Advertisment

দেবী সরস্বতী বাক্যের দেবী, তিনিই দণ্ডনীতি সৃষ্টিকারিণী

শাস্ত্রের যে দণ্ডনীতি, তা কেমন ধরনের রাজনীতি? পুরাণ বলে, দেবী সরস্বতী এই দণ্ডনীতির সৃষ্টি করেছিলেন। সাধারণত চার বিদ্যার কথা শাস্ত্রে পাওয়া যায় - আন্বীক্ষিকী, ত্রয়ী, বার্তা ও দণ্ডনীতি। লিখছেন শামিম আহমেদ

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
goddess saraswati and politics

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

বাগ্-দেবী সরস্বতীর বন্দনার পাশাপাশি জেনে নেওয়া ভালো, তিনিই দণ্ডনীতি বা রাজনীতির সৃষ্টি করেন। কেন? কী তার উদ্দেশ্য?

Advertisment

দেবী সরস্বতী বাক্যের অধিষ্ঠাত্রী। বাক্য কী? বাক্য হলো সার্থক পদসমষ্টি। পদ কী? যা শক্তিবিশিষ্ট, তাকে পদ বলে। শক্তি হলো পদ ও তার অর্থের সম্বন্ধ। মহাভারত বলছে, 'সসৃজে দণ্ডনীতি সা ত্রিষু লোকেষু বিশ্রুতা' - সরস্বতী দণ্ডনীতির সৃষ্টি করেছিলেন। মহাকাব্যের প্রত্যেক পর্বের শুরুতে 'নারায়ণং নমস্কৃত্য' প্রভৃতি শ্লোকে দেবী সরস্বতীকে বন্দনা করা হয়েছে - 'দেবীং সরস্বতীঞ্চৈব ততো জয়মুদীরয়েৎ'।

খেয়াল করলে দেখা যাবে, সরস্বতীর সঙ্গে দুটো বিষয় খুব গভীরভাবে সম্পৃক্ত - একটি হল নিরুক্ত (semantics), এবং অন্যটি দণ্ডনীতি, যাকে আমরা politics বলতে পারি। পদ ও তার অর্থের সম্পর্ক সাধারণত সিমান্টিক্সে আলোচিত হয়। কোনও একটি পদ দিয়ে অমুক বস্তু কেন বুঝব, সেটা কী শুধু একটি প্রথা বা বৃদ্ধব্যবহারজনিত? নাকি পদ (শব্দও বলতে পারি) যে পদার্থকে বোঝায়, সে দুটির (পদ ও পদার্থ) মধ্যে কোনও অন্তরঙ্গ নিবিড় সম্বন্ধ আছে? এ নিয়ে বহু কথা বিভিন্ন জায়গায় আলোচিত হয়েছে।

এটি বৈয়াকরণের বিষয় নয়। 'সনৎসুজাতীয়-প্রকরণে' বলা হয়েছে, যিনি শব্দগত অর্থ, ব্যুৎপত্তি প্রভৃতির ব্যাক্রিয়া অর্থাৎ তত্ত্বার্থ বোঝেন, তাঁকে বৈয়াকরণ বলে। ষড়ঙ্গের মধ্যে যেমন ব্যাকরণ আছে, তেমনি রয়েছে নিরুক্ত। আচার্য যাস্কের নিরুক্তের কথা পাওয়া যায় শাস্ত্রে। নিরুক্ত হলো নিঃশেষে ব্যাখ্যাত বা কথিত। পদের অবয়বশক্তি থেকে নির্বচন করে পদের অর্থ নিষ্কাশিত হয়। পদের অর্থের জন্য পদের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে যে পদের শক্তিই পদার্থকে নির্দেশ করে। কোন শব্দ বা পদ দিয়ে কোন অর্থ বুঝব, তাকে এইভাবে বায়বীয় শক্তি দিয়ে বোঝার মধ্যে এক ধরণের রাজনীতি আছে। সে নিয়ে প্রচুর তত্ত্ব ও কথাবার্তা রয়েছে।

শাস্ত্রের যে দণ্ডনীতি, তা কেমন ধরনের রাজনীতি? পুরাণ বলে, দেবী সরস্বতী এই দণ্ডনীতির সৃষ্টি করেছিলেন। সাধারণত চার বিদ্যার কথা শাস্ত্রে পাওয়া যায় - আন্বীক্ষিকী, ত্রয়ী, বার্তা ও দণ্ডনীতি। আন্বীক্ষিকী হলো যুক্তিবিজ্ঞান। ত্রয়ী হল তিন বেদ, বার্তা হলো অর্থনীতি, এবং দণ্ডনীতি হলো রাজনীতি।  আচার্য মনু যুক্তিবিজ্ঞানকে স্বতন্ত্রভাবে মানেননি। তিনি তিন বিদ্যার সমর্থক - ত্রয়ী, বার্তা, ও দণ্ডনীতি। যুক্তিবিজ্ঞানের বিষয়টি তাঁর মতে এই ত্রয়ীর অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ কিনা বেদের যুক্তি তাঁর কাছে শিরোধার্য।

কিন্তু বেদ তো শব্দ-প্রমাণ। তাঁকে বহু ক্ষেত্রে নির্বিচারে মেনে নিতে হয়। যুক্তিবিজ্ঞান নির্বিচারবাদের ঘোর বিরোধী। দেবতাদের গুরু আচার্য বৃহস্পতি আন্বীক্ষিকী ও ত্রয়ী, দুটিকেই মানেননি। দেবগুরু বার্তা ও দণ্ডনীতি, এই দুই বিদ্যা মেনেছেন। তাঁর অভিমত, অর্থনীতি ও রাজধর্ম জানলে যুক্তিবিজ্ঞান বা তিন বেদকে পৃথক বিদ্যা মানা নিষ্প্রয়োজন। এই দুই বিদ্যা - অর্থনীতি ও রাজনীতি - সব কিছুর নিয়ামক।

অসুরদের গুরু শুক্রাচার্য আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছেন। তিনি মনে করেন, বিদ্যার সংখ্যা এক, এবং সেটি হলো দণ্ডনীতি। একত্ববাদী শুক্র কারণ হিসেবে জানিয়েছেন, ত্রয়ী, বার্তা ও আন্বীক্ষিকীর উৎস হলো দণ্ডনীতি বা রাজনীতি, যা সৃষ্টি করেছিলেন দেবী সরস্বতী। এতক্ষণ পদ ও পদার্থের সম্পর্ক নিয়ে যা বলা হচ্ছিল, তাকে ত্রয়ীর অন্তর্ভুক্ত করে বিবেচনা করলে রাজনীতির বিষয়টি পরিষ্কার হবে।

শব্দ বা পদ কিংবা বাক্য দিয়ে কোন অর্থ বুঝবো তা যেমন শেষমেশ রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে, তেমনি যুক্তিশাস্ত্র, ত্রয়ী, অর্থনীতি, সব কিছুর অন্তিম নিয়ন্ত্রক হলো রাজনীতি বা দণ্ডনীতি। দণ্ডনীতি বলতে শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কিত প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত যে কোনও নীতিকে বোঝায়। শাসন হলো উপদেশ, দমন, নিয়ন্ত্রণ ও শাস্তি। নীতি হলো নৈতিকতা, রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি; ন্যায়, সাম-দান ইত্যাদি। বার্তা বা অর্থনীতিকে তাই এক কালে রাজনৈতিক অর্থনীতি বলা হতো। অর্থনীতির বিবর্তন ঘটেছিল প্রধানত নীতিশাস্ত্রের শাখা হিসাবে। অর্থনীতির যে দুটো উৎস - নৈতিকতা ও যন্ত্রবিদ্যা - তাদের রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগ আছে। সর্বোপরি, অর্থনীতির সঙ্গে মানুষের লক্ষ্যের বা মানবকল্যাণের যোগ রয়েছে।

রাজনীতি পরম শিল্প। অর্থনীতি চূড়ান্তে এসে যোগ হয় নীতিশাস্ত্র ও রাজনীতির চর্চার সঙ্গে। আমাদের দেশে যে চার পুরুষার্থের কথা বলা হয়, তার প্রথমটি হল ধর্ম বা নীতি। ‘ধর্ম’ শব্দের একটি অর্থ হলো, যা ধন প্রদান করে। রাজধর্ম বা রাজনীতিও কিন্তু ধন প্রদান করে। ‘ধন’ শব্দ দিয়ে পার্থিব ও অপার্থিব, দু'প্রকার ধনকেই বুঝতে হবে। ক্ষত্রিয়রা মোক্ষের কথা ভাবে না। তাদের কাছে তিনটি পুরুষার্থ - ধর্ম, অর্থ ও কাম। যুধিষ্ঠির ধর্মপুত্র, ভীম কামকে বেশি গুরুত্ব দেন, কিন্তু অর্জুন বেশ পণ্ডিত মানুষ, তিনি বলছেন, অর্থই হলো পরম পুরুষার্থ। অপার্থিব ধনের কথা ঋষিরা ভাবতে পারেন। অর্জুনের মতে, পণ্ডিতরা যাকে ধর্ম বলে মনে করেন, তার উদ্ভব ধন থেকেই। ক্ষমতাশালী যাকে ধনে মারে তাকে প্রাণেও মারে এবং তার ধর্মও হরণ করে। অর্থ থেকেই ধর্ম, কাম ও স্বর্গ আসে। দারিদ্র জীবনের মহাপাপ।

শব্দ নিয়ে রাজনীতি এবং রাজধর্ম, অর্থাৎ দণ্ডনীতি বা রাজনীতি নিয়ে নীতিশাস্ত্রের কথা চলতে থাকুক। যদিও সমস্ত আলোচনা গুলিয়ে যেতে থাকে। গুলিয়ে দেওয়া হয়। স্বাভাবিক। গুলিয়ে গেলে রাজনীতিরই সুবিধা।

দেবী সরস্বতী আমাদের সুবুদ্ধি দিন।

(শামিম আহমেদ উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ লেখক তথা দর্শনের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)

Advertisment