে পড়ে থাকতে শিখল!
আজ পত্রিকাগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায় গবেষণামূলক নিবন্ধ ও উপন্যাসের আকাশচুম্বী অবস্থানের পাশে ছোট গল্প নেহাৎ হতশ্রী ভাড়াটে বাড়ি। কেন এমন হল, মিডিয়ার তাতে ভূমিকা আছে কিনা, ছোট গল্প গদ্য সাহিত্যের গোত্র হিসেবে আর কতটা সসম্ভ্রম বিবেচ্য - এসব প্রশ্ন আপাতত মুলতুবি রেখে দেখি এই একুশ শতকেও কোনও কোনও তরুণ ছোটগল্পকে তাঁদের অনামিকার আংটি মনে করেন। তেমনই একজন শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য।
অনতিক্রান্ত চল্লিশের এই যুবকের দিকে আমি যে আগ্রহ নিয়ে তাকালাম তার কারণ তিনি না লেখেন উদারীকরণ-উত্তর ফ্ল্যাটবাড়ির রোজনামচা অর্থাৎ হালকা পরকীয়া বা আকাশচুম্বনপ্রত্যাশী কোনও অট্টালিকায় উচ্চাশার পেলব হাহাকার। তিনি এমন নাগরিক নন যে সুরভিত পাপবোধ বিতরণ করবেন যাতে আমাদের জীবনচর্চায় কোনও আঁচড় না লাগে, অথচ আমরা বেকসুর খালাস পেয়ে আবার পানপাত্র অথবা স্তনসন্ধির জন্য আকুল হয়ে উঠি। অন্যদিকে জমিজিরেত গ্রামোন্নয়ন নিয়ে পাঁচমিশেলি সমীক্ষার পরিচয়ও তাঁর উপজীব্য নয়। অর্থাৎ বাজারচালু সমাজ-সচেতনতার সহজিয়া সাধনাও তিনি পরিহার করেছেন।
গল্প লেখার রীতিটিকে প্রশ্ন না করেও তিনি এমন এক জলবায়ুর ইঙ্গিত দেন যেখানে স্বাভাবিকতাই প্রশ্নের সামনে দাঁড়ায়। আমাদের অসুস্থতা যখন সুস্থভাবে প্রকাশিত হয় তখন যে অস্বস্তি শিরা-উপশিরা দিয়ে রাত্রির গহনে চলে যায়, শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য সেই ব্যাধির রূপরেখা বিষয়ে অবহিত করতে চেয়েছেন। তিনি যে সর্বত্রই সফল তা বলব না কিন্তু সাহিত্য যে জীবনের ভিত নড়িয়ে দিতে পারে, শব্দ যে সিমেন্টের চাইতে হৃদয়হীন, এই বিশ্বাস থেকে আমাদের বসবাসের চেনা নিরাপত্তাকে একটু সংকটের দিকে ঠেলে দিতে চেয়েছেন - আর লেখকের মূল কর্তব্য তো তা-ই : চৈতন্যের উদ্বোধন। 'মেঘে ঢাকা তারা' ছবিতে রবীন্দ্রসংগীতের স্বরলিপিতে যেমন সিনেমামদির সমাজের দিকে চাবুক আছড়ে পড়ে, শাক্যজিতের মনোবিকলনগ্রস্ত চরিত্রেরা তেমন নিজেরা হয়ত আক্রান্ত, কিন্তু লেখকের দক্ষতা এই যে পাঠক বিনা রক্তপাতে সাহিত্য-পাঠের সুখানুভূতি থেকে সরে গিয়ে কুয়াশা ও ত্রাস শনাক্ত করতে পারে।
আচমকা প্রথম গল্পটি পড়তে গিয়ে খানিকটা হোঁচট খাই। ফ্রানজ কাফকার মেটামরফোসিস গল্পটি তাহলে শহর যেখানে সোহাগ করে মফসসলকে জড়িয়ে ধরতে চাইছে সেখানেও সত্যি হল! এই দক্ষিণ শহরতলির ছোট একটি নিঃসন্তান স্বামী-স্ত্রী তাহলে নাৎসি গেস্টাপোদের চাইতেও নির্মম হয়ে উঠতে পারে। মানুষের রূপান্তর কত মর্মান্তিক হতে পারে তা প্রাগে না থেকেও আমরা উপলব্ধি করি। জীবিতের ছদ্মবেশে আমরা যে কীটে পরিণত হয়েছি আর ধ্যান শিবির যে এখন ঘরে ঘরে তা টের পেয়ে মুহূর্তের জন্যে হলেও আমরা আতঙ্কিত হই। কপোত-কপোতী যথা উচ্চবৃক্ষচূড়ে বাঁধি নীড়, থাকে সুখে আত্মরতিপরায়ণ সভ্যতা এই স্বপ্নকে কবে যে পরিত্যাগ করে গড়ে তুলেছে গ্যাসচেম্বার।
নগরায়নের রূপকথাটিকে দার্শনিক পরিপ্রেক্ষিতে দেখেন বলেই শাক্যজিৎ 'বৃহদারণ্যক' নামের এই জনপদের প্রতিবন্ধী উপনিষদ লিথে ফেলতে পারেন। এমন অসামান্য আখ্যান ইতিহাসচেতনার পাহারা না থাকলে লেখা সম্ভব নয়। চার্লি চ্যাপলিন মডার্ন টাইমস চলচ্চিত্রে যে চালচুলোহীন ভবঘুরেটিকে রেঞ্চ দিয়ে কলকব্জা টাইট করতে করতে পাগল হয়ে যেতে দেখেন, আমাদের আরণ্যক ট্র্যাফিক পুলিশ হেমব্রম তার স্ব-গোত্র। পুঁজিবাদী সভ্যতার চাপ একজন পাপশূন্য মানুষকে উন্মাদ করে দিল। পড়ে থাকল রক্তের দাগ আর পরিহাস। ভরা বর্ষায় যে গ্রামে পুণ্যাহ উৎসবে যোগ দিত, আকাশপানে হানি যুগল ভুরু নিজস্ব রণহুংকার যার স্বাভাবিক ছিল তাকে কলকাতায় ছিটকে পড়ে ধাতব অভিসম্পাত শুনতে হয়। ছোটনাগপুরের জঙ্গল, স্বাধীন শার্দুলের বাঁক আর পুলিশ ব্যারাক! আচ্ছন্নের মত সে শুনতে পায় লালবাতি জ্বললে রাগে পা আছড়ায় ক্রুদ্ধ বাইসনসম মোটরবাইক। আকাশ অন্ধ করা কেবলের জাল আর ঘাতক লরি একদিন হেমব্রমের স্নায়ুতন্তু ছিঁড়ে দিল।
হায়! সে যে সভ্যতার যাবতীয় দায় সম্বল করে এক নামহীন ভিখিরির মুখচেনা দৈনন্দিন পরিচয়টুকুকে স্মারকচিহ্ন মনে করতে চেয়েছিল। মহাজাগতিক উৎস হারিয়ে ফেলে মানুষ যদি শুধুই গতির তীর লক্ষ্য করে ক্রমশ অলীক ঠিকানায় পৌঁছে যাওয়াকে নিয়তি ভাবে নির্বিকল্প, তা হেমব্রমের একার নয়, উন্নয়নের নামে পরিকল্পিত আত্মহনন একটি জনজীবনের ভবিতব্য হয়ে উঠেছে। কী সুন্দর ছিন্নমূল, দলবদ্ধভাবে নরকগামী মানুষের কথা লিখেছেন শাক্যজিৎ।
অনেকদিন বাদে শাক্যজিৎ হয়ত নির্মম কিন্তু নিটোল ও স্বচ্ছন্দগতি কিছু কাহিনি উপহার দিলেন পাঠককে। 'আক্রান্ত' বা 'ঘাতক' জাতীয় গল্প কত চেনা, তবু কতদূর মনে হয় এই ফ্যাশনসেবিত বাংলা সাহিত্যে। 'বসন্ত উৎসব' জাতীয় গল্প কী ভীষণ সাম্প্রতিক। না, একথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয় যে এই লেখক অযোনিসম্ভূত। শুধু নবারুণ ভট্টাচার্য কেন, সাধারণভাবে সমাজমনস্কতা তার ঐতিহ্য ও পথচলার সঙ্গী। কিন্তু যা শতমুখে বলার যে শাক্যজিৎ যখন সত্য উচ্চারণ করেন তা শুকনো সন্দর্ভ নিঃসৃত মনে হয় না বরং তার রচনায় মেলে মৃত্তিকার প্রাণস্পর্শ। অনেকদিন বাদে একটি গল্প সংকলন পড়লাম যাতে মনে পড়ে গেল গল্পের হাত বাঙালি লেখকের পক্ষে মৌলিক অধিকার।
আক্রান্ত ও অন্যান্য গল্প, শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য
আপনপাঠ, ২১০ টাকা