শহর থেকে বেরিয়ে এই গ্রাম গ্রাম জায়গাটায় আসতে রোজ আমার আর ভালো লাগছেনা। কিন্তু উপায় নেই। যে প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করি, তাদের আদতে দুধের পাইকারি কারবার ছিল। এখন জাতে উঠতে পয়সার সদ্ব্যবহার করতে চাইছেন মালিক। একটা এডুকেশন ইন্সটিটিউট তৈরি করবেন। বেশ সমাজসেবার সঙ্গে ব্যবসা হবে। জমি কিনতে এই জায়গাটা বেছেছেন। সস্তা হবে। এক লপ্তে অনেকটা পাওয়া যাবে। আর এরকম পরিবেশে তো রোজ যাওয়া আসা করে ছাত্রদের পড়াশুনো সম্ভব নয়। তাই হোস্টেল ব্যবসাও ভালোই চলবে। আমি এই কোম্পানিতে শুরু থেকে আছি। মালিকের পেয়ারের লোক। তাই জমি নির্বাচন থেকে কেনা ও প্ল্যান করা সব আমার ওপরে ভার।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে ভ্যান রিকশায় চেপে চরকাঁঠালি বললেই এখানে আনে। সকাল সাড়ে সাতটায় ভ্যানে চেপে যেতে যেতে বুঝতে পারছিলাম এখানে আগেই শীত এসে গেছে। ভ্যান চালাতে চালাতে সুকুর বলছিল, বাবু আপনার মতিকাকার সঙ্গে কথা হলো? এরাও আসলে মুখিয়ে আছে। কবে কলেজ হবে। ওদের আয় বাড়বে। দু দশটা লোকজনের আসাযাওয়া। ছাত্রছাত্রীদের হরেক প্রয়োজন। কিন্তু সমস্যা রয়ে যাচ্ছে। ওই মতিকাকাই সমস্যার কারণ। মালিক পক্ষ যে জমি পছন্দ করে রেখেছেন, প্রায় দশ একর জমির মধ্যিখানে বেখাপ্পা ভাবে মতি দাসের জমি রয়ে যাচ্ছে। বেশি নয়। বিঘে চারেক মতন। কিন্তু ওইতেই মুস্কিল। অতএব মতি দাসকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করাতে হবে। অন্যান্য আইনি কাজের সঙ্গে এই কাজটার দায়িত্বে আমিই। সুকুরের কথা শুনে মুখটা তেতো হয়ে গেলো। লোকটাকে কিছুতেই রাজি করানো যাচ্ছেনা যে। কত চেষ্টা করছি কিন্তু ভবি ভোলবার নয়। এদিকে লোকটা চাষাভুষোর মতন থাকলে কি হবে, অনেকেই বলেছে ও নাকি উচ্চশিক্ষিত। আমি মনে মনে হাসি। উচ্চশিক্ষিত তো এ অঞ্চলে স্কুলপাসকেও বলে। যে অত লেখাপড়া করেছে সে কি সারাদিন ধরে রোদজলে মাঠে পড়ে থাকবে? চাষবাস করে বাঁচবে? মানছি অনেকের বাপ ঠাকুরদার পেশাই জমি চষা। সে তো তারা সাতপুরুষে ওই কম্মই করেছে! কিন্তু এ নাকি আগে এখানে থাকতনা। এখন ক বছর এসে রয়েছে। মাটি ছাড়বেনা কিছুতেই। আমি রোজ একবার করে যাই। বসে কথা বলি। মতি দাসের চাষের প্রশংসা করি। সুখদুঃখের গল্প করি। সেও আমার দুঃখ দেখে কষ্ট পায়। বলে, একেনেই চলে এইসে থাকো দিকিনি। আর থাকতি হপেনা। লোকটার এমনিতে স্বভাব মিষ্টি। আমি তাই ঝেঁজে কোনও কথা বলতে পারিনা। ওই হয়ত দুচার কথার পর বললাম, কাকা কি চিন্তা করলে তাহলে? এতোগুলো ছেলেপুলে লেখাপড়া শিখতে পারবে। চাকরিবাকরি হবে। দুটো অন্ন জুটবে, এ কি ভালো নয়? তোমার তো এখানে তেমন কেউ নেই। একলা মানুষ। তুমি বরং কলেজ হলে ওখানকার বাগান দেখাশুনো কোরো। আমি ব্যবস্থা করে দেবো। কলেজ হলে এলাকার উন্নতি হবে, সে তো বুঝতে পারছ! মতি দাস মাথা নাড়ে, মিটিমিটি হাসে। উত্তর দেয়না। খানিক পর বলে – আমি তো বলেচি এ মাটি ছেড়ে কোথাও যাবুনি। তোমরা করো কলেজ। কত্ত মানুষ মুকিয়ে আচে! ধীরে ধীরে বুঝতে পারছি, মতি দাসকে টলানো মুস্কিল।
আরও বাংলা ছোট গল্প পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে
ভ্যান থেকে নেমে নির্দিষ্ট জমির সীমার মধ্যে ঢুকে পরলাম। মতি দাসের শান্তি নষ্ট করতে আমি এদিকটায় খোঁড়াখুঁড়ির কাজ শুরু করে দিয়েছি। মালিকও আমার বুদ্ধিতে খুশি। একদিকে ওদের কাজের খবর, অন্যদিকে খুঁজছি মতি দাসকে। লোকটা এই চৌহদ্দির মধ্যে কোথায় যে ঘাপটি মেরে থাকে মাঝে মাঝে হারিয়ে ফেলি। মিস্তিরিদের জিজ্ঞেস করলাম, ওই পাগলা কাকারে দেকিচ? সাধন মিস্তিরি হেড। বলল – ওদিকপানে বাঁদাকবি চারাগুলিরে দেকতিচে। জলের নল দেছিলাম না বলে বড় গোল করিচে আজ। শ্যাশে একটুস দিলম। কাকারে বলিই বা কি হপে? কানে তো শোনেনা কিচু! এটা আমিও লক্ষ করেছি। একমনে যখন কাজ করে জমিতে বসে, ডাকলেও শুনতে পায়না। আমি একদম সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। তখন চোখ তুলে মুখ ভরিয়ে হাসে। আমায় ডাকে কোম্পানি বলে। কত গল্প হয়। তখন কিন্তু মতি দাসকে আমার কালা বলে মনে হয়না। মনে হয় ও ইচ্ছে করে নিজেকে এমন সাজিয়ে রেখেছে। কই? সামনে বসে কথা বলার সময় তো ও সব শুনতে পায়! আস্তে আস্তে কথা বলে। আমার আস্তে বলা কথাও দিব্যি শুনতে পায়। তাহলে? ও নিজের সম্পর্কে এরকম একটা মিথ্যে খাড়া করে রেখেছে।
আজ ভেবে এসেছিলাম এমন ভালো সম্পর্কের বোঝা আর বইবনা। আমার কাছে মালিক পক্ষের কথাই শেষ কথা। এতগুলো টাকা খরচ করে জমি নেওয়া হয়েছে, শেষে এই মতি দাসের জন্য প্রোজেক্ট আটকে যাবে? এরকম লোকসান হলে আমাকেই হয়ত চাকরি খোয়াতে হবে। সেই ভেবে গিয়ে দাঁড়ালাম মতি দাসের সামনে। সে তখন বাঁধাকপির চারার পরিচর্যায় ব্যাস্ত। আমাকে দেখে চোখ তুলে হাসল। - দেকিচ আমার চারাগুলান কেমন লকলকে হইচে? আমি গম্ভীর মুখে বললাম – ও বাঁধাকপি তো চল্লিশ পয়সা দামে বিকোবে। ওর পেছনে এত খেটে কি লাভ? মতি দাসের মুখটা কেমন যেন হয়ে গেলো। ও মাথা নাড়তে নাড়তে বলল – ট্যাকার কতা হচ্চেনা। কতা হল গে, গাচে ফল ধরবে। কেমুন সবুজ লকলকে গাচ হইচে। দেকো চেয়ে। আমি মুখে গাম্ভীর্য ভাসিয়ে রেখেছি। বললাম – কাকা ও ফল দেখে কি হবে আর? তার চেয়ে বেশ একঝুড়ি ট্যাকা হতো, তো তুমি ভালমন্দ খেইয়ে বাঁচতে তো! মতি দাসের মুখে কিসের বেদনা যেন সরে গেলো। আমাকে নাছোড় বসে থাকতে দেখে বলল – আজ কাজ সেরে এইসো দেকিনি। বলব তোমায়।
অন্য সব জমিমালিকের সঙ্গে কথা সারা হয়েছে। টাকাপয়সা কাজের সুযোগ ইত্যাদি ইত্যাদি জটিল ব্যপার সহজেই মিটেছে। মালিক খুশি। শুধু এই মতি দাসকে বাগে আনতে পারলেই কাজ মেটে। আমাকেও কর্তৃপক্ষ প্রোমোশন দেবে। দুপুরের মধ্যে ফিরে যাবো। তার আগে আজই একটা হেস্তনেস্ত করব মনে করে ছোট্ট মেটে ঘরটার সামনে দাঁড়ালাম। আর তখনই চোখে পরল, মতি দাস উবু হয়ে মাটির গায়ে কান লাগিয়ে শুয়ে আছে যেন। বুকের মধ্যে যেন ধড়াস করে উঠল! একি! মারা গেলো নাকি? অনেকেই ওর কারণে অধৈর্য হয়ে পড়ছিল। ওরই গাঁয়ের লোক সব। কেউ কি তবে...? কিন্তু আমাকে চমকে দিয়ে মতি দাস উঠে বসল। আমি হেসে ফেললাম। বললাম – কাকা এমুন করে শুয়ে ছিলে কেন গো? কি ভয়টা যে পাইচিলাম? ইচ্ছে করেই একটু আপন করে নেবার মতলবে আমি ওদের সঙ্গে এই ভাষায় কথা বলি। মতি দাস একমুখ হেসে আমাকে কাছে ডাকল। বলল - নীচু হও। ন্যাও, এবারে কান পাতো দেকি। দেকো মাটির মদ্যি কত সাতরকমির শব্দ হয়। হয় কিনা? নাহ এ পাগলকে নিয়ে আর পারা যাবেনা। এ মাটির শব্দ শোনে। আমি বলি – ও কাকা, দূরের রেলগাড়ির শব্দ শুনা যায় বটে। সে মাথা নাড়ে – না না। সে নয় গো। কান পাতো। দেকো কেমুন বীজগুলান শব্দ করতিচে। এবার আমার হতবাক অবস্থা। বীজের শব্দ? কি বলছ যা তা? মতি দাস জ্বলজ্বলে চোখে তাকায়। হ্যাঁ গো। শুনোই না একবার। এসো এদিকপানে। আমি অগত্যা এগিয়ে যাই। মাটিতে খরগোসের মতো কান পাতি। কিছুই শুনতে পাইনা। কিন্তু মতি দাস উৎসাহের আতিশয্যে বলতে থাকে – ওই বীজগুলান আমি দুইদিন হয়েল ছরাইচি। একুনি কিনা ওরা বেরুবার জন্য মাটিকে বিরক্ত করচে! দেকচ কাণ্ড? কিছু শুনতে না পেলেও মতি দাসের ওই কথার অভিঘাত আমাকে টেনে বসিয়ে দেয়। আমি স্তব্ধ চেয়ে থাকি ওর মুখের দিকে। কি বলছে লোকটা! ওই বীজগুলো গাছ হবে! তাই সেই প্রাণের কথা ও মাটিতে কান পেতে শোনে! তাই কলেজ হোস্টেল ওর কাছে মানে রাখেনা। ওর জমিটুকুতে শুধু বীজেদের গাছ হয়ে ওঠা চলতে থাকবে! নিজের ঘোর ঘোর অবস্থাটা কাটাবার জন্য আমি বলি – কাকা? তুমি নাকি কালা? কানে শুনতে পাওনা? তবে এসব শোনো কি করে? মতি দাস বলে – ওই যেমন তোমার মুকের দিকে চেয়ে চেয়ে তোমার মূক নাড়া দেকে কতা বুজতে পারি, ঠিক ওমনি আমি বীজগুলানের কতাও শুনতে পাই।
সেদিন রাতে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছিলাম। মতি দাস লোকটা তাহলে গাছ ভালোবাসে! ওই গাছই ওর শিশু! তাই জমি বেচতে চায়না। দেখি যদি অন্যখানে ওকে বসাবার ব্যবস্থা করা যায়।
আজ দুদিন হল মালিক পক্ষের সঙ্গে আমার একটু মন কষাকষি হয়েছে। আমার দ্বারা সম্ভব হচ্ছেনা বলে মালিকের ছোট ছেলে নিজে গিয়েছিল চরকাঁঠালি। কি নাকি ব্যবস্থা সে করেছে, মতি দাসের ঝামেলা এবার মিটে যাবে। আমার একটু অহংএ লেগেছে। পুরো কাজটা আমি সেরে ফেলেছিলাম। এখন ওরা ক্ষীর খাবে। অফিস না গিয়ে বসে আছি বাড়িতে। মা এসে বলল অফিসের আর্দালি বাড়িতে এসেছে। অগত্যা মালিকের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার গোমড়া মুখ দেখে মালিক সস্নেহে বললেন – কি হল? শরীর খারাপ নাকি? ওদিকে সাধন মিস্তিরি তো তুমি না গেলে কাজই করছেনা! কি হয়েছে খুলে বলো দেখি? আমি ইতস্তত করে বলেই ফেললাম – ওই মতি দাসের কেসটা আমিই সল্ভ করতে পারতাম। কিন্তু খামোখা...। মালিক হাসলেন। ওহ এই কথা? ওটা সল্ভ হয়ে গেছে। আমি তাকিয়ে আছি। তাহলে লোকটা লোভে পড়ে গেলো? টাকার লোভ সইতে পারলনা? নিশ্চয় আরও বেশি টাকা দেওয়া হয়েছে ওকে? অথচ আমি ভেবেছিলাম, আমরা যেমন মানুষের বাচ্চাগুলোকে বড় করতে চাইছি ও তেমন গাছের বাচ্চাদের বড় করতে চায়। কি ভুল ভেবেছি! বেরিয়ে আসবার সময় বলে এলাম, কাল থেকে কাজে যাবো। শরীর খারাপের জন্যই বাড়িতে বসেছিলাম।
আরও পড়ুন, প্রথম ভারতীয় ভাষা হিসেবে বাংলাকেই বেছে নিল অ্যামাজন-ওয়েস্টল্যান্ড
সকাল হতেই উচ্ছল মনে রওনা দিলাম চরকাঁঠালির দিকে। যাক। সব বাধা সরে গেছে। মতি দাসের স্বভাবটাও যে গড়পড়তা মানুষের মতন, জেনে স্বস্তির সঙ্গে একটা কাঁটার খচখচানি টের পাচ্ছি। আমল দিচ্ছিনা। ভ্যান নিয়ে সুকুর হাজির। ও এখন মোটামুটি পারমানেন্ট ভ্যানওয়ালা। আমি হাসিমুখে উঠে বসেছি। সুকুর ভ্যান ছেড়ে দিয়েছে। বললাম – দুদিন শরীরটা ভালো ছিলোনা রে। আসতে পারিনি। সব ঠিকঠাক তো রে? ওর মুখ দেখা যাচ্ছেনা। গলা শোনা যাচ্ছে। ও বলল – ঠিকই আছে... শুধু ওভাবে পাগলা কাকারে না সরালিই পাত্তেন। আমি বলি – ও আর আমি কি করব বল? মালিকের ছেলে এসেছিল নিজে। কাকা আমার কথা নিলনা। টাকাপয়সা ভালো পেয়েছে তো? কোথায় আছে রে? একবার দেখে যাই চল। সুকুর খুব ধীরে ধীরে বলছিল – কাকা তো আর নেইই! সেইদিনে আপনাদের কন্টাক্টরের গাড়িতি পিষি গিয়েচে। মাঠের মদ্যি শুয়েচেল। সব শেষ। ভ্যান রিকশায় বসে বসে সকালবেলার হাজার হট্টগোল আমি আর শুনতে পেলামনা। এমনকি সুকুর আরও অনেক কিছু বলছিল... বড়লোকেদের সঙ্গে পারা যায়না, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আমি ওর শেষের কথাগুলো শুনতে পেলামনা। কখন যেন মাটিতে শুয়ে পারেছি, আর মাটির মধ্যে থেকে অজস্র শিশুকণ্ঠের কলকলানি শুনতে পাচ্ছি। সেই বীজগুলো কি?