Advertisment

কল্পবিজ্ঞানের গল্প: ঘরের মধ্যে ‘ঘর’

কয়েকজন বিজ্ঞানীর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় আমরা তৈরি করলাম এই যন্ত্রটা। যার নাম ‘গ্রিনহাউস এয়ার রিফ্রেশার’। সংক্ষেপে জি. এইচ. এ. আর বা এককথায ‘ঘর’। কল্পবিজ্ঞানের গল্প লিখলেন সুকুমার রুজ।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
sukumar rujGHAR E GHAR E GHAR - SUKUMAR RUJ (1)-002

ছবি- চিন্ময় মুখোপাধ্যায়

সুকুমার রুজ

Advertisment

তোমাদের প্রিয় সেই ভাইবোনের জুটি, সুুমন আর তিতলির গল্প বলব আজ। তোমরা হয়তো জানো না, ওরা আজ অবধি কোনও দিন বিমানে চড়েনি। তাই ওদের মনে হালকা হালকা দুঃখ। একবার বিমানে চড়ার সুুযোগ হতে হতেও ফসকে গিয়েছিল। ওদের বাপি বলেছিলেন, কাঠমান্ডু ঘুরতে যাওয়ার সময়ে সবাই মিলে আকাশপথে যাওয়া হবে, আর ফেরা হবে স্থলপথে। সেটা কী কারণে যেন বাতিল হয়ে গেল। কিন্তু এবার পুজোর সময়ে ওরা বিমানে চড়ার আনন্দ উপভোগ করবেই। বাতিল হওয়ার কোনও চান্স নেই। কারণ ওদের ছোটোকাকু এবার নিজেই একখানা বিমান নিয়ে আসছে। না না, মোটেও গালগল্প নয়, একশো পারসেন্ট সত্যি।
ওদের ছোটোকাকুকে মনে আছে তো? সেই যে শুভদীপ রায়, মহাকাশবিজ্ঞানী। ফ্লোরিডায় থাকেন। কখনও সখনও স্পেস-সিটিতে দু-এক মাস কাটিয়ে আসেন নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। পুজোর ছুটি আর বড়দিনের ছুটিতে অবশ্যই কলকাতায আসেন। সুুমন আর তিতলির জন্য নিযে আসেন তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো নানারকম নতুন নতুন যন্ত্র। সেই যে স্বপ্নরেকর্ডার, ইচ্ছে-রিমোট, জাদুজোব্বা, জিনপিউটার, স্মাইলাফটার আরও কত কিছু। ওদের দেখে তোমরাও নিশ্চয় এদ্দিনে এমন কিছু যন্ত্র হাতে পেয়ে গেছো। আমিও একটা স্বপ্নরেকর্ডার এনে দেওয়ার আবদার করেছিলাম ওই শুভদীপের কাছে। ঘুমের মধ্যে যা স্বপ্ন দেখব, তা স্বপ্নরেকর্ডারে রেকর্ড হয়ে যাবে; পরে আবার রেকর্ডার চালিয়ে সেই স্বপ্নটা দেখা যাবে। এমন মজার জিনিস পেতে ছোট বড় কার না লোভ হয়, বল !
ও এনেও দিয়েছিল। আসলে বিজ্ঞানী শুভদীপ আমার খুব ভালো বন্ধু। তোমাদের চুপি চুপি বলে রাখি, ওকে দিয়ে একখানা গ্র‌্যাভিটার গাড়ি আনানোর খুব ইচ্ছে আছে আমার। সেই যে গ্র‌্যাভিটেশন ফোর্স যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে গাড়ি চলে। জ্বালানি তেল লাগে না। পুজোর সময ছোটোকাকু এসে ওই গাড়িতে চড়িয়ে সুুমনদের নানা জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যায়। কখনও হাইবারনেসিয়াম, কখনও ব্যাথিস্কোপ সিটি, আবার কখনও বা গ্রামের বাড়িতে। ওদের দেখে আমারও ইচ্ছে হয়েছিল ...। কিন্তু সাধ থাকলেও সাধ্যে কুললো না। যাক্গে, সবার ইচ্ছা পূরণ হয় না। এর জন্য মন খারাপ করতে নেই। তোমাদের মধ্যে যাদের গ্র‌্যাভিটার গাড়ি নেই, তারাও যেন মন খারাপ করো না।
আরে যা! গাড়ির কথা বলতে গিয়ে ছোটোকাকুর বিমানের কথা বলতে ভুলেই গেছি। সত্যিই এবার বিজ্ঞানীকাকু পুজোর সময়ে নিজের বিমানে চড়েই আসছে। সুুমন আর তিতলি তো আহ্লাদে আট দু’গুণে ষোলোখানা। আমি সুুমনের কাছ থেকেই জানলাম। মর্নিং ওয়াকের সময়ে আমি ওর সামনাসামনি। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে সুুমন বলে উঠল -- ‘ইয়া একাইনো ডারমাটেক্সিয়া আপিস থুপিস!’
বুঝতেই পারলাম, নিশ্চয কোনও খুশির খবর ! ও একমুখ হেসে বলল, জানো কাকু ! এবার ছোটোকাকু নিজের বিমানে আসছে। ষষ্ঠীর দিন রবিবারে পৌঁছে যাবে কলকাতায়। আর তো মাত্র দু’দিন। কাকু রওনা হয়ে গেছে পাঁচদিন আগে।
আমি তো অবাক ! পাঁচদিন আগে ফ্লোরিডা থেকে বিমানে রওনা হয়ে, আরও দু’দিন লাগবে কলকাতা পৌঁছতে! ওটা বিমান না ঠেলাগাড়ি !
সুুমন বলল, ওটা নাকি হাইড্রোজেন সেল, মানে ব্যাটারি চালিত বিমান। নতুন আবিষ্কার। ওটার গতিবেগ ঘন্টায় মাত্র দু’শো কিলোমিটার। তাছাড়া বিমানটা বেশ কয়েকটা দেশ ঘুরে কলকাতায আসছে। বিমানে আছেন দু’জন বন্ধু। তাঁরা পরিবেশ বিজ্ঞানী। গ্রিনহাউস গ্যাস ধ্বংসকারী কী এক যন্ত্রের প্রচারে বেরিয়েছেন। এসবের জন্যই এত সময় লাগছে।
সুুমনের কথা শুনে আমি বেশ খুশি হলাম। শুভ আমার ছেলেবেলার বন্ধু। ও বিজ্ঞানী হয়েছে এতেই আমার দারুণ আনন্দ ! বিমান কিনেছে শুনে বেশ গর্ব হচ্ছে আমার। তাও আবার যে সে বিমান নয়; নতুন আবিষ্কৃত ব্যাটারিচালিত বিমান। ও বিমান আনলে আমারও চড়া হবে বিমানে। কথাটা ভাবতেই আমিও সুুমনের মতো আহ্লাদে আটখানা না হলেও অন্তত চারখানা হয়ে গেলাম। তাই বললাম -- সুুমন ! ষষ্ঠীর দিন তোমাদের বাড়িতে আমার নেমন্তন্ন, বুঝলে তো !
সুুমন প্রথমে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেও, কথাটা বুঝে হো-হো করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল -- তাহলে রবিবার সকালের চা-টা আমাদের বাড়িতেই খেতে হবে কিন্তু।
আমি বললাম -- অবশ্যই ! একদম সক্কালবেলা পৌঁছে যাবো।

GHAR E GHAR E GHAR - SUKUMAR RUJ 1 759 ছবি- চিন্ময় মুখোপাধ্যায়

কথা দিয়ে কথা রাখতে পারলাম না। সকালের চা সুুমনদের বাড়িতে খাওযার কথা ছিল। কিন্তু রবিবার, তাই আলসেমি করে বিছানা ছাড়লাম দেরিতে। তারপর সকালের ব্যাপার-ট্যাপার সেরে ওদের বাড়ি পৌঁছলাম বেলা ন’টায। গিয়ে দেখি, সে এক পেল্লায় ব্যাপার ! ওদের বাড়ির সামনের মাঠটাতে একটা দুধ-সাদা বিমান দাঁড়িয়ে রয়েছে। খুব বেশি বড় নয়, হেলিকপ্টারের মতো সাইজ হবে। তার চারপাশে অনেক মানুষের ভিড়। আমি তো তাজ্জব ! বিমান নামবে বিমানবন্দরে, তাই জানি। কিন্তু এ যে একেবারে ...! ঠোঁট কামড়াতে থাকি দেরি করার জন্য। ভাবি, জীবনে আর কোনও দিনও আলসেমি করে বিছানা আঁকড়ে পড়ে থাকব না। কোন মহাপুরুষ যেন বলেছেন, ‘যে শুয়ে থাকে তার ভাগ্যও শুয়ে থাকে।’ কথাটা যে কতখানি সত্যি, তা আজ হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। সকালে পেঁছে গেলে বিমান নামা দেখতে পেতাম। যাক্গে ! এখন বাড়ির ভেতর তাড়াতাড়ি ঢুকে পড়া যাক। আর কিছু মিস করতে রাজি নই আমি।
আমাকে সামনে পেয়ে তো শুভ জড়িয়ে ধরল। প্রায দশ মাস পর দুই বন্ধুর দেখা সাক্ষাৎ। যখন ছাড়াছাড়ি হলাম, দেখি দু’জনের চোখেই জল। একেই নিশ্চয় আনন্দাশ্রু বলে! প্রাথমিক আবেগ কেটে গেলে বিমানের প্রসঙ্গ তুললাম। ও বলল, হ্যাঁ ছোট্ট বিমান। এর নাম হেলিপ্লেন। জ্বালানি তেল লাগে না। হাইড্রোজেন সেল ব্যাটারিতে চলে। কোনো দূষণ হয় না এর দ্বারা। কারণ এর ধোঁয়া মানে জলীয় বাষ্প শুধু। বিমানের প্রযুক্তিতে এটা ওড়ে, আবার হেলিকপ্টারের মতো মাঠে মযদানে নেমে যেতেও পারে, রানওয়ে লাগে না। একদিন সবাই মিলে চড়ব, আছি তো মাস খানেক। ওর কথা শুনে আমি তো রোমাঞ্চিত ! সত্যি কথা বলতে কি আমিও কোনওদিন বিমানে চড়িনি ! না না হেসো না তোমরা !
এরপর শুভ মানে তোমাদের প্রিয় বিজ্ঞানীকাকু আমাকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে গেল। ওর দু’জন বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবে। ঘরে ঢুকে দেখি, দু’জন বিদেশি মানুষ সোফায় বসে রয়েছেন। আমার বয়সীই হবেন হয়তো ! সাদা ধবধবে গায়ের রঙ। মাথার চুল আর ভ্রুগুলো সাদা। ঠোঁটগুলো গোলাপি আর দাঁতগুলো মুক্তোর মতো ঝকঝকে। ওরা হেসে হেসে কথা বলছেন পাশে বসা সুুমন আর তিতলির সঙ্গে। শুভ বলল -- এই যে ! এঁরা হলেন স্যামুয়েল জনসন আর আর আইভ্যান ডিক্সন। দু’জনেই পরিবেশ বিজ্ঞানী। ভারতে প্রথম এলেন।
আমি হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করতে গিয়ে তো অপ্রস্তুত। ওঁরা দু’জনেই হাতজোড় করে বাঙালি ঢঙে বলে উঠলেন -- নমস্কার ! আপনি নিশ্চয় ওর লেখক বন্ধু। আপনার কথা শুনেছি।
আমি ধাক্কাটা সামলিয়ে কোনওক্রমে নিজের নাম বললাম। প্রতিনমস্কার জানিয়েছি কিনা, তাও মনে পড়ছে না। শুভ আবার বলতে শুরু করেছে -- এখনকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা গ্লোবাল ওয়ার্মিং বিষয়ে ওঁরা গবেষণা করছেন দীর্ঘদিন ধরে। একবার স্পেস সিটি যাওয়ার সময়ে অ্যাসেন্ডার বিমানে ওঁরা আমার সঙ্গী হয়েছিলেন, তখনই আলাপ। ওঁরা গিয়েছিলেন বায়ুমণ্ডলের ওজোন-স্তর মেরামত করতে। স্পেস সিটি থেকে কাজটা করার সুুবিধা। স্পেস শাট্ল-এ চড়ে ওঁরা বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্তরে নেমে এসে, কাজকর্ম সেরে আবার ফিরে যেতেন স্পেস সিটিতে।

আরও পড়ুন, ছোট গল্প: উপনিবেশ

ও ! ভালো কথা, ওজোন-স্তর কাকে বলে, নিশ্চয় জানা আছে ! বায়ুমণ্ডলের উপরিভাগে ওজোন গ্যাসের ঘন স্তর থাকে। ওই স্তর পৃথিবীকে রক্ষা করে সূর্য থেকে আসা নানারকম ক্ষতিকারক রশ্মি থেকে। অতিবেগুনি রশ্মি, অবলোহিত রশ্মি এরকম আরও অনেক ক্ষতিকারক রশ্মিকে আটকে দেয় ওই ওজোন-স্তর। নিশ্চয় তোমরা জানো এসব ! আমিও যেমন ... ! সুুযোগ পেয়ে মাস্টারি করে ফেললাম। যাক্ গে ! তোমাদেরও আর একবার ঝালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। তো, ওই উপকারী ওজোন-স্তরের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে আমাদের নিজেদের দোষেই। মহাকাশে প্রচুর মহাকাশযান পাঠানো তো অন্যতম কারণ বটেই। তাছাড়া বায়ুতে প্রচুর গ্রিন হাউস গ্যাস, মানে কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, ক্লোরোফ্লুরো কার্বন, মিথেন আরও কীসব গ্যাস প্রতিনিয়ত মিশছে গাড়ি, কলকারখানার ধোঁয়া, ফ্রিজ, এয়ারকন্ডিশনার এসব থেকে। তাতেই ওই ওজোন-স্তর ফর্দাফাঁই। সে সব রিপেয়ার করতে গিয়েছিলেন ওই দু’জন বিজ্ঞানী।
শুভ তো অনেকক্ষণ ধরেই ওদের ব্যাপারে অনেক কিছু বললো। সব বুঝতেও পারিনি। মনেও নেই। তবে ওদের দু’জনকে আমার খুব ভালো লেগে গেল ওদের অমায়িক হাসি আর ওদের মুখে বাংলা ভাষা শুনে। ওরা এত ভাল বাংলা ভাষা শিখল কার কাছে! শুভকে জিজ্ঞেস করতে ও বলল, ওটা একটা মাইক্রো চিপ-এর কারসাজি। ওদের নেক্ টাইয়ে বসানো আছে অত্যাধুনিক ল্যাঙ্গুয়েজ কনভার্টার। তার মধ্যে আছে এই মাইক্রো চিপ। যখন যে ভাষায় কথা বলার দরকার, তখন সে ভাষার জন্য তৈরি বিশেষ চিপ লাগিয়ে নিতে হয়।
ব্যাপারটা শুনে আমি তো চনমনিয়ে উঠলাম। আবেগ সামলাতে না পেরে বন্ধুকে বলেই ফেললাম ওরকম একটা যন্ত্র আমাকে দেওযার জন্য। আসলে আমি ইংরাজিতে ভালোভাবে কথা বলতে পারি না। ওটা পেলে ...! বুঝতে পারছি, তোমাদেরও খুব লোভ হচ্ছে। চুপি চুপি বলি, আমাকে পরে একটা দিও গিফ্ট হিসেবে। পরে দেখাবো তোমাদের। কিন্তু চাইলে দিতে পারব না, বলে দিচ্ছি এখন থেকে।
বিজ্ঞানী দু’জনের সঙ্গে আলাপ পর্ব শেষ হতে না হতেই দেখি, বউদি মানে সুুমন আর তিতলির মা ট্রে-তে সরবতের গ্লাস সাজিয়ে হাজির। নতুন অতিথিদের সামনেই প্রথমে ট্রে ধরা হলো। ওরা গ্লাসে হাতে দিয়ে হাত সরিয়ে নিল। বলল, এগুলো দেখছি ঠান্ডা। নিশ্চয় ফ্রিজে ছিল। আমরা খাব না।
বউদি বলল -- ও ! ঠান্ডা খেলে বুঝি গলা বসে যায় ! তাহলে না হয়...।
ওরা বলে ওঠে -- না না, তার জন্য নয ! অন্য কারণে !
আমরা তো অবাক। শুভ দেখি মিটিমিটি হাসছে। কিছু বলছে না।
ওরা দু’জনে মুখ তাকাতাকি করে বলে ওঠে -- আমরা ফ্রিজের জিনিস খাই না। এযার কন্ডিশনিং ঘরে ঢুকি না। জ্বালানি তেল চলা গাড়িতেও চড়ি না। এটা আমাদের প্রতীকী প্রতিবাদ। মানুষকে বোঝানোর জন্য যে, এসবে পৃথিবীর পরিবেশের কী দারুণ ক্ষতি হচ্ছে। আমাদের ওই প্রতিবাদ ও প্রচারে বেশ কয়েকটা দেশে এইসব যন্ত্র ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। সচেতন হবে মানুষ।
শুভ এবার বলে ওঠে -- আর কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য নিষেধাজ্ঞা উঠে গিয়ে অন্য নির্দেশ জারি হবে। বউদি! তোমাকেও সে নির্দেশ পালন করতে হবে কিন্তু।
শুভ আর কিছু না বলে চুপ করে যায়। ওর ঠোঁটের কোণে হাসি। আমার মনের কোণে প্রশ্ন -- নিষেধাজ্ঞা উঠবেই বা কেন, আর নতুন নির্দেশই বা কী হবে ? কিন্তু জিজ্ঞেস করতে সাহস পাচ্ছি না। আমি আবার একটু মুখচোরা। কিন্তু সুুমনের মুখে তো খই ফোটে, তোমরা জান। ও ধাঁ করে প্রশ্নটা করেই ফেলল।
ওই বিজ্ঞানী দু’জন কিছু বলতে যাচ্ছিল মনে হলো। শুভ তার আগেই বলল -- এ প্রশ্নের উত্তর এখন থাক। ব্যাপারটা বলতে সময লাগবে। কাকুরা জার্নিতে ক্লান্ত। খেয়ে বিশ্রাম নেওযা হোক। বিকেলে অদ্ভুত এক যন্ত্রের ডিমনস্ট্রেশন সহ ওঁরাই দেবেন তোমার প্রশ্নের উত্তর।
তিতলি বলে ওঠে সেই ভালো। আমার কাছে এখন আইপড্টা নেই। কথাগুলো রেকর্ড করতে পারবো না। রিয়ার কাছ থেকে ওটা আমি এখখুনি নিয়ে আসি গে।

আরও পড়ুন, সাদাত হাসান মান্টোর গল্প: লাইসেন্স


একে তো ভাই মহাকাশ বিজ্ঞানী, তার ওপর আরও দু’জন বিজ্ঞানীকে বেড়াতে নিয়ে এসেছে। তাই আয়োজনের ত্রুটি রাখেননি আমাদের দাদা, মানে সুুমন-তিতলির বাপি। সে এক এলাহি কাণ্ড-কারখানা। আমি নিতান্তই একজন লেখক, বিজ্ঞানীদের কাছে তুচ্ছ। তার ওপর আবার যেচে নেমন্তন্ন নিয়েছি। তাই ভেতরে ভেতরে কেমন একটা লজ্জার স্রোত। কিন্তু ও বাড়িতে আমার আদর ও কদর যথেষ্ট। একে তো শুভর বন্ধু, ছোটবেলা থেকেই ও বাড়িতে যাওযা আসা। তাছাড়া সুুমন, তিতলি আর ওদের বিজ্ঞানীকাকুকে নিয়েদারুণ দারুণ গল্প লিখে তোমাদের কাছে পৌঁছে দিই ওদের কাণ্ড কারখানা আর আবিষ্কার। তাহলে আদর হবে না কেন বল ! এই তোমরাই কি আমাকে কম ভালোবাস ! গল্পগুলো পড়ে কত চিঠি লেখ। সে কি ভালোবাসা নয়!
খাওয়ার সময়ে বিজ্ঞানী, খুদে বিজ্ঞানী, লেখক, খুদে লেখিকা, সব একসঙ্গে খেতে বসেছি। চর্ব্য-চূষ্য-লেহ্য-পেয় কিছুই বাদ গেল না খাওযার পাতে।
কী ব্যাপার ভ্রু কোঁচকানো হচ্ছে কেন ? ও ! কথাটা খটমট লাগল বোধহয। আরে বাবা ! ‘চর্ব্য’ মানে চিবিয়ে খাওযা যায়। ‘চূষ্য’ হলো চুষে খাওযার জিনিস। ‘লেহ্য’ হলো লেহন করা মানে চেটে খাওযার খাদ্য আর ‘পেয়’ মানে ...? হ্যাঁ ঠিক বলেছ -- পানীয়।
তো রাজকীয় খাওয়া দাওয়ার পর আমেজে অনেকেরই চোখ এঁটে আসে। বিজ্ঞানীগণেরও তাহাই হইল। ওরা গেল বিশ্রাম নিতে। আমার তো দিনে ঘুমানো অভ্যেস নেই। ডাক্তার বলেন -- দিনে ঘুমালে শরীর ও মন দু’টোই মোটা হয়ে যায। শরীরের ভার বাড়ে, আর মননের ধার কমে। সুুমন-তিতলিও আমার আদর্শে বিশ্বাসী। তাই খাওযাদাওযার পর সুুমন-তিতলি আর আমি গেলাম বিমান পরিদর্শনে। তখন মানুষজনের ভিড় কমে গেছে। আমরা পাইলটের সঙ্গে ভাবটাব করে বিমানের ভেতরে ঢুকে পড়লাম। বেশি জায়গা নেই ভেতরে। তবে, বেশ ছিমছাম। পেছনে মালপত্তর রাখার জাযগা। সামনে দু’টো আর পেছনে দু’টো সিট। সঙ্গে সিটবেল্ট। সাইডে ট্রে, পেপার কেস ইত্যাদি। সুুমন তো সোজা গিয়ে পাইলটের সিটে বসে পড়ল। পাইলটও মজা পেয়ে হেডফোনটা ওর মাথায় বসিয়ে দিল। সত্যি সত্যি পাইলট মনে হচ্ছে ওকে। আমরা সিটে বসেছি। ঠিক যেন যাত্রী।
তিতলি বলে ওঠে -- ইস! এসময়ে কেউ একটা ছবি তুলে নিলে দারুণ হতো।
কথাটা শেষ হতে না হতেই পাইলট বলে- দাঁড়াও আমি সি সি ভি আর-টা চালিযে দিচ্ছি। তাহলেই সমস্তটা রেকর্ডিং হয়ে যাবে।
সুুমন তার তীক্ষ্ন বুদ্ধি দিয়ে বুঝে ফেলেছে সি সি ভি আর হলো -- ক্লোজ সার্কিট ভিডিও রেকর্ডার। ও তখন সামনের ড্যাশবোর্ডে নানারকম বোতামগুলোতে আঙুল ছোঁযাতে থাকল ছবি আরও ন্যাচারাল করার জন্য। আমার খুব ইচ্ছে করছে, বিমানটা যদি আকাশে এক চক্কর মেরে আসত এখন, কী মজাটাই না হতো ! কিন্তু বুড়ো ধাড়ি আমি। তোমাদের মতন বাযনা করতে পারি না। তাই মনের ইচ্ছা মনেই চেপে রাখলাম। শুভ তো বলেইছে একদিন সকালে বিমানে চড়ে ঘোরা হবে। বিমানের মধ্যে থাকতে থাকতে কখন যে ফুরুত্ করে ঘণ্টা দেড়েক সময পেরিয়ে গেছে। হঠাৎ দেখি, তোমাদের বিজ্ঞানীকাকু এসে ডাকছে -- এই যে খুদে বিজ্ঞানী ! আর পাইলট সাজতে হবে না, নেমে এস।
আর তিতলি, একদিনে এতকিছু দেখলে তোমার ডায়েরির পাতায আজ জায়গা কম পড়ে যাবে যে !
আমরা বিমান থেকে গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে মাঠ পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকি। গিয়ে দেখি জম্পেশ আসর বসেছে চায়ের। আমিও সে আসরে অংশগ্রহণ করি। সুুমন-তিতলির জন্য আসে হেলথ ড্রিংক। আমাদের ছোটবেলায় দুধভর্তি গ্লাস আসত। এখন তোমাদের জন্য কত প্ল্যান! কমপ্ল্যান, বেশিপ্ল্যান আরও কতরকম স্বাস্থ্যভরা পানীয়। চা-পর্ব শেষ হওযার পর সকলে ড্রয়িংরুমে। সবাই সোফায় বসে আছি যেন সেমিনারে মনোযোগী স্টুডেন্ট। ওপাশে ডিভানে বিজ্ঞানী জনসন যেন লেকচারার। আর পাশেই ঢাউস একটা যন্ত্রের সামনে বিজ্ঞানী।

আরও পড়ুন, পাগলের পাগলামি কিংবা একটি নিখাদ প্রেমের গল্প

ডিক্সন এমনভাবে দাঁড়িয়ে যেন ডিমন্স্ট্রেটর। তোমাদের ছোটকাকু সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ভূমিকা সেরে নেয় -- খুদে বিজ্ঞানী সুুমন ওবেলায় যে প্রশ্ন তুলেছিল, তার উত্তর এবং সেই সঙ্গে আরও কিছু প্রয়োজনীয় কথা বলবেন আমার বন্ধুবর বিজ্ঞানী জনসন ও ডিকসন।
জনসন বলতে শুরু করেন -- ও বেলা বলেছিলাম যে, কোনও কোনও দেশে ফ্রিজ, এযারকন্ডিশনার, কুলার এসবরে ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। কেন হয়েছে তা আপনারা প্রত্যেকেই কমবেশি জানেন। দেখুন, আমরা নিজেরাই পৃথিবীকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছি। গ্রিনহাউস গ্যাস ওজোন-স্তরের ব্যাপক ক্ষতি করছে। পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে বিশ-পঁচিশ বছরের মধ্যে পৃথিবীর অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। মেরুপ্রদেশের বরফ গলবে, সমুদ্রতল ওপরে উঠবে। স্থলভূমি জলের তলায় চলে যাবে। এ ব্যাপারে যে দেশ সচেতন হয়েছে, তার গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনকারী যন্ত্র ব্যবহার আইন করে বন্ধ করেছে। আমরা পরিবেশ বিজ্ঞানীরা ওজোন-স্তরও রিপেয়ার করার পরিকল্পনা নিয়েছিলাম। কাজও শুরু হয়েছিল। কিন্তু তা সিন্ধুতে বিন্দুর মতো। বিশাল বায়ুমণ্ডলের সুবিশাল ওজোনস্তর মেরামত করা প্রচুর ব্যয়সাপেক্ষ এবং তা করেই বা কী হবে ! গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বন্ধ না করে ওটা করা, আর গাছের গোড়া কেটে আগায় জল ঢালা একই ব্যাপার। তাই আমরা উৎসমুখ বন্ধ করতে সচেষ্ট হলাম। কয়েকজন বিজ্ঞানীর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় আমরা তৈরি করলাম এই যন্ত্রটা। যার নাম ‘গ্রিনহাউস এয়ার রিফ্রেশার’। সংক্ষেপে জি. এইচ. এ. আর বা এককথায ‘ঘর’। ডিকসন এখন এই নতুন যন্ত্রের কার্যপ্রণালী দেখাবেন।
বিজ্ঞানী ডিক্সন মিষ্টি হেসে বাও করেন জাদুকরের মতো। যেন জাদু দেখানো শুরু করবেন এখুনি। তারপর ধীরে ধীরে যন্ত্রটার ঢাকনা খোলেন। কতকগুলো পাইপ ফিট করা নিরীহ ধরনের একটা পেটমোটা যন্ত্র। ডিক্সন বলেন, এটা একটা সহায়ক যন্ত্র। অন্য যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত করে দিলে এ কাজ করবে। ফ্রিজ, কুলার, এযারকন্ডিশনার কিংবা দূষিত গ্যাস-নির্গত মোটর এসব যন্ত্রের সঙ্গে বিশেষ পদ্ধতিতে এই যন্ত্র জুড়ে দেওয়া যাবে। নির্গত দূষিত গ্যাস এই সব পাইপগুলোর মধ্যে দিয়ে চলে আসবে এই চেম্বারে বা বিজারণ ঘরে। এখানে বিশেষ ধরনের রাসযনিক আর নির্ধারিত কম্পাঙ্কের লেজার রশ্মি পাঠিয়ে দূষিত গ্যাসকে কার্বন, হাইড্রোজেন, ফ্লোরিন, সালফার, ফসফরাস, নাইট্রোজেন ইত্যাদিতে ভেঙে ফেলা হবে। হাইড্রোজেন, অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিযা করে জলে পরিণত হবে। অন্যান্য অজৈব পদার্থগুলো গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে রাস্ট চেম্বারে জমা হবে। নির্ধারিত সময় পর পর সেগুলো বের করে ফেলা হবে। ব্যাস ! গ্রিন হাউস গ্যাস জন্মিয়ে মৃত্যুপথে। ওজোন-স্তর অবধি আর যেতে হলো না ব্যাটাকে।
আমরা সবাই মুগ্ধ হয়ে দেখছি যন্ত্রটাকে। এমন সময বিজ্ঞানী জনসন আবার শুরু করেন -- তাই আমরা চাই, মানুষ ওইসব অপকারী যন্ত্র ব্যবহার করুক ক্ষতি নেই। কিন্তু অবশ্যই ব্যবহার করার আগে এই উপকারী যন্ত্রটার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে দিক। তাহলেই ব্যাটা জব্দ হবে। পৃথিবী মহাবিপদের হাত থেকে বাঁচবে।
শুভ উঠে দাঁড়িয়ে বলে -- অর্থাৎ ঘরে ঘরে ‘ঘর’ চাই। নিষেধাজ্ঞা উঠে গিয়ে ‘ঘর’ লাগানোর নির্দেশ জারি হোক।
সুুমন তীক্ষ্ন নজরে দেখছিল আর মনোযোগ দিয়ে শুনছিল এতক্ষণ। হঠাৎ দেখি ওর চোখে উদাস দৃষ্টি। ঘরে বসে আছে, অথচ যেন ঘরে নেই। ও আপন মনে বিড়বিড় করছে - এ আবিষ্কারটাও হয়ে গেল !
ওর পাশেই আইপড হাতে তিতলি। ও সুুমনের কথা শুনতে পেয়ে বলে -- ভাই ! তুই বিজ্ঞানী হতে হতে সমস্ত কিছুই আবিষ্কার হয়েযাবে। তুই আর কী আবিষ্কার করবি ?
বলেই দুষ্টু হাসি হাসে তিতলি। তখন তোমাদের বিজ্ঞানীকাকু বলে -- এই যে খুদে বিজ্ঞানী ! পৃথিবীতে অসংখ্য সমস্যা। এত বছর ধরে আমরা তার দশ শতাংশও সমাধান করতে পারিনি। প্রায় সমস্তটাই পড়ে রয়েছে তোমার মতো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বিজ্ঞানীদের জন্য। তোমরাই তো পৃথিবীর ভবিষ্যৎ। মন খারাপ করার কিছু নেই। চল, আমরা সবাই দূষণমুক্ত বিমানে চড়ে একটা চক্কর দিয়ে আসি। তাহলেই মন ভাল হয়ে যাবে।
সুুমন এবার লাফিয়ে উঠে বাতাসে ঘুসি ছুঁড়ে বলে ওঠে -- ইয়া একাইনো ডারমাটেক্সিয়া আপিস্ থুপিস্।

short story
Advertisment